সাজেদা মারের আঘাত সহ্য করতে না পেরে একসময় আলমারীর ছিপনে ঢুকে গেল। সে মোটা তাই পুরো শরীর ঢুকল না। যে পাশটা বাইরে রইল, সেই পাশে নাদিম আঘাতের পর আঘাত করে চলল। শেষে বেতটা আলমারীর সঙ্গে বাড়ি খেয়ে দুতিন টুকরো হয়ে যেতে ক্ষ্যান্ত দিল।
এদিকে সাজেদার আর্তনাদে তাদের বাড়ির ও অন্যান্য চাচাদের বাড়ির সবাই উঠোনে এসে জমা হয়েছে।
আফ্রিদা ও ফাহমিদা বৌয়ের চিৎকার শুনে ছেলের রুমের দরজা ধাক্কা দিতে দিতে অনেকবার মারতে নিষেধ করে দরজা খুলতে বলেছে। নাদিম তাদের কথা শোনেনি। যখন নাদিম মারে ক্ষ্যান্ত দিয়ে দরজা খুলে বেরোল তখন তারা রুমের ভিতরে ঢুকে বৌয়ের অবস্থা দেখে শিউরে উঠল। তার গায়ের সমস্ত জামা-কাপড় ছিঁড়ে ছিন্ন-ভিন্ন। হয়ে গেছে। আলমারীর পিছনে দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপছে। শরীরের এক সাইডের অনেক জায়গা ফেটে গিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে।
আফ্রিদা ও ফাহমিদা তাকে ধরে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে আলনা থেকে একটা শাড়ি নিয়ে দুভাজ করে সাজেদার গায়ে ঢাকা দিল। তারপর আফ্রিদা বাইরে এসে নাদিমকে খুঁটি ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে গর্জে উঠল, এ রকমভাবে কেউ কাউকে মারে? তুই। লেখাপড়া করে হাদিস-কালাম পড়ে মানুষ না হয়ে জানোয়ার হয়েছিস। তোকে আমি পেটে ধরেছি ভাবতে ঘেন্না হচ্ছে।
ঘর থেকে বারান্দায় আসার পর থেকে নাদিমের রাগ পড়তে শুরু করার সাথে সাথে সাজেদাকে এভাবে মারার জন্য মনে অনুশোচনা হচ্ছিল। মায়ের কথার কোনো জবাব দিতে পারল না। তখন তার চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠেছে।
লোকজনের কোলাহল শুনে রহিমা ও বাতেন এতক্ষণ অন্যান্যদের সঙ্গে উঠোনে ছিল। আফ্রিদা কথাগুলো বলে ঘরে ঢুকে যাওয়ার পর বাতেন সেখান থেকে নাদিমকে উদ্দেশ্য করে বলল, তুই যদি বৌ নিয়ে ঘর করতে না চাস, তা হলে ছেড়ে দে। তুই কি মনে করেছিস, এখানে ওর কেউ নেই। পরের মেয়ের উপর অত্যাচার করার দরকার নেই। তোর মতো একটা শিক্ষিত ছেলে হয়ে এভাবে বৌকে পেটাবে তা ভাবতেই পারছি না।
নাদিম চোখের পানি মুছে বলল, আপনি যে কথা বললেন তা কত বড় ভয়ানক চিন্তা করে দেখেছেন? আমার স্ত্রীকে আমি শাসন করব আপনারা বলার কে?
বাতেন নিজের ভুল বুঝতে পেরে বলল, নাদিম তোকে আমরা বংশের গৌরব মনে করি। তুই আজ যা করলি, তাতে পাঁচজনের কাছে আমাদের মাথা হেঁট হয়ে গেল। স্ত্রীকে শাসন করার অধিকার সকলের আছে। তাই বলে একরম শাসন করার অধিকার আল্লাহ ও তাঁর রসুল (দঃ) দেয়নি। তুইও সে কথা ভালো করে জানিস।
নাদিম আগেই নিজের অন্যায় বুঝতে পেরে মনে যে অনুশোচনা হয়েছিল, বড় মেজ চাচার মুখে আল্লাহ ও রসুল (দঃ)-এর কথা শুনে তা আরো বেড়ে গেল।
ঘরে ঢুকে পাঞ্জাবীটা নিয়ে বেরিয়ে গিয়ে অজু করে মসজিদে ঢুকল। সেখানে সারারাত নফল নামায পড়ে আল্লাহপাকের কাছে অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চাইতে লাগল।
এদিকে আফ্রিদা ও ফাহমিদা সাজেদার আঘাত পাওয়া জায়গাগুলো তুলোতে ডেটল লাগিয়ে রক্ত পরিষ্কার করে অন্য জামা-কাপড় পরিয়ে বৌয়ের কাছে সারারাত বসে রইল।
পরের দিন সকালে নাদিম ফজরের নামাজ পড়ে ঘরে এল না। মসজিদ থেকে বেরিয়ে ডাক্তার নিয়ে আসার জন্য রওয়ানা দিল।
নাদিম যে ডাক্তারকে আনতে গেল, তার নাম অলোক ঘোষ। তাদের বাড়ি সারেংপুর থেকে দুমাইল পূর্বদিকে। সে নাদিমের ছোট মামা মহসীনের বন্ধু। একসঙ্গে স্কুল-কলেজে পড়েছে। অসংখ্যবার দুজন দুজনের বাড়িতে যাতায়াত করেছে। দুজন দুবাড়ির ছেলের মতো। অলোক ডাক্তারের বাবার সঙ্গে মহসীনের বাবারও বন্ধুত্ব ছিল।
অলোক ডাক্তার মর্নিংওয়াক করতে বেরিয়েছিল। নাদিমকে ভালভাবে চিনে। রাস্তায় তাকে জিজ্ঞেস করল, কি খবর ভাগনা? মন খারাপ করে কোথায় যাচ্ছিস?
নাদিম বলল, আপনার কাছে যাচ্ছিলাম। এক্ষুনি আমাদের বাড়িতে আপনাকে একবার যেতে হবে।
কেন, কারো কিছু হয়েছে নাকি?
না-মানে, আপনার বৌমার শরীর খুব খারাপ। বৌমার কি হয়েছে, বলবি তো?
নাদিম কি হয়েছে বলতে না পেরে আমতা আমতা করে বলল, আপনি তাড়াতাড়ি চলুন। গেলেই জানতে পারবেন।
আমার সঙ্গে আয় বাসা থেকে ব্যাগটা নিতে হবে; সেই সঙ্গে ড্রেসটাও পাল্টে নেব। তারপর যেতে যেতে বললেন, কি হয়েছে বলছিস না কেন? বললে সেই রকম প্রিপারেশন নিয়ে যেতে হবে তো।
নাদিম বাধ্য হয়ে বলল, মামা, আপনাদের বৌমা মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করেছিল বলে তাকে আমি মেরেছি। রাগের মাথায় মারটা একটু বেশি হয়ে গেছে।
স্কুলে পড়ার সময় যখন পরপর তিন বছর নাদিমের টাইফয়েড় হয়েছিল তখন এই অলোক ডাক্তার তাকে চিকিৎসা করে ভালো করেছিল। সেই শেষবারে চিকিৎসা করার সময় বলেছিল, তিনবার টাইফয়েড় হলে কোনো রোগী বাঁচে না। যদিও বেঁচে যায়, তা হলে হয় পাগল হয়ে যাবে, নচেৎ কোন্ একটা অঙ্গহানী হবে কিন্তু তা না হয়ে সে যে খুব বদরাগী হয়েছে, সে কথা অলোক ডাক্তার জানে। তাই এখন তার কথা শুনে বলল, হু, বুঝতে পেরেছি। নিশ্চয় বৌমার গুরুতর কিছু হয়েছে। তা না হলে আমাকে নিয়ে যেতে এসেছিস কেন? কিন্তু তুই একটা শিক্ষিত ছেলে, তার উপর ধার্মিক। তোর এটা করা ঠিক হয়নি। বৌমাকে সৎ উপদেশ দিয়ে ভালভাবে বুঝিয়ে ব্যাপারটা নিষ্পত্তি করতে পারতিস। ততক্ষণে তারা বাড়িতে পৌঁছে গেল।