নাদিমের বাড়ি থেকে প্রায় পনের-বিশ মাইল দূরে মহেশবাথানে নওশেরের ডিসপেন্সারী। বাসে করে নাদিম যাতায়াত করে। সারেংপুর গ্রামের ভিতর থেকে বাস রাস্তা গেছে। প্রথম প্রথম নাদিম মায়ের কাছ থেকে বাস ভাড়া চেয়ে নিত তখন বাসের ভাড়া কম ছিল।
প্রতিদিন ছেলেকে পয়সা চাইতে দেখে তার মা আফ্রিদা একদিন জিজ্ঞেস করল, রোজ রোজ পয়সা দিয়ে কি করিস?
নাদিম কি বলবে ভেবে না পেয়ে চুপ করে রইল।
আফ্রিদা বলল, কি রে, কিছু বলছিস না কেন? স্কুলে যা, আজ পয়সা হবে না।
এরপর থেমে নাদিম স্কুলের বেতন না দিয়ে সেই টাকায় বাস ভাড়া দিয়ে নওশের খালুর কাছে হাদিস পড়তে যেত। বছরের শেষে বার্ষিক পরীক্ষার সময় গভীর রাতে গোপনে গোলা থেকে ধান পেড়ে পাড়ার একজনের কাছে বিক্রি করে স্কুলের বেতন পরিশোধ করল। কিন্তু পরীক্ষায় পাস করতে পারল না। সারা বছর স্কুলে যায়নি। তার উপর ভাল করে পড়াশোনাও করেনি, পাস করবে কি করে। নাদিমের রেজাল্ট শুনে ঘরের সবাই অবাক হয়ে গেল। সে ফেল করবে এটা কেউ ভাবতে পারল না। বাপ চাচারা রাগারাগি করল।
আফ্রিদা ছেলেকে তেমন কিছু বলল না। বরং ছেলের মন খারাপ দেখে বলল, ফেল করেছিস তো কি হয়েছে, এবার ভাল করে লেখাপড়া কর, যাতে করে সামনের বছর স্ট্যান্ড করতে পারিস।
নাদিম কিন্তু ঘরের কারুর কথায় কান দিল না। এ বছরও স্কুলে যাওয়ার নাম করে নওশের খালুর কাছে গিয়ে কুরআন-হাদিসের ব্যাখ্যা পড়তে লাগল। ফলে এ বছরও সে ফেল করল।
এবার তার বাপ চাচারা তার সাথে ভীষন রাগারাগি করল, শুধু মারতে বাকি রাখল। নাদিমের ছোট চাচা স্কুলে গিয়ে হাজিরা খাতা দেখে এসে ভাইদের জানাল, নাদিম গত দুবছর স্কুলে যায়নি বললেই চলে। তারা তখন নাদিমকে জিজ্ঞেস করল, তুই স্কুলে যাওয়ার নাম করে কোথায় যাস?
নাদিম কোন উত্তর করল না।
অনেক বকাবকি করেও যখন তার কাছে কোন উত্তর পেল না। তখন তারা খোঁজ নিতে লাগল, নাদিম তা হলে কোথায় যায়?
এর মধ্যে নাদিমের সমস্ত শরীরে চাকাঁচাকা দাগ ও খোস-পাঁচড়া হল। সকলের ধারণা হল সে নিশ্চয় কোন নিষিদ্ধ পল্লীতে যায়। তাই তার শরীরে পার ফুটেছে। তার মা আফ্রিদা কিন্তু কথাটা বিশ্বাস করল না। একদিন ছেলেকে জিজ্ঞেস করল, তুই স্কুলে না গিয়ে কোথায় যাস আমাকে বল, আমি তোকে কিছু বলব না। তাকে চুপ করে। থাকতে দেখে আবার বলল, তুই যদি আমার পেটে হয়ে থাকিস, তা হলে আমার কথার। জবাব দে।
নাদিম বলল, নওশের খালুর কাছে।
আফ্রিদা খুব অবাক হয়ে বলল, কেন?
কুরআন-হাদিসের ব্যাখ্যা পড়তে।
কি বলছিস তুই।
হ্যাঁ আম্মা, খালুর আলমারী ভর্তি হাদিসের বই। আমি এই দুবছরের মধ্যে বহু হাদিস পড়ে ফেলেছি।
হাদিস পড়া ভালো। কিন্তু তোকে স্কুল কামাই করে স্কুলের পড়া না পড়ে হাদিস পড়তে কে বলেছে?
কেউ বলেনি, আমি নিজেই তার কাছে গিয়ে পড়ি।
তুই যে স্কুল কামাই করে যাস, তোর খালু কিছু বলে না?
না।
আফ্রিদার চাচাতো বোনের স্বামীর উপর খুব রাগ হল। চিন্তা করল, অমন জ্ঞানী গুণী আল্লাহওয়ালা লোক হয়ে নাদিমকে কিছু বলেনি কেন? তা হলে এর ভিতরে কি কোন রহস্য আছে? নাদিমকে বলল, আর কোনদিন যাবি না। আগে লেখাপড়া শেষ। কর তারপর হাদিস-কালাম পড়বি।
নাদিম প্রায় দুমাস ভুগে ভাল হল। তারপর আবার নওশের খালুর কাছে যাতায়াত আরম্ভ করল। এবারে ইমাম গাজ্জালী (রঃ)-এর একটা বইয়েতে রেযেক সম্বন্ধে একটা ঘটনা পড়ে তার মাথা খারাপের মতো হয়ে গেল। সব সময় একটা কথা তার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল, রেযেক যখন আল্লাহপাকের হাতে তখন শুধু মানুষ কেন রুজী রোজগারের জন্য হালাল হারাম বিচার না করে পরিশ্রম করছে? সে সিদ্ধান্ত নিল-স্কুলে পড়ে মাদ্রাসায় পড়বে। রেযেক সম্বন্ধে যে ঘটনাটা নাদিম পড়ে এই সিদ্ধান্ত নিল, সেটা হল
হযরত মুসা (আঃ) শফর শেষে বাড়ি ফিরছিলেন। পথে মৃত্যুর ফেরেশতা আজরাইল (আঃ) তাঁকে সালাম দিয়ে পরওয়ানা শোনালেন। হযরত মুসা (আঃ) তখন স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের রিযিকের কথা ভেবে একটু চিন্তিত হলেন। আল্লাহপাক হযরত মুসা (আঃ) এর সঙ্গে সরাসরি কথা বলতেন। সেই জন্য হযরত মুসা (আঃ)-কে কলিমুল্লাহ বলা হয়। আল্লাহ হযরত মুসা (আঃ) এর চিন্তার কারণ বুঝতে পেরে বললেন, হে মুসা! তোমার হাতে ওটা কি?
হযরত মুসা (আঃ) বললেন, একটা আসা (লাঠি)। আল্লাহ বললেন, তোমার সামনে যে পাহাড়টা রয়েছে তাতে তোমার হাতের আসাটা ঠেকাও। হযরত মুসা (আঃ) আসাটা পাহাড়ে ঠেকাতে সেখানে একটা কূয়া হয়ে গেল। আল্লাহ বললেন, আসাটা কূয়ার পানিতে ঠেকাও। হযরত মুসা (আঃ) তা করতেই একটা সিন্দুক উঠে এল। আল্লাহ বললেন, সিন্দুকের উপর আসা ঠেকাও। উনি তাই করতে সিন্দুক খুলে গেল, আর তার ভিতরে একটা ছোট পাথর দেখা গেল। আল্লাহ বললেন, ঐ পাথরে আসাটা ঠেকাও। হযরত মুসা (আঃ) পাথরে আসাটা ঠেকাতে দুভাগ হয়ে গেলে সেখানে একটা জীবন্ত ফড়িং দেখা গেল। আর সেই ফড়িং-এর মুখে একখন্ড সবুজ ঘাস। আল্লাহ বললেন, তুমি মৃত্যুর পরওয়ানা পেয়ে স্ত্রী-ছেলেমেয়ে কি খাবে চিন্তা করছ, জেনে নাও, এই ফড়িংটা সাত তবক জমিনের নিচে ছিল। দেখ, তাঁকেও আমি কিভাবে আহার দান করি। এই কথা শুনে হযরত মুসা (আঃ) সিজদায় গিয়ে আল্লাহ পাকের শুকরিয়া আদায় করে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন।