নাদিম তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, সে কথাও আমি শুনেছি। স্কুলের দেরি হয়ে যাচ্ছে তাই এখন কিছু বললাম না। যা বলার, যা করার এসে করব। তবে তোমাকে একটা কথা বলে যাচ্ছি, আমি চলে যাওয়ার পর আম্মা ও মেজ মার পায়ে ধরে মাফ চেয়ে নিও। তারা যদি কিছু বলে, তা হলে তুমি কোনো কথা না বলে চুপ করে থাকবে আর যদি তা না কর, তা হলে তোমার পরিণতি খুব খারাপ হবে। কথাটা দুতিনবার রিপিট করে স্কুলে চলে গেল।
নাদিম চলে যাওয়ার পর সাজেদা বিছানায় শুয়ে শুয়ে রাগে ফুলতে লাগল। সংসারের কাজ তো করলই না, এমন কি গোসল ও খাওয়া-দাওয়া না করে শুয়ে রইল।
সকলের খাওয়া দাওয়ার পর চার জা যখন একসঙ্গে খেতে বসল তখন বৌ আসছে না দেখে আফ্রিদা ছোট জাকে বলল, যা তো বৌকে ডেকে নিয়ে আয়।
ফাহমিদা নাদিমের ঘরে এসে দেখল, সাজেদা ঘুমোচ্ছে। পাশে বসে গায়ে হাত দিয়ে নাড়া দিয়ে বলল, সাজেদা উঠে পড়ে মা ভাত খাবে চল। সাজেদার সঙ্গে ফাহমিদার খুব ভাব, তার উপ্র দুজনের বয়সও প্রায় কাছাকাছি। তাই ফাহমিদা তার নাম ধরে ডাকে। সাজেদা জেগে গিয়ে বলল, ছোট মা, তোমরা খেয়ে নাও, আমি খাবনা।
আফ্রিদা জাদেরকে বলল, তোরা খাওয়া শুরু কর, আমি বৌকে ডেকে নিয়ে আসি। তারপর ঘরে এসে সাজেদাকে শুয়ে থাকতে দেখে বলল, এস বৌমা, ভাত খাবে এস। ভাতের উপর রাগ করতে নেই।
স্বামী স্কুলে যাবার সময় যখন ঝগড়ার কথা জিজ্ঞেস করে তখন সাজেদা মনে করেছিল, ছেলে ঘরে আসতেই শাশুড়ী তাকে সবকিছু লাগিয়েছে। তাই শাশুড়ীর উপর রেগে ছিল। এখন ডাকতে এলে কিছু না বলে চুপ করে রইল।
আফ্রিদা বলল, বৌমা তুমি কি আমার কথা শুনবে না?
সাজেদা রাগের সঙ্গে বলল, বৌমা বৌমা করছেন কেন? আমাকে আপনারা এ বাড়ির বৌ বলে মনে করেন নাকি? করলে এরকম হেনস্থা করতে পারতেন না। আমি কি এমন করেছিলাম, যার জন্য এতকিছু আমাকে শুনতে হল?
আফ্রিদা বৌয়ের কথা শুনে রেগে গেলেও সংযত স্বরে বলল, তুমি ছেলেমানুষ তোমার বুদ্ধি শুদ্ধি কম। তা ছাড়া নিজের দোষ নিজে কেউ ধরতে পারে না। তাই আমরা…।
সাজেদা তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে উঠে বসে ঝংকার দিয়ে বলল, আমি হয় ছেলেমানুষ, বুদ্ধি-শুদ্ধি আমার কম। কিন্তু আপনারা তো বড় এবং জ্ঞানী, তবে কেন আমাকে যা-তা বলে ঝগড়া করলেন? আসলে আপনারা কেউ আমাকে দেখতে পারেন না। তাই সব সময় আমার দোষ খুঁজে বেড়ান। আব্বা কি দেখে যে এ বাড়িতে আমার বিয়ে দিল, ভেবে পাচ্ছি না।
আফ্রিদা এতক্ষণ রাগ সামলে রেখে কথা বলছিল। এবার বেশ রাগের সঙ্গে বলল, তুমি এক ফোঁটা দুধের বাচ্চা মেয়ে হয়ে বেয়াদবের মতো বড়বড় কথা বলতে শিখেছ, তোমার বাপ-মা কি তোমাকে আদব-কায়দা শিক্ষা দেয়নি?
সাজেদা রাগে চিৎকার করে বলল, আমার বাপ-মা তুলে কথা বলবেন না। আপনারা যে রকম মানুষ, আপনাদের সঙ্গে আবার কি আদব রেখে কথা বলব?
আফ্রিদা ভাবল, এই অবুঝ মেয়েটার সঙ্গে কথা বলা বৃথা। বলল, ঠিক আছে, আমাদের সঙ্গে তোমার কথা বলার দরকার নেই, নাদিম আসুক, যা করার সে করবে।
সাজেদা বলল, হা হা, তাকে তো একবার সত্য-মিথ্যা বানিয়ে অনেক কিছু বলেছেন, এলে আবার বলবেন। কি করে আমিও দেখব।
আফ্রিদা বলল, আমি নাদিমকে বলেছি, একথা তোমাকে কে বলল?
সাজেদা বলল, কে আবার বলবে? আমি কি এতই বোকা, এই সামান্য জিনিসটা বুঝব না?
আফ্রিদা বলল, আমি বলিনি, তবে এবার বলব।
সাজেদা বলল, তাই বলুনগে যান।
আফ্রিদা রাগে গরগর করতে করতে ফিরে এসে দেখল, জাদের খাওয়া শেষ। সে শুধু এক গ্লাস পানি খেয়ে কাউকে কিছু না বলে চলে গেল।
আবিদা বলল, বৌ বোধ হয় বড় বুবুকে যা-তা করে কিছু বলেছে; তাই ভাত খেল না।
ফাহমিদা বলল, বৌটার কপালে আজ কি আছে কি জানি। তারপর তারা যে যার ঘরে চলে গেল।
নাদিমের স্কুলে পরীক্ষার পর একটা মিটিং ছিল। মিটিং শেষ হতে সন্ধ্যে হয়ে গেল। মাগরিবের নামায পড়ে সে টিউশনি পড়াতে গেল। তারপর ফেরার পথে বন্ধু। আসাদের সঙ্গে দেখা। সে ঢাকায় একটা ভাল চাকরি করছে। তার সঙ্গে সালাম বিনিময় ও কোলাকুলি করার পর নাদিম বলল, কেমন আছিস বল, তোর সঙ্গে অনেকদিন পর দেখা।
আসাদ বলল, হ্যাঁ এবারে প্রায় চার মাস পর বাড়ি এলাম। তা হ্যাঁ রে, আমি তো একরকম আছি। শুনলাম তুই বিয়ে করেছিস, খুব সুন্দরী বৌ পেয়েছিস। ভালই আছিস কি বলিস?
নাদিম বলল, আল্লাহপাকের রহমতে এক রকম চলে যাচ্ছে। তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে, না জানিয়ে বিয়ে করেছি বলে মনে কষ্ট পেয়েছিস। অবশ্য পাওয়ার কথা। কি জানিস, বিয়েটা হঠাৎ করে হয়ে গেল। তাই শুধু তোদেরকে কেন, কোনো আত্মীয়স্বজনকেও জানান হয়নি।
আসাদ বলল, তাই নাকি? যাকগে, তুই আজ আমাদের বাড়িতে চল। রোজী তোর কথা বলছিল। তুই নাকি বিয়ে করার পর আর আমাদের বাড়ি যাস নি?
রোজী ঠিক কথাই বলেছে। কিন্তু দোস্ত, আজ যেতে পারব না, অন্যদিন যাব। গেলে খালাআম্মা, রোজী না খাইয়ে ছাড়বে না। আজ বাড়িতে একটু তাড়াতাড়ি ফেরার কথা, কাজ আছে।
কবে আসবি বল?
কাল-পরশু যাব।
কাল না, পরশু আসিস। কাল একটু টাউনে যাব। আমি আম্মাকে ও রোজীকে তোর আসার কথা বলব। ভাবিকেও সাথে করে নিয়ে আসিস। কি রে, আসবি তো?
নাদিম আসাদের পিঠ চাপড়ে বলল, এত করে বলতে হবে না, বললাম তো আসব। তারপর সালাম বিনিময় করে যে যার পথ ধরল। শত ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও নাদিম বাড়িতে অশান্তির জন্য আসাদকে সঙ্গে করে নিয়ে আসতে পারল না।