নাদিম এতক্ষণ শ্বশুরকে কি বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। এখন তার কথা শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তাই হবে আব্বা। কয়েকদিন পর আমাদের স্কুলে ছুটি পড়বে। সেই সময় আমি নিয়ে যাব।
শিহাব বলল, বেশ, তাই নিয়ে যেও। মেয়ের বাড়ি দুদিন থেকে শিহাব ফিরে এসে বাড়িতে জানাল, কয়েকদিন পর জামাই সাজেদাকে সাথে করে নিয়ে আসবে।
ছেলের মনটা একটু ভার ভার দেখে সাজেদার দাদি হামিদা বানু জিজ্ঞেস করলেন, তোর মেয়েকে না হয় জামাই নিয়ে আসবে, কিন্তু মেয়ের বাড়ি থেকে মন খারাপ করে ফিরে এলি কেন?
শিহাব বন্ধু বাতেনের কাছে সাজেদা শাশুড়ীদের সঙ্গে ঝগড়া করেছিল বলে জামাই। তাকে খুব মেরেছে, সে কথা শুনেছে। সে কথা মাকে বলা ঠিক হবে কিনা ভাবতে লাগল।
ছেলে কিছু বলছে না দেখে হামিদা বানু বললেন, কি রে, কিছু বলছিস না কেন?
শিহাব মাকে মিথ্যা বলতে পারল না। বলল, সাজেদা শাশুড়ীদের সঙ্গে ঝগড়া করেছিল বলে জামাই মেরেছে।
শুনে হামিদা বানু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে জিজ্ঞেস করলেন, তুই কার কাছে। শুনেছিস?
বাতেনের কাছে।
তোর মেয়ে কিছু বলে নি।
না।
তুই মেয়ে জামাইকে বা অন্য কাউকে এ ব্যাপারে কিছু বলিস নি তো?
না আম্মা, কাউকে কিছু বলিনি।
খুব ভালো করেছিস। তোর জামাইকে যতটুকু জেনেছি আমার মনে হয় সামান্য কারণে সে মারধর করেনি। নিশ্চয়ই তোর মেয়ে কোনো গুরুতর অন্যায় করেছিল। মেয়ে জামাইয়ের মিল দেখে এসেছিস তো?
তা দেখেছি আম্মা।
যাক, তা হলে ওসবে তুই মন খারাপ করিস না। সব সংসারেই ওরকম হয়ে থাকে।
সাজেদার মা সালেহা সেখানে ছিল শাশুড়ীর কথা শুনে তখন কিছু বলতে সাহস করেনি। এক সময় স্বামীকে একাকী জিজ্ঞেস করল, জামাই কি সাজেদাকে খুব বেশি মেরেছে।
শিহাব সবকিছু জেনেও চেপে গিয়ে বলল, তা আমি কি করে বলব? বাতেনের মুখে শুনলাম, মেরেছে।
মায়ের জান, মেয়েকে জামাই মেরেছে শুনে সালেহা মনে খুব কষ্ট অনুভব করছিল। স্বামীর কথায় মন বোধ মানল না। আবার জিজ্ঞেস করল, তোমাকে দেখে সাজেদা খুব কান্নাকাটি করেছিল নাকি?
এই মেয়েকে শিহাব কখনো চোখ রাঙিয়ে মানুষ করেনি। ছোটবেলা থেকে যত রকম জিদ করেছে, সব পূরণ করেছে। বড় আদরের সঙ্গে মানুষ করেছে। সেই মেয়েকে জামাই ভীষণ মারধর করেছে শুনার পর রাতে চোখের পানি ফেলেছে। পরে মনকে শক্ত করে নিয়েছে। সাজেদা যে সালেহার জান, সে কথা শিহাব জানে। তাই স্ত্রীকে বারবার তার কথা জিজ্ঞেস করতে বিরক্ত না হয়ে ভালো মুখে বলল, কান্নাকাটি করবে কেন? জামাইয়ের সঙ্গে বেশ মিলমিশ দেখলাম। সেই তো তাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসার কথা জামাইকে বলার জন্য আমাকে শিখিয়ে দিল। আমি সে কথা জামাইকে বলতে সে খুশি মনে রাজি হল।
কয়েকদিন পর স্কুলে ছুটি পড়তে নাদিম আব্বা-আম্মার মতামত নিয়ে সাজেদাকে সাথে করে শ্বশুরবাড়ি রওয়ানা দিল। পথে চিন্তা করল, যদি শ্বশুর মেয়েকে মারার কথা কারো কাছে শুনে থাকেন এবং তিনি সে কথা বাড়িতে গিয়ে বলে থাকেন, তা হলে তারা আমাকে নিশ্চয় খুব খারাপ ছেলে ভেবেছেন। সেখানকার কেউ কিছু এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে কি উত্তর দেব, সেই কথা ভেবে খুব লজ্জা পেতে লাগল। এক সময় সাজেদাকে জিজ্ঞেস করল, আব্বা কি তোমাকে মারার কথা শুনে গেছেন?
সাজেদা বলল, আমি আব্বাকে কিছু বলিনি। তোমার মেজ চাচা কিছু বলেছেন কিনা জানি না।
তোমার শরীর খারাপ দেখে আব্বা কিছু জিজ্ঞেস করেন নি?
করেছিল। বলেছি, কয়েকদিন আগে আমার জ্বর হয়েছিল।
নাদিম আর কিছু না বলে চুপ করে গেল।
শ্বশুরবাড়ি পৌঁছে নাদিম প্রতিবারের মতো দুশ্বশুর, শাশুড়ী ও দাদি শাশুড়ীকে কদমবুসি করে ভালমন্দ জিজ্ঞেস করল।
তারা দোয়া করে নাদিমের বাড়ির ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করল।
এবারে নাদিমের খাতির-যত্ন আগের থেকে বেশি হতে দেখে তার কেবল মনে হতে লাগল, এখানকার সবাই সাজেদাকে মারার কথা জেনে গেছে। নিজের অপকর্মের কথা চিন্তা করে নাদিম যেমন লজ্জা পেতে লাগল, তেমনি মনে একটু ভয় ভয় অনুভব করল।
রাতে ঘরের মেঝেয় পাঠির সব বিছিয়ে দূরখানা পেতে ভাত খাওয়ার ব্যবস্থা হল। নাদিম এলে তার শালা লিয়াকত সব সময় নাদিমের সাথে থাকে। একসঙ্গে নাশতা ও অত খায়। এবারে কাছে এলেও বেশিক্ষণ থাকে নি। খাওয়ার সময় তাকে দেখতে না পেয়ে সাজেদাকে জিজ্ঞেস করল, লিয়াকত কোথায়? তাকে ডাক, এক সাথে খাব।
সাজেদা তাকে ডেকে নিয়ে এল।
সাজেদার দাদাজীর দুছেলে দুমেয়ে বড় ছেলের নাম শিহাব আর ছোট ছেলের নাম হাবিব। বড় মেয়ে কুলসুম পাঁচ বছরের একটা ছেলে রেখে মারা গেছে। প্রায় পনের মাইল দূরে তার বিয়ে হয়েছিল। সেই ছেলে এখন যুবক। ছোট মেয়ে জয়নাব। তার বিয়ে নিজেদের পাড়ায় এক আত্মীয়ের ছেলের সঙ্গে হয়েছে। তারও এক ছেলে। ছেলেটার নাম ইয়াকুব। তার বয়স এখন চৌদ্দ-পনের বছর। ইয়াকুব হওয়ার পর থেকে জয়নাব সূতিকা রোগে ভুগছে। শিহাব ও দুভাই এক সংসারে। দুভাইয়ের মধ্যে এত ভালবাসা যে, একজনের কোনো অসুখ-বিসুখ হলে অন্যজন খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেয়। দুজায়ের মধ্যেও খুব ভাব। মাঝে-মধ্যে যদিও বা কিছু হয়, তখন ছোট একটু রেগে গেলে বড় তাকে জড়িয়ে ধরে আদর করে রাগ মানিয়ে নেয়। বিয়ের পর ছোটর অনেক বছর ছেলেপুলে হয়নি। সে সাজেদা ও লিয়াকতকে মানুষ করেছে। তারপর তার ছেলে হলে বড় তাদেরকে মানুষ করেছে। শিহাবের ইন্টারের ফাইনাল পরীক্ষার পর তার বাপ মারা যান। তখন হাবিব সিক্সে পড়ত। বাপ মারা যাওয়ার পর শিহাব পড়াশোনা বন্ধ করে সংসার দেখাশুনা করতে থাকে। হাবিব লেখাপড়ায় তেমন ভালো ছিল না। তাই সেও পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে ভাইয়ের সাথে সংসারের কাজে লেগে যায়। শিহাব তাকে লেখাপড়া করাবার চেষ্টা করে। কিন্তু হাবিব করল না। শেষে দুভাই মিলে বাপ যা জমি-জায়গা রেখে গিয়েছিল তা দেখাশোনা করতে লাগল। তাদের বাপের বেশ কিছু জমি-জায়গা ছিল। সেগুলোর পিছনে দুভাই কঠোর পরিশ্রম করে আরো অনেক জমি-জায়গা করেছে। গ্রামের মধ্যে এখন তারাই সব চেয়ে বড় গৃহস্থ বাপ মারা যাওয়ায় নিজে বেশি লেখাপড়া করতে পারেনি বলে শিহাবের খুব ইচ্ছা ছেলেমেয়েকে উচ্চ শিক্ষা দিবে। তাই সাজেদাকে ম্যাট্রিক পাস করিয়ে কলেজে ভর্তি করতে চেয়েছিল। কিন্তু রাস্তার বখাটে ছেলেদের জন্যে তা সম্ভব হয়নি। সাজেদা খুব সুন্দরী বলে স্কুলে যাওয়ার সময় বখাটে ছেলেদের অনেক উৎপাত সহ্য করেছে। তাই মেয়েকে কলেজে পড়াবার শত ইচ্ছা থাকলেও পড়ায়নি। তারপর বি.এ. পাস ধার্মিক ছেলে নাদিমকে জামাই করে সবাই খুব আনন্দিত। কিন্তু জামাই মেয়েকে মেরেছে জেনে তাদের মন খারাপ হয়েছিল। মেয়ে জামাইকে হাসি-খুশিতে আসতে দেখে তাদের মন অনেকটা হালকা হয়েছে। তবু দুভাই মাকে একসময় বলল, আম্মা, তুমি তোমার নাত-জামাইকে একটু বুঝিয়ে বলল সে যেন আর তোমার নাতনি কে মারধর না করে।