রহিম তবু মেরে চলেছে। শেষে নাদিমের যখন জ্ঞান হারাবার উপক্রম হল তখন তার কানে দাদির গলা ভেসে এল, আর মারিস না রহিম, মরে যাবে যে। তারপর নাদিমের কিছু মনে নেই।
আজিজ সেদিন ঘরে ছিল না। দুদিন হল ছোট বোনের বাড়ি গেছে। নাদিমের দাদি কবিরন বিবি মেজ বৌ আয়মনের অসুখ বলে তার কাছে ছিলেন। নাদিমের কান্নার চিৎকার শুনে যখন বেরিয়ে এসে ঐ কথা বলতে বলতে তার কাছে এলেন তখন নাদিম অজ্ঞান হয়ে গেছে।
এদিকে হানিফ কুদ্দুসের সঙ্গে লুটোপুটি খাচ্ছে। কিছুতেই তার হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারছিল না। কারণ কুদ্দুসও খুব শক্তিশালী যুবক। রোজ ভোরে উঠে ফজরের নামায পড়ে দুটো সাড়ে সাত সের করে পনের সের ওজনের মুগুর নিয়ে ব্যায়াম করে। শেষমেশ হানিফ যখন কুদ্দুসের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে নাদিমের কাছে এল তখন নাদিম জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে আছে। তার রক্তাক্ত অজ্ঞান দেহটা দুহাতে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে বলল, বড় ভাই, মেজ ভাই, আপনারা যে নাদিমকে এভাবে শাসন করবেন, তা যদি ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারতাম, তা হলে নিয়ে আসতাম না। তারপর চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে ভিজে গলায় বলল, এর কিছু হলে আল্লাহ আপনাদের ক্ষমা করবেন না। কথা শেষ করে সে গেটের দিকে যেতে লাগল।
কবিরন বিবি বললেন, ওকে তুই কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস?
হানিফ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, এর মাকে কথা দিয়েছিলাম; ওকে যে অবস্থায় নিয়ে এসেছি সেই অবস্থায় তার কাছে ফিরিয়ে দেব। আমি সেই ওয়াদা রাখতে পারলাম না। জানি না আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করবেন কিনা, আর এর মাও হয়ত আমাকে ক্ষমা করবেন না। তবু যার কাছ থেকে এনেছি তার কাছেই নিয়ে যাচ্ছি। তারপর সে হনহন করে চলে গেল।
ছেলেকে হানিফের সাথে পাঠিয়ে দিয়ে আফ্রিদা তাদের ফিরে আসার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগল। যত দেরি হচ্ছে তত তার মন বিপদের আশংকায় ছটফট করছে। তার কেবলই মনে হচ্ছে-নাদিমকে নিশ্চয় মারধর করছে। দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আল্লাহকে জানাতে লাগল, আল্লাহ তুমি আমার নাদিমকে হেফাজত করো, তাকে আমার কোলে সুস্থ অবস্থায় ফিরিয়ে এনে দাও। রক্তাক্ত নাদিমকে পাঁজাকোলা করে হানিফকে গেট দিয়ে ঢুকতে দেখে তার মন আতঙ্কে ধক করে উঠল। তাড়াতাড়ি নেমে এসে নাদিমের অবস্থা দেখে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে হানিফকে বলল, তুমি আমার জ্যান্ত ছেলে নিয়ে গিয়ে মরা ছেলে ফেরত দিতে এসেছ কেন? তুমি এত বড় ধূর্ত ও নাদান, আমাকে মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে চালাকি করে মেরে ফেলতে নিয়ে গিয়েছিলে। নাদিমের কিছু হলে তোমাকে ছেড়ে কথা বলব না।
হানিফের চোখ দিয়ে তখনও পানি পড়ছিল। বলল, বড় ভাবি আপনি আমাকে যা শাস্তি দেন দিবেন, আগে নাদিমের চিকিৎসা করা দরকার। ও অজ্ঞান হয়ে গেছে। ততক্ষনে বাড়ির অন্যান্য মেয়ে-পুরুষ ও ছেলেমেয়েরা এসে ভীড় করেছে। হানিফ তাদেরকে পাশ কাটিয়ে উপরে এসে বারান্দার চৌকিতে শুইয়ে দিয়ে বলল, আপনারা ওর মাথায় পানি ঢালুন, আমি ডাক্তার আনতে যাচ্ছি। তারপর সে ছুটে চলে গেল।
হানিফ চলে যাওয়ার পর আফিদা কঁদতে কাঁদতে নাদিমের মাথায় পানি ঢালতে লাগল।
নাদিমের নানি সুরাতন বিবি সব নাতি-নাতনিদের চেয়ে নাদিমকে বেশি ভালোবাসেন। নাদিমের অবস্থা দেখে কেঁদে কেঁদে বুক ভাসাতে লাগলেন। সবাই বলাবলি করতে লাগল, বাপ হয়ে যে ছেলেকে এভাবে মারে তা আমরা কখনও দেখিনি ও শুনিনি।
নাদিমের মামারা অফিস থেকে ফিরে নাদিমকে দেখে ও মারার কথা শুনে বলল, কোনো মানুষ কখনো কোনো জন্তু-জানোয়ারকেও এভাবে মারেনি।
ডাক্তার এসে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে গেল। সন্ধ্যের পর নাদিমের জ্বর একশ পাঁচ ডিগ্রীতে উঠল। ডাক্তারের নির্দেশ মতো মাথায় বরফ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হল। জ্বর একটানা তিন দিন তিন রাত রইল। এর মধ্যে নাদিমের জ্ঞান ফিরল না। চার দিনের দিন জ্বর কমার পর নাদিমের জ্ঞান ফিরল। এই কদিন আফ্রিদা ও সুরাতন বিবি খাওয়া-দাওয়া ত্যাগ করে রোযার উপর রোযা রেখে নাদিমকে ভালো করে দেওয়ার জন্য আল্লাহপাকের কাছে দোয়া চেয়েছে। নাদিমের মামীরা অনেক বলে-কয়ে শুধু ইফতারের সময় কিছু নাশতা খাওয়াতে পারলেও ভাত খাওয়াতে পারেনি।
প্রায় দশ-বারো দিন পর নাদিম সুস্থ হল। এ পর্যন্ত নাদিমের বাপ চাচারা কেউ দেখতে আসেনি।
ঐদিন ডাক্তার নাদিমকে দেখে চলে যাওয়ার পর আফ্রিদা হানিফের কাছে সবকিছু শুনে স্বামী ও দেবরদের ব্যবহারে ভীষণ মনে কষ্ট পেল।
হানিফ আফ্রিদার পায়ে হাত দিয়ে কেঁদে কেঁদে মাফ চেয়েছে। আফ্রিদা তাকে মাফ করে পারেনি।
মাসখানেক পর নাদিম নওশের খালুর কাছে গিয়ে সবকিছু জানিয়ে বলল, আমি মাদ্রাসায় পড়তে চাই, আপনি ব্যবস্থা করে দিন।
নওশের বলল, তা না হয় করে দেব, কিন্তু থাকা-খাওয়ার খরচ দেবে কে? তুমি যা বললে, তাতে তো মনে হচ্ছে, তোমার বাপ-চাচারা খরচপত্র দেবে না।
নাদিম বলল, আমি ওসব নিয়ে চিন্তা করি না। আপনি শুধু ভর্তি করে দিন, আমি লজিং খুঁজে নেব।
নওশের বলল, ঠিক আছে, তুমি তোমার মাকে বলে বেডিংপত্র নিয়ে এস।
নাদিম ফিরে এসে মাকে নিজের মতামত বলে খালুর কথা বলল।
আফ্রিদা বলল, মাদ্রাসায় যে পড়বি বলছিস, খরচপত্র দেবে কে? তোর বাপ-চাচারা তো দেবে না।