রশিদার গায়ের রং কাল হলেও দেখতে-শুনতে ভাল। বাপ-মার একমাত্র সন্তান বলে হয়ত একটু উগ্র ধরনের। তাকে কেউ কিছু বলে পার পায় না। একটা বললে সাতটা শুনিয়ে দেয়। তবে নাদিমকে খুব ভয় পায়। এই রকম স্বভাবের জন্যে সে ছোট বেলা থেকে তার চড়-চাপটা খেয়ে আসছে।
নাদিম বি.এ. পাস করে যখন গোদাগাড়িহাই স্কুলে মাস্টারি করতে লাগল তখন রহমত আলী একদিন নাদিমের আব্বাকে বলল, আমি রশিদাকেনাদিমের হাতে দিতে চাই।
রহিম বলল, আমার মেজ ও ছোট শালী নাদিমকে জামাই করবে বলে অনেক দিন আগে প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে। তা ছাড়া আমার মামাতো ভাই আফসু ও খালাত ভাই কাদের এবং বড় বুবুও প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে। তোমাকে এখন কিছু বলতে পারছি না, পরে জানাব।
রহমত আলী চিন্তা করল, ওরা হয়ত অনেক কিছু যৌতুক দেয়ার কথা বলেছে, তাই এরকম বলছে। বলল, রশিদা আমাদের একমাত্র মেয়ে। পরে ওরাই তো আমাদের সব কিছু পাবে, তবু আমি এখন নাদিমের নামে পাঁচ বিঘা ধানী জমি লিখে দেব।
রহিম বলল, তুমি আমাকে ভুল বুঝো না। যৌতুকের কথা যা বললে তা আর কোনদিন মুখে উচ্চারণ করো না। জান না, বিয়েতে লেনদেন হারাম? নাদিম এসব কথা শুনলে খুব রেগে যাবে। সে কি ধরনের ছেলে, তা তো জান। আমি ওর মায়ের সাথে কথা বলে দেখি। তা ছাড়া নাদিমেরও মতামত নিতে হবে, আম্মাকেও জানাতে হবে। সেদিন আর এ ব্যাপারে কোন কথা হল না।
ঐ দিন রাতে রহিম স্ত্রীকে রহমত আলীর কথা জানাল।
আফ্রিদা বলল, রশিদা একটু খরখরি আর রং কাল। নাদিম যদি মত দেয়, তা হলে আমার কোন অমত নেই। তবে তুমিও তো জান, বড় বুবু ও জয়নাব অনেক আগে প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে।
রহিম বলল, শুধু তারা কেন, আমাদের আত্মীয়দের মধ্যেও অনেকে প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে। ওসব কথা বাদ দিয়ে বল, রহমত আলীকে কি বলব?
আফ্রিদা বলল, আমরা যাই বলি না কেন সবার আগে নাদিমের মতামত নিতে হবে তার উপর আম্মা রয়েছেন। ওনাকে না জানিয়ে, মতামত না নিয়ে আমরা কিছু করতে পারি না।
রহিম বলল, আমি সে কথা রহমত আলীকে বলেছি।
আফ্রিদা বলল, আমার মতে কোন আত্মীয়ের মেয়ের সঙ্গে নাদিমের বিয়ে না দেয়াই ভাল। কারণ একজনের মেয়েকে বৌ করলে অন্যজন মনে কষ্ট পাবে।
রহিম বলল, কথাটা তুমি মন্দ বলনি। তবে কি জান, যার যেখানে হুকুম আছে তার সেখানেই হবে।
আত্মীয়দের মধ্যে অনেকে নাদিমের মা-বাপের কাছে সুবিধে করতে না পেরে তার দাদী কবিরন বিবির কাছে প্রস্তাব দিতে লাগল।
কবিরন বিবি খুব চিন্তায় পড়ে গেলেন। একদিন চার ছেলেকে ডেকে নাদিমের বিয়ের প্রস্তাবের কথা বলে আলোচনা করে ঠিক করলেন, কোন আত্মীয়ের মেয়ের সঙ্গে নাদিমের বিয়ে দেবেন না। যত তাড়াতাড়ি পারা যায় অন্য জায়গায় বিয়ের ব্যবস্থা করতে ছেলেদেরকে বললেন, তাই প্রায় আঠার-বিশ মাইল দূরের এক গ্রামের জানাশোনা বংশের একটা ভাল মেয়ের খোঁজ পেয়ে কাউকে কিছু না জানিয়ে হঠাৎ করে নাদিমের বিয়ে দিয়ে দিলেন।
মেয়ের বাবা শিহাব নাদিমের মেজ দাদাজীর মেজ ছেলে বাতেনের ক্লাসফ্রেণ্ড ছিল। গোদাগাড়িতে তখন হাইস্কুল থাকলেও কলেজ ছিল না। তাই বাতেন রাজশাহী কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়েছে। সেই সময় সে প্রেমতলী গ্রামের বাড়িতে লজিং থাকত। সেই বাড়ির ছেলে শিহাবও ইন্টারে পড়ত। ফলে দুজনের মধ্যে বেশ সখ্যতা গড়ে উঠে। ইন্টারমিডিয়েট পাস করার পর দুজনেরই বাবা মারা যান। তাই বাতেন যেমন পড়াশোনা বন্ধ করে দেয়, তেমনি শিহাবও বন্ধ করে দেয়। সে সব অনেক আগের ব্যাপার হলেও তারা আজও সখ্যতা বজায় রেখেছে। বছরের বিভিন্ন সময় পিঠা, ফল-পাকাড়ি নিয়ে দুজন দুজনের বাড়িতে যাতায়াত করে। শিহাব নাদিমের সম্বন্ধে সব কিছু জেনে তাকে জামাই করার জন্য একদিন বন্ধু বাতেনকে বলল।
বাতেন বলল, ভাইপো বলে বলছি না, ছেলে হিসাবে নাদিম সত্যিই খুব ভাল। উপযুক্ত মেয়ে থাকলে আমি তাকে জামাই করতাম। ছেলের বাপের সঙ্গে কথা বলে তোমাকে জানাব।
শিহাব বাড়ি চলে যাওয়ার পর একদিন বাতেন রহিমকে শিহাবের কথা বলে বলল, তোমরা তো জান আমি একসময় তাদের বাড়িতে থেকে কলেজে পড়েছি। ওদের অবস্থা ভালো বংশও ভালো। এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলেটা ছোট। ক্লাস থ্রী না ফোরে পড়ে। মেয়েটাই বড়। গত বছর ম্যাট্রিক পাস করেছে। দেখতে-শুনতে খুব ভাল। আর শিহাবকে তো তোমরা সবাই চেন।
চাচাতো ভাইয়ের কথা শুনে রহিমের মায়ের ও স্ত্রীর কথা মনে পড়ল, আত্মীয়দের মেয়ের সঙ্গে নাদিমের বিয়ে না দেয়াই ভাল। কারণ একজনের মেয়েকে বৌ করলে অন্যরা মনে কষ্ট পাবে। চিন্তা করল, এখানে বিয়ে হলে কোন আত্মীয়ই মনে কষ্ট পাবে না। বলল, আমার কোন অমত নেই। তুমি আম্মার সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বল।
বাতেন একসময় ছোট চাচীর কাছে এসে প্রস্তাবটা পাড়ল।
কবিরন বিবি শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তিনিও শিহাবকে চেনেন। যতবার শিহাব এসেছে ততবার বাতেনের সাথে এসে কদমবুসি করে ভালমন্দ জিজ্ঞেস করেছে। ভাবলেন, এখানে নাদিমের বিয়ে দেয়া চলে। হঠাৎ ওনার মনে হল, কোন আত্মীয়ের মেয়ের সঙ্গে নাদিমের বিয়ে হলে বোধ হয় ভাল হত। শেষমেষ মনকে শক্ত করে বাতেনকে বললেন, তুমি তো ওদের বাড়িতে থেকে দুবছর লেখাপড়া করেছ। এখনও যাতায়াত কর। মেয়েকে নিশ্চয় দেখেছ? আর ওদের বংশপরিচয়ও জেনেছ?