- বইয়ের নামঃ সংসার
- লেখকের নামঃ কাসেম বিন আবুবাকার
- প্রকাশনাঃ আফসার ব্রাদার্স
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. নাদিমের বিয়েটা অ্যাকসিডেন্টের মতো
সংসার – ইসলামিক উপন্যাস – কাসেম বিন আবুবাকার
নাদিমের বিয়েটা অ্যাকসিডেন্টের মতো হঠাৎ করে হয়ে গেল। এখন তার বিয়ে করার মোটেই ইচ্ছা ছিল না। দাদির কথা রাখতে গিয়ে একরকম বাধ্য হয়ে রাজী হয়েছে। তাই বিয়ে পড়ানোর সময় অসন্তুষ্ট মনে তিনবার কবুল উচ্চারণ করেছে। সেই সময় তার মনে হয়েছে, যে কাজ অনিচ্ছায় ও অসন্তুষ্টির সঙ্গে করা হয়, তার পরিণতি কি ভালো হয়? না সেই কাজ ভালভাবে সমাধা হয়? কথাটা মনে হতে শিহরিত হয়ে সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহপাকের কাছে দিলে দিলে ফরিয়াদ করল, তুমি সর্বশক্তিমান ও সব কিছুর মালিক। তুমি সমস্ত জীবের অন্তরের কথা জান। তোমার ঈশারাতেই এই কাজ সম্পন্ন হল। তুমি আমাদের ভবিষ্যৎ জীবন সুখের ও শান্তির করো।আমাদেরকে তোমার ও তোমার হাবিবে পাকের প্রদর্শিত পথে চালিত করে ইহকাল ও পরকালে কামিয়াব করো।
রাজশাহী টাউনের প্রায় বিশ-বাইশ মাইল উত্তরে সারেংপুর গ্রাম। গ্রামটার পশ্চিম দিকে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান নদী পদ্মা। এই গ্রামে বেশ কয়েক ঘর ধনী ও মানী লোকের বাস। তাদের মধ্যে চৌধুরী বংশের খুব নাম-ডাক। তবে চৌধুরীদের এখন পড়ন্ত বেলা। নাদিম এই বংশের ছেলে। নাদিমের দাদাজীরা পাঁচ ভাই। বিরাট এলাকা নিয়ে তাদের বসতবাড়ি। সবার ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনী ও আত্মীয়-স্বজন যে কত, কে তার হিসাব রাখে। একই বাড়িতে পাঁচ ভাইয়ের সংসার। তবে তা ভাগাভাগি হয়ে যে যার প্রয়োজন মতো বাড়ি-ঘর করেছে। প্রত্যেকের বাড়ির সামনে বিরাট বিরাট উঠোন। সেই উঠোনে চাষের মৌসুমি ধান ঝাড়াই-মাড়াই হয়। মেয়ে ও পুরুষের জন্য সেফটি ট্যাংকের ভিন্ন ভিন্ন পায়খানা আছে। প্রত্যেকের উঠোনের একপাশে একটা করে চাপকলও আছে। প্রত্যেকে আলাদা আলাদা বাড়ি ঘর তৈরি করলেও এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে যাওয়ার রাস্তা আছে। বাইরে যাওয়ার জন্য প্রত্যেকের পাঁচিলের গায়ে সদর দরজা আছে। নাদিমের দাদাজী সবার ছোট। পাঁচ ভাইয়ের কেউ বেঁচে নেই। এক সময় এই চৌধুরী বাড়ির খুব নাম ডাক ছিল। পাঁচ ভাইয়ের পাঁচটা দহলিজ ছিল। যে কোন আত্মীয়-স্বজন এলে দহজিলে থাকতে দেয়া হত। শুধু রাতের বেলা এক সময় কেউ সাথে করে বাড়ির ভিতরে নিয়ে গিয়ে তার আপনজনের সঙ্গে দেখা করিয়ে আনত। কালের পরিবর্তনে সে সব আর নেই। তবে ঐ যে একটা কথা প্রচলিত আছে, তাল পুকুরে ঘটি ডুবে না। সেই রকম অবস্থা এখন চৌধুরী বংশের। যে কোন আত্মীয়-স্বজন এলে এখন বাড়ির ভিতরে নিয়ে গিয়ে মেহমানদারী করান হয়। নাদিমের দাদাজীর নাম ছিল আবদুস সোবহান চৌধুরী। তিনি খুব সৎ ও ধার্মিক ছিলেন। উনার স্ত্রী কবিরন বিবি চৌকস মহিলা। সংসার গুছানোয় যেমন পারদর্শিনী তেমনি স্বামীর সঙ্গে ছিল গভীর সম্পর্ক। ধর্ম কর্মও খুব মেনে চলেন। চার বৌয়ের মধ্যে মাঝে মাঝে ঝগড়া হতে দেখে সংসারের কাজ চার ভাগ করে চার বৌয়ের উপর ন্যস্ত করে দিয়েছেন। পনের দিন অন্তর অন্তর বৌদের উপর ন্যস্ত কাজের পরিবর্তন হয়। স্বামী মারা যাওয়ার পর বড় ছেলে রহিম সংসারের হাল ধরলেও আয়-ব্যয়ের হিসাব কবিরন বিবি রাখতেন। রহিমের বিয়ের ছমাসের মধ্যেই বৌ আফ্রিদার গুণে মুগ্ধ হয়ে সংসারের হিসাবপত্র তাকে বুঝিয়ে সিন্দুকের চাবি তার আচঁলে বেঁধে দিয়ে বললেন, মা, আজ থেকে এই সংসারের ভাল মন্দ সবকিছুর দায়িত্ব তোমার হাতে তুলে দিলাম। এই দায়িত্ব যতদিন তোমার উপর থাকবে ততদিন সংসারের কারো সঙ্গে বেঈমানী করো না। কারো প্রতি অবিচার করো না।
আফ্রিদা শাশুড়ীর পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে বলেছিল, আপনি দোয়া করুন আম্মা, আল্লাহ পাক যেন আমাকে আপনার উপদেশ মেনে চলার তওফিক দেন। সেই থেকে আফ্রিদা ও রহিম দুজনে সংসার চালিয়ে আসছে। তিন ভাই ও দুবোনকে মানুষ করে বিয়ে দিয়েছে।
নাদিমরা দুভাই ও পাঁচ বোন। পাঁচ বোনের মধ্যে দুবোন জমজ। তাদের একজন। পাঁচ বছর বয়সে পুকুরে ডুবে মারা গেছে। আর অন্যজন সাত বছর বয়সে ধনুষ্টংকর হয়ে মারা গেছে। বাকি তিন বোনের বাকেরা ও ফৌজিয়ার বিয়ে হয়ে গেছে। ছোট মমতাজ ক্লাস নাইনে পড়ে। আর ছোট ভাই আবুল খায়ের ক্লাস সেভেনের ছাত্র। নাদিমের মেজ চাচার তিন ছেলে এক মেয়ে। সেজ চাচার দুছেলে দুমেয়ে। আর ছোট চাচার তিন বছরের ও এক বছরের শুধু দুটো ছেলে। আগের থেকে সংসার অনেক বড় হয়েছে। ছেলেদের মধ্যে নাদিম বড়। সেই জন্য এবং চারিত্রিক গুণাবলীর জন্য সে সকলের প্রিয়পাত্র। তার মা আফ্রিদা এই গ্রামের ধনী হাজী আকবর আলীর কন্যা। যেমন রূপবতী তেমনি গুণবতী। চৌধুরী বাড়ির সবাই তাকে ভক্তি-শ্রদ্ধা করে। যে। কোন ঘরে কোন উৎসব বা কাজ-কর্ম হলে আফ্রিদার উপস্থিতি থাকা চাই। তার কথামতো সবকিছু হয়। সব ঘরের ছেলে-মেয়েরা তাকে বড়মা বলে ডাকে।
নাদিম কলেজে পড়ার সময় থেকে আত্মীয়দের মধ্যে অনেকে তাকে জামাই করার জন্য চেষ্টা করে আসছে। নাদিমের আব্বা রহিমের সাথে চাচাতো ভাই রহমত আলীর গাঢ় সম্পর্ক। রহমত আলী ও তার স্ত্রী হুসনেআরা নাদিমকে জামাই করতে খুব আগ্রহী। নাদিমকে তারা ছোটবেলা থেকে খুব স্নেহ করত। বিয়ের পর অনেক দিন তাদের কোন সন্তানাদি না হওয়ায় তারাই এক রকম নাদিমকে মানুষ করেছে। পরে তাদের মাত্র একটা মেয়ে হয়েছে। তার নাম রশিদা। রশিদা এখন ক্লাস এইটে পড়ছে। নাদিমকে জামাই করবে ভেবে তাকে আগের থেকে অনেক বেশি স্নেহ করে। রহমত আলী সেল্ফ সাফিসিয়েন্ট। সে যেমন সাংসারিক প্রয়োজনীয় কোন জিনিস কারো কাছ থেকে নেয় না, তেমনি নিজের জিনিসও কাউকে দেয় না। কিন্তু নাদিমের জন্য সাত খুন মাফ। যখন যা প্রয়োজন নাদিম এসে চাইলেই খুশি মনে দিয়ে দেয়। নাদিম হুসনেআরাকে ছোট বৌ বলে ডাকে। রহমত আলী সংসারের যাবতীয় জিনিসপত্র একটা ঘরে চাবি দিয়ে রাখে। নাদিমের যখন কোন কিছুর দরকার হয় হুসনেআরার কাছে এসে বলবে, ছোট বৌ চাবিটা দাও। হুসনেআরা আঁচল থেকে চাবির গোছা খুলে তার হাতে দিয়ে দেয়। যেদিন রহমত আলীর ঘরে মেহমান কুটুম আসে অথবা ভাল কিছু রান্না হয়, সেদিন নাদিমকে দাওয়াত করে খাওয়াবে। নাদিমও ছোটবেলা থেকে তাদেরকে খুব শ্রদ্ধা করে।