বড়রা ছাড়া ছোটরা সবাই খেয়ে নিয়েছে। তারা নাদিমের ফেরার অপেক্ষায় আছে। প্রতিদিন নাদিম ফিরলে তাকে নিয়ে একসাথে চার ভাই খায়। আজ নাদিমের ফিরতে একটু দেরি হল। সে ফেরার পর সবাইকে খেতে দেওয়া হল। আফ্রিদা খাওয়াচ্ছে, আর অন্য জায়েরা এনে দিচ্ছে।
সব ভাইয়েরা তাদের স্ত্রীদের কাছ থেকে আজকের বৌ-শাশুড়ীদের ঝগড়ার কথা শুনেছে।
রহিম শুনে স্ত্রীকে বলেছে, বৌমা ছেলেমানুষ, বুদ্ধিশুদ্ধি কম। তোমাদের উচিত তাকে বুঝিয়ে নিয়ে চলা।
সুলতানও স্ত্রীকে ঐ একই কথা বলেছে।
আজিজ বলেছে, ওসব নিয়ে মাথা ঘামিও না, বড় ভাই ও ভাবি কি করে চুপচাপ দেখে যাও।
কুদ্দুস বলেছে, বৌটার জন্য দুঃখ হয়। দেখতে-শুনতে ও লেখাপড়া জানা মেয়ে এ রকম করবে ভাবতে পারছি না। যদি একটু নম্র ও বুঝদার হত, তা হলে কতই না ভালো হত।
ফাহমিদা তখন স্বামীকে বলেছে, তুমি নাদিমকে একটু বঝিয়ে বলল, সে যেন বৌটাকে মারধর না করে।
এখন ভাত খাওয়াবার সময় আফ্রিদা ছেলের পাতে তরকারী দেয়ার সময় বলল, তুই চলে যাওয়ার পর বৌ শুয়েছিল। দুপুরে খাওয়ার সময় আমি ডাকতে গেলে আবার আমাকে যা-তা করে বলেছে। সকালেও সবার সামনে আমাকে অপমান হতে হল। তুই যদি আমার পেটে জন্মে থাকিস, তা হলে এর একটা বিহিত করবি। কথা শেষ করে আঁচলে চোখ মুছল।
নাদিম এক লোকমা ভাত মুখের কাছে তুলেছিল, সেটা না খেয়ে প্লেটে রেখে দিয়ে এক গ্লাস পানি খেয়ে হাত ধুয়ে উঠে বাইরে চলে গেল।
তাই দেখে রহিম স্ত্রীকে বলল, খাওয়া হয়ে গেলে কথাটা বলতে পারতে।
তখন গরমকাল। নাদিম বেরিয়ে এসে মসজিদের সিঁড়িতে বসে কি করা উচিত চিন্তা করতে লাগল। প্রায় ঘণ্টা দুয়েক পর রাত বারটার সময় ঘরে ফিরে এল।
সদর গেট দিয়ে ঢুকলেই প্রথমে কুদ্দুসের ঘর। কুদ্দুস গরমের জন্য ছেলেদের নিয়ে বারান্দায় বিছানা করে মশারি খাটিয়ে ঘুমায়। আজ সে স্ত্রীর সঙ্গে মশারির বাইরে বসে নাদিমের জন্য অপেক্ষা করছিল। তাকে ফিরতে দেখে কুদ্দুস ডেকে কাছে বসাল।
ফাহমিদা কাগজীলেবুর রস দিয়ে এক গ্লাস শরবত করে রেখেছিল। উঠে গিয়ে সেটা এনে নাদিমের হাতে দিয়ে বলল, এটা খাও তো বাবা।
নাদিম গ্লাস হাতে নিয়ে বলল, তোমারা খাবে না?
কুদ্দুস বলল, আমরা একটু আগে খেয়েছি, তুই খেয়ে নে।
নাদিম শরবত খেয়ে গ্লাসটা ছোটমার হাতে ফেরত দিল।
ফাহমিদা গ্লাসটা পাশে রেখে নাদিমের গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, বাবা। নাদিম, তুমি খুব বুঝদার ছেলে। বৌ ছেলেমানুষ, জ্ঞানও কম। তাই আজ একটা। অন্যায় করে ফেলেছে। তাকে মারধর না করে বুঝিয়ে বলো। সে দুপুর থেকে কিছু খায়নি।
স্ত্রী থেমে যেতে কুদ্দুস বলল, হ্যাঁ নাদিম, আমরা তোকে এই কথা বলব বলে অপেক্ষা করছিলাম। তোর ছোট মা ঠিক কথা বলেছে। মারধর করা ভালো নয়। সে। কথা তুই আমার চেয়ে ভালো জানিস। তোকে আর আমরা কি বলব। যা এবার ঘরে যা।
নাদিম জানে তার ছোট চাচা ও ছোট মা তাকে অন্যান্য চাচা-চাচিদের চেয়ে বেশি ভালবাসে এবং সেই কারনে তার স্ত্রী সাজেদাকেও ভালবাসে। তাদের কথা শুনে
ক্ষণিকের জন্য তার মন সাজেদার প্রতি একটু নরম হয়েছিল। তাই কিছু না বলে উঠে যখন নিজের ঘরের দিকে আসছিল তখন আম্মার কথাগুলো ও তার চোখের পানির কথা মনে পড়তে মন শক্ত হয়ে গেল। ঘরে ঢুকে দেখল, মশারি না খাটিয়ে সাজেদা বিছানায় শুয়ে আছে। সে জেগে আছে বুঝতে পেরে দরজা জানালা বন্ধ করে ছিটকিনি লাগিয়ে বিছানার কাছে এসে বলল, আমি স্কুলে যাওয়ার সময় আম্মা ও মেজ মার পায়ে ধরে মাফ চাইতে বলেছিলাম, মাফ চেয়েছিলে?
সাজেদা বলল, না।
কেন?
সাজেদা উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইল।
আমি যে তোমাকে তখন বলেছিলাম, আম্মা কিছু যদি বলে তার সঙ্গে কথা কাটাকাটি করবে না, তবু করেছ কেন?
আমার শরীর ভাল নেই, আমি অত কেনর উত্তর দিতে পারব না।
নাদিম আর রাগকে কন্ট্রোল করতে পারল না, সে আলমারীর কাছে গিয়ে তার মাথা থেকে বেতটা নিতে গিয়ে দেখল, নেই।
নাদিম ছোট ছোট ভাইবোনদের ভয় দেখাবার জন্য অনেক আগে শহর থেকে একটা বেতের ছড়ি কিনে এনেছিল। সেটা দিয়ে মাঝে মাঝে তাদেরকে দুএক ঘা মেরে শাসন করে।
আজ স্কুলে যাওয়ার আগে এক ফাঁকে বেতটা দেখেছে। এখন নেই দেখে মনে করল, নিশ্চয় সাজেদা সরিয়ে দিয়েছে। কোথায় সরিয়ে রাখতে পারে ভেবে সম্ভাব্য জায়গাগুলো খুঁজেও পেল না। ফলে আরো রেগে গেল। হঠাৎ বিছানার দিকে নজর পড়তে ভাবল, বিছানার নিচে লুকিয়ে রাখেনি তো? বিছানার চারপাশ খুঁজে দেখেও পেল না।
পাবে কি করে? স্কুলে যাওয়ার সময়কার নাদিমের কথাগুলো ভেবে সাজেদার মনে হয়েছে, সে যা রাগী, মারধর করতে পারে। আলমারীর মাথায় বেত আছে সে জানে। তাই বেতটা নিয়ে বিছানার নিচে ঠিক মাঝখান থেকে গড়িয়ে সরে যেতে নাদিম বেতটা দেখতে পেল। নাদিমের রাগ ততক্ষণে চরমে উঠে গেছে। বেতটা নিয়ে পাগলের মতো সাজেদাকে মারতে লাগল।
সাজেদা ভয়ে ও মারের আঘাতে চিৎকার করে বলতে লাগল, তোমরা কে কোথায় আছ, আমাকে বাঁচাও। ও বাবারে আমাকে মেরে ফেলল রে।
নাদিম তখন মারতে মারতে বলল, আমাকে স্বামী বলে মনে করনি কেন? যদি করতে, তা হলে আমার কথামতো চলতে। যে মেয়েমানুষ স্বামীর কথা শুনে না, তার বেঁচে না থাকাই ভাল।