একদিন আফ্রিদা মেয়েকে ভাবির কাছ থেকে চোখ মুছতে মুছতে আসতে দেখে জিজ্ঞেস করল, কি রে, কাঁদছিস কেন?
মমতাজ বলল, আমি ভাবির একটু স্নো পাউডার মুখে দিয়েছি বলে যা-তা করে বলল, স্নো-পাউডার মেখে কি আর রূপসী হওয়া যায়? আর কোনদিন যেন না মাখি, ভাইয়া এসে পড়ল, সেও ভাবিকে কিছু বলল না।
আফ্রিদা বৌয়ের আসল রূপ অনেক আগেই বুঝতে পেরেছে। বৌ যে এরকম করবে তাও টের পেয়েছে। এখন মেয়ের কথা শুনে বলল, কেন ঐ সব ছাই-পাস মাখতে যাস? আর কখনও যাবি না।
বৌকে নিয়ে আফ্রিদার অনেক চিন্তা মাঝে মাঝে তাকে পাশে বসিয়ে কার সঙ্গে কি রকম ব্যবহার করতে হয় বুঝিয়ে বলে। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয় না। বরং উল্টো শাশুড়ীর সঙ্গে কথা বন্ধ করে দেয়। আফ্রিদা বুঝতে পেরে বৌমা বৌমা করে ডেকে কথা বলে। একদিন ছেলেকে বলল, তুই বৌমাকে কুরআন-হাদিসের কথা বলে তার কর্তব্য বোঝাবি, নচেৎ তোদের ভবিষ্যৎ জীবনে অশান্তি আসবে। ঠিকমতো নামাযও পড়ে না। আমি বললে দুএকদিন পড়ে। তারপর যেইকে সেই। তুই কি কিছু লক্ষ্য করিস না? তাকে সকলের সঙ্গে নরম মেজাজে মিষ্টি ব্যবহার করতে বলি। কিন্তু সে কথাও সে মোটেই কানে তুলে না। নিজের ইচ্ছামতো সব কিছু করে। মমতাজ ও আবুল খায়েরকে মোটেই দেখতে পারে না। আমি কত বোঝাই, তুইও বোঝাবি।
নাদিম বলল, আম্মা, আমি তোমাদের বৌকে বহুবার কুরআন-হাদিসের কথা বলে বুঝিয়েছি। মহিলা সাহাবীদের ও পুণ্যবতী মহিলাদের কত ঘটনা শুনিয়ে সেইভাবে চলার চেষ্টা করতে বলেছি। কোনো কোনো রাতে এইসব কথা বলে বোঝাতে বোঝাতে ফজরের আযান হয়ে গেছে। কিন্তু যে বুঝতে চায় না, তাকে আর কেমন করে বোঝাব। আজ ছমাস হয়ে গেল, বুঝিয়ে-বুঝিয়ে আমি বিফল হয়েছি। সে কিছুই বুঝতে চায় না। সে খুব একগুঁয়ে স্বভাবের মেয়ে। যেটা নিজে ভালো মনে করে সেটা ছাড়া অন্য কোনো কিছু মানতে চায় না। ঐদিন মমতাজ তার স্নো-পাউডার মেখেছিল বলে তার সাথে রাগারাগি করছিল। আমি সে সময় এসে মমতাজকে রাগারাগি করার কারণ জেনে তার কদর্য মনের পরিচয় পেয়ে হতবাক হয়ে যাই। মমতাজের চোখে পানি দেখে আমি খুব রেগে যাই। রেগে গেলে আমি কি রকম অমানুষ হয়ে যাই তা তো তুমি জান। কিছু অঘটন ঘটিয়ে ফেলতাম। কিন্তু হঠাৎ আল্লাহপাকের রসুল (দঃ)–এর রাগের উপর একটা হাদিস মনে পড়ে যেতে রাগটা দমন করে নিই। মমতাজ চলে যাওয়ার পর তাকে অনেক বোঝালাম। এতদিন তুমিও যেমন বুঝিয়েছ, আমিও কম বোঝাইনি। দিন দিন সে যেন আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে। তাই অনেক চিন্তা-ভাবনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ওকে তালাক দেব। আফ্রিদা চমকে উঠে বেশ রাগের সঙ্গে বললেন, কি বললি? আর একবার বল, দেখি বলে তার গালে চড় মারতে গিয়ে হাত তুলে রয়ে গেল। তারপর হাতটা নামিয়ে নিয়ে রাগটা সংযত করার জন্য মাটির দিকে চেয়ে রইল।
নাদিম ভেজা গলায় বলল, মারতে গিয়ে থেমে গেলে কেন আম্মা? বিয়ে করার পর থেকে যে অশান্তির আগুনে জ্বলছি, তোমার হাতের মার খেলে সেই আগুন হয়ত কিছুটা নিভে যেত। তারপর কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে নিজেকে সামলে নিয়ে আবার বলল, এটা ছাড়া আমি অন্য কোনো পথ দেখছি না, আম্মা। নচেৎ তোমরা যেমন কোনোদিন শান্তি পাবে না তেমনি আমিও পাব না। ওর রূপই ওর কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। জান আম্মা, মমতাজ একটু কালো বলে একদিন আমাকে বলল, তোমার ঐ কালোপেত্নী বোনকে বিদায় করবে কি করে? তখন আমি রেগে ওর গালে কয়েকটা চড় মেরে বলেছিলাম, আবার যদি কোনোদিন ঐ রকম কথা বলো, তাহলে চিরজীবনের মতো তার মুখ বন্ধ করে দেব। সে মারের কথা হয়ত তোমরা জেনেছিলে। কিন্ত কেন মেরেছিলাম জাননি। আমি ওকে নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছি।
আফ্রিদা ততক্ষণে রাগ সংযত করে নিয়েছে। বলল, বৌমার সবকিছু আমি অনেক আগেই বুঝেছি। সেই জন্যে তাকে বোঝাই। আর তুইও বোঝাস। তাতে কোন ফল হচ্ছে না ঠিক কথা, তাই বলে তুই যে সিদ্ধান্তের কথা বললি, তা আর কোনোদিন মুখে উচ্চারণ করবি না। স্ত্রীকে তালাক দেয়া অতি ঘৃণিত কাজ। হাদিসে তালাকের ব্যাপারে আল্লাহপাকের রসুল (দঃ) বলিয়াছেন, সমস্ত হালাল জিনিসের মধ্যে আল্লাহর নিকট সর্বাপেক্ষা অপ্রিয় হল তালাক। খবরদার, ঐ কথা আর কখনও মনে স্থান দিবি না। যদি কখনও মনে উদয় হয়, তখন আউজুবিল্লাহ হি মিনাস শায়তোয়ানের রাজীম ও দোয়া আস্তাগফার পড়বি। নচেৎ শয়তান তোর মনে ঐ কাজের ওয়াস ওয়াসা দিবে। আর শোন, মানুষ জঙ্গলের হিংস্র পশুকে ধরে এনে নিজেদের কথামতো চলার জন্য শিক্ষা দিতে কত রকমের খেলা দেখাচ্ছে। আর তুই একটা মেয়েকে শিক্ষা দিয়ে বসে আনতে পারবি না, এটা কেমন কথা?
নাদিম বলল, কিন্তু,যে নিজেকে অহঙ্কারী ও বেশি জ্ঞানী মনে করে তাকে যতই নসিহত কর না কেন, সে হেদায়েত হয় না।
আফ্রিদা বলল, হেদায়েত করার মালিক একমাত্র আল্লাহ। তিনি কাকে কখন কোন অসিলায় হেদায়েত করবেন তা তিনি ছাড়া আর কেউ জানেন না। তুই তার হেদায়েতের জন্য আল্লাহপাকের কাছে দোয়া চাইবি। আর খুব মিষ্টি কথায় বোঝাবি। হাজার হোক মুসলমানের মেয়ে। কুরআন-হাদিসের কথা শুনতে শুনতে একদিন না একদিন শুধরে যাবেই।
নাদিম বলল, ঠিক আছে-আম্মা, আমি তাই করব।