নাদিম সকালে ও সন্ধ্যায় কয়েকটা ছেলেকে প্রাইষ্টে পড়ায়। সেই টাকাও এতদিন মায়ের হাতে দিয়ে এসেছে। এবার যখন প্রাইস্টে পড়ানোর টাকা মাকে দিতে গেল তখন আফ্রিদা বলল, ঐ টাকাটা তুই রেখে দে। তোর নিজেরও তো একটা খরচ আছে।
নাদিম বলল, সব খরচ তো তুমিই দাও, আমার আবার খরচ কিসের?
আফ্রিদা হেসে উঠে বলল, পাগল ছেলের কথা শোন। বৌমার কিছু শখ-সাধ হলে কিনে দিবি। সে সব কি আর বৌমা আমাকে বলবে।
তারপর থেকে নাদিম ঐ টাকা নিজের কাছে রাখে। সেই টাকা থেকে সাজেদাকে নানারকম প্রসাধনী ও অন্যান্য টুকটাক জিনিস কিনে দেয়।
এবারে সাজেদা যখন বাপের বাড়িতে ছিল তখন তার সই দীলরুবাও শশুরবাড়ি থেকে বাপের বাড়িতে এসেছে। তার বিয়ে সাজেদার বিয়ের ছমাস আগে হয়েছে। দুজনের বাড়ি কাছাকাছি। তাই বাপের বাড়িতে এসে দুজন দুজনকে পেয়ে মহাখুশি। একে অন্যের স্বামীর কথা, শ্বশুর-শাশুড়ীর কথা এবং শ্বশুর বাড়ির নানান কথা বলাবলি করতে লাগল। দীলরুবার যখন বিয়ের সম্বন্ধ আসে তখন সাজেদা শুনেছিল, পাত্র বাপ মার একমাত্র ছেলে। জমি-জায়গাও অনেক। পাত্র ম্যাট্রিক পাস করে টাউনে ব্যবসা করে। এক সময় সে দীলরুবাকে বলল, তুই তো খুব সুখে আছিস তাই না? অন্য শাশুড়ী নেই, কোনো ননদ নেই, বেশ নির্ঝঞ্ঝাট সংসার।
দীলরুবা বলল, তা যা বলেছিস আল্লাহ আমাকে খুব সুখে রেখেছে। সে জন্য তার দরবারে জানাই লাখ লাখ শুকরিয়া। তারপর বলল, শুনেছি তোর শ্বশুররা চার ভাই এক সংসারে আছে। খুব বড় সংসার তাই না? হ্যাঁ রে, তোর বর তো বি.এ. পাস। খুব চরিত্রবান। তুই ঐদিক দিয়ে খুব ভাগ্যবতী।
সাজেদা বলল, সে শুধু চরিত্রবান নয় গোড়া ধার্মিক। বিয়ে হওয়ার পর থেকে তার কাছে ধর্মের বাণী শুনে শুনে কান ভোতা হয়ে গেছে। একটু এদিক-ওদিক হলেই অমনি কুরআন-হাদিসের কথা আওড়াতে থাকে। আচ্ছা, তুই-ই বল, কেউ কোনো দিন কুরআন-হাদিসের কথা সব মেনে চলতে পারে? না চলেছে। মাঝে মাঝে এইসব নিয়ে বেশ মনোমালিন্য হয়। তবে আমাকে খুব ভালবাসে।
দীলরুবা বলল, তোর ব্ল কি কি ব্যাপারে কুরআন হাদিসের কথা বলে বল তো শুনি?
এই যেমন নামায পড়া নিয়ে। এক ওয়াক্ত নামায কাযা করার উপায় নেই। মাসিক হওয়ার পর পাক হতে এক-আধদিন দেরি করলে, ভি-গলা ব্লাউজ ও পাতলা কাপড় পরলে, ভোরে উঠে ফজরের নামাযের পর কুরআন তেলোয়াত না করলে, প্রতিদিন কিছু কিছু কুরআন-হাদিসের ব্যাখ্যা এবং অন্য কোনো বইপত্র না পড়লে। কত আর বলব? এ রকম কত ব্যাপারে যে কত উপদেশ হজম করতে হয় তার ইয়ত্তা নেই।
সাজেদা ও দীলরুবা ছোট বেলা থেকে সই পাতিয়েছে। দুজনে এক সঙ্গে ম্যাট্রিক পাস করেছে। কিন্তু দীলরুবা খুব ধার্মিক। ছোটবেলা থেকে ধর্মের যতটুকু জেনেছে ততটুকু মেনে এসেছে। জ্ঞান হওয়ার পর সে আল্লাহর কাছে ধার্মিক স্বামী কামনা করে এসেছে। কিন্তু আল্লাহপাকের কুদরত বোঝা মানুষের অসাধ্য। তাই যার সঙ্গে তার। বিয়ে হয়েছে সে বেনামাযি, বেরোযাদার, টি ভি, ও টেপের পোকা। বাসায় যতক্ষণ থাকবে ফুল ভলিউমে টেপে গান শুনবে। রাতে টিভি প্রোগ্রাম শেষ না হওয়া পর্যন্ত ঘুমাবে না। বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে মাঝে-মধ্যে মাগী পাড়ায় যায়। যেদিন যায় সেদিন মদ খেয়ে ঘরে ফেরে। দীলরুবা স্বামীকে কতবার বুঝিয়ে নামায পড়তে বলে টেপ টি.ভি. চালালেও আস্তে চালাতে বলে। এমন কি যখন আযান হয় তখন সে সব বন্ধ করা তো দূরের কথা ভলিউম কমায়ও না। প্রতি সপ্তাহে সিনেমা দেখা চাই। কোনো ভালো ছবি হলে চার-পাঁচবার দেখে। একবার দীলরুবাকে বেড়াতে যাওয়ার নাম করে যখন বন্ধুদের সঙ্গে সিনেমা দেখতে নিয়ে গেল তখন সে খুব বাধা দিয়ে বলেছিল, আমি কখনও সিনেমা দেখিনি, এখনও দেখব না। এটা খুব গোনাহর কাজ। তার স্বামী শুনেনি। সেদিন দীলরুবা সিনেমা হলের ভিতরে সারাক্ষন কেঁদেছে। বাড়িতে এসে তার স্বামী চড়, কিল ও ঘুঁসি মেরে বলেছিল, তোমার জন্য আজ আমি বন্ধুদের কাছে অনেক অপমান হয়েছি। দীলরুবা স্বামীর মার খেয়ে একটুও প্রতিবাদ করেনি। পায়ে ধরে বলেছিল, তুমি আর কখনও আমাকে এমন জায়গায় নিয়ে যেও না, যেখানে গেলে আমি তোমার সম্মান রাখতে পারব না। তারপর কেঁদে কেঁদে মাফ চেয়েছে। তারপর থেকে তার স্বামী তাকে কোথাও নিয়ে যায় না। স্বামীকে ঐসব বদ অভ্যাস ছেড়ে দিয়ে নামায পড়ার কথা বললে মেজাজ দেখিয়ে বলে, আমার ব্যক্তিগত ব্যাপারে মাথা ঘামিও না। আমি তোমার স্বামী। তুমি আমার স্ত্রী। তোমার কথা আমি শুনব, না-তুমি আমার কথা শুনবে? এত নামায-কালাম পড় আর এটা জান না, স্ত্রীর প্রধান কর্তব্য স্বামীর হুকুম মেনে চলা? কোনোদিন আর আমাকে কোনো উপদেশ দিবে না। নচেৎ তোমার কপালে খারাবি নেমে আসবে। এরপর থেকে সে সুখী। শ্বশুর-শ্বাশুড়ী তাকে খুব ভালবাসে। এমন কি তার স্বামীর স্বভাব-চরিত্র ঐরকম হলেও ঐ একদিন ছাড়া আর কোনোদিন মারধর করেনি। তাকে অবহেলাও করেনি। দীলরুবার এক এক সময় মনে হয়, তার স্বামী যদি ধার্মিক হত, তা হলে তার মতো ভাগ্যবতী মেয়ে বুঝি আর পৃথিবীতে কেউ হত না।
আজ সাজেদার স্বামী ধার্মিক জেনে দীলরুবার নিজের স্বামীর কথা মনে পড়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তোর স্বামীর কথা শুনে খুবই আনন্দিত হলাম। কিন্তু তুই অসন্তুষ্ট হচ্ছিস কেন? বরং খুশি হওয়ার কথা। জানিস না বুঝি সংসারের সব রকমের সুখ-শান্তি র চেয়ে স্ত্রীর কাছে স্বামীর চরিত্র ও ধার্মিকতা লক্ষগুন বেশি সুখ-শান্তির? যে মেয়ে এমন স্বামী পায় সে মহাসৌভাগ্যবতী।