এই ঘটনাটা পড়ে নাদিম ঐ রকম সিদ্ধান্ত নিয়ে ভাবল, আল্লাহ ও তার রসুলকে (দঃ) চিনতে হলে ধর্মীয় বড় বড় বই পড়তে হবে। সে সব বই আরবি ভাষায়। আরবি ভাষা শিখতে হলে মাদ্রাসায় পড়তে হবে। সে এই সিদ্ধান্ত নিলেও সাহস করে কাউকে জানাতে পারল না।
সেই সময় আফ্রিদা অনেকদিন জ্বরে ও পায়খানায় ভুগে দুর্বল হয়ে পড়ে। নাদিমের নানা আকবর আলী বছর পাঁচেক আগে হজ্ব করে আসার মাস খানেক পরে মারা গেছেন। ওনার চার ছেলে, ছয় মেয়ে। মেজ ও সেজ ছেলে এবং এক মেয়ে ছোটবেলায় মারা গেছে। বড় ও ছোট বেঁচে আছে। আকবর আলী খুব ধনী লোক। ছিলেন। তিনি ছেলেদেরকে বি.এ. পর্যন্ত পড়িয়েছেন। আর মেয়েদেরকে ম্যাট্রিক পর্যন্ত। পড়িয়ে বিয়ে দিয়েছেন। দুছেলেই চাকরি করে। ভাইয়েরা বোনের অসুখের কথা শুনে নিজেদের বাড়িতে নিয়ে এসে ভালো করে চিকিৎসা করাতে লাগল। নাদিমরা সব ভাইবোন মায়ের সঙ্গে মামাদের বাড়িতে এসেছে। তারা সেখানে থেকে স্কুলে যাতায়াত করতে লাগল।
নাদিম মামা বাড়িতে আসার পর একদিন মাকে বলল, আমি আর স্কুলে পড়ব না; মাদ্রাসায় পড়ব।
আফ্রিদা খুব অবাক হয়ে বলল, সে কি রে? আর দুবছর পড়লে তুই ম্যাট্রিক পাস করবি। এ রকম কথা মুখে আনবিনা। তোর বাপ-চাচারা শুনলে তোকে আস্ত রাখবে না।
নাদিম সে কথা জানে। তাই ভয়ে ভয়ে বলল, তুমি আব্বাকে ও চাচাদেরকে বুঝিয়ে বললে, তারা কিছু বলবে না।
আফ্রিদা বেশ রেগে গিয়ে বলল, আমি তাদেরকে বলতে পারব না। তোকে এই যুক্তি কে দিয়েছে বল তো?
নাদিম বলল, কেউ দেয়নি। আমি হাদিস পড়ে বুঝেছি, স্কুল-কলেজে পড়ে আল্লাহ ও রসুল (দঃ)-কে চেনা যায় না। তাই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
আফ্রিদা বলল, তুই এখন ছেলেমানুষ। তোর বুঝশক্তি কম। আমি যা বলছি শোন, দুবছর মন দিয়ে পড়ে ম্যাট্রিক পাস করে নে। তারপর আমি তোকে মাদ্রাসায় পড়বার ব্যবস্থা করে দেব।
নাদিম বলল, ম্যাট্রিক পাস করে কোন লাভ নেই। কত বি.এ. এম.এ. পাস ছেলেরা চাকরি পাচ্ছে না। শুধু শুধু দুটো বছর নষ্ট করব না।
আফ্রিদা ছেলেকে আরো অনেক কিছু বলে বোঝাল, তাতে ফল না হতে শেষে বাপ-চাচাদের মারধর করার কথা বলে ভয়ও দেখাল। কিন্তু নাদিমের এক কথা, সে আর স্কুলে পড়বে না-মাদ্রাসায় পড়বে।
নাদিম আর স্কুলে যায় না খবর পেয়ে তার বাপ রহিম একদিন শ্বশুর বাড়ি এসে স্ত্রীকে ছেলের স্কুলে না যাওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করল।
রহিমের শ্বশুর বাড়ি একই গ্রামের অন্য পাড়ায়।
আফ্রিদা নাদিমের মতামত জানাল।
স্ত্রীর মুখে ছেলের কথা শুনে রহিম খুব রেগে গেল। কিন্তু বাইরে তা প্রকাশ না করে বাড়ি ফিরে গেল।
রহিম ভাইদের মধ্যে বড়। গম্ভীর ও শান্ত ধরনের লোক। পাড়ার বা গ্রামের সাথে পাঁচে নেই। তাকে রেগে যেতে কেউ কোনোদিন দেখেনি। কথা খুব কম বলে। অন্যান্য ভাইদের চেয়ে একটু বেশি ধার্মিক। পাড়ার ছোটবড় ছেলেমেয়েরা তাকে দেখে রাস্তা থেকে সরে যায়। তার সামনে কোনো ছেলেমেয়ে দুষ্টুমি করে না। খেলাধুলা করতেও সাহস পায় না। সে কোনোদিন কোনো ছেলে মেয়েকে বকাবকি না করলেও তার চেহারা ও বড় বড় লাল চোখ দেখে তারা ভয় পায়। রহিমরা চার ভাই ও তিন বোন। সব ভাইবোনের বিয়ে হয়ে গেছে। মেজ ভাইয়ের নাম সুলতান। সেজ ভাইয়ের নাম আজিজ। আর ছোটর নাম কুদ্দুস। রহিম ও কুদ্দুস ম্যাট্রিক পাস। আর আজিজ ও সুলতান নাইনে উঠে আর পড়েনি। আব্দুস সোবহান চৌধুরীর অনেক না হলেও জমি জায়গা যা ছিল তাতে চার ভাই মিলেমিশে বেশ স্বচ্ছন্দে সংসার চালিয়ে যাচ্ছে। চার ভাইয়ের একান্নবর্তি পরিবার। সবাই চাষবাস করে। রহিম যে বছর ম্যাট্রিক পাস করে, সে বছর আব্দুস সোবহান চৌধুরী মারা যান। সংসারের হাল বড় ছেলে হিসাবে রহিমকে ধরতে হয়। তাই আরো পড়াশুনার ইচ্ছা থাকলেও তা সম্ভব হয়নি। সে ভাইদের ও বোনদের মানুষ করেছে। তাদের মা কবিরন বিবি বেঁচে আছেন। তিনি ছেলেদের বিয়ে হওয়ার পর সংসারের সব দায়-দায়িত্ব ছেলে-বৌদের হাতে বুঝিয়ে দিলেও সংসারে ভাঙ্গন যাতে না ধরে সেদিকে খুব লক্ষ্য রাখেন।
সেদিন রাতে রহিম তিন ভাইকে নাদিমের কথা জানাল। ততদিনে তারা নাদিম গত দুবছর স্কুলে না গিয়ে নওশেরের কাছে হাদিস পড়তে যেত তা জেনে গেছে।
সুলতান বলল, ওর নওশের খালু ওকে নষ্ট করেছে। নাদিমকে শাসন করা দরকার। আর নওশেরকেও বলা দরকার, সে যেন ওকে প্রশ্রয় না দেয়।
রহিম বলল, ঠিক আছে, দেখি কি করা যায়।
পরের দিন সকালে রহিম পাড়ার দূর-সম্পর্কের চাচাতো ভাই হানিফের কাছে গিয়ে বলল, তোমার সঙ্গে তো নাদিমের খুব ভাব। তুমি আজ জোহরের নামাযের পর তাকে তার মামার বাড়ি থেকে ডেকে আমার কাছে নিয়ে আসবে। সে স্কুলে আর পড়বে না, মাদ্রাসায় পড়বে। সে ব্যাপারে তার সঙ্গে কথা বলব।
হানিফ সুন্দর, স্বাস্থ্যবান ও খুব কর্মঠ ছেলে। ধর্মকর্মও বেশ মেনে চলে। সেই জন্যে নাদিম চার-পাঁচ বছরের ছোট এবং চাচা-ভাইপো সম্পর্ক হলেও বন্ধুর মতো তাদের দুজনের সম্বন্ধ। হানিফরা দুভাই। ছোট হালিম স্কুলে পড়ে। হানিফদের সংসারে অভাব। তাই সে ক্লাস নাইনে উঠে আর পড়েনি। অন্যের চাষবাসে কাজ করে বাপকে সাহায্য করে। যখন দেশ-গ্রামে কাজ থাকে না তখন শহরে গিয়ে রং-এর কাজ করে। সে একা দুতিন জনের কাজ করতে পারে। সেই জন্য যে কোনো কাজ সে রোজে করে না। ফুরোনে করে। যেমন খাটতে পারে তেমনি খেতেও পারে। শারীরে শক্তিও প্রচুর। অবসর সময়ে সে নাদিমের কাছে কুরআন-হাদিসের কথা শুনে এবং সেগুলো যথাসম্ভব মেনে চলে। সেও শুনেছে, নাদিম স্কুলে না পড়ে মাদ্রাসায় পড়তে চাচ্ছে। রহিমের কথা শুনে বলল, আপনি যদি কথা দেন, নাদিমকে মারধর করবেন না, তা হলে আমি তাকে আপনার কাছে নিয়ে আসতে পারি।