তোর সঙ্গে তর্কে পারব না। তবে তোর কথাগুলো খুব দামী। আল্লাহর কাছে তুই আমার জন্য দোয়া করিস, তিনি যেন আমাকে সব ডিউটি পালন করার তওফিক দেন।
শুধু তোর জন্য নয়, পৃথিবীর সব মুসলমানের জন্য প্রত্যেক নামাযের পর। মোনাজাতের সময় দোয়া করি। আর এটা করা পৃথিবীর সব মুসলমানের কর্তব্য। তুই দুছেলের বাপ হলি এখনো ঠিকমত নামায পড়িস না। আগে কি করেছিস না করেছিস, এবার থেকে ঠিকমত ধর্মের সব কিছু মেনে চলবি। ছেলেমেয়েরা বাপ-মাকে ধর্মের আইন মেনে চলতে দেখলে তারাও মেনে চলার প্রেরণা পাবে, জানিস না বুঝি, ছোটবেলায় ছেলেমেয়েরা বাপ মাকে যা করতে দেখবে তারাও তা অনুকরন করবে?
আমি তো সব সময় নামায পড়তে চাই; কিন্তু কেন জানি তা পারি না। এর কারণ কি বলতে পারিস?
এর কারণ এমন কিছু নয়, শুধু গাফিলতি অর্থাৎ অলসতা। আর এর পিছনে কাজ করছে শয়তান। তুই যদি একটা কাজ করতে পারিস, তা হলে জীবনে কোনোদিন নামায ছাড়তে পারবি না।
বল কি কাজ?
তুই যদি একচল্লিশ দিন পাঁচ ওয়াক্ত নামায এক ওয়াক্তও কাজা না করে জামাতে তকবীরে উলার সঙ্গে পড়তে পারিস, তা হলে নামায ছাড়তে চাইলেও নামায তোকে ছাড়বে না। আর শয়তানও পাফিলতিতে গ্রেফতার করতে পারবে না।
সত্যি বলছিস?
সত্যি না মিথ্যা তা করলেই জানতে পারবি।
ঠিক আছে, ইনশাআল্লাহ কাল থেকে শুরু করব।
না কাল থেকে নয় আজ থেকেই। কোনো কাজ কাল করব বলে ফেলে রাখতে নেই। এটা মনীষীদের কথা।
ঐ দিন যোহর থেকে রিয়াজুল সেই যে নামায পড়তে শুরু করল তারপর সারাজীবনে আর কোনোদিন পরিত্যাগ করেনি।
সেদিন রাতে ঘুমাবার সময় নাদিম স্ত্রীকে বলল, তোমাকে কয়েকটা কথা বলছি, সেগুলো মনে রেখে মেনে চলার চেষ্টা করবে।
সাজেদা যে কদিন শ্বশুর বাড়িতে ছিল, সে কদিন স্বামীর কাছ থেকে হিতোপদেশ শুনে শুনে বিরক্ত হয়েছে। তখন ভয়ে লজ্জায় কিছু বলেনি। আজ স্বামীর কথা শুনে বুজতে পারল, এখন আবার হিতোপদেশ দিবে। তাই বিরক্ত বোধ করে বলল, তুমি শুধু আমাকে কুরআন-হাদিসের কথা বলে উপদেশ দাও। আমি কি তোমার সঙ্গে বা তোমাদের বাড়ির সকলের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করি? বিয়ের রাত থেকে অনেক উপদেশ শুনিয়েছ, আর কত শোনাবে?।
নাদিম স্ত্রীর কথা শুনে মনে আঘাত পেয়ে দীঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, কুরআন হাদিসের কথা শুনতে তোমার ভালো লাগে না।
ভলো লাগবে না কেন? কিন্তু তুমিই বল, ভালো কথা কি সব সময় শুনতে ভালো লাগে?
ভালো সব সময় মানুষের কাছে ভালো লাগে। তবে তাদের কাছে ভালো লাগে না, যারা ভালোকে গ্রহণ করতে চায় না। যাকগে, এ প্রসঙ্গ এখন থাক, আমার ঘুম পাচ্ছে। বলে সে পাশ ফিরে চোখ বন্ধ করল।
নাদিমের কথায় সাজেদা অসন্তুষ্ট হল। সে বড় লাইট অফ করে ডিম লাইট জ্বেলে এসে তার পাশে শুয়ে পড়ল।
চারদিন পর নাদিম শ্বশুরবাড়ি থেকে চলে এল। যদিও শ্বশুর, শাশুড়ী, দাদি শাশুড়ী ও সাজেদা তাকে এত তাড়াতাড়ি আসতে দিতে চায়নি। ওনারা অনেক বাধা দিয়ে আরো কয়েকদিন থাকতে বলেছিল; কিন্তু নাদিম সাজেদার স্বভাব চরিত্র দেখে-শুনে মনে খুব আঘাত পেয়েছে বলে সেখানে তার এক দণ্ড থাকতে মন চাইল না। সবার অনুরোধে রিয়াজুলও তাকে আরো দুএকদিন থাকতে বলেছিল, সে শুনেনি।
আসার সময় সাজেদা স্বামীকে অনেকবার থাকতে বলে যখন বিফল হল তখন। কদমবুসি করে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, আমি যদি কোনো দোষ করে থাকি তবে মাফ করে দিও। তারপর জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠে বলল, কবে আসবে। বল?
সাজেদার কথায় ও কান্নায় নাদিমের মন একটু নরম হল। বলল, আল্লাহ যখন রাজি হবেন তখন আসব। তারপর তাকে আদর করে চলে এসেছে।
মাস দুয়েক পর নাদিমের শালা লিয়াকত তার ফুপাতো ভাই ইয়াকুবকে সাথে করে নাদিমকে নিয়ে যেতে এল।
নাদিম যখন তাদের সঙ্গে শ্বশুরবাড়ি গেল তখন আফ্রিদা ছেলেকে বৌমাকে নিয়ে আসার কথা বলে দিল।
নাদিম শ্বশুরবাড়িতে তিনদিন থেকে সাজেদাকে নিয়ে বাড়ি ফিরল। এবার তাকে নিজের মতো করে গড়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে লাগল।
সাজেদা ধনী ঘরের সন্তান। তার উপর সে হওয়ার পর অনেক বছর আর কোনো ভাইবোন হয়নি। ফলে বাপ মার ও বাড়ির সকলের কাছে খুব আদরের। যখন যা আবদার করেছে পেয়েছে। ঘরের কোনো কাজকর্ম করা তো দূরের কথা, এক গ্লাস পানি পর্যন্ত নিজে ঢেলে খায়নি। কারো হুকুম পালন করে সে মানুষ হয়নি, বরং হুকুম চালিয়ে মানুষ হয়েছে। মাছ-মাংস ছাড়া একবেলাও ভাত খায়নি। দামি দামি জামা কাপড় পরে মানুষ হয়েছে। রান্না-বান্নাও কিছু শিখেনি। বিয়ের পর এই দুমাসের মধ্যে তার মা তাকে কিছু কিছু রান্নার কাজ শিখিয়েছে। সেই সাজেদা শ্বশুরবাড়িতে এসে খুব অসুবিধে বোধ করতে লাগল। নাদিমের কথায় ভোরে উঠে ফজরের নামাযের পর কুরআন শরীফ পড়তে হচ্ছে। বাড়িতে সে মাঝে মাঝে পড়লেও কোনোদিন ফজরের নামায পড়েনি। শীতকালে তো অনেক বেলা পর্যন্ত লেপের তলায় ঘুমিয়ে থাকত। একান্নবর্তী পরিবারে বৌ হয়ে এসে তাকে অনেক পরিশ্রম করতে হচ্ছে। নাদিমদের মুদি বাজার ছাড়া অন্য কোনো বাজার করা হয় না। সব রকমের তরকারী নিজেরা চাষ করে। যে মৌসুমে যে তরকারী চাষ হয়, সে সময় সেই তরকারী খায়। যেমন-বেগুনের সময় বেগুন, তেঁড়সের সময় বেঁড়শ, পুঁইশাকের সময় পুঁইশাক, ডাটা শাকের সময় ডাটা শাক, আলুর সময় আলু। তবে আলু ওদের প্রচুর হয়। কিছু বিক্রি করে বাকিটা সারা বছর ধরে খায়। মেহমান-কুটুম এলে পুকুরে জাল ফেলে মাছ ধরে, ঘরের মুরগি জবাই করে। তা ছাড়া মাছ মাংস বড় একটা হয় না। তবে বর্ষার মৌসুমে মগরীতে নানারকম মাছ পড়ে। সে সময় প্রতিদিন মাছের তরকারী রান্না হয়। সাজেদা যখন শ্বশুরবাড়ি এল তখন পুঁইশাকের সময়। যেমন বিক্রি করা হচ্ছে তেমনি দুবেলা পুঁইশাকের তরকারী রান্না হচ্ছে। পুইশাক সে কোনোদিন খায়নি। এখন বাধ্য হয়ে খেতে হচ্ছে। কিন্তু এই তরকারী দিয়ে ভাত খেতে খুব কষ্ট হয়। দুচার গাল খেয়ে উঠে পড়ে। প্রথম আফ্রিদা বুঝতে পেরে ডিম ভেজে দিত।