সে কথা তোমাকে ভাবতে হবে না। আমি কারো বাড়িতে লজিং থাকব।
তা না হয় থাকলি, কিন্তু আরও খরচ আছে।
আল্লাহ সে সব চালিয়ে দেবে।
আফ্রিদা ভেবেছিল, এত মারধর খাওয়ার পর সে আর মাদ্রাসায় পড়তে চাইবে না, স্কুলেই মন দিয়ে পড়বে। কিন্তু তাকে মাদ্রাসায় পড়ার কথা বলতে শুনে বেশ অবাক হলেও বিরোধিতা করল না। বলল, তুই এক কাজ কর, তোর দাদিকে গিয়ে বল; তিনি যেন তার ছেলেদের বলে খরচপত্র দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেন।
নাদিম সেই দিনই বাড়িতে গিয়ে দাদিকে সালাম দিয়ে কদমবুসি করে আম্মা যা বলতে বলেছিল বলল।
কবিরন বিবি বললেন, এতকিছু হওয়ার পরও যখন তুমি মাদ্রাসায় পড়তে চাচ্ছ। তখন আর কি করা। তারপর ছেলেদের ডেকে পাঠালেন। তারা এলে তিনি নাদিমের মাদ্রাসায় পড়ার কথা বলে খরচের ব্যাপারে কি করবে জিজ্ঞেস করলেন।
বড় ভাই কিছু বলছে না দেখে সুলতান বলল, নাদিম যখন আমাদের অমতে মাদ্রাসায় পড়তে চাচ্ছে তখন আমরা তার খরচ দেব না। দেখি ও কি করে পড়ে। তারপর ভাইদের উদ্দেশ্যে বলল, তোমরা কি বল?
রহিম বলল, তোমার কথা ঠিক। যে ছেলে মুরুব্বিদের কথা শুনে না, সে ছেলের জন্যে আমরা টাকা খরচ করব না। ও যদি নিজে পড়তে পারে পড়ুক, তাতে আমাদের। কোনো আপত্তি নেই।
কবিরন বিবি বললেন, তা কি করে সম্ভব? বিদেশে টাকা-পয়সা না হলে ওর খুব কষ্ট হবে।
আজিজ বলল, ও নিজে যদি কষ্টের পথে পা বাড়ায় তাতে আমরা কি করব? কিছুদিন কষ্ট করলে আপনা-আপনি ফিরে আসতে পথ পাবে না।
কবিরন বিবি চিন্তা করলেন, এখন নাদিমের উপর জোর খাটালে কিছু হবে না। ও নিজে যতক্ষণ না নিজের ভুল বুঝতে পারবে ততক্ষণ কারো কথা শুনবে না। তাই তিনি নাদিমকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তোমার বাপ-চাচাদের কথা তো শুনলে; আর তোমাকে সাহায্য করার মতো আমার কিছু নেই। তারপরও যদি তুমি মাদ্রাসায় পড়তে চাও, তা হলে পড়তে পার।
নাদিম ফিরে এসে মাকে তাদের কথা জানাল।
আফ্রিদা শাশুড়ী, স্বামী ও দেবরদের কথা শুনে তাদের উদ্দেশ্য বুঝতে পারল। বলল, আমার কাছে মাত্র ত্রিশ টাকা আছে, তোকে দিতে পারি।
নাদিম মায়ের কাছ থেকে সেই ত্রিশ টাকা নিয়ে নওশের খালুর কাছে এল।
নওশের নাদিমকে খরচপত্রের কথা জিজ্ঞেস করে সবকিছু জেনেও কিছু বলল না। পরের দিন তাকে নিয়ে রাজশাহী টাউনে এসে একটা মাদ্রাসায় সোমে (ক্লাস থ্রিতে) ভর্তি করে দিয়ে আপাতত মাদ্রাসার এতিমখানায় থাকার ব্যবস্থা করে ফিরে এল।
এতিম খানায় থেকে নাদিম পড়াশুনা করতে লাগল, আর লজিং খুঁজতে লাগল। এদিকে এতিমখানার সীমিত খাবার খেয়ে নাদিম দিনের পর দিন শুকিয়ে যেতে লাগল। যারা এতিমখানায় থাকে তাদের গার্জেনরা মাঝে মাঝে এসে তাদেরকে মুড়ি, চিড়ে, মুড়কী কিনে দিয়ে যায়। কেউ কেউ ঘর থেকে ঐসব জিনিস দিয়ে যায়। আবার অনেকে টাকা-পয়সা দিয়ে যায়। নাদিমের কাছে যা ছিল তা দিয়ে ভর্তি হওয়ার পর একটা মশারি কিনতে প্রায় শেষ হয়ে গেছে।
এতিম খানায় শুধু দুবেলা ভাত দেয়া হয়। তাও আধপেটা, তার উপর কোনো ছাত্রের যদি কোনো মেহমান আসে তা হলে ভাগে আরো কম পড়ে। কারন মেহমানের জন্যে বেশি করে রান্না হয় না। অন্য ছেলেরা যখন নাশতা খায় তখন নাদিমের ক্ষিধের চোটে চোখ দিয়ে পানি পড়ে। সে তখন বাইরে চলে যায়। অনেক চেষ্টা করেও বাড়িতে লজিং পেল না।
ওদের ক্লাসচিটার, নাদিম ভালো পড়াশুনা করে বলে একটু স্নেহের চোখে দেখেন। দিন দিন তার চেহারা শুকিয়ে যাচ্ছে এবং সব সময় মনমরা হয়ে থাকে দেখে একদিন তিনি নাদিমকে জিজ্ঞেস করে সব কিছু জানতে পেরে তার মনে নাদিমের জন্য দুঃখ হল। তিনি নাদিমকে বুঝিয়ে বললেন, বাপ-চাচাদের মনে কষ্ট দিলে কোনো কাজে সফলতা আসে না। আল্লাহপাকও অসন্তুষ্ট হন। তুমি তাদের কথামতো ম্যাট্রিক পাস করে মাদ্রাসায় ভর্তি হলে ভালো করতে। মাদ্রাসায় পড়াশোনা করতে হলে বই-খাতা কেনার জন্য টাকা লাগবে। সেসব তোমাকে কে দেবে? তারপর তাকে আরো অনেক কথা বলে বুঝিয়ে তার গাড়ি ভাড়া দিয়ে বাড়ি চলে যেতে বললেন।
সেদিন রাতে নাদিম ক্লাসটিচারের কথা চিন্তা করে নিজের ভুল বুঝতে পারল। পরের দিন সে মামাদের বাড়িতে ফিরে এল।
আফ্রিদা ছেলেকে কাঁথা-বালিশ নিয়ে ফিরে আসতে দেখে যা বোঝার বুঝে গেলেন। তবু জিজ্ঞেস করলেন, কি রে সব কিছু নিয়ে এলি কেন?
নাদিম ক্লাসটিচারের কথা বলল, আমি স্কুলে পড়ব।
আফ্রিদা বলল, ঠিক আছে, তোর দাদিকে সে কথা বলবি।
নাদিম বলল, এখন অক্টোবর মাস, ভর্তি হয়ে কোনো কাজ হবে না। সামনের বছর জানুয়ারিতে ভর্তি হব।
আফ্রিদা বলল, তাই হবে।
নাদিম মাদ্রাসায় পড়তে চলে যাওয়ার পর রহিম স্ত্রীকে আনার জন্য ছোট ভাই কুদ্দুসকে পাঠিয়েছিল। ভাইয়েরা সাবই মিলে নাদিমকে মেরেছিল এবং মারার পর কেউ একজনও দেখতে আসেনি। বলে স্বামী দেবরদের প্রতি আফ্রিদার প্রচণ্ড অভিমান। তাই আফ্রিদা কুদ্দুসকে ফিরিয়ে দেয়।
এরপর সুলতান ও আজিজ একে একে নিয়ে যেতে এলে আফ্রিদা তাদেরকেও ফিরিয়ে দেয়।
এর মধ্যে কবিরন বিবির খুব জ্বর হল। ছেলেরা ডাক্তার নিয়ে এল। রাতে ছেলেদেরকে বললেন, বড়মাকে তোমরা আনছ না কেন? তিনি আফ্রিদাকে ভীষণ ভালোবাসেন। তাই অন্য বৌদেরকে মেঝ বৌ, সেজ বৌ ও ছোট বৌ বলে ডাকলেও আফ্রিদাকে বড়মা বলে ডাকেন।