একদিন আয়মনের কোলের বাচ্চাটা ক্ষিধের চোটে খুব কান্নাকাটি করছে। আয়মন তখন ধান সিদ্ধ করতে চুলোয় জ্বাল দিচ্ছিল। আর আবিদা ঘরের বারান্দায় বসে খেজুর পাতার চাটাই বুনছিল। ছেলের কান্না শুনে আয়মন আবিদাকে শুনিয়ে বলল, চুলোয় জ্বাল দেয়ার মতো লোকও নেই, ছেলেটা ক্ষিধের জ্বালায় কেঁদে কেঁদে খুন হয়ে যাচ্ছে কারো যদি নজরে পড়ে। এই কথা বলে সে দোলনা থেকে বাচ্চাটাকে নিয়ে এসে চুলোয় জ্বাল দিতে দিতে বুকের দুধ খাওয়াতে লাগল। কিন্তু ছেলেটার তখন খুব জিদ উঠে গেছে। সে দুধ মুখে না নিয়ে চিল্লাতে লাগল।
তাই দেখে সাজেদা হাতের কাজ ফেলে রেখে সেখানে এসে বলল, মেজমা আমি জ্বাল দিচ্ছি, আপনি ওকে দোলায় বসে দুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে আসুন।
আয়মনের রাগ আবিদার উপর। সেই রাগ সাজেদার উপর ঝাড়ল। ঝংকার দিয়ে বলল, নিজের কাজ ফেলে রেখে কে তোমাকে দরদ দেখাতে আসতে বলেছে? তুমি তোমার কাজে যাও। আরো তো লোক আছে, তারা কি চোখে কানা, না কানে কালা?
সাজেদা আর কিছু না বলে ফিরে এসে নিজের কাজ করতে লাগল। আবিদা এবার উঠে চুলোর কাছে এসে বলল, মেজ বুবু, তুমি শুধু শুধু রাগ করছ। আমাকে তো জ্বাল দিতে ডাকলেই পারতে। যাও, বাচ্চাকে থামিয়ে দুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে এস।
আয়মনের রাগ তবু পড়ল না। বলল, ডাকতে হবে কেন, তুই কি বাচ্চার কান্না শুনতে পাস নি। বসে-শুয়ে তো গতরটা দিন দিন ফোলাচ্ছিস।
আবিদা তার হাত ধরে তুলে দাঁড় করিয়ে বলল, আমার অন্যায় হয়েছে মেজবুবু। তুমি যাও, বাচ্চাটা কেঁদে কেঁদে গলা শুকিয়ে ফেলল।
আয়মন গজর গজর করতে করতে চলে গেল।
আয়মন বিয়ের পর বেশকিছু দিন মৃগী রোগে ভুগেছে। চিকিৎসা করানোর ফলে এবং প্রথম ছেলে হওয়ার পর ভালো হয়েছে। কিন্তু তারপর থেকে সে ভীষণ রাগী হয়েছে। এমনি সে হিংসুটে ধরণের মেয়ে। তারপর মৃগী রোগ হওয়ার পর থেকে সামান্য কারণে খুব রেগে যায়। আর রেগে গেলে কাউকে কিছু বলতে বাকি রাখে না। তাই সে রেগে গেলে সবাই চুপ করে থাকে। তার কথায় কেউই তেমন কিছু মনে করে না। আবিদাও হিংসুটে কিন্তু হঠাৎ রাগে না। তবে বড় অলস। আফ্রিদা সাজেদাকে মেজ শাশুড়ীর মেজাজের কথা বলে তার সঙ্গে কোনো ব্যাপারে কথা কাটাকাটি করতে নিষেধ করে দিয়েছে।
৫. সাজেদার দাদি হামিদা বানু
সাজেদার দাদি হামিদা বানু ফিরে গিয়ে শিহাবকে বললেন, তুই তোর মেয়েকে যেভাবে মানুষ করেছিস সেই রকম ঘরে তার বিয়ে দেয়া উচিত ছিল। সেখানে তাকে অনেক খাটাখাটনি করতে হচ্ছে। বিরাট সংসার। তাদের সংসারে যে সব তরকারী রান্না হয়, সে সব সাজেদা কখনও খায় নি। তোর মেয়ে ঐ সব না খেতে পেরে বেশ রোগা হয়ে গেছে। তুই বোধ হয় কাজটা ভালো করিসনি।
শিহাব বলল, আম্মা, আপনি ওসব নিয়ে চিন্তা করবেন না। সব কিছু আস্তে আস্তে সহ্য হয়ে যাবে। মেয়েদের ভালোমন্দ নির্ভর করে স্বামীর উপর। নাদিমকে তো দেখেছেন, অমন ছেলে কয়টা দেখেছেন বলুন দেখি? তাছাড়া ওর শ্বশুর-শাশুড়ীও খুব ভালো।
হামিদা বানু বললেন, তা অবশ্য ঠিক কথা বলেছিস। অমন স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ী কটা মেয়ের কপালে জোটে। তবে সাজেদার মেজ ও সেজ শাশুড়ীকে তেমন ভালো মনে হল না। তুই কিছুদিন পর গিয়ে সাজেদাকে নিয়ে আসবি।
শিহাব বলল, তাই নিয়ে আসব।
প্রায় দুআড়াই মাস পর শিহাব সারেংপুর গিয়ে মেয়েকে নিয়ে এল। জামাইকেও নিয়ে আসতে চেয়েছিল, তার ছুটি নেই বলে আসেনি। সাজেদার মা সালেহা মেয়ে রোগা হয়ে গেছে দেখে শ্বশুরবাড়ির অনেক কথা জিজ্ঞেস করল। সাজেদা মায়ের কথার উত্তরে যা বলল, তা সবই ভালো। শুধু তরকারী ও খাটা-খাটনি ছাড়া সালেহার খারাপ কিছু মনে হল না। মেয়েকে বুঝিয়ে বলল, সব গৃহস্থবাড়ি সমান না। মেয়েরা বাপের বাড়িতে যেভাবেই মানুষ হোক না কেন স্বামীর বাড়িই তার আসল বাড়ি। প্রত্যেক মেয়ের উচিত নিজেকে স্বামীর বাড়ির সবকিছুর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়া। আল্লাহর কাছে দোয়া করি, তিনি যেন তোকে সহ্য করার ও সবার সঙ্গে মানিয়ে চলার তওফিক দান করেন।
মাসখানেক পরে স্কুলে ছুটি পড়তে নাদিম শ্বশুরবাড়িতে এসে দুদিন থেকে। সাজেদাকে নিয়ে বাড়ি ফিরল।
কবিরন বিবি সংসারের সব দায়িত্ব আফ্রিদাকে বুঝিয়ে দিয়ে সিন্দুকের চাবি তার হাতে তুলে দেয়ার পর থেকে সংসারে যা কিছু আয় হয়, তা সব চার ভাই মিলে আফ্রিদার হাতে দেয়। তারপর সংসারের খরচের দরকার মতো টাকা-পয়সা চেয়ে নেয়। আফ্রিদা কাকে কোন্ খানে কত টাকা দেয় এবং কি কি ফসল বিক্রি করে কত। টাকা জমা রাখে, সে সব প্রতিদিন ঘুমাবার আগে জমা-খরচের খাতায় লিখে রাখে। তাকে সংসারের সব দিক লক্ষ্য রাখতে হয়। সকলের কাপড়-চোপড় কেনা থেকে অসুখ-বিসুখ ডাক্তার ও ওষুধপত্রের খরচ, ছেলেমেয়েদের স্কুলে ভর্তি হওয়া ও তাদের। বই–খাতা কেনা, এমন কি মেহমান-কুটুমের যত্নের দিকেও তাকে লক্ষ্য রাখতে হয়। প্রতিদিন রাতে চার ভাই একসঙ্গে খাবে। তারপর চাষবাসের ব্যাপারে ও সংসারের কেনাকাটার ব্যাপারে বারান্দায় আলোচনা করবে। ততক্ষণে চার জা খাওয়ার কাজ শেষ করে ঘরের মধ্যে এসে বসবে। টাকা-পয়সার দরকার থাকলে ভাইয়েরা আফ্রিদাকে জানাবে। আফ্রিদা আগে খরচের খাতায় লিখবে তারপর দরকার মতো সিন্দুক থেকে বের করে দেবে। কোননা কোনো দিন আঁচল থেকে চাবির গোছা খুলে ছোট জা ফাহমিদার হাতে দিয়ে বলবে, আমি লিখছি তুই সিন্দুক খুলে টাকাটা বের করে দে। আফ্রিদা মাঝে মাঝে ফাহমিদাকে জমা-খরচের হিসাব বুঝিয়ে দিয়ে খাতা লেখা। শেখায়। ফাহমিদা বনেদী ঘরের জ্ঞানী মেয়ে হয়েও বাপের আর্থিক দুরাবস্থার জন্য ক্লাস এইট থেকে ভালভাবে পাস করে নাইনে উঠে আর পড়তে পারে নি। দুচারদিনের মধ্যে জমা খরচের হিসাব বুঝে নিয়ে বেশির ভাগ দিন সে-ই খাতা লিখে।