অলোক ডাক্তার ড্রেস চেঞ্জ করে ডাক্তারি ব্যাগটা নাদিমের হাতে ধরিয়ে মটর সাইকেলে করে দুজনে রওয়ানা দিল।
আফ্রিদা সাজেদার জ্বর উঠেছে দেখে বসে বসে তার মাথায় জলপট্টি দিচ্ছিল, অলোক ডাক্তার নাদিমকে সঙ্গে করে ঘরে ঢুকে তাকে দেখে বলল, দিদি, নাদিম আমাকে ডেকে নিয়ে এল। সে নাকি বৌমাকে গতরাতে মারধর করেছে?
আফ্রিদা মহসীনের চেয়ে অনেক বড়। তাই ছোট ভাইয়ের বন্ধুকে বরাবর তুই তোকারি করে বলে এসেছে। এখন তার কথা শুনে বলল, হ্যাঁ রে, দেখ না ছেলের কাণ্ড। গতকাল আমার মেজ জার ও আমার সঙ্গে বৌমা কথা কাটাকাটি করেছিল বলে আমি বৌমাকে একটু শাসন করতে বলেছিলাম। কিন্তু ও যে এরকম জঘন্য কাজ করবে তা কল্পনা করি নাই। তুই ওকে একটু শাসন করে দিস তো। জানোয়ারটা রেগে গেলে মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলে কেন?
অলোক ডাক্তার বলল, আমি ওর কাছে শুনেই এরকম কিছু-একটা অনুমান করে অনেক বকাবকি করেছি। তারপর সাজেদার আঘাত পাওয়া জায়গাগুলো দেখাতে বলল।
আফ্রিদা কাপড় সরিয়ে সরিয়ে শুধু আঘাত পাওয়া জায়গাগুলো দেখাল। আঘাতের চিহ্নগুলো সব দগদগে হয়ে গেছে দেখে অলোক ডাক্তার আঁতকে উঠে বলল, দিদি, নাদিমের মতো ছেলে যে এরকমভাবে মারবে চিন্তা করতে পারছি না। তখন ওর কথা শুনে মনে করেছিলাম, সেই অসুখের পর থেকে বদরাগী হয়েছে, তাই হয়ত রেগে গিয়ে একটু বেশি মারধর করেছে। কিন্তু হিংস্র জানোয়ারের মতো কাজ করবে ভাবিনি। তারপর জ্বর দেখে প্রেসক্রিপশান করে নাদিমকে বলল, বৌমা যত বড় অপরাধই করে থাকুক না কেন, তুই যা করেছিস তা ক্ষমার অযোগ্য। চাবকে তোর পিঠের ছাল তুলে নিতে ইচ্ছে করছে। চল, আমার সঙ্গে ওষুধগুলো নিয়ে আসবি। বৌমার যদি কিছু হয়ে যেত তখন টের পেতিস।
ডাক্তারকে আফ্রিদা যখন মারের জায়গাগুলো দেখাচ্ছিল তখন নাদিমও দেখেছে। দেখে খুব মর্মাহত হয়ে নিজের প্রতি ঘৃণা বোধ করছিল। হঠাৎ তার মনে পড়ল, এই জন্যে আল্লাহপাকের রসুল (দঃ) রাগকে হারাম বলেছেন। অনুশোচনায় তার চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠল। অলোক ডাক্তারের কথা শুনে তাকে অনুসরণ করল।
ঘণ্টা দেড়েক পর নাদিম ওষুধ নিয়ে ফিরে এসে মাকে সংসারের কাজ করতে দেখে নিজে সাজেদাকে ওষুধ খাওয়াবার সময় ভিজে গলায় বলল, আমি রেগে গেলে অমানুষ হয়ে যাই। সেই সময় আমার কোনো হিতাহিত জ্ঞান থাকে না, তুমি আমাকে মাফ করে দাও।
সাজেদা কোনো কথা বলল না। ওষুধ খেয়ে চোখের পানি ফেলতে লাগল। এমন সময় আফ্রিদার গলা শোনা গেল, নাদিম বৌমাকে ওষুধ খাইয়ে এখানে আয়, নাশতা খাবি, অনেক বেলা হয়েছে।
নাদিম মায়ের উদ্দেশ্যে বলল, তুমি নাশতা বের কর, আমি আসছি। তারপর সাজেদার দুটো হাত ধরে বলল, তোমাকে এভাবে মেরে কাল থেকে আমিও কম কষ্ট পাচ্ছি না। বল, মাফ করে দিয়েছ?
সাজেদার চোখ থেকে আরো বেশি পানি পড়তে লাগল। বলল অন্যায় আমি করেছি, তুমি মাফ চাইছ কেন?
নাদিম স্ত্রীর গালে গাল ঠেকিয়ে বলল, শাসন যখন জুলুমের পর্যায়ে চলে যায়, তখন অন্যায় হয়। আমি তোমার উপর জুলুম করেছি। সেই জন্যে মাফ চাইছি।
সাজেদা তার প্রতি স্বামীর যে ভালবাসার কথা এতদিন বুঝেছিল, এখন তাকে চোখের পানি ফেলে বারবার মাফ চাইতে দেখে সে ভুল ভাঙল। বুঝতে পারল, নাদিম তাকে তার দেহ ভোগ করার জন্য শুধু ভালবাসে না, সত্যিকার ভালবাসে। ভিজে গলায় বলল, তুমি স্বামী হয়ে স্ত্রীর কাছে মাফ চাইছ কেন? তোমার কথা না শুনে আমি অন্যায় করেছি। বরং তুমি আমাকে মাফ করে দাও।
নাদিম উঠে বসে নিজের চোখ-মুখ মুচে সাজেদার চোখ-মুখ মুছে দিতে দিতে বলল, আমরা দুজনেই অন্যায় করেছি, আল্লাহ আমাদেরকে মাফ করুক।
.
০৫.
এই ঘটনার দিন পনের পর শিহাব মেয়েকে নিয়ে যেতে এল। সে মেয়ের বাড়িতে এলেও বন্ধু বাতেনের কাছে ঘুমায় এবং বেশিরভাগ সময় তার সঙ্গে থাকে।
দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর এক সময় শিহাব সাজেদাকে বলল, তোকে নিয়ে যেতে এসেছি। তোর শুশুর-শাশুড়ীকে বলতে তারা নাদিমকে বলার জন্য বলল।
সাজেদা সুস্থ হলেও তার শরীরের দুতিন জায়গার ঘা এখনও ভালো হয়নি। তাই বলল, আমি এখন যাব না, কয়েকদিন পর যাব। তুমি তোমার জামাইকে কয়েকদিন পরে আমাকে সাথে করে নিয়ে যাওয়ার কথা বল।
এবারে এসে শিহাব মেয়ের মুখে বিষণ্ণতার ছাপ দেখে এবং বেশ একটু রোগা হয়ে গেছে দেখে জিজ্ঞেস করল, তোর মুখ এত শুকনো কেন? রোগাও হয়ে গেছিস।
সাজেদা বলল, কয়েকদিন আগে জ্বর হয়েছিল, এখন ভালো আছি।
শিহাব বলল, ঠিক আছে, জামাইকে তাই বলব। ততদিনে তোর শরীরটা আরো একটু সুস্থ হোক।
এক সময় শিহাব মেয়ের সামনে জামাইকে বলল, আমি সাজেদাকে নিয়ে যেতে চাই, তোমার আব্বা-আম্মা তোমাকে বলতে বলল।
শ্বশুরের কথা শুনে নাদিম চিন্তা করতে লাগল, এ অবস্থায় পাঠান ঠিক হবে না। সেখানকার মেয়েরা ওর শরীরের ঘা দেখে জিজ্ঞেস করলে সাজেদা কি বলতে কি বলবে।
জামাইকে চুপ করে থাকতে দেখে শিহাব বলল, কিছু বলছ না কেন বাবাজী? তুমি ওকে পাঠাতে চাচ্ছ না?
নাদিমের অবস্থা বুঝতে পেরে সাজেদা বলল, কয়েকদিন জ্বরে ভুগে আমার শরীরটা খুবই দুর্বল কিছুদিন পরে এসে নিয়ে যেও।
শিহাব বলল, এখন চাষের মৌসুম। চাষ তুলে আসতে অনেক দেরি হবে। তারপর জামাইকে উদ্দেশ্য করে বলল, বাবাজী, তুমি যদি কয়েকদিন পর সাজেদাকে সাথে করে নিয়ে যেতে, তাহলে খুব ভাল হত।