সাজেদা বলল, তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে-তোর বর তোর মন মতো হয়নি। আমার বরের কথা তো শুনলি, এবার তোর বরের কথা বল শুনি।
দীলরুবা স্বামীর কথা আদ্যোপান্ত সব বলল।
সাজেদা বলল, তা হলে এক কাজ করলে হয় না? আমরা আমাদের স্বামীদেরকে বলে স্বামী-স্ত্রী বদল করার ব্যবস্থা করি আয়। কথা শেষ করে সে হাসতে লাগল।
দীলরুবা রেগে গিয়ে বলল, তোর দীলে কি আল্লাহর ভয় একটুও নেই? এরকম কথা ইয়ার্কি করে বলাও কঠিন গোনাহ।
সাজেদা হাসি থামিয়ে বলল, কি জানি ভাই, ইয়ার্কি করলেও যে গোনাহ হয় তা জানতাম না। তারপর তার নাকে নোলক দেখে বলল, এটা আবার কে দিল? বিয়ের সময় তো তোর শ্বশুররা নোলক দেয়নি?
দীলরুবা বলল, আমার উনি দিয়েছে। নোক পরলে নাকি আমাকে খুব সুন্দরী দেখায়।
সাজেদা ভাবল, আমি যদি মোলক পরি, তা হলে আমাকে আরও বেশি সুন্দরী দেখাবে। তাই নাদিম যখন তাকে নিতে এল তখন তাকে এক সময় জিজ্ঞেস করল, তুমি নোলক পরা পছন্দ কর?
নাদিম বলল, করি। নোলক পরলে তোমাকে আরও সুন্দরী দেখাবে।
তা হলে আমাকে একটা বানিয়ে দেবে? আমি পরব।
ঠিক আছে, চেষ্টা করব।
স্বামীর বাড়িতে এসে সাজেদা স্বামীকে নোলক বানিয়ে দেয়ার জন্য প্রায়ই তাগিদ দিতে লাগল।
.
নাদিমের সাজেদাকে নোলক বানিয়ে দেবার ইচ্ছা থাকলেও টাকার জন্য পারছে। টিউশনীর টাকা থেকে এটা-ওটা কিনে দিয়ে যা বাঁচে সেই টাকা জমিয়ে বানাতে গেলে দেরি হবে। তাই দেব দেব করে কাটিয়ে দেয়।
একদিন রাতে ঘুমাবার সময় মোলক বানিয়ে দেয়ার কথা বলতে নাদিম যখন বলল, দেব তখন সাজেদা স্বামীর মুখে একই কথা বারবার শুনে বলল, দেব দেব তো অনেক দিন বলছ, এখনও কি দেয়ার সময় হয়নি?
নাদিম বলল, বানিয়ে দিতে হলে আরও দেরি হবে। নোলক বানাতে অনেক টাকা লাগবে। অত টাকা আমার কাছে নেই।
কেন, আম্মাকে বললেই তো বানিয়ে দেবে।
আম্মাকে বলেছিলাম। আম্মা বলল, পরে সময় মতো বানিয়ে দেবে।
পরে কেন? আম্মার কাছে তো সংসারের সব টাকা জমা থাকে, সেই টাকা দিয়ে। বানিয়ে দিতে পারেন।
সংসারের সব টাকা যেমন জমা থাকে তেমনি সংসারের সব খরচও তাকে খুব বুঝেসুঝে করতে হয়। কখন কি দরকার হয় তার কোনো ঠিক আছে? আম্মার কথা থাক, আমি টাকা জমিয়ে তোমাকে বানিয়ে দেব।
সাজেদা বেশ রাগের সঙ্গে বলল, বিয়ের সময় এবং আজ পর্যন্ত তোমরা আমাকে গয়না তো দূরের কথা, একটা ভালো জামা-কাপড়ও দাওনি। আমার কি শখ হয় না, স্বামীর বাড়ি থেকে ঐসব পাওয়ার।
নাদিম আহতস্বরে বলল, তোমার কথা অস্বীকার করছি না। কিন্তু আমাদের একান্নবর্তী সংসার। আব্বা-আম্মা নিজেদের ইচ্ছামতো কিছু করতে পারেন না। তা ছাড়া আমাদের এমন সচ্ছলতাও নেই যে, হঠাৎ করে একসঙ্গে বেশি টাকা খরচ করবে। আম্মা যে কত হিসাব করে সংসার চালাচ্ছে তা তো তুমি দেখতে পাচ্ছ।
সাজেদা বলল, তাই বলে নুতন বৌকে শ্বশুর-শাশুড়ীরা কিছু দেবে না-এ কেমন কথা? এবারে আব্বাদের বাড়িতে অনেকে জিজ্ঞেস করছিল, আমি শ্বশুর বাড়ি থেকে কি কি গয়না পেয়েছি। আমার তখন যা লজ্জা পেয়েছিল। বুদ্ধি করে বললাম হঠাৎ বিয়ে হয়েছে, তাই তারা গয়না গড়াবার সময় পায়নি। এবারে আব্বাদের ওখানে যাওয়ার আগে কিন্তু দুএকখানা সোনার জিনিস বানিয়ে দিতে হবে। আর সেই সঙ্গে ভালো জামা-কাপড়ও দিতে হবে।
এখন ওসব দিতে পারব না।
দিতে পারবে না কেন? না দিলে আব্বাদের বাড়িতে তোমাদের মান-ইজ্জত থাকবে না।
একটা কাজ করলে থাকবে।
কি কাজ?
যতদিন তোমাকে ঐ সমস্ত জিনিস দেয়া হচ্ছে না, ততদিন আর আব্বাদের বাড়িতে যাওয়ার নাম মুখে আনবে না।
এটা একটা কথা হল নাকি? তোমরা যদি পাঁচ বছর দিতে না পার, তা হলে আমি কি অতদিন আব্বাদের বাড়ি যাব না?
হ্যাঁ, তাই।
আব্বা নিয়ে যেতে এলে কি বলবে?
আমাদের হয়ে তুমি বুদ্ধি করে কিছু একটা বলে কাটিয়ে দেবে।
কতদিন ঐভাবে আব্বাকে ফেরাব?
যতদিন তুমি ঐসব ছাড়া যেতে পারবে না।
তা হলে বোঝা যাচ্ছে, তুমি আমাকে শাস্তি দিতে চাও।
তা যদি বুঝে থাক, তা হলে তাই।
কিন্তু কেন?
সব কিছু জেনেও ঐসবের বায়না ধরছ বলে?
আমার বায়না ধরা কি অন্যায় হয়েছে?
না, বায়না ধরাটা অন্যায় হয়নি, অন্যায় হয়েছে তড়িঘড়ি চাওয়ার জন্য।
ঠিক আছে, আর কোনোদিন কোনো কিছুর জন্য তোমাকে বলব না।
এটা তুমি রাগের কথা বললে। আচ্ছা, তুমি অত অবুঝ কেন? আমারও কি সখ হয় না, তোমাকে ভালো জামা-কাপড় কিনে দেয়ার? দুখানা গয়না বানিয়ে দেয়ার? আল্লাহপাক যখন রাজি হবেন তখন মনের সাধ পূরণ করব।
ততদিনে বুড়ী হয়ে যাব, তোমার মনের সখ মনেই থাকুক।
নাদিম স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে করতে বলল, তুমি যখন বুড়ী হবে তখন আমিও বুড়ো হব। সেই সময় দুবুড়োবুড়িতে মনের শখ মিটিয়ে খুব ফুর্তি করব।
সাজেদা স্বামীর মতলব বুঝতে পেরে বিরক্ত কণ্ঠে বলল, অত আদর আর ইয়ার্কি করতে হবে না, আমার শরীরটা ভালো নেই, ঘুমাব।
নাদিম তাকে ছেড়ে দিয়ে বলল, আমি কি তোমাকে ঘুমাতে বাধা দিচ্ছি নাকি? তারপর পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ল।
সাজেদা চৌধুরী বাড়ির বৌ হয়ে আসার কয়েক মাসের মধ্যে তাকে সবাই অহঙ্কারী ও অসল টাইপের মেয়ে বলে বুঝতে পারল। সাজেদা সবার কাছে বাপের বাড়ির বড়াই করে কথা বলে। এখানে যা খাচ্ছে-পরছে- সেসব বাড়িতে কখনো খাইনি-পরেনি সে কথাও বলে। সংসারে খেটে খেটে সে অনেক ময়লা হয়ে গেছে, তাও বলে। নাদিমের ছোট বোন মমতাজ কোনো সময় ভাবির সঙ্গে গল্প করতে এলে নানা অজুহাত দেখিয়ে এড়িয়ে যায়। কয়েকবার এরকম হতে মমতাজ ভাবির মনোভাব বুঝতে পেরে চোখভরা অশ্রু নিয়ে চলে যায়।