প্রতি বছর রমজান মাসের তিন তারিখে একবার বার্ষিক আয়-ব্যয়ের হিসাব নিকাশ হয়। হিসাবের পর কত টাকা জাকাত দিতে হবে, কত টাকা ফেতরা দিতে হবে এবং সবার জামা-কাপড় কেনার ব্যাপারে বাজেট তৈরি হয়। এ বছরও রমজানের তিন তারিখে তারাবীর নামাযের পর চার ভাই ও চার জা হিসাব-নিকাশে বসল। আগে নাদিম কোনোদিন এর মধ্যে থাকেনি। এবার তাকেও ডাকা হয়েছে।
জাকাত-ফেতরার হিসাবের পর যখন জামা-কাপড় কেনার বাজেট হচ্ছিল তখন কুদ্দুসের স্ত্রী ফাহমিদা বলল, বৌমাকে ঈদে ভালো জামা-কাপড় দিতে হবে। আর সেই সঙ্গে হাতের দুগাছা সোনার বালাও দিতে হবে। বিয়ের সময় বৌমাকে তো গয়না দেয়া হয়নি। বড় বুবু তার নিজের কানের দুল বৌমাকে দিয়েছে।
তার কথা শুনে কেউ কিছু বলার আগে সুলতান বলল, অবশ্যই দিতে হবে। তারপর সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল, তোমরা কি বল?
আজিজ বলল, কিন্তু একসঙ্গে এতকিছু করলে তহবিল শূন্য হয়ে যাবে।
কুদ্দুস বলল, হোক শূন্য। তবু করতে হবে। আজ প্রায় সাত-আট মাস হল ও বৌ হয়েছে। এখনও যদি তাকে আমরা কিছু না দিই, তা হলে লোকে কি বলবে? তাছাড়া বাপের বাড়িতে বৌমার একটা প্রেসটিজ বলে কথা আছে।
এরপর আর কেউ কিছু না বলে সম্মতি দিল।
সবকিছু মিটে যওয়ার পর আফ্রিদা বলল, আমি এখন তোমাদের কাছে যে কথা বলব তা তোমরা ভেবে-চিন্তে উত্তর দেবে। আমি সংসারের সব দিক লক্ষ্য রাখতে হিমশিম খেয়ে যাই। তার উপর এই টাকা-পয়সা ও আয়-ব্যয়ের হিসাব রাখা আমার পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছে না। মাঝে মাঝে জমা-খরচ লিখতে ভুলে যাই। আম্মা ইন্তেকাল করার পর আমার মনের অবস্থা ভালো নেই। এ সমস্ত ঝক্কি ঝামেলা আর সামলাতে পারছি না। তাই আম্মা যে দায়িত্ব আমাকে দিয়েছিলেন, সেই দায়িত্ব অন্যকে দিতে চাই। কাকে দেব তোমরা ঠিক কর।
রহিম ছাড়া অন্য তিন ভাই চমকে উঠে একসঙ্গে বলে উঠল, তোমাকে সংসারের কোনো দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে না। তুমি শুধু হিসাব-নিকাশের দিকটা সামলাবে।
আফ্রিদা মৃদু হেসে বলল, তোমরা তো বলেই খালাস। আমি না দেখলে এত বড় সংসারের সবকিছু কে দেখবে? মেজ, সেজ ও ঘোটর কাজ আম্মা নির্দিষ্ট করে দিয়ে গেছেন? তারা সেগুলো সামলাবে, না ঐসব দিকে লক্ষ্য রাখবে? তার চেয়ে আমি যেভাবে সংসারের সবকিছু দেখছি, সেভাবেই দেখে যাব। শুধু জমা-খরচের ও টাকা পয়সার হিসাব অন্য কাউকে দেয়ার ব্যবস্থা কর।
বেশ কিছুক্ষণ কেউ কোনো কথা বলতে পারল না।
আফ্রিদা বলল, কি হল? তোমরা কিছু বলছ না কেন?
সুলতান বলল, ভাবি তুমি যখন আমাদের কথা শুনবে না তখন তুমি যাকে উপযুক্ত মনে কর তাকেই এই কাজের ভার দাও।
সাথে সাথে আজিজ ও কুদ্দুস বলে উঠল, মেজ ভাই, তুমি ঠিক কথা বলেছ।
আফ্রিদা বলল, আমি ছোটকে জমা-খরচের হিসাব শিখিয়েছি। তোমরা যদি রাজি থাক, তা হলে এই কাজের ভার আমি তার উপর দিতে চাই।
নাদিম এতক্ষশ কোনো কথা বলেনি। এবার সে বলল, আম্মার কথা আমি সমর্থন করলাম।
নাদিমের কথা শেষ হতে না হতে ভাইয়েরা ও জায়েরা কলল, আমরাও মেনে নিলাম।
শুধু সুলতানের স্ত্রী আয়মন চুপ করে রইল।
কুদ্দুস তা লক্ষ্য করে বলল, মেজ ভাবি কিছু বলছ না কেন?
আয়মন মনে করেছিল, বড় বুবু তার উপর ঐ কাজের ভার দিবে। তাকে না দিয়ে ছোটকে দিতে সে খুব রেগে গেছে।
কুদ্দুস বলার পরও যখন আয়মন কিছু বলল না তখন আফ্রিদা তাকে উদ্দেশ্য করে বলল, কিরে মেজ, কিছু বলছিস না কেন? সবার নিজস্ব মতামত বলার অধিকার আল্লাহ ও তাঁর রসুল (দঃ) দিয়েছেন। তার কিছু বলার থাকলে বল, চুপ করে আছিস কেন? তবু যখন আয়মন কিছু বলল না তখন আফ্রিদা তার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে বলল, তুই যদি এই কাজের ভার নিতে চাস তা হলে আমি দিতে রাজি আছি।
সুলতান বলল, তা কি করে হয়? ও এত হিসাবপত্র রাখতে পারবে না। না-না, ও কিছু নাই বলুক। তুমি ও আমরা সবাই ছোট বৌয়ের হাতে এই কাজের ভার যখন দিতে চাই তখন একজন না চাইলেও কোনো অসুবিধে নেই।
আফ্রিদা বলল, এতে মনে কষ্ট পাওয়ার কি আছে? যে যে কাজের উপযুক্ত, তাকে সেই কাজের ভার দেয়া উচিত। মেজ ভাবি সে কথা নিশ্চয় জানে।
কুদ্দুস বরাবর একটু ঠোঁটকাটা। বলল, মেজ ভাবি যা রাগি, যদি তার কাছে ক্যাশ থাকে তা হলে কেউ টাকা-পয়সা চাইলে তাকে লাঠি নিয়ে দৌড়াবে।
তার কথা শুনে আফ্রিদা ছাড়া সবার মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠল।
আফ্রিদা গম্ভীর স্বরে বলল, বড় ভাইদের সামনে ফাজলামি করছিস। সেজ ভাই ওর কানটা ভালো করে মলে দাও তো বেয়াদব কোথাকার!
সেজ ভাইকে আর কষ্ট করতে হবে না বলে কুদ্দুস নিজের কান নিজে মলে বলল, দোহাই বড় ভাবি, মেজ ভাবিকে ক্যাশের চাবি দিও না। কথা শেষ করে উঠে চলে গেল। কারন সে জানে ভাইয়েরা কখনও তার কান মলেনি। ন্যায়-অন্যায় করলে বড় ভাবি ছোটবেলা থেকে কান মলে লাল করে দেয়। বিয়ের পর দুছেলের বাপ হয়েও তাকে মাঝে-মধ্যে বড় ভাবির হাতের কান মলা খেতে হয়। এখানে থাকলে সবার সামনেই বড় ভাবি উঠে এসে কান মলে দেবে। তাই সে সরে গেল।
কুদ্দুসকে উঠে চলে যেতে দেখে আফ্রিদা বলল, ওটা বরাবর জানোয়ার রয়ে গেল। দুছেলের বাপ হল, তবু মানুষ হল না। তারপর চাবির গোছা নিজের আঁচল থেকে খুলে আয়মনের হাতে দিয়ে বলল, হয় তুই রাখ, নচেৎ তোর যাকে মন চায় তাকে দে।