সাজেদার সঙ্গে তার দাদি এসেছিলেন। তিনি যতদিন ছিলেন, ততদিন ঐ তরকারীর সাথে আলাদা কিছু ভাল তরকারী রান্না করে দেয়া হয়েছে। উনি খাওয়ার পর যা অবশিষ্ট থাকত, তা দিয়ে সাজেদা ভাত খেত। তিনি পনের দিন থেকে চলে গেছেন। তারপর থেকে খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে সাজেদার খুব অসুবিধা হতে লাগল। সকালে আলাদা কোনো নাশতা তৈরি হয় না। সবাই বাসি ভাত খায়। নাদিম স্কুলে যাবে বলে গরম ভাত হয়। সাজেদার ভাত খাওয়ার অভ্যেস নেই। সে জন্য না খেয়ে থাকে।
নাদিম জানতে পেরে একদিন সাজেদাকে বলল, খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু আমি কি করব বল, আলাদাভাবে কিছু করা সম্ভব নয়। এক কাজ কর, ঘরে তো মুড়ি থাকেই; সকালে সরষের তেল মাখিয়ে মুড়ি খেও। তারপর আমি যখন স্কুলে যাওয়ার সময় ভাত খাব তখন আমার সঙ্গে তুমি গরম ভাত খেয়ে নিও।
সাজেদার ছোটবেলা থেকে চা খাওয়ার অভ্যেস। নাদিমদের বাড়িতে কেউ চা খায়। বলে তর ব্যবস্থা নেই। স্বামীর কথা শুনে বলল, তুমি চা-চিনি এনে দিও; আমি শুধু মুড়ি খেতে পারি না, চা দিয়ে খাব।
নাদিম বলল, ঠিক আছে, আমি আম্মাকে বলে তার ব্যবস্থা করব।
সাজেদা বলল, কেন তুমি কিনে এনে আমাকে দিতে পার না?
না, পারি না, কারণ আমি বেতনের সব টাকা আম্মার হাতে দিয়ে দিই।
বিয়ের আগে না হয় দিয়েছ, এবার কিছু কিছু হাতে রাখলেই পার।
কথাটা শুনে নাদিম একটু রেগে গেল। বলল, না তাও পারি না, কারণ গোটা সংসারের আয় যেমন আম্মার কাছে জমা থাকে, তেমনি সমস্ত খরচের দায়-দায়িত্ব আম্মার হাতে। আর কখনও এরকম কথা বলবে না।
তা হলে তুমি তোমার স্ত্রীর শখ-সাধও মেটাতে পারবে না?
যখন তোমার কোনো শখ-সাধ হবে তখন চেয়ে দেখো, মেটাতে পারি কিনা।
কি আর দেখব, আম্মার কাছ থেকে টাকা চেয়ে মেটাবে-এই তো?
নাদিম আরো রেগে গিয়ে বলল, কিভাবে কি করব, সেটা আমার ব্যাপার। তোমাকে ভাবতে হবে না।
সাজেদা স্বামীকে রেগে যেতে দেখে আর কিছু বলল না।
নাদিম আম্মাকে সাজেদার চা খাওয়ার অভ্যাসের কথা বলায় আফ্রিদা সকালে ও সন্ধ্যায় তার জন্য চায়ের ব্যবস্থা করল।
কুদ্দুসের স্ত্রী ফাহমিদার বাপের বাড়িতে চায়ের প্রচলন আছে। ফাহমিদাও চাখোর ছিল। শ্বশুরবাড়িতে এসে অনেক কষ্টে সে অভ্যাস ছেড়েছে। বৌয়ের জন্যে দুবেলা চা হচ্ছে দেখে তার পুরোন অভ্যাস মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। সেও সাজেদার সঙ্গে দুবেলা চায়ের পার্টনার হয়ে গেল। তাই দেখে মেজ আয়মন ও সেজ আবিদার হিংসা হতে লাগল। একদিন সকালে সাজেদা ও ফাহমিদা যখন চা-মুড়ি খাচ্ছিল তখন তাদেরকে শুনিয়ে আয়মন সেজ জা আবিদাকে বলল, হোটেল খুললেই তো ভালো হত সবাই চা খেতে পেতাম।
সাজেদা শুনতে পেয়ে ফাহমিদাকে বলল, দেখলে ছোট মা, আমরা একটু চা খাচ্ছি তাও মেজ মা সহ্য করতে পারছে না।
ফাহমিদা বলল, মেজ বুবুর কথা ধরো না, সে সব সময় ওরকম। এইভাবে দিন গড়িয়ে চলল। সেই সঙ্গে নাদিম সাজেদাকে নানারকম উপন্যাস ও ধর্মীয় বই পড়ার জন্য তাগিদ দিতে লাগল। সৎ উপদেশ দিয়ে নিজের মনের মতো গড়ার যত চেষ্টা করতে লাগল তত সাজেদা স্বামীর প্রতি রুষ্ট হয়ে উঠতে লাগল। প্রায়ই দুজনের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়।
সাজেদা স্বামীর প্রতি দুটো কারণে দিন দিন রুষ্ঠ হয়ে উঠছে। প্রথম কারণ বই পড়ার তাগিদ। বিয়ের আগে বই পড়ার নেশা কিছু কিছু থাকলেও বিয়ের পর বই যেন তার কাছে দুচোখের বিষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বই পড়ার কথা শুনলে তার মেজাজ বিগড়ে যায়। যে কারনে এখন তার বইয়ের প্রতি এত অনীহা তা হল, বিয়ের আগে গল্প উপন্যাস পড়ে স্বামী ও সংসারের যে স্বপ্ন সে দেখেছিল, বিয়ের পর তার এক কণাও বাস্তবে না দেখে এ রকম হয়েছে। আর দ্বিতীয়টা হল, সাজেদার ধারণা সে রূপসী বলে নাদিম শুধু তার দেহ ভোগ করার জন্য তাকে ভালবাসে, তা না হলে সব সময় তার দোষ ধরে কেন? কুরআন হাদিসের কথা বলে উপদেশ দেয় কেন? কোনোদিন এতটুকু গুণগান করে না কেন? প্রথমদিকে স্বামী ও শ্বশুর বাড়ির সকলের সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করার চেষ্টা করলেও ক্রমশ অসহ্য হয়ে উঠতে লাগল। একদিকে যেমন প্রতি রাতে স্বামীর কাছে উপদেশ শুনে কান ঝালাপালা, অপরদিকে প্রথম দিকে সবাই তাকে যে চোখে দেখত, এখন তারা অন্য চোখে দেখছে। এত খেটেও তার দুর্ণাম। মেজ শাশুড়ী প্রায়ই বলে, বড়লোকের মেয়েকে গৃহস্থ ঘরের বৌ করা ঠিক হয়নি। সেজ শাশুড়ীও তাকে দেখতে পারে না। শুধু ছোট শাশুড়ীর সঙ্গে তার মিলমিশ। ছোট শ্বশুরও বেশ স্নেহ করেন।
আফ্রিদা বৌয়ের উগ্র স্বভাব দেখে বুঝতে পেরেছে, এই বৌ নিয়ে সে যেমন সুখী হতে পারবে না, তেমনি নাদিমও জীবনে সুখ-শান্তি পাবে না। তবু নতুন বৌ; জ্ঞান কম সেই কথা ভেবে তাকে নিজেদের মতো করে গড়ে নেয়ার জন্য সংসারের কাজকর্ম ধৈর্যের সঙ্গে শেখাতে লাগল। কোনো কিছু ভুল করলে তা সংশোধন করে দেয়। কিন্তু মেজ শাশুড়ী কট কট করে সাজেদাকে কথা শুনিয়ে দেয়। সেজ শাশুড়ীও বলতে কম করে না। কোনো কাজ করতে একটু দেরি করলে বড়লোকের নবাবজাদী বলে খোটা দেয়। সেজ শাশুড়ী খুব মোটা। সংসারের কাজকর্ম তেমন করতে পারে না। কবিরন বিবি চার বৌকে তাদের কাজ নির্দিষ্ট করে দিলেও আবিদা মোটা বলে কিছু করতে পারে না। অন্য জায়েরা করে দেয়। সাজেদা বৌ হয়ে আসার পর আবিদা আগে যতটুকু করত, এখন সে সব সাজেদাকে দিয়ে করায়। আর সে শুয়ে-বসে শুধু আতখাই করে, আল্লাহ আমাকে এমন করল যে, কোনো কাজ করতে গেলে দম বেরিয়ে আসে। আয়মন তাকেও ছেড়ে কথা বলে না। তার আতখাই শুনে বলে, শুয়ে-বসে খেলে মোষের মতো গতর হবে না তো কি হবে!