এরপর থেকে নাদিম সাজেদার পিছনে উঠেপড়ে লাগল। রাতের টিউশনি বন্ধ করে দিয়ে তাকে নানারকম বই পড়াতে চেষ্টা করল। বই পড়ার নেশা ধরাবার জন্য ঘরে যে সমস্ত প্রেমের উপন্যাস ছিল সেগুলো পড়িয়ে শোনাতে লাগল। তারপর পাঠাগার থেকে খুব রসাল প্রেম-কাহিনী এনে তাকে পড়তে বলল। মাঝে মাঝে স্বামী-স্ত্রীর কর্তব্য সম্বন্ধে বিভিন্ন হাদিস পড়েও শোনাতে লাগল। কিন্তু তার সমস্ত চেষ্টা বিফলে গেল।
একদিন মা ফাতেমা (রাঃ) ও কাঠুরিয়ার স্ত্রীর স্বামীভক্তির কথা বলে তাকে তাঁদের অনুকরণ করার কথা বলতে সাজেদা রেগে গিয়ে বলল, তুমি আমার স্বামী। স্বামী যে পদে পদে স্ত্রীর দোষ ধরে তা কখনো কারো কাছে শুনিনি। আমার সব কিছুই দোষের, আমার কি কোনো গুণ নেই? দোষগুণ নিয়েই তো মানুষ। আমার যেমন দোষ আছে, তেমনি নিশ্চয় গুণও আছে। আর মানুষ হিসাবে তোমারও তো অনেক দোষগুণ আছে। কই, আমি তো তোমার কোনোদিন কোনো দোষ ধরিনি। তা হলে তুমি আমার দোষ ধর কেন? তুমি যদি সব সময় আমার দোষ ধর, তা হলে সারাজীবন আমি তোমার সঙ্গে কাটাব কেমন করে? এইসব বলে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।
নাদিম বলল, তোমাকে দোষী করার জন্য তোমার দোষ ধরিনি। বরং তোমাকে নিজের মনের মতো করে গড়বার জন্য দোষ ধরে সৎ উপদেশ দিই। পুণ্যবতী রমণীদের জীবন চরিত এনে দিই। প্রত্যেক স্বামী চায়, তার স্ত্রী তার মনের মতো হোক। তাই তোমাকে সৎ উপদেশ দিই। সেই উপদেশগুলো আমার নিজের কথা নয়, আল্লাহ ও তাঁর রসুলের (দঃ) এবং মনীষীদের কথা। কোনো সৎ উপদেশ দিলেই তুমি রেগে যাও কেন বলতে পার? তাকে চুপ করে থাকতে দেখে বলল, জানি তুমি উত্তর দিতে পারবে না। আমি বলে দিচ্ছি শোন, তোমার মধ্যে দ্বীনি এলেম কম, আল্লাহ ও রসুলের (দঃ) পরিচয়ও ঠিকমতো জান না। তাই তাদের কথা শুনলে রেগে যাও। আর সাংসারিক জীবনে তোমার চাচা, চাচি, আত্মীয়-স্বজন ও পাড়াপড়শীদের আচার ব্যবহার দেখে যা শিখেছ, তাকেই যথেষ্ট বলে মনে কর। এটা মনে করা ঠিক নয়। আমি তোমার স্বামী। তোমাকে মনেপ্রাণে ভালবাসি। তাই ঐসব বলে তোমার জ্ঞানের দুয়ার খুলে দিয়ে এবং সেইভাবে চালিত করে তোমাকে আদর্শ বধূ করতে চাই। আর তুমি মনে কর, আমি তোমাকে দেখতে পারি না, ভালবাসি না। তাই তোমার দোষ ধরে সব সময় উপদেশ দিই। এটা তোমার ভুল ধারণা। মানুষ দুশমনকে দেখতে পারে না। তাই সব সময় তার দোষ-ক্রটি অন্বেষণ করে। তুমি তো আমার দুশমন নও। তোমাকে আমি ভালবাসি কিনা তা তুমি নিশ্চয় জান। তবু তুমি আমার কোনো উপদেশে কান দাও না কেন ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করে দেখো।
সাজেদা কাঁদতে কাঁদতে বলল, শুধু তুমি আমাকে ভালবাস? আমি কি বাসি না? তোমার কোন হুকুম শুনিনি বলতে পার?
নাদিম বলল, আমি তো বলিনি, আমার হুকুম মান না, আমাকে ভালবাস না। তবে যে ভালবাসার কথা আমি বলছি তা তোমার জানা নেই। ভালবাসা কাকে বলে শুনবে? কেউ কাউকে ভালবাসলে, একে অপরের কথা মেনে চলা তো দূরের কথা, প্রাণ বিসর্জন দিতেও কুণ্ঠাবোধ করে না। স্বামী-স্ত্রীর ভালবাসার একটা বাস্তব ঘটনা বলছি, আমার সেজ খালাদের গ্রামে একবার ভীষণ কলেরা দেখা দেয়। যে বাড়িতে যার কলেরা হচ্ছে সে-ই মারা যাচ্ছে। সেই সময় আমার মেজ খালার এক দেবরের কলেরা হল। ভয়ে গোটা বাড়ি ছমছম করছে।.দুপুরের দিকে দুতিনবার পায়খানা হওয়ার পর বমি করতে লাগল। সেজ খালা রান্না করছিল। রান্না হয়ে যাওয়ার পর দেবরকে দেখতে গিয়ে যা দেখল তাতে সে ভয়ে ও বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। স্বামী খাটে বসে বমি করছে আর তার স্ত্রী মেঝেয় বসে দুহাত পেতে সেই বমি ধরছে আর খেয়ে নিচ্ছে। বিস্ময় ভাবটা কাটিয়ে মেজ খালা ছুটে শাশুড়ীকে কথাটা বলল। শাশুড়ী তাড়াতাড়ি এসে বৌয়ের হাত ধরে হিড়হিড় করে টেনে আনবার সময় বললেন, এ কি করছিস হতভাগী, তোর কি জানে ভয় নেই? মেজ খালার জা শাশুড়ীর হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে স্বামীর কাছে ছুটে এসে বলল, আপনাদের জানের ভয় থাকলেও আমার নেই। আমার স্বামী বাঁচবে না, আর আমি বেঁচে থাকব, এটা হতে দেব না। আল্লাহ পাকের কি অপার কুদরত সে যাত্রা মেজ খালার দেবর বেঁচে গেল আর তার স্ত্রীরও কিছু হল না। এই ঘটনা আমার মেজ খালার মুখে শুনেছি। দেখলে তো স্বামী-স্ত্রীর কি গভীর সম্পর্ক! আজকালের মেয়েরা স্বামীকে কি এত গভীরভাবে ভালবাসতে পারে? যদি পারত তা হলে তারা এ দুনিয়াতেই বেহেশতের নমুনা দেখতে পেত।
সাজেদা বলল, আগের যুগে ওরকম লাখে এক-আধটা দেখা গেছে। এখনকার মানুষ ঐ সব শুনলে গালগল্প মনে করবে।
নাদিম বলল, স্বামী-স্ত্রীর গভীর প্রেমের কাহিনী আগের যুগে যেমন ছিল এখনও তেমনি আছে। তবে তাদের সংখ্যা কম। তাই মানুষ তাদের খোঁজ খবর পায় না। এসব থাক, ঘুমিয়ে পড় অনেক রাত হয়েছে।
এরপর থেকে নাদিম স্ত্রীর জন্য যা কিছু কিনে সব ডবল। বাড়িতে এসে মমতাজের হাতে দিয়ে বলে এগুলো তোর ভাবির কাছে নিয়ে যা। সে তার পছন্দমতো নেয়ার পর তুই নিবি।
হঠাৎ একদিন নাদিমের দাদি কবিরন বিবি জ্বর হয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলেন। ছেলেরা ডাক্তার নিয়ে এসে চিকিৎসা করাতে লাগল। কিন্তু কিছুই হল না। জ্বরে অজ্ঞান থাকা অবস্থায় তিন দিনের দিন তিনি মারা গেলেন। উনি মারা যাওয়ার দুমাস পর রমজান মাস এসে গেল।