হামিদা বানুও হেসে ফেললেন। বললেন, এটা তুমি ঠিক কথা বলেছ ভাই। ওর ঐ একগুঁয়েমির জন্য ছোটবেলা থেকে আমার ও ওর মায়ের হাতে কম মারধর খায়নি। এখন আবার তোমার হাতে মার খেতে শুরু করেছে। কথা না শুনলে মেরে মেরে শোনাবে। কথা শেষ করে তিনি আবার হেসে ফেললেন।
নাদিম হাসতে হাসতে বলল, দাদি, মারধর করে অথবা জোর করে কারো মন পাওয়া যায় না, ভালবেসে পাওয়া যায়। আমি ভালবেসে যত ওর মনকে জয় করতে চাই ও সেটাকে খোশামোদ মনে করে তত বেশি লাই পেয়ে যায়। কি করব বলে দেবেন দাদি?
হামিদা বানুও হাসিমুখে বললেন, যাকে ভালবাসা দিয়ে জয় করা যায় না তাকে শাসন করে শায়েস্তা করতে থাকলে একদিন না একদিন সে নিজের ভুল বুঝতে পারবে। তুমি ভাই বিদ্বান লোক, আমি মুখ মানুষ, তোমাকে আমি আর কি বলব? যা ভালো বুঝবে তাই করবে।
বাইরে বারান্দায় নাদিমের দুশ্বশুর, শাশুড়ী এবং তাদের চাচাতো ভাই ও ভাইদের বউরা ছিল। নাদিমের কথা শুনে তাদের সকলের মনের দুঃখ দূর হয়ে গেল। তারা জামাইয়ের কোনো দোষ দেখতে পেল না। সাজেদার সম্বন্ধে জামাই যা বলল তা তারা জানে। তাই সাজেদারই দোষ ভেবে একে একে চলে গেল।
নাদিমকে চুপ করে থাকতে দেখে হামিদা বানু বললেন, তুমি আমার কথায় মনে কষ্ট পেলে নাকি ভাই?
নাদিম ওনাকে কদমবুসি করে বলল, আপনার কথায় মনে কষ্ট পাব কেন? বরং আমি আপনার নাতনির ও আপনাদের ন্যায়-অন্যায়ের কথা বলে বেয়াদবি ও অন্যায় করেছি। সেজন্যে আপনাদের সকলের কাছে মাফ চাইছি।
শিহাব ও হাবিব তখনও বারান্দায় ছিল। জামাইয়ের কথা শুনে তারা ভিতরে এল। তারপর হাবিব বলল, আমরা তোমাকে ভুল বুঝে তোমার প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েছিলাম। এখন তোমার কথা শুনে আমাদের ভুল ভেঙে গেছে?
নাদিম খাট থেকে নেমে তাদেরকে কদমবুসি করে বলল, আমি অনেক বেয়াদবি করে ফেলেছি, আপনারা মাফ করে দিন।
দুভাই একে একে জামাইকে জড়িয়ে ধরে মাথায় চুমো খেয়ে দোয়া করল। হাবিব জামাইকে উদ্দেশ্য করে বলল, বেয়াদবি হলেও তুমি খুব দামি কথা বলেছ। তারপর তারা বেরিয়ে গেল।
নাদিম দাদি শাশুড়ীকে চলে যেতে দেখে জিজ্ঞেস করল, আম্মারা কি বারান্দায় আছেন?
হামিদা বানু বারান্দায় এসে বউরা রয়েছে দেখে বললেন, আছে।
নাদিম বারান্দায় এসে দুশাশুড়ীকে কদমবুসি করে বলল, আপনারাও মাফ করে দিন।
কেন? আল্লাহ তোমাকে ও সাজেদাকে সুখী করুক, এই দোয়া করি।
নাদিম ঘরে ঢুকে চিৎ হয়ে শুয়ে শুয়ে চিন্তা করতে লাগল, সাজেদা এই সব কথা শুনে কি মনে করছে আল্লাহ মালুম।
স্বামী, দাদি, বাপ, চাচা ও মা-চাচির কথা শুনে সাজেদা নিজেকে চিনতে পারল। সেই সাথে স্বামীর উন্নত মনের পরিচয় পেয়ে এবং তার উদ্দেশ্য জানতে পেরে নিজের অন্যায় দিকগুলোও বুঝতে পারল। ভাবল, এবার থেকে স্বামীর কথা সব সময় মেনে চলব। তখন তার সই দীলরুবার কথা মনে পড়ল, তোর স্বামী ধার্মিক বলে তুই অসন্তুষ্ট হচ্ছিস কেন? বরং খুশি হওয়ার কথা। জানিস না বুছি, সংসারে সব রকমের সুখ-শান্তির চেয়ে স্ত্রীর কাছে স্বামীর চরিত্র, ধার্মিকতা ও ভালবাসা লক্ষগুণ বেশী সুখ শান্তির। যে মেয়ে এমন স্বামী পায়, সে শুধু ভাগ্যবতী নয়, মহাভাগ্যবতী। মা-চাচীর সঙ্গে ভাত খেয়ে ঘরে বসে নাদিম ঘুমিয়ে পড়েছে দেখে তার মুখের উপর ঝুঁকে ঘুম ভাঙাবার জন্য ডাকল, এই শুনছ?
নাদিম ঘুমায়নি। তার একটু তন্দ্রাভাব এসেছিল। সাজেদার ডাক শুনে তন্দ্রা ছুটে গেল। চোখ মেলে দেখল সাজেদার মুখ তার মুখের চার কড়া উপরে। আর তার চোখ দুটোতে পানি টলটল করছে। নাদিম কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই সাজেদার চোখের পানি তার মুখের উপর পড়ল। নাদিম সাজেদাকে বুকে জড়িয়ে ধরে তার কান্নাভেজা সারামুখে চুমো দিয়ে বলল, আমার কথা শুনে মনে খুব কষ্ট পেয়েছ তাই না? আল্লাহপাকের কসম খেয়ে বলছি, তোমাকে অপমান করার জন্য অথবা তোমার মনে কষ্ট দেয়ার জন্য কথাগুলো বলিনি। তবু যদি কষ্ট পেয়ে থাক, তাহলে মাফ চাইছি।
আল্লাহপাকের অসীম দয়ায় এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সাজেদা স্বামীকে যতটা না চিনতে পেরেছিল, এখন তার কথা শুনে আরো বেশি চিনতে পারল। চোখের পানি ফেলতে ফেলতে স্বামীর সারা মুখে চুমোর প্রতিদান দিতে লাগল।
নাদিমের তখন মনে হল, সাজেদা বিয়ের পর থেকে আজকের আগে পর্যন্ত এত আন্তরিকতার সাথে আবেগপ্রবণ হয়ে এরকমভাবে চুমো খায়নি।
সাজেদা চুমো খাওয়ার বিরতি দিয়ে বলল, আমার একগুঁয়েমির জন্য তোমাকে চিনতে অনেক দেরি করে ফেলেছি তাই এতদিন তোমার মনে অনেক কষ্ট দিয়েছি। তোমার এইসব কথা শুনে মনে কষ্ট হয়নি বরং আল্লাহ আমার জ্ঞানের দুয়ার খুলে দিয়ে তোমাকে চিনবার, জানবার এবং নিজের ভুল ধরার সুযোগ করে দিলেন। সাজেদার কথা শুনে নাদিম মনে এক অনাবিল শান্তি অনুভব করল। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বলল, তোমার কথা শুনে আমার এত আনন্দ লাগছে যা আমি জীবনে কোনোদিন পাইনি। আমি রাগ করলে তুমি সব সময় রাগ মানিয়ে আমাকে খুশি কর। আজ আমি তোমাকে এত বেশি আদর করে খুশি করব যে, খুশিতে পাগল না হয়ে যাও। কথা শেষ করে সাজেদাকে আদর করতে করতে অস্থির করে তুলল।
সাজেদা জানে নাদিম যেদিন তাকে ভোগ করতে চাইবে, সেদিন ইচ্ছে করে সামান্য কথায় রাগ করবে। তখন তাকে খুশি করার জন্য সাজেদাকে অগ্রণী ভূমিকা নিতে হয়। এখন স্বামীর মুখে খুশি করার কথা শুনে এবং তাকে অগ্রণী ভূমিকা নিতে দেখে বেশ লজ্জা পেল। তবু আদরের প্রতিদান দিতে দিতে ফিসফিস করে বলল, এই কি হচ্ছে- আস্তে বলবে তো কেউ বারান্দায় থাকতে পারে, শুনলে কি মনে করবে?