হামিদা বিবি বললেন, রাতে খাওয়ার সময় বলব।
সাজেদা হাত ধুইয়ে বেরিয়ে যাওয়ার একটু পরে হামিদা বানু ভাতের প্লেট নিয়ে ঢুকলেন।
তাই দেখে নাদিম বলল, দাদি, আপনি কষ্ট করছেন কেন? আপনার নাতনি কোথায়?
হামিদা বানু বললেন, সে রান্নাঘর থেকে এনে আমার হাতে দিল। তারপর হাসিমুখে বললেন, কেন ভাই, আমার হাতে খেতে বুঝি ভালো লাগবে না। নাত জামাইকে খাওয়াতে আমার বুঝি শখ হয় না?
নাদিম লজ্জা পেয়ে বলল, কি যে বলেন, আপনার হাতে খাওয়া তো আমার সৌভাগ্য। আপনার কষ্ট হবে ভেবে বলেছি।
হামিদা বানু ভাতের প্লেট দস্তরখানার উপর রেখে দরজার কাছে গিয়ে কয়েক পদের তরকারী এনে বললেন, নাও ভাই শুরু কর, কষ্ট আবার কি! তোমার মতো নাত জামাই কজনের ভাগ্যে জুটে?
নাদিম বুঝতে পারল সাজেদা ও দুশাশুড়ী রান্নাঘর থেকে সবকিছু নিয়ে এসে যোগান দিচ্ছে। বলল, আপনিও আসুন।
হামিদা বানু বললেন, খাব, তবে আজ নয়। তুমি শুরু কর তো।
খেতে খেতে নাদিমের মনে হল, দরজার কাছে বারান্দায় বেশ কয়েকজন মেয়ে ও পুরুষ রয়েছে। দাদির হাবভাব দেখে নাদিম বুঝতে পারল, সাজেদাকে মেরেছি জেনে কিছু বলতে চান। ভেবে রাখল, খাওয়ার পর দাদি কিছু বলার আগে সে নিজেই কথা তুলবে। কিভাবে কথাটা তুলবে খেতে খেতে তাও ভেবে রাখল। খাওয়া শেষ করে হাত মুখ ধুয়ে খাটে বসে নাদিম বলল, দাদি, আমি দুএকটা কথা আপনাদেরকে বলতে চাই।
হামিদা বানু সাজেদার নাম ধরে ডেকে বললেন বাসনপত্র নিয়ে যাও। তারপর নাত-জামাইয়ের পাশে বসে নাদিমকে বললেন, বেশ তো ভাই, বল কি বলবে।
নাদিম বলল, কথাটা ছোট মুখে বড় কথা হয়ে যাবে। তাই আপনাদের কাছে প্রথমে মাফ চেয়ে নিচ্ছি।
আব্বা আমাদের ফ্যামিলির সবাইকে চেনেন। আমাকেও ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছেন। আমাদের অবস্থা এবং আমার স্বভাবচরিত্র কেমন তাও ভালোভাবে জানেন। আর আপনার নাতনি ওনার নিজের মেয়ে। তার স্বভাব-চরিত্র, মন-মেজাজ কি রকম তাও নিশ্চয় জানেন, এবং এটাও জানতেন, আমি ওনার মেয়ের অনুপযুক্ত। নিজের মেয়ের স্বভাব-চরিত্র ও মন-মানসিকতার দিকে লক্ষ্য রেখে প্রত্যেক বাবা-মার জামাই পছন্দ করা উচিত। ওনার চোখে হয়ত আমি ভালো ছেলে। কিন্তু ওনার মেয়ের চোখে কেমন লাগবে তা চিন্তা করা উচিত ছিল। আপনাদের মতো সংসারের সচ্ছলতা আমাদের নেই। আপনাদের কর্তব্য ছিল, আপনার নাতনির বিয়ে কোনো বড়লোকের ছেলের সঙ্গে দেয়া। কারণ তার মতো মেয়ে আমাদের সংসারে খাপ খায় না। সে উচ্চভাষিণী ও আরামপ্রিয়। আমাদের মধ্যবিত্ত ঘরে কোনোদিন হয়ত তার আশা আকাংক্ষা পূরণ হবে না। প্রত্যেক গার্জেনের উচিত তাদের মেয়েকে যেভাবে, যে পরিবেশে মানুষ করবে, তাকে সেইভাবে সেই পরিবেশে বিয়ে দেয়া। আপনার নাতনিকে অনেক পরিশ্রম করতে হয়। অথচ এখানে সে একটা কুটো নেড়ে মানুষ হয়নি। এখানে ভালো ভালো খেয়ে পরে মানুষ হয়েছে। সে তুলনায় আমাদের বাড়িতে কিছুই পায় না। এতে সে যেমন খুব কষ্ট পাচ্ছে, তেমনি তার মনে খুব টর্চারিং হচ্ছে। মনের সেই টর্চারিং সহ্য করবে, না সবাইকে খুশি রাখার চেষ্টা করবে? আর একটা কাজ প্রত্যেক পিতামাতার করা একান্ত কর্তব্য। সেটা হল, ছেলে হোক বা মেয়ে হোক, তাকে স্কুলে-কলেজে লেখাপড়া করানোর সাথে সাথে ধর্মীয় শিক্ষা দিয়ে তার অনুশীলন করান। সেদিকটাও আপনারা অবহেলা করেছেন। আল্লাহপাক আমাকে যতটুকু এলেম দিয়েছেন, সেই সব দিয়ে আমি ওকে বোঝাবার চেষ্টা করেছি। কিন্তু ঐ মানসিক টর্চারিং-এর জন্য কোনো সৎ উপদেশ গ্রহণ করতে পারেনি। আমিও তো মানুষ। আমারও দোষ-ত্রুটি আছে। আমার কথামতো না চললে মাঝে মাঝে রেগে গিয়ে বকাঝকা করি, কখনও বেশি রেগে গেলে দুএকটা চড়-চাপড়ও মারি। এবারে শয়তান ঘাড়ে চেপেছিল, আর আপনার নাতনিও বেশ বড় রকমের অন্যায় করে ফেলেছিল। তাই রাগ সামলাতে না পেরে একটু বেশি মারধর করে ফেলি। আপনারা হয়ত সে কথা শুনে থাকবেন। তবে সে জন্য আমি খুব অনুতপ্ত।
নাদিমের কথা শুনে হামিদা বানু চিন্তা করলেন, নাদিম যেমন খুব বুদ্ধিমান তেমনি খুব ভালো ছেলে। বললেন, হ্যাঁ, ভাই শুনেছি। শুনে ভেবেছি, সাজেদা নিশ্চয় কোনো গুরুতর অন্যায় করেছে। নচেৎ তোমার মতো ছেলে তাকে মারধর করবে কেন? অন্যায় করেছে মেরেছ, তা বেশ করেছ। সে জন্য তোমাকে কিছু বলব না। শুধু বলব, ঐ গাধাটাকে যেমন করে হোক তোমার মনের মতো করে গড়ে নিও। আর উচিত অনুচিতের যে সমস্ত কথা বললে, সেগুলো খুব খাঁটি কথা। তবে কি জান ভাই, তোমার শ্বশুর নিজের স্বভাব-চরিত্র জানে বলেই তাকে কোনো বড় ঘরে বিয়ে দেয়নি। কত বড় বড় ঘর থেকে সম্বন্ধ এসেছিল। ওর ঐ স্বভাবের কথা চিন্তা করে সেসব ঘরে বিয়ে দিতে শিহাব রাজি হয়নি। তোমার সব কিছু জেনেই তোমাকে জামাই করেছে। বিয়ের আগে তোমাদের বাড়ির ও তোমার সম্বন্ধে আমাকে সবকিছু জানিয়ে বলেছে। সাজেদার কপালে যদি সুখ থাকে, তা হলে তোমার মতো ছেলের হাতেই হবে। তুমি কুরআন হাদিসের কথা বলে বোঝাবে।
নাদিম বলল, বিয়ের পর থেকে তাই করে আসছি। আপনি দোয়া করুন। আল্লাহপাক যেন আমার মনের বাসনা পূরণ করেন। আর আপনার নাতনিকে বুঝিয়ে বলবেন, ও যেন আমার কথামতো চলে। সে তো নিজের মতের বাইরে একটুও চলে না। এই কথা বলে নাদিম হেসে উঠল।