রহিম বলল, না মারধর করব না। তোমাকে তো বললাম, তার সঙ্গে মাদ্রাসায় পড়ার ব্যাপারে কথা বলব।
হানিফ বলল, ঠিক আছে, আমি তাকে নিয়ে আসব।
নাদিম দুপুরে খেয়েদেয়ে মসজিদে নামায পড়তে যাওয়ার জন্য পাঞ্জাবীটা গায়ে দিয়েছে, এমন সময় হানিফ এসে নাদিমকে ও তার মাকে দেখে সালাম দিয়ে বলল, বড় ভাবি কেমন আছেন?
আফ্রিদা সালামের উত্তর দিয়ে বলল, ভালো আছি। তুমি কেমন আছ? চাচা চাচী ভালো আছেন?
হানিফ বলল, আল্লাহপাকের রহমতে আমরা ভালো আছি।
আফ্রিদা বলল, তা এমন সময় কি মনে করে? ভাত খেয়েছো? না খেয়ে থাকলে একমুঠো খেয়ে নাও।
হানিফ বলল, ভাত খেয়েই এসেছি আর খাব না। বড় ভাই নাদিমকে সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাকে পাঠালেন।
আফ্রিদা যেদিন স্বামীকে নাদিমের মতামত জানিয়েছিল, সেদিন তার মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পেরেছিল খুব রেগে গেছে। তাই আজ হানিফের কথা শুনে বলল, আমি ওকে যেতে দেব না। ওর বাপ-চাচারা মারধর করবে।
হানিফ বলল, বড় ভাবি আপনি এ কথা ভাবতে পারলেন, আমি নাদিমকে মার খাওয়াবার জন্য নিয়ে যেতে এসেছি? নাদিমকে মারলে ও যত না কষ্ট পাবে, তার চেয়ে যে আমি বেশি কষ্ট পাব, একথা নিশ্চয় জানেন?
আফ্রিদা ওদের দুজনের গভীর সম্পর্কের কথা জানে। বলল, জানি, কিন্তু তবু আমার যেন কেমন ভয় করছে। তুমি তো জান, তোমার বড় ভাই রেগে গেলে কি রকম হয়।
হানিফ বলল, তা জানি বড় ভাবি। তবু একথা জোর গলায় বলতে পারি, আমার গায়ে এক বিন্দু রক্ত থাকতে নাদিমের গায়ে কাউকে হাত তুলতে দেব না। শুধু বড় ভাই কেন, তারা চার ভাই একসঙ্গে যদি মারতে চায় তবু পারবে না, এ বিশ্বাস রাখবেন।
আফ্রিদা বলল, সে বিশ্বাস আমার আছে। তবু তোমাকে ওয়াদা করতে হবে, যে অবস্থায় নাদিমকে নিয়ে যাবে সেই অবস্থায় ফিরিয়ে আনবে।
হানিফ বলল, তা তো নিশ্চয়। তারপর নাদিমকে বলল, চল, তোর কোনো ভয় নেই। নাদিমকে ওর মামাদের পাড়ার মসজিদের দিকে যেতে দেখে হানিফ বলল, আমাদের মসজিদে নামায পড়ব।
চাচা-ভাইপো জোহরের নামায পড়ে হানিফ নাদিমকে সঙ্গে নিয়ে তাদের ঘরে এসে উঠোন থেকে বড় ভাই বলে ডাকল।
তখন বৈশাখ মাস। রোদের প্রচণ্ড তাপ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সবাই ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে ঘুমাচ্ছে। রহিমদের বাড়িটা দোতলা। সে দোতলার সিঁড়ির দিকের রুমে থাকে।
রহিম দরজা অল্প ভিড়িয়ে ঘরের ভিতর দরজার পাশে বসে জাল বুনছিল। হানিফের গলা শুনতে পেয়ে বলল, এস, উপরে এস।
হানিফ নাদিমকে নিয়ে উপরে এসে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে তাকে ভিতরে যেতে বলল। আসবার সময় সে তাকে সাহস দিয়ে বলেছে, আমি থাকতে তোর কোনো ভয় নেই। সে দাঁড়িয়ে রইল।
তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হানিফ তার একটা হাত ধরে ভিতরে ঠেলে দিয়ে বলল, বড় ভাই নাদিম এসেছে।
রহিম জাল বুনতে বুনতে নাদিমের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, স্কুলে পড়তে চাচ্ছনা কেন? রহিম ছোটবড় সব ছেলেমেয়েদের সঙ্গে তুমি করে কথা বলে।
আব্বার গম্ভীর কণ্ঠস্বর শুনে ভয়ে নাদিমের গলা শুকিয়ে গেল। কোনো কথা বলতে পারল না।
কয়েক সেকেণ্ড বিরতি নিয়ে রহিম বলল, কি হল কিছু বলছ না কেন?
আমি মাদ্রাসায় পড়ব।
এ যুক্তি তোমাকে কে দিয়েছে?
কেউ দেয়নি।
দুবছর পড়ে ম্যাট্রিক পাস করে নাও, তারপর মাদ্রাসায় পড়।
নাদিম এর আগে আব্বার সঙ্গে কথা বলা তো দূরের কথা সামনে যেতে খুব ভয় পেত। আজ এত কথা বলার পরও আব্বা কিছু করছে না দেখে তার সাহস হল। বলল, আমি আর স্কুলে পড়ব না।
নাদিমের কথা শুনে রহিম জাল থেকে ছড়িটা টেনে নিয়ে নাদিমকে মারতে মারতে বলল, এত বড় বেয়াদব হয়েছ, বাপের কথা অগ্রাহ্য করে নিজের খেয়াল মতো চলতে চাচ্ছ?
দুতিন ঘা মার খেয়ে নাদিম ছুটে বারান্দায় বেরিয়ে এল।
রহিম তাকে মারার জন্য বেরিয়ে এলে হানিফ তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, বড় ভাই, আপনি ওকে মারবেন বলে তো ডেকে আনতে বলেননি।
রহিম তখন রাগে কাঁপতে কাঁপতে নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করে বলল, আমাকে ছেড়ে দাও হানিফ, নাদিম নষ্ট হয়ে গেছে; শাসন না করলে আরো নষ্ট হয়ে যাবে।
হানিফ তাকে ছাড়ল না। বলল, আমি বেঁচে থাকতে ওর গায়ে আর একটা চাবুকও মারতে পারবেন না।
কুদ্দুস নিচের তলার একটা রুমে থাকে। সে হানিফের গলা পেয়ে দরজা ফাঁক করে নাদিমকে হানিফের সাথে আসতে দেখেছে। তারা উপরে চলে যেতে বেরিয়ে এসে সিঁড়ির উপরের ধাপে দাঁড়িয়ে এতক্ষণ অপেক্ষা করছিল। হানিফ বড় ভাইকে ছাড়ছে না দেখে তাড়াতাড়ি এসে হানিফকে ধরে বড় ভাইকে মুক্ত করে দিল।
রহিম ছাড়া পেয়ে নাদিমকে মারতে গেল।
নাদিম ঘর থেকে বারান্দায় এসে পালাবার জন্য সিঁড়ির দিকে এগোতে গিয়ে ছোট চাচাকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। ছোট চাচা যখন হানিফকে ধরে আব্বাকে মুক্ত করে দিল এবং আব্বা তাকে মারতে এল তখন সে তাড়াতাড়ি সিঁড়ি দিয়ে নেমে সদর গেটের দিকে ছুট দিল। গেটের কাছে এসে দেখল, মেজ চাচা গেট লাগিয়ে তাতে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নাদিম মেজ চাচার কিছু দূরে দাঁড়িয়ে ভয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগল। ততক্ষণে রহিম এসে জালছড়ি দিয়ে আঘাতের পর আঘাত করে চলল।
নাদিম মারের আঘাত সহ্য করতে না পেরে মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি খেতে খেতে বলতে লাগল, আব্বাগো আর মারবেন না, আমি মরে যাব।