মায়ের কথার জবাবে সুলতান বলল, আমরা বড় ভাবিকে আনতে গিয়েছিলাম, সে আসেনি।
কবিরন বিবি বললেন, তোমরা নাদিমকে ঐভাবে মেরেছ বলে বড়মার মনে কষ্ট হয়েছে, তাই আসেনি। তারপর রহিমকে বললেন, তুমি গিয়ে আমার অসুখের কথা বলে বলবে, আমি তাকে নিয়ে আসার জন্য তোমাকে পাঠিয়েছি।
পরের দিন রহিম নাশতা খেয়ে শ্বশুরবাড়ি গেল।
আফ্রিদা স্বামীকে কমদবুসি করে জিজ্ঞেস করল, কেমন আছ, আম্মা কেমন আছেন? আমি ভালো, তুমি কেমন আছ?
আমার খবর এতদিন যখন নাওনি তখন আর জানার দরকার নেই। আম্মা কেমন আছেন বললে না যে?
আজ দুদিন আম্মার খুব জ্বর। ডাক্তার এনে দেখান হয়েছে। আম্মা তোমাকে নিয়ে যেতে পাঠালেন।
আফ্রিদা নাস্তা, শরবত ও পান দিয়ে বলল, আম্মার কথায় নিয়ে যেতে এসেছ? নিজের ইচ্ছায় আসনি তা হলে?
তা কেন? আমি তো তোমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য ওদেরকে বারবার পাঠিয়েছি।
তাদের আসা আর তোমার আসা কি এক?
তুমি এত জ্ঞানী হয়েও স্বামীর ভুল ক্ষমা করতে পারলে না?
আফ্রিদা ছলছল নয়নে বলল, তুমিই বা কি করে ভাইদের সঙ্গে যুক্তি করে সবাই মিলে নিজের ছেলেকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলে? সেটা বুঝি খুব বুদ্ধিমানের কাজ করেছ? বাপ হয়ে ছেলের অন্যায় ক্ষমা করতে পারলে না কেন? শাসন করবে ভালো কথা, তাই বলে মেরে ফেলার মতো শাসন কোনো বাপ কোনো দিন করেছে কিনা জানি না। এই কথা বলার পর মুখে আঁচল চাপা দিয়ে ফুঁপিয়ে উঠে আবার বলল, ছেলেটা মরল না বাঁচল একবার দেখতেও এলে না।
রহিম বলল, দেখতে না এলেও খবর ঠিকই নিয়েছি। তুমি তো জান, আমি হঠাৎ কখনও রাগি না। দুবছর ছেলেটা লেখাপড়ায় ফাঁকি দিয়ে ফেল করল। তারপর মাদ্রাসায় পড়ার কথা শুনে সামলাতে পারলাম না। আর মানুষ রেগে গেলে শয়তান ঘাড়ে চাপে। তাই সেদিন ঐ রকম একটা কাণ্ড করে ফেলেছি। আমিও তো মানুষ। আমারও পিতৃস্নেহ আছে। সেদিন রাগ পড়ে যাওয়ার পর মনে যে কত ব্যাথা অনুভব করেছি তা আল্লাহপাক জানেন। আজও সে কথা মনে হলে নিজের কাছে নিজে ছোট হয়ে যাই। স্ত্রীকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে দেখে বলল, আমাকে কি তুমি ক্ষমা করে দিতে পার না?
আফ্রিদা আঁচলে চোখ মুছে স্বামীকে আর একবার কদমবুসি করে বলল, বারবার ক্ষমা চেয়ে আমাকে গোনাহগার করো না। আমাকে নিয়ে যেতে তুমি ভাইদেরকে পাঠিয়েছিলে। আমি তোমার উপর অভিমান করে না গিয়ে অন্যায় করেছি, তুমি বরং আমাকে মাফ করে দাও।
রহিম বলল, আল্লাহপাক আমাদেরকে মাফ করুন। আচ্ছা, নাদিম তো মাদ্রাসায় ভর্তি হয়েছে, চিঠিপত্র দিয়েছে? নাদিম যে কয়েক দিন আগে ফিরে এসেছে রহিম তা জানে না।
আফ্রিদা বলল, সে চার-পাঁচদিন হল ফিরে এসেছে। তারপর তার ফিরে আসার কারণ ও স্কুলে পড়ার ইচ্ছার কথা জানাল।
রহিম শোকর আলহামদুলিল্লাহ বলে বলল, আমরা সবাই চেয়েছিলাম সে তার নিজের ভুল নিজে বুঝুক। তাই আম্মা যখন মাদ্রাসায় পড়ার খরচের কথা বললেন তখন আমরা তাকে পড়ার অনুমতি দিলেও খরচপত্র দিতে চাইনি। আল্লাপাকের কাছে শুকরিয়া জানাই, তিনি ওকে তাড়াতাড়ি ভুল বোঝার তওফিক দিলেন। নাদিম কোথায়? ওকে কাউকে দিয়ে ডাক তো, অনেক দিন দেখিনি।
আফ্রিদা রুম থেকে বেরিয়ে ভাইপো সাইদুলকে দেখতে পেয়ে নাদিমকে ডেকে দিতে বলল।
নাদিম জানে না তার আব্বা এসেছে, সাইদুল ডেকে দিতে ঘরে ঢুকে আব্বাকে দেখে আতঙ্কিত হয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।
আফ্রিদা ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বলল, কি হল, বেয়াদবের মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? সালাম দিয়ে কদমবুসি কর।
নাদিম সালাম দিয়ে কদমবুসি করল।
রহিম সালামের উত্তর দিয়ে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে মাথায় চুমো খেয়ে ভিজে গলায় বলল, তুমি তোমার ভুল বুঝতে পেরেছ শুনে খুশি হয়েছি। এবার মন দিয়ে পড়াশোনা কর।
ঐদিন দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর আফ্রিদা ছেলেমেয়েদের নিয়ে স্বামীর সঙ্গে বাড়ি ফিরল।
বাড়িতে এসে আফ্রিদা যখন শাশুড়ীর কাছে এসে কদমবুসি করে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করছিল তখন রহিম ছাড়া অন্য তিন ভাই সেখানে ছিল।
কবিরন বিবি বড় বৌকে দোয়া করে বললেন, তুমি তোমার দেবরদেরকে ছোট ভাই মনে করে মাফ করে দাও। ওদেরকে তো তুমি ছেলের মতো মানুষ করেছ। তারপর ছেলেদেরকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তোমরা বড়মার পা ধরে মাফ চেয়ে নাও।
আফ্রিদা যখন এ বাড়িতে বৌ হয়ে আসে তখন সুলতারে বয়স আট, আজিজের পচ আর কুন্দুসের দুবছর। আফ্রিদাই তাদেরকে এক রকম মানুষ করেছে। তারাও বড় ভাবিকে মায়ের মতো জ্ঞান করে। মা না বললেও তারা বড় অব্রি পা ধরে ক্ষমা চাইত।
শাশুড়ীর কথা শুনে আফ্রিদা বলল, না না আমাকে কদমবুসি করতে হবে না। এদেরকে মাফ করে দিয়েছি।
তিন ভাই তা শুনল না। একে একে কদমবুসি করে মাফ চাইল। আফ্রিদা তাদের মাথায় হাত দিয়ে চুমো খেয়ে বলল, আল্লাহ আমাদের সবাইকে মাফ করুক।
পরের বছর নাদিম স্কুলে ভর্তি হয়ে মন দিয়ে লেখাপড়া করতে লাগল। ম্যাট্রিক চার বিষয়ে লেটার নিয়ে পাস করে চাঁপাই নবাবগঞ্জ কলেজে ভর্তি হল। সেখান থেকে ভালোভাবে বি.এ. পাস করে কিছুদিন বেকার ছিল। তারপর গোদাগাড়ি হাইস্কুলে মাস্টারি করছে। ম্যাট্রিক পাস করার পর কলেজে পড়লেও ধর্মীয় জ্ঞান অর্জনে তার কখনও শিথিলতা আসেনি। সেই সঙ্গে পাড়ার ও গ্রামের অশিক্ষিত লোকদের কুরআন হাদিসের জ্ঞান ছড়িয়ে দিয়েছে। তার সাহচর্যে এসে গ্রামের অনেকে যারা তাড়ি খেত, চুরি করত, নামায-রোযা করত না, তারা এই সব গর্হিত কাজ ছেড়ে দিয়ে নামায-রোযা করছে। মাস্টারিতে জয়েন করার এক বছর পর আজ নাদিমের বিয়ে হল।
৪. বিয়েতে রাতে খাওয়া-দাওয়া
বিয়েতে রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর নাদিম মসজিদে গিয়ে দুরাকাত শোকরানার নফল নামায পড়ে তাদের ভবিষ্যৎ জীবনের সুখ-শান্তির জন্য দোয়া চাইল। তারপর ঘরে এসে দেখল, তার রুমের বারান্দায় মেয়েদের ভিড়। তাদের সঙ্গে জুলেখা ভাবিও রয়েছে। রুমের ভিতর হাসির রোল শুনে নাদিম বুঝতে পারল, নতুন বৌকে নিয়ে নানারকম কৌতুক চলছে। নাদিম মায়ের রুমের দিকে আসতে লাগল।