Site icon BnBoi.Com

যেখানে কেউ নেই – কাসেম বিন আবুবাকার

যেখানে কেউ নেই - কাসেম বিন আবুবাকার

১-২. চৈত্রের দুপুর

যেখানে কেউ নেই – কাসেম বিন আবুবাকার

চৈত্রের দুপুর। রোদের তাপে চারদিক খাঁ খাঁ করছে। বাহেরচর গ্রামের মাঠের মাঝখানের রাস্তা দিয়ে কাঁধে সাইড ব্যাগ ঝুলিয়ে সুঠাম দেহের অধিকারী এক সাদা দাড়িওয়ালা বুড়ো লোক হেঁটে চলেছে। ঘামে গায়ের গেঞ্জি ও জামা ভিজে গেছে। রাস্তার পাশে তেমন গাছ পালাও নেই যে ছায়ায় বসে একটু বিশ্রাম নেবে। সামনে গ্রামের কিনারে একটা বাগান দেখতে পেয়ে ওখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেবে ভেবে দ্রুত পা চালাল। কাছে এসে একটা বড় জামগাছের ছায়ায় বসে বিশ্রাম নিতে লাগল। হঠাৎ বাগানের ভিতর কোনো মেয়ের আর্ত চিৎকার ও পরক্ষণে ধস্তাধস্তীর শব্দ শুনে দাঁড়িয়ে উঠে বাগানের ভিতর সন্ধানী দৃষ্টিতে তাকাতে দেখতে পেল, একটা লোক একটা যুবতী মেয়েকে মাটিতে ফেলে দিয়ে শালীনতাহানির চেষ্টা করছে। মেয়েটি নিজেকে রক্ষা করার জন্য আপ্রাণ বাধা দিচ্ছে। বুড়োটা তাড়াতাড়ি সেখানে গিয়ে লোকটার ঘাড় ধরে তুলে দাঁড় করাল। তারপর মেয়েটিকে বলল, তুমি চলে যাও। এ আর কোনো দিন তোমার পেছনে লাগবে না।

সাফিয়া প্রায় বিবস্ত্র হয়ে গিয়েছিল। তাড়াতাড়ি কাপড় গায়ে জড়িয়ে কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়াল। তার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না, মাতব্বরের ছেলে রশিদের হাত থেকে ইজ্জত রক্ষা পেয়েছে। ফ্যাল ফ্যাল করে বুড়োর দিকে তাকিয়ে রইল।

একসময় তার চোখ দিয়ে পানি গড়াতে লাগল।

বুড়োটা বলল, ঘরে অনেক কাঁদবার সময় পাবে, এখন তাড়াতাড়ি চলে যাও।

আজ ঘরে কোনো আনাজ নেই। তাই হাজেরা মেয়ে সাফিয়াকে মাতব্বরের বাগানের পুকুর থেকে কলমী শাক তুলে আনতে পাঠিয়েছিল। সাফিয়া কলমী শাক তুলে পুকুরের পাড়ে উঠে রশিদকে তার দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভয় পেয়ে দ্রুত পাশ কেটে চলে আসছিল। রশিদ পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে মাটিতে শুইয়ে শালীনতাহানীর চেষ্টা করছিল। তারপর একজন অচেনা বুড়ো লোক এসে তার ইজ্জত রক্ষা করাতে কৃজ্ঞতায় চোখে পানি এসে গেছে। তাকে চলে যেতে বলায় একরকম ছুটে চলে গেল।

সাফিয়া চলে যাওয়ার পর বুড়োটা রশিদকে বলল, বাপের স্বভাব পেয়েছিস তাই না? মেয়ে মানুষের লালসার কারণে তোর বাপের যে দশা হয়েছে তাতেও তোর জ্ঞান হল না? আজ তোকে এমন শাস্তি দেব জীবনে আর কোনোদিন মেয়েদের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারবি না।

রশিদ ত্রিশ বছরের শক্তিশালী যুবক। তাই তার ঘাড় ধরতে রেগে গিয়ে নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করে বুঝতে পারল, প্রতিপক্ষ তার চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। তাকে দেখার জন্য ঘাড় ঘোরাতে গিয়ে সফল হল না। নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করতে প্রতিপক্ষের হাতের চাপ বেড়ে যাচ্ছে বুঝতে পেরে এতক্ষণ চুপ করে থাকলেও রাগে ফুলছিল। প্রতিপক্ষের কথা শুনে রাগের সঙ্গে কিছু বলতে যাচ্ছিল; কিন্তু গলা থেকে শব্দ বের হল না। কারণ ততক্ষণে দুই কানের নিচে প্রচণ্ড চাপ অনুভব করে জ্ঞান হারাবার উপক্রম হল এবং কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সত্যিই জ্ঞান হারিয়ে ফেলল।

বুড়োটা তার অবস্থা বুঝতে পেরে মাটিতে শুইয়ে দিল। তারপর ব্যাগ থেকে রশি বের করে ডানহাতের কব্জির একটু উপরে বেঁধে কজ্জিটা কেটে দিয়ে একটা চোখও তুলে নিল, তারপর একটা কাগজে মেয়েদের ইজ্জতের উপর হামলা করার ফল লিখে কাগজটা তার বুকের উপর রেখে একটা মাটির ঢেলা চাপা দিয়ে যেদিক থেকে এসেছিল সেইদকে হাঁটতে শুরু করল।

বাহেরচর গ্রামের অল্প কয়েকজন ছাড়া সবাই গরিব লোক। যে কয়েকজনের অবস্থা ভালো তাদের থেকে দিলদার মাতব্বরের অবস্থা সবার থেকে ভালো। তিনি বাপ-মায়ের একমাত্র সন্তান। গ্রামে প্রাইমারী স্কুল থাকলেও হাই স্কুল প্রায় আট দশ মাইল দূরে। তাই প্রাইমারী পাশ করার পর দিলদার আর পড়াশোনা করেনি। যুবক বয়সে গ্রামের গরিব ঘরের অনেক মেয়ের ইজ্জত নষ্ট করেছে। মেয়ের বাবারা দিলদারের বাবা সালেহ উদ্দিন মাতব্বরের কাছে নালিশ জানিয়ে সুবিচার পায় নি। তিনি টাকা পয়সা দিয়ে সে সব মেয়েদের বিয়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। সালেহ উদ্দিন মাতব্বর চরিত্রহীন ছিলেন না; কিন্তু তারই ছেলে দিলদার যে কেন চরিত্রহীন হল; তা অনেক চিন্তা করেও পান নি। তাই ছেলেকে ভালো করার জন্য পাঁচ মাইল দূরের গ্রামের এক সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দেন।

বিয়ের পর বছর দুই দিলদারের কুকর্ম বন্ধ ছিল। তারপর পরনারীর নেশা আবার জেগে উঠে। বড়লোকের ছেলেদের অনেক চামচা থাকে। দিলদারেরও ছিল। সেই চামচারা মেয়ে জোগাড় করে দিত। এর মধ্যে তার বাবা সালেহ উদ্দিন মাতব্বর মারা গেলেন। বাবা মারা যাওয়ার পর দিলদার গ্রামের মাতব্বর হলেন এবং আরো তিনটে বিয়ে করেন। তারপরও তার নারীর লোভ গেল না। সুযোগ পেলে চামচাদের সাহায্যে গ্রামের গরিব বৌ বেটিদের ভোগ করত। চারটে বিয়ে করলেও প্রথম স্ত্রীর গর্ভে একটি মাত্র ছেলে ছাড়া অন্য তিন স্ত্রীর গর্ভে কোনো সন্তান হয় নি। সেই ছেলেই রশিদ।

রশিদের বয়স যখন বার বছর তখন তার মা মারা যায়। তারপর দিলদার মাতব্বর আবার বিয়ে করার জন্য চামচাদের মেয়ের খোঁজ করতে বললেন।

ঐ গ্রামের মঈন সেখ দরিদ্র কৃষক। বছরের বেশিরভাগ দিন সে দিলদার মাতব্বরের চাষ বাসের কাজ করে। তার বৌ সায়রা খুব সুন্দরী। তাদের একমাত্র ছেলে হালিম। হালিম যখন সাত বছরের তখন মঈন সেখ মাস দুই অসুখে ভুগে মারা যায়।

প্রথম স্ত্রী মারা যাওয়ার কিছুদিন পর দিলদার মাতব্বরের আর একটা বিয়ের খায়েস হল। তাই চামচাদের যখন মেয়ের খোঁজ করতে বললেন তখন শাকিল নামে এক চামচা বলল, হুজুর, মেয়ে আমাদের গ্রামেই আছে, দেখতে পরীর মতো।

দিলদার মাতব্বর বললেন, তাই নাকি? তা মেয়েটা কে?

শাকিল বলল, মঈন সেখের বৌ, একটা সাত আট বছরের ছেলে থাকলে কি হবে? দেখলে মনে হবে এখনো বিয়েই হয় নি।

দিলদার মাতব্বর বেশ কিছুদিন আগে মঈন সেখের অসুখের কথা শুনে একদিন দেখতে গিয়েছিলেন। সে সময় তার বৌকে ঘোমটা অবস্থায় দেখলেও শরীরের বাঁধন দেখে লোভাতুর হয়ে উঠেছিলেন। অন্য কারো বৌ হলে কয়েকদিনের মধ্যে ভোগ না করে ছাড়তেন না। মঈন সেখ তারই কামলা, তাই কিভাবে কাজটা করবেন ভেবে ধৈর্যের সঙ্গে চিন্তা করছিলেন, আর দু’একদিন ছাড়া মঈন সেখকে টাকা পয়সা সাহায্য করার অসিলায় তার বৌকে দেখার জন্য যেতেন। কিন্তু একবারের জন্যও ঘোমটা থাকার কারণে তার বৌ-এর মুখ দেখতে পান নি।

একদিন সাড়া না দিয়ে ঢুকে পড়ে দেখলেন, সায়রা স্বামীকে ওষুধ খাওয়াচ্ছে, মাথায় ঘোমটা নেই। গায়েও ভালো করে কাপড় নেই। ঐ অবস্থায় সায়রাকে দেখে মাতব্বর ভিমরি খেলেন। তাকে পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলেন। কোনো উপায় না পেয়ে কবিরাজকে অনেক টাকা দিয়ে মঈন সেখকে মেরে ফেলার ব্যবস্থা করেন। মঈন সেখ মারা যাওয়ার পর তার বৌ ও ছেলেকে সাহায্য করার জন্য যাতায়াত শুরু করেন।

সায়রা গ্রামের অশিক্ষিত সহজ সরল মেয়ে, দিলদার মাতব্বরের কৌশল ধরতে পারল না। ভাবল, স্বামী বারমাস মাতব্বরের ক্ষেতে খামারে কাজ করত, তাই সে মারা যেতে সাহায্য করছে। ঘোমটা অবস্থায় হাত পেতে টাকা নিত।

একদিন মাতব্বর টাকা দেয়ার সময় হালিমকে দেখতে না পেয়ে হঠাৎ করে সায়রার হাত ধরে ঘোমটা সরিয়ে দিয়ে বললেন, আমার কাছে ঘোমটা দেয়ার দরকার নেই। ভেবেছি, ইদ্দতের পর তোমাকে বিয়ে করে ঘরে নিয়ে যাব।

মাতব্বরের কথা শুনে সায়রা লজ্জা পেলেও তার মতলব বুঝতে পেরে খুব রেগে গিয়ে অন্য হাতে ঘোমটা টেনে বলল, হাত ছাড়ুন, নচেৎ চিৎকার করে লোকজন ডাকব।

মাতব্বর মৃদু হেসে বললেন, সেটা করা কি উচিত হবে? লোকজনদের আমাকে কিছু বলার সাহস হবে না, বরং তোমারই দুর্নাম হবে।

সায়রা হাতটা জোর করে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, আমি আপনাকে বাপের মতো মনে করি, আর আপনি কিনা আমাকে বিয়ে করতে চান? যান, চলে যান এখান থেকে। আর কোনোদিন আসবেন না। কথা শেষ করে টাকাগুলো মাতব্বরের পায়ের কাছে ফেলে দিয়ে ছুটে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে খিল দিয়ে দিল।

মাতব্বর কিছুক্ষণ বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে ফিরে আসার সময় বিড় বিড় করে বললেন, ইদ্দৎ শেষ হোক তারপর তোর দেমাগ ভাঙব।

মাতব্বর যখন আসেন তখন হালিম ঘরে ছিল না। পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে খেলা করছিল। কিছুক্ষণ আগে ফিরে মাতব্বরকে মায়ের হাত ধরে কথা বলতে দেখে এতক্ষণ রান্না ঘরের আড়ালে দাঁড়িয়ে সবকিছু দেখছিল ও শুনছিল। ছোট ছেলে বলে ঘটনাটা বুঝতে না পারলেও মাতব্বরের কথায় মা যে খুব রেগে গেছে বুঝতে পারল। মাতব্বর চলে যাওয়ার পর ঘরের দরজার কাছে এসে বলল, মা দরজা খোল, মাতব্বর চলে গেছে।

সায়রা নিজের ভাগ্যের কথা চিন্তা করে কাঁদছিল। মাতব্বর চলে গেছে শুনে। দরজা খুলে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল।

হালিম বলল, তুমি কাঁদছ কেন মা? মাতব্বর তোমাকে বকেছে বুঝি? তুমি দেখে নিও, এবার মাতব্বর এলে ইট মেরে মাথা ফাটিয়ে দেব।

সায়রা কান্না থামিয়ে চোখ মুছে বলল, ছি বাবা, উনি মুরুব্বী মানুষ, ওরকম কথা বলতে নেই। তারপর তাকে পান্তা খেতে দিয়ে বলল, বাইরে কোথাও যাবি না, ঘরে থাকবি। আমি তোর করিম দাদাদের ঘরে যাব। দেখি তাদের সংসারের কোনো কাজ কাম করা যায় কিনা।

করিম সেখের অবস্থা মোটামুটি ভালো, তার চার ছেলে দু’ মেয়ে। সবার বিয়ে হয়ে গেছে। চার ছেলের বৌ ও নাতি-নাতনিদের নিয়ে করিম সেখের একান্নবর্তী পরিবার। দু’জন কাজের মেয়ে থাকলেও সায়রার দুরবস্থার কথা ভেবে করিম সেখের স্ত্রী তিনবেলা খাওয়ার বদলে তাকে কাজে রাখলেন। সায়রা তিন বেলাই খাবার ঘরে নিয়ে এসে ছেলেকে নিয়ে খায়।

সে কথা শুনে দিলদার মাতব্বর তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে চামচাদের বললেন, মঈন সেখের বিধবা বৌকে কত টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করলাম, আর সে কিনা আমার কাছে না এসে করিম সেখের সংসারে কাজ নিল? ঠিক আছে, সময় হলে আমিও দেখে নেব।

দিলদার মাতব্বর সায়রার ইদ্দতের হিসাব রেখেছিলেন। চারমাস দশ দিন হয়েছে দুদিন আগে। তাই আজ চামচাদেরকে বিয়ে করার কথা বলে মেয়ে দেখতে বলেছিলেন। চামচা শাকিলের কথা শুনে মুচকি হেসে বললেন, তুই ব্যবস্থা কর, আমি রাজি। তারপর তিনটে একশ টাকার নোট তাকে দিয়ে বললেন, এগুলো নিয়ে তোর মাকে প্রস্তাব দিতে পাঠাবি। আর বলে দিবি টাকাগুলো যেন মঈন সেখের বিধবা বৌকে দেয়।

শাকিলের বাপ অনেক আগে মারা গেছে। তার মা রহিমন বিবির বয়স প্রায় ষাট বছর। গ্রামের সব ঘরেই তার অবাধ বিচরণ। বৌড়ী ঝিউড়ী কেউ চাচি আবার কেউ দাদি সম্বোধন করে।

রহিমন বিবি প্রায় দিনই সায়রার কাছে আসে। সায়রা তাকে দাদি বলে ডাকে। রহিমন বিবি মাতব্বরের প্রথম বৌ ছাড়া তিন বৌয়ের ঘটকালি করেছে। আজ শাকিল মাকে যখন টাকাটা দিয়ে মাতব্বরের কথা বলল তখন রহিমন বিবি বলল, মাতব্বরের এত বয়স হল, তিন-তিনটে বৌও রয়েছে, তবু বিয়ে করার সখ গেল না।

শাকিল বলল, যাদের টাকা আছে তাদের সখও আছে।

করিম সেখের তো টাকা আছে, কই, সেতো মাতব্বরের মতো চার পাঁচটি বিয়ে করে নি? আসলে মাতব্বর তোক ভালো না।

মাতব্বর ভালো না মন্দ সে কথা ভাবতে হবে না। তোমাকে যে কাজের ভার দিয়েছেন তা করতে পারলে বেশ কিছু টাকা পাওয়া যাবে। তুমি আজই প্রস্তাবটা সায়রার কাছে দিবে।

সায়রা করিম সেখের ঘর থেকে বেলা তিনটের দিকে ভাত নিয়ে ঘরে এসে দেখল, হালিম ঘুমিয়ে পড়েছে। তাকে জাগিয়ে মায়ে পুতে খেতে বসল।

এমন সময় রহিমন বিবি এসে বলল, কাজ সেরে এখন এলি বুঝি?

সায়রা বলল, হ্যাঁ দাদি, করিম চাচার সংসারে কত মানুষ তাতো জান। খাওয়ার পর অত লোকের হাঁড়ি থালা-বাসন ধুয়ে রেখে তারপর এলাম। ছেলেটা ভুখের চোটে ঘুমিয়ে পড়েছিল।

কি আর করবিরে বুন, সব কপালের লিখন। অমন তরতাজা মঈনকে আল্লাহ তুলে নেবে ভাবতেই পারি নি।

সায়রা বলল, ওসব কথা থাক দাদি, এমন অসময়ে এলে যে?

রহিমন বিবি বলল, তোকে একটা কথা বলতে এলাম, কথাটা ভেবে চিন্তে উত্তর দিবি।

পাতের ভাত কমে গেছে দেখে সায়রা ছেলেকে খেতে বলে হাত মুখ ধুয়ে বলল, কি কথা দাদি?

তোর কাঁচা বয়স, স্বাস্থ্য ভালো, বাকি জীবনটা কিভাবে কাটাবি ভেবেছিস?

সায়রা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, ভেবে আর কি করব? আল্লাহ কপালে যা রেখেছে তাই হবে।

তাতো হবে, কিন্তু লোকের বাড়ি কাজ করে কতদিন চলবি? পাকাপাকি কিছু একটা করাই তো ভালো।

পাকাপাকি করার কথা কি বলছ বুঝতে পারছি না।

বলছি নিকে কর। তা হলে পরের ঘরে কাজ করতে হবে না। ছেলেটাও খেয়ে পরে মানুষ হবে। তা না হলে তুইও যেমন শান্তি পাবি না। তেমনি ছেলেটাও কষ্ট, পাবে। তা ছাড়া গ্রামের ছেলে ছোকরারা তোকে জ্বালাতন করবে। কতদিন তাদের হাত থেকে বাঁচতে পারবি?

সায়রা এই চার মাসের মধ্যে বুঝতে পেরেছে গহীন রাতে করা যেন তার ঘরের চারপাশে চলাফেরা করে। ভয়ে মাথার কাছে বড় হেসো রেখে সারারাত একরকম জেগেই থাকে। একবার ভেবেছিল, ভাই ভাবির কাছে চলে যাবে; কিন্তু তাদের সংসারের দুরবস্থার কথা চিন্তা করে যায় নি। এখন রহিমন দাদির কথা শুনে বলল তোমার কথাগুলো আমিও চিন্তা করেছি। কিন্তু কি কবর ভেবে পাইনি। গ্রামের কেউ কি আমাকে নিকে করতে চাইবে? আর চাইলেও ছেলেটার কি হবে?

রহিমন বিবি বলল, তোর মতো মেয়ের নিকের বরের অভাব আছে নাকি গ্রামে? ছেলেকে নিয়েই তোকে নিকে করার জন্য কতলোক হাঁ করে রয়েছে। মাতব্বর তো তোকে নিকে করার জন্য এক পা। আমি বলি কি সবার থেকে মাতব্বরের ঘরে গেলে তুই সবদিক দিয়ে সুখী হবি। মাতব্বর তোকে রাজরানী করে রাখবে। আর ছেলেটাও মানুষ হবে।

সায়রা বলল, তা আমি জানি দাদি। কিন্তু মাতব্বরের বয়স আমার বাপের বয়সের চেয়ে বেশি। তাকে আমি বাপের মতো মনে করি, তুমিই বলো, তাকে কি নিকে করতে পারি?

বাপের মতো মনে করলে তো বাপ হয়ে যায় না। আর বয়সের কথা যে বললি, পুরুষদের আবার বয়স আছে নাকি? একশ বছরের বুড়োও বিশ বছরের ছুঁড়িকে বিয়ে করছে। ওসব কথা বাদ দিয়ে তুই রাজি হয়ে যা। তারপর কাপড় থেকে তিনশ টাকা বের করে তার হাতে দিয়ে বলল, তোর কষ্ট দেখে মাতব্বর আমাকে দিয়ে পাঠিয়েছে।

সায়রা টাকাটা ফেরত দিয়ে বলল, এটা তাকে ফিরিয়ে দিও। যাকে বাপের মতো মনে করি, জান গেলেও তাকে নিকে করতে পারব না। অন্য কেউ হলে ভেবে দেখতাম।

কিন্তু মাতব্বর কি স্বভাবের লোক তুই তো জানিস না। এই গ্রামে বৌ হয়ে এসেছি আজ পঞ্চাশ বছর হয়ে গেল। সেই থেকে তার স্বভাব চরিত্র জানি। যে মেয়ে একবার তার নজরে ধরবে তাকে ভোগ না করে ছাড়ে না। এখনো সেই স্বভাব যায় নি। তুই তার নজরে পড়েছিস। অন্য কারো সঙ্গে নিকে বসতে দেবে না। আর গ্রামে এমন কেউ নেই, তার মতের বিরুদ্ধে তোকে নিকে করবে। তাই বলছি মাতব্বরের হাত থেকে বেশি দিন ইজ্জৎ বাঁচিয়ে রাখতে পারবি না। ইজ্জত বাঁচাতে হলে তাকে নিকে করা ছাড়া অন্য কোনো রাস্তা নেই।

সায়রা বলল, দশ বছর এই গ্রামে এসেছি। হালিমের বাপের মুখে মাতব্বরের স্বভাবের কথা শুনেছি। তা ছাড়া হালিমের বাপ মারা যাওয়ার পর টাকা দিয়ে আমার ইজ্জৎ লুটতে চেয়েছিল। রাজি হয় নি বলে এবার বিয়ে করতে চাচ্ছে। তার মতলব আমি বুঝি। তোমাকে বলে রাখি দাদি, আমি এই লম্পট মাতব্বরকে কিছুতেই নিকে করব না। তাতে যদি আমার জান যায় অথবা গ্রাম ছাড়তে হয়, তাতেও রাজি।

রহিমন বিবি টাকাগুলো গেট কাপড়ে রেখে বলল, গ্রামের পাঁচটা বৌ বেটির চেয়ে তোকে বেশি ভালোবাসি। তাই তোর ভালোর জন্য বলছি, মাতব্বরের কথা মেনে নে। নচেৎ টাকা ফেরত দিয়েছিস জেনে কি করবে কি জানি। এবার আসিলো বুন। চলে যাওয়ার আগে বলল, আমার কথাটা ভেবে দেখিস।

সায়রাও সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, শুনে যাও দাদি, আমার ভাববার কিছু নেই। জান গেলেও আমি মাতব্বরকে নিকে করব না।

রহিমন বিবি নিজের ঘরে না গিয়ে মাতব্বরের কাছে গিয়ে টাকা ফেরত দিয়ে বলল, না হুজুর সায়রা কিছুতেই রাজি হল না। তারপর সায়রা যা বলেছে বলল।

মাতব্বর তার কথা শুনে খুব রেগে গেলেও সামলে নিয়ে বললেন, ঠিক আছে, তুমি যাও। যা করার আমি করব।

কয়েকদিন পর এক গভীর রাতে মাতব্বর দুজন চামচাকে নিয়ে মঈন সেখের ঘরের দরজার কাছে এলেন। তারপর চামচা দুজনের দ্বারা বেড়া কেটে ফাঁক করে তাদেরকে বাইরে রেখে মাতব্বর একা ঘরে ঢুকে দেখলেন, হারিকেনের বাতি কমানো রয়েছে, মায়ে পুতে পাশাপাশি শুয়ে আছে দেখে সায়রাকে জড়িয়ে ধরে তার কাপড় খুলতে গেলেন।

রহিমন বিবি যেদিন এসেছিল, সেদিনই সায়রার দৃঢ় ধারণা হয়েছিল, মাতব্বর রাতের অন্ধকারে তার ইজ্জত লুটতে আসবে। তাই তারপর থেকে সে রাতে ঘুমায় না। মাতব্বরের লম্পটগিরী বন্ধ করার জন্য এবং নিজের ও গ্রামে গরিব ঘরের বৌ বেটিদের ইজ্জৎ বাঁচাবার এক কঠিন শপথ নেয়। আগে রাতে বিছানায় যাওয়ার সময় হারিকেনের বাতি কমিয়ে একটা হেঁসো রাখত, শপথ নেয়ার পর একটা ব্লেড কিনে এনে সেটাও বালিশের তলায় রেখে ঘুমায়।

আজও সেসব রেখে জেগে শুয়ে ছিল। মাতব্বর ও চামচাদের ফিস ফিসানি ও বেড়া কাটা সবকিছু জানতে পেরেও কিছু বলে নি। মাতব্বর ঘরে ঢুকে টর্চ লাইট জ্বালাতে চোখ বন্ধ করে ঘুমের ভান করে ছিল। যখন তার কাপড় খুলছিল তখন বাধা না দিয়ে বালিশের তলা থেকে ব্লেড নিয়ে তৈরি হয়ে রইল। শেষে যখন উপগত হতে গেল তখন তার লিঙ্গটা এক হাতে ধরে অন্য হাতে ব্লেড চালিয়ে কেটে নিল। মাতব্বর অর্ত চিৎকার দিয়ে শালি মেরে ফেললরে বলে লিঙ্গের গোড়টা চেপে ধরে বিবস্ত্র অবস্থায় দরজা খুলে ছুটে বেরিয়ে এল। তখন গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে।

মাতব্বরের অবস্থা দেখে চামচা দুজনের আক্কেলগুড়ুম। তাড়াতাড়ি মাতব্বরকে গ্রামে কোনো ডাক্তার না থাকায় করিবাজের বাড়িতে নিয়ে গেল।

তখন গভীর রাত। কবিরাজের বাড়ির সবাই ঘুমে অচেতন। অনেক ডাকাডাকি করার পর কবিরাজ ঘর থেকে বেরিয়ে মাতব্বরের অবস্থা দেখে বললেন, এরকম কেসের চিকিৎসা আমি করতে পারব না। শহরের হাসপাতালে নিয়ে যান। আপাতত আমি রক্ত বন্ধ করার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।

মাতব্বরের আর্তচিৎকার ও লাফালাফিতে হালিমের ঘুম ভেঙে যেতে তাকিয়ে দেখল, বাবারে মারে শালী মেরে ফেললরে বলে মাতব্বর ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ভয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করল, মাতব্বর এসেছিল কেন? তার কি হয়েছে? ওরকম চিল্লাতে চিল্লাতে চলে গেল কেন?

সায়রা তখন শাড়িটা ঠিক করে পরছিল। বলল, আমাকে ছেড়ে দে, দেখছিস রক্তে শাড়ি ভিজে গেছে।

হালিম মাকে ছেড়ে দিয়ে হারিকেনের সলতে বাড়িয়ে দিয়ে বিছানায় ও মায়ের। শাড়িতে রক্ত দেখে আবার জিজ্ঞেস করল, এত রক্ত কেন মা?

আসল কথা বলতে না পেরে সায়রা বলল, এতরাতে মাতব্বর আমার কাছে এসেছিল বলে তার গায়ে বঁটির কোপ দিয়েছি। এসব তারই রক্ত। তারপর বলল, এসব কথা কাউকে বলবি না।

হালিম ভয়ার্তস্বরে বলল, কাল মাতব্বর যদি লোকজন নিয়ে এসে তোমাকে মারে?

চুপকর, তোকে ওসব ভাবতে হবে না। তারপর বালতি ভরে পানি এনে লাতা ভিজিয়ে ঘরের ভিতরের ও বাইরের রক্ত পরিষ্কার করতে লাগল।

মাতব্বর বাড়ির লোকজন ও চামচেরা ঘটনাটা গোপন রাখতে চেষ্টা করলেও এককান দু’কান করে সবাই জেনে গেল, অনেকে খুশী হয়ে মন্তব্য করল, যেমন কর্ম তেমনি ফল, সেই সাথে সায়রাকে সবাই বাহবা দিতে লাগল।

.

০২.

প্রায় একমাস হাসপাতালে থেকে মাতব্বর ঘরে ফিরে এলেন। হাসপাতালে থাকাতেই কিভাবে সায়রাকে শায়েস্তা করবেন চিন্তা করলে ও ঘরে ফিরে গ্রামের পরিস্থিতি দেখে আগের চিন্তা বাদ দিয়ে নতুন ভাবে চিন্তা করে কাজে নামলেন।

একদিন ফজলু ভিক্ষে করতে এলে তাকে বললেন, কতদিন আর ভিক্ষে করে খাবি? যা বলছি শোন, আমি তোকে একটা কাজ দেব। কাজটা করতে পারলে তোকে আর ভিক্ষে করে খেতে হবে না। তারপর কি করতে হবে না হবে বুঝিয়ে বলে বললেন, যদি কাজটা করতে পারিস, তা হলে সায়রার সঙ্গে তোর বিয়ে দেব, নতুন ঘর করে দেব, দশ কাটা জমিও তোকে লিখে দেব, বাজারে একটা মুদি দোকানও করে দেব। দোকানদারী করবি আর বৌ নিয়ে সুখে থাকবি।

ফজলু খুব রোগা ও খোঁড়া, কোনো কাজ করতে পারে না। তার মা ছাড়া কেউ নেই। বাবা মারা যাওয়ার পর তার মা ভিক্ষে করে সংসার চালাত। বয়স বেশি হওয়ার কারণে সে ভিক্ষা করতে পারে না। এখন ফজলু ভিক্ষে করে সংসার চালায়। বিয়ে করার ইচ্ছা থাকলেও কোনো মেয়ের বাপ তার কাছে মেয়ে দিতে চায় নি বলে আজও বিয়ে হয় নি। বয়সে মঈন সেখের চেয়ে দুতিন বছরের ছোট। মঈন সেখ যখন বেঁচে ছিল তখন ফজলু তাদের ঘরে যেত। এখনও যায়। সায়রাকে ভাবি বলে ডাকে।

মাতব্বরের কথা শুনে খুব খুশী হলেও চিন্তা করতে লাগল। সায়রা সুন্দরী, সেকি আমাকে বিয়ে করতে রাজি হবে? শেষে যদি মাতব্বরের মতো অবস্থা তারও করে?

তাকে চুপ করে থাকতে দেখে তার মনের ভাব বুঝতে পেরে বললেন, কিরে কাজটা করতে পারবি না?

ফজলু হ্যাঁ-না কিছু বলতে না পেরে শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে মাতব্বরের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

মাতব্বর মুচকি হেসে বললেন, ঠিক আছে। যা করতে বললাম, তা যদি করতে না পারিস, তা হলে বাদ দে। এবার যা বলছি শোন, তারপর কি করতে হবে না হবে বলে জিজ্ঞেস করলেন, কিরে এই কাজটাও পারবি না?

এবার ফজলুর মুখে হাসি ফুটে উঠল। বলল, পারব।

এই তো বাপের বেটার মতো কথা বলেছিস। যা যা বললাম মনে আছে তো?

হ্যাঁ হুজুর, মনে আছে।

তা হলে এবার যা বলে মাতব্বর আবার মুচকি হাসলেন।

.

ফজলু সারাদিন ভিক্ষা করে সন্ধ্যের সময় ঘরে ফিরে। আজ মাতব্বরের কথা শুনে তার মনে বসন্তের বাতাস বইছে। তাই সন্ধের অনেক আগেই ঘরে ফিরে এল।

তার মা জয়তুন বিবি বলল, আজ বেলা থাকতে ফিরে এলি যে?

ফজলু বলল, আজকাল আর কেউ ভিক্ষে দিতে চায় না। সবাই বলে মাফ কর।

জয়তুন বিবি দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলল, কি আর করবি বাবা, আমাদের পোড়া কপাল। ভিক্ষে করা ছাড়া কি আর উপাই আছে।

ফজলু বলল, আজ শরীরটা ভালো নেই। দুপুরেও কেউ খেতে দেয় নি। তাড়াতাড়ি রান্না কর।

এমন সময় হালিমকে আসতে দেখে ফজলু বলল, কিরে বাবা, কেন এয়েছিস।

হালিম বলল, কাল রাত থেকে মায়ের খুব জ্বর। সারাদিন উঠতে পারে নি। দাদিকে মা যেতে বলেছে।

জয়তুন বিবি ছেলের দিকে চেয়ে বলল, তুই একটু দেখে আয়। আমি বেঁধে রেখে যাব।

ফজলু হালিমের সঙ্গে এসে দেখল, সায়রা কাঁথা মুড়ী দিয়ে শুয়ে আছে।

হালিম মায়ের গায়ে হাত রেখে নাড়া দিয়ে বলল, দাদি ফজলু চাচাকে পাঠিয়েছে। সে বেঁধে রেখে আসবে।

কাছাকাছি ঘর বলে ফজলুর মা জয়তুন বিবি প্রায়ই সায়রার কাছে আসে। আর সায়রাও স্বামী বেঁচে থাকতে তাদের ঘরে মাঝে মধ্যে যেত। স্বামী মারা যাওয়ার পরও যায়।

সায়রার চার পাঁচের মতো জ্বর। চোখ বন্ধ করে শুয়েছিল। কোনোরকমে চোখ খুলে বলল, ফজলু ভাই, চাচিকে একটু তাড়াতাড়ি আসতে বল। আমার জান কেমন করছে। আমি বোধ হয় আর বাঁচব না।

ফজলু সায়রার কপালে হাত দিয়ে জ্বর পরীক্ষা করার ইচ্ছাটা দমন করতে পারল না। সায়রার কথা শুনে সাহস করে কপালে হাত রেখে বলল, ইসরে, জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। আমি মাকে ডেকে নিয়ে আসি, মাথায় পানি দিতে হবে। তারপর ঘরে গিয়ে মাকে বলল, এখুনি চল, রাধা-বাড়া পরে করো। সায়রা ভাবির খুব জ্বর, মাথায় পানি দিতে হবে।

জয়তুন বিবি ছেলের সাথে এসে সায়রার মাথায় পানি দিতে দিতে ছেলেকে বলল, তুই কবিরাজকে ডেকে নিয়ে আয়।

কবিরাজের ডিসপেন্সারী মাইল খানেক দূরে বাজারে। ফজলু গিয়ে বলল, কবিরাজ ভাই, জলদি চল। সায়রা ভাবির কাল থেকে খুব জ্বর।

কবিরাজ খুব শক্ত দীলের মানুষ। টাকা ছাড়া কারো চিকিৎসা করে না। ফজলুর কথা শুনে বলল, তোর তো কোনো বড় ভাই নেই, সায়রা ভাবি এল কোথা থেকে?

সায়রা ভাবিকে চিনলে না? মঈন ভাই-এর বৌ।

ও—মঈন সেখের বৌ-এর কথা বলছিস? মঈন সেখ তো প্রায় সাত আট মাস আগে মারা গেছে। আমার ফি ও ওষুধের দাম দেবে কে?

কবিরাজের স্বভাব ফজলু জানে। তাই বলল, মঈন ভাই মারা গেলে ও আমি তো আছি। আমি দেব। তুমি চলোতো কবিরাজ, দেরি হয়ে যাচ্ছে।

তুইতো ভিক্ষে করে খাস, টাকা কোথায় পাবি?

ভিক্ষে করার সময় সবাই চাল দেয় না। কেউ কেউ টাকা পয়সাও দেয়। সেইগুলো আমি খরচ না করে জমিয়ে রেখেছি, সেখান থেকে দেব।

তা হলে চল বলে কবিরাজ ওষুধের ব্যাগ নিয়ে রওয়ানা দিল।

ফজলু যখন কবিরাজকে নিয়ে ফিরে এল তখনও জয়তুন বিবি সায়রার মাথায় পানি ঢালছিল।

কবিরাজ সায়রাকে পরীক্ষা করে ব্যাগ থেকে ওষুধ বের করে কোনটা কখন খাবে বুঝিয়ে দিল। তারপর ফজলুর দিকে চেয়ে বলল, আমার ফি দশ টাকা ও ওষুধের দাম বিশ টাকা, মোট ত্রিশ টাকা দে।

এতক্ষণ পানি ঢালার পর সায়রার জ্বর একটু কমেছে। করিবাজের কথা শুনে বলল, ফজলু ভাই টাকা কোথায় পাবে? আমি ভালো হয়ে করিম চাচার কাছ থেকে চেয়ে তোমাকে দেব।

কবিরাজ অসন্তুষ্ট গলায় বলল, কিন্তু ফজলু তো টাকা দেবে বলে আমাকে ডেকে নিয়ে এল।

কবিরাজের কথা শেষ হতে ফজলু বলল, টাকা আমিই দেব। তুমি আমার সাথে এস। তারপর তাকে নিয়ে বেরিয়ে এল।

কবিরাজ বেরিয়ে আসার সময় বলল, মাথায় পানি ঢালা বন্ধ করা চলবে না। জ্বর আরো না কমলে সারা রাত ঢালতে হবে।

ফজলু ভিক্ষা করে যে টাকা পয়সা পায়, তা থেকে মাকে অল্প কিছু দেয়। বাকিগুলো একটা মাটির ব্যাংকে ফেলে। ব্যাপারটা জয়তুন বিবি জেনে অসন্তুষ্ট না হয়ে বিপদে কাজে লাগবে ভেবে সন্তুষ্টই হয়েছে। কবিরাজকে নিয়ে ফজলু বেরিয়ে যাওয়ার পর বলল, ও ভিক্ষে করে কিছু টাকা জমিয়েছে। সেখান থেকে দেবে। তুই ভালো হয়ে করিম সেখের কাছ থেকে চেয়ে দিয়ে দিস। কবিরাজ কেমন লোক জানিস তো? টাকা না দিলে কারো চিকিৎসা করে না।

সায়রা বলল, হ্যাঁ চাচি, তাই দেব।

ফজলু কবিরাজকে বিদেয় করে এসে বলল, সন্ধ্যে হয়ে গেছে। তুমি এবার ঘরে গিয়ে রান্না কর। আমি ভাবির মাথায় পানি ঢালছি।

জয়তুন বিবি বললেন, তাই কর। হালিম ও সায়রা বোধহয় সারাদিন কিছু খায় নি। আমি হালিমকে নিয়ে যাই। রান্না করে ওকে খাইয়ে ওর হাতে সায়রার জন্য একমুঠো পাঠিয়ে দেব।

ঐ রাতে জয়তুন বিবি ছেলেকে নিয়ে সারারাত সায়রার মাথায় পানি ঢালল। সকালের দিকে জ্বর অনেকটা কমতে সায়রাই তাদেরকে ঘরে চলে যেতে বলল।

প্রায় আট ন’দিন পর সায়রা সুস্থ হল। এই ক’দিন ফজলু ও জয়তুন বিবি দিনে রাতে এসে তার সেবা করেছে। সুস্থ হওয়ার পর। সায়রা করিম সেখের ঘরে কাজে যেতে লাগল। চিকিৎসা করার কথা বলে করিম সেখের কাছ থেকে টাকা চেয়ে এনে একদিন ফজলুকে দিতে গেল।

ফজলু বলল, ওটা তোমার কাছে রাখ। দরকার পড়লে চেয়ে নেব।

সায়রা বলল, তুমি ও চাচি আমাকে না দেখলে মরেই যেতাম। তোমরা আমার যে উপকার করেছ, সে কথা জীবনে ভুলতে পারব না। তুমি কত কষ্ট করে টাকা জমিয়েছিলে। সেই টাকা দিয়ে আমার চিকিৎসা করিয়েছ। এই টাকা তোমাকে নিতেই হবে।

বললাম তো, টাকাটা এখন তোমার কাছেই থাক। দরকার হলে চেয়ে নেব? আমার কাছে থাকলে খরচ হয়ে যাবে বলে ফজলু তার কাছ থেকে চলে গেল।

এরপর ফজলু প্রতিদিন ভিক্ষে করে ফেরার সময় সায়রার সঙ্গে দেখা করে। যেদিন ফিরতে সন্ধ্যে হয়ে যায়, সেই দিন রাতে দেখা করতে যায়।

দিলদার মাতব্বর কিভাবে সায়রার ঘরে যাতায়াত করবে ও তার সঙ্গে কিভাবে কথা বলবে ফজলুকে শিখিয়ে দিয়েছিলেন। সেই সব করার আগেই সায়রার অসুখ হতে ফজলুর সাপেবর হল। মাতব্বর যা কিছু করতে বলেছিল, সে সব করতে হল না।

মাতব্বর তার চামচাদেরকে ফজলু ও সায়রার দিকে লক্ষ্য রাখতে বলেছিলেন। তাদের কাছ থেকে সবকিছু শুনে বললেন, তোমরা গ্রামে রটিয়ে দাও, ফজলু সায়রার ঘরে রাতে থাকে।

কয়েকদিনের মধ্যে চামচরা গ্রামময় কথাটা রটিয়ে দিল।

কথাটা করিম সেখের কানে পড়ার আগেই হঠাৎ একদিন তিনি মারা গেলেন। তার বড় ছেলে আসগরের বৌ চিররুগী। সায়রা তাদের ঘরে কাজে লাগার পর থেকে তার উপর আসগরের চোখ পড়েছিল। এমন কি তাকে নিকে করার কথাও ভেবেছিল। কিন্তু বাপের ভয়ে তা সম্ভব হয় নি। বাপ মারা যাওয়ার পর সেই ইচ্ছাটা প্রবল হল। সায়রা ও ফজলুকে নিয়ে যে কথা গ্রামে কানাঘুষো চলছে, তা শুনে দু’জনের উপরেই খুব রেগে গেল।

একদিন রাস্তায় ফজলুর সঙ্গে দেখা হতে আসগর জিজ্ঞেস করল, গ্রামের লোকজন যে কথা বলছে, তা কি সত্য?

মাতব্বর ফজলুকে শিখিয়ে দিয়েছিলেন, কেউ যদি তোকে সায়রার ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করে, তাহলে বলবি সায়রাকে বিয়ে করবি। তাই যখন তখন ওদের ঘরে যাস।

আসগর জিজ্ঞেস করতে মাতব্বরের শেখান কথা ফজলু বলল। আসগর খুব রেখে গেলেও সংযত কণ্ঠে আবার জিজ্ঞেস করল, সায়রা তোকে নিকে করতে চায়?

হ্যাঁ, চায়। তা না হলে আমাকে রাতে থাকতে দেয় কেন? ঠিক আছে, তুই যা বলে ঘরে এসে এক ফাঁকে সায়রাকে বলল, তুই নাকি খোঁড়া ফকির ফজলুকে নিকে করতে চাস?

গ্রামময় লোকজন বলাবলি করলেও এ পর্যন্ত সায়রার কানে পড়ে নি। আসগরের মুখে শুনে সায়রার পিত্তি জ্বলে উঠল। বলল, কে একথা বলেছে?

কে আবার বলবে? সারা গ্রামের লোক বলাবলি করছে।

তুমি কার কাছে শুনেছ?

ল্যাংড়া ফকির ফজলুর কাছে। সে নিজেই গ্রামের সবাইকে বলে বেড়াচ্ছে?

এতদিনে সায়রা বুঝতে পারল, ফজলু ভাই কেন তার ভিক্ষে করা জমান টাকা দিয়ে তার চিকিৎসা করিয়েছে? চিকিত্সা করার টাকা ফেরত দিতে কেন সে নেয় নি? কেন সে প্রতিদিন তার কাছে আসে?

তাকে চুপ করে থাকতে দেখে আসগর বলল, তুই পরীর মতো দেখতে। আর ফজলু দেখতে চামচিৎকার মতো। তা ছাড়া সে ল্যাংড়া, শরীরের হাড় পাঁজরা দেখা যায়, তাকে নিকে করলে লোকজন তোকে ছি ছি করবে। তার চেয়ে আমার সঙ্গে নিকে বস। আমার কাছে খেয়ে পরে সুখে থাকবি। তোর ছেলেটাও খেয়ে পরে মানুষ হবে। আর শোন, লোকজনের কাছে কথাটা বেশি জানাজানি হওয়ার আগে তোকে নিকে করতে চাই।

সায়রা তখন চিন্তা করছিল, মাতব্বর ফজলুকে দিয়ে ফাঁদ পেতে তাকে জব্দ করতে চায়। আজ ফজলু এলে তাকে কি করবে না করবে ভাবছিল।

সায়রা কিছু না বলে মুখ নিচু করে রয়েছে দেখে আসগর ভাবল; সে তাকে নিকে করতে রাজি। চারদিকে তাকিয়ে কেউ নেই দেখে জড়িয়ে ধরে বলল, তুই কিছু চিন্তা করিস না। একবার শুধু হা বল, দেখবি আমি তোকে এক দু’দিনের মধ্যে নিকে করে ঘরে না তুলেছি তো আমার নাম আসগর না।

সায়রা ধাক্কা দিয়ে তাকে সরিয়ে বলল, মিয়া ভাই, আমাকে জড়িয়ে ধরতে সরম করল না?

আসগর বলল, আমি তো আর তোর আপন মিয়া ভাই নই। আপন ছাড়া যে কোনো সম্পর্কে বিয়ে করা যায়। চিররুগী বলে তোর ভাবি আমাকে কিছুই দিতে পারে না। তোকে নিকে করলে তুই আমাকে সবকিছু দিতে পারবি বলে আবার জড়িয়ে ধরে চুমো খেতে গেল।

সায়রা তার গালে একটা চড় মেলে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে ছুটে সেখান থেকে নিজের ঘরে চলে এল। বিকেলে আর কাজ করতে গেল না। সিদ্ধান্ত নিল, খেতে না পেয়ে মরে গেলেও ওদের ঘরে কাজ করতে যাবে না।

আজ ভিক্ষে করে ফেরার পথে মাতব্বরের সঙ্গে দেখা হতে ফজলু বলল, আপনার কথামতো কাজ করেছি। গ্রামের লোকজন সায়রার সঙ্গে আমার সম্পর্কের কথা জেনে গেছে। এবার আমাদের বিয়ের ব্যবস্থা করবেন না?

মাতব্বর মৃদু হেসে বললেন, হ্যাঁ, এবার তোদের বিয়ের ব্যবস্থা করব।

আপনি কিন্তু বিয়ের আগে নতুন ঘর করে দেবেন বলেছিলেন?

যা যা বলেছি সব ব্যবস্থাই করব। তার আগে তোকে একটা কাজ করতে হবে।

বলুন কি কাজ?

কাজ কিছু না। এখন আমি তোকে যা কিছু শেখাব বিচারের সময় সবার সামনে তুই সেগুলো বলবি।

বিচারের কথা শুনে ফজলু ভেবাচেকা খেয়ে গেল। বলল, কিসের বিচার? কার বিচার?

সে কথা তোর জানার দরকার নেই? শুধু শুনে রাখ, বিচারের মাধ্যমেই তোর বিয়ের ব্যবস্থা হবে।

বিচারের মাধ্যমে কথাটা শুনে ফজলু মনে করল, বিচারের লোকজনের সামনে তাদের বিয়ে হবে। তাই খুশী হয়ে বলল, লোকজনের সামনে কি বলতে হবে শিখিয়ে দেন।

কি বলতে হবে মাতব্বর তাকে বুঝিয়ে বললেন।

মাতব্বরের কথা শুনে ফজলুর মন খুশীতে নেচে উঠল। বলল, ঠিক আছে হুজুর, তাই বলব। তারপর হাঁটতে শুরু করে ভাবল, সায়রার সঙ্গে দেখা করে ঘরে যাবে। আবার ভাবল, সে তো এখন ঘরে নেই। কাজ থেকে সন্ধ্যের সময় আসে। তবু মনের তাগিদে সায়রাদের ঘরে এসে তাকে দেখে বলল, আজ কাজে যাও নি?

সায়রা ফজলুর উপর ভীষণ রেগেছিল। তার কথার উত্তর না দিয়ে ঘর থেকে টাকার পুঁটলীটা এনে তার হাতে দিয়ে বলল, এখুনি চলে যাও। আর কোনো দিন আসবে না।

সায়রা টাকা ফেরত দিতে ও তার কথা শুনে ফজলুর মন খুব খারাপ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ কোনো কথা বলতে না পেরে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, যখন দরকার হবে তখন চেয়ে নেব বলেছি। এখন দিচ্ছ কেন? আর আমাকেই বা আসতে নিষেধ করলে কেন?

সায়রা রাগ চেপে রেখে বলল, গ্রামের লোকজন তোমাকে নিয়ে আমার নামে বদনাম করছে শোন নি?

ফজলু মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, ও এই কথা? যা সত্য, গ্রামের লোকজন সেটাই বলছে। এটা আবার বদনাম হবে কেন?

সত্য আবার কি? তুমি কি মনে করেছ? আমি তোমার সঙ্গে নিকে বসব?

হ্যাঁ, আমি তাই মনে করেছি।

তা হলে তুমিই গ্রামে কথাটা প্রচার করেছ?

আমি করতে যাব কেন? গ্রামের লোকজনের কি চোখ নেই। রোজ রোজ তোমার ঘরে দিন রাত আসি, তা কি তারা দেখতে পায় না? মাতব্বর হুজুরের কানেও কথাটা গেছে। আজ ফেরার সময় আমাকে জিজ্ঞেস করলেন। আমি বললাম, কথাটা সত্য। শুনে খুশী হয়ে বললেন, তা হলে দু’একদিনের মধ্যে তোদের বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।

সবকিছু যে মাতব্বরের পাতা ফাঁদ তা সায়রার দৃঢ় বিশ্বাস হল। নিজের বোকামির জন্য রাগে ও দুঃখে সায়রা কেঁদে ফেলল। অল্পক্ষণের মধ্যে সামলে নিয়ে বলল, তুমি যা ভেবেছ, তা ঠিক নয়। আমি তোমাকে ভায়ের মতো মনে করে তোমার সাহায্য নিয়েছি। যদি জানতাম মাতব্বরের কথামতো কাজ করছ, তা হলে অসুখে মরে গেলেও তোমার সাহায্য নিতাম না।

ফজলু বলল, মাতব্বরের কথা বাদ দাও। আমি তোমাকে নিকে করব, তুমি রাজি আছ কিনা বল?

সায়রা খুব রাগের সঙ্গে বলল, আমাকে যে নিকে করবে, খাওয়াবে কি? ভিক্ষে করে মায়ে পুতে দু’বেলা খেতে পাও না। তা ছাড়া তোমার যা সুরৎ, তোমার দিকে চাইতেই ঘেন্না লাগে। চলে যাও এখন থেকে। আবার যদি আস, তা হলে কি করি তখন দেখবে।

এবার ফজলুও খুব রেগে গেল। চড়া গলায় বলল, এই মাগি, তেজ দেখাবি। তোর তেজ না ভেঙেছি তো আমার নাম ফজলু না।

সায়রাও চড়া গলায় বলল, তেজ ভাঙতে এসে দেখিস, মাতব্বরের মতো তোর অবস্থা না করিতো আমার নামও সায়রা না।

এই কথা শুনে ফজলু চুপসে গেল। আর কিছু না বলে চলে গেল।

পরের দিন ভিক্ষে করতে বেরিয়ে ফজলু মাতব্বরের সঙ্গে দেখা করে গতকাল সায়রা যা কিছু বলেছিল বলল।

মাতব্বর রেগে গিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, ঐ মাগির কত তেজ দেখব। তুই চিন্তা করিস না। যেমন করে হোক তোর সঙ্গে ওর নিকে দেবই। তুই এখন যা। ভেবে দেখি কিভাবে কি করা যায়।

.

সায়রার কথা শুনে ও তার হাতের চড় খেয়ে আসগর প্রতিজ্ঞা করেছিল, যেমন করে হোক প্রতিশোধ নেবে। কিভাবে নেবে ঠিক করতে না পেরে মাতব্বরের কাছে গেল।

ফজলু চলে যাওয়ার পর মাতব্বর কিভাবে তার সঙ্গে সায়রার নিকে দেবেন বৈঠক খানায় বসে চোখ বন্ধ করে চিন্তা করছিলেন?

আসগার এসে সালাম দিল।

মাতব্বর চোখ খুলে আসগরকে দেখে সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, কি খবর ভাতিজা?

খবর আর কি? গ্রামের লোকজন ফজলু আর সায়রাকে নিয়ে যেসব কথা বলছে, তা কি আপনার কানে পড়ে নি?

পড়েছে। তাই তো চিন্তা করছিলাম কি করা যায়?

আপনি হলেন গ্রামের মাথা। আপনি যা করবেন সেটা সবাই মানতে বাধ্য।

আমি চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, একদিন গ্রামের লোকজনদের ডেকে ওদের রিচারের ব্যবস্থা করব এবং সবার মতামত নিয়ে বিচারের রায় ঘোষণা করব।

হ্যাঁ চাচা, যত তাড়াতাড়ি পারেন সেই ব্যবস্থাই করুন।

দু’একদিনের মধ্যে কবর। তুমি এখন যাও। বিচারের রায়ের ব্যাপারে আমি এখন চিন্তা করব।

৩-৪. মাতব্বর সাহেবের বৈঠকখানা

০৩.

আজ মাতব্বর সাহেবের বৈঠকখানার সামনের চাতালে সায়রা ও ফজলুর বিচার হবে। এশার নামাযের পর গ্রামের লোকজন এসেছে। অনেক বয়স্ক মেয়েরাও এসেছে। তারা বৈঠকখানার ভিতরে বসেছে।

মসজিদের ইমাম সাহেবকে খবর দেয়া হয়েছিল। তিনিও এসেছেন। ফজলু মাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছে। সায়রা এখনো আসে নি। তাকে ডাকতে একজনকে পাঠানো হয়েছে। মাতব্বর ইমাম সাহেবকে ঘটনাটা বলা শেষ করেছেন, এমন সময় সায়রা মাথায় ঘোমটা দিয়ে ছেলের হাত ধরে এসে বৈঠকখানার একপাশে দাঁড়াল।

তাকে দেখে একজন বলে উঠল, মাতব্বর সাহেব, এবার বিচার শুরু করুন।

মাতব্বর ফজলুকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করলেন, গ্রামের লোকজন বলছে মঈন সেখের বিধবা বৌ–সায়রার সঙ্গে তোর অবৈধ সম্পর্ক রয়েছে, কথাটা কি সত্য?

ফজলু অবৈধ সম্পর্ক কি জিনিস জানে না। তবু মাতব্বরের শেখান কথা বলল, হ্যাঁ সত্য।

এটা ইসলামে নিষেধ। তাই তোকে কঠিন শাস্তি পেতে হবে।

আপনারা যা শাস্তি দেবেন মাথা পেতে নেব।

মাতব্বর এবার সায়রাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, এই ব্যাপারে তুই কি বলবি?

সায়রা বলল, আমি আর কি বলল? বললেও আপনারা বিশ্বাস করবেন না।

ইমাম সাহেব বললেন, আমরা বিশ্বাস করি আর না করি তুমি বল।

সায়রা বলল, তা হলে শুনন, ঐ লম্পট মাতব্বর প্রথমে আমাকে বিয়ে করার জন্য রহিমন দাদিকে আমার কাছে পাঠিয়েছিল। আমি রাজি হয় নি বলে এক গভীর রাতে আমার ঘরে ঢুকে ইজ্জতের উপর হামলা করেছিল। আমি তখন কি করেছিলাম আপনারা জানেন। হাসপাতাল থেকে ফিরে আমাকে শায়েস্তা করার জন্য ফজলুকে দিয়ে গ্রামে মিথ্যে বদনাম ছড়িয়ে আজ বিচারের ব্যবস্থা করেছেন। ফজলুর সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক গড়ে উঠে নি। তবে আমার অসুখের সময়। ফজলু ও তার মা আমাকে সেবা করে ভালো করেছে। এরপর থেকে ফজলু আমার ঘরে যাতায়াত করত। কয়েকদিন আগে আমাকে বিয়ে করার কথা বলায় তাকে আমার ঘরে আসতে নিষেধ করে দিই। তারপর থেকে সে আর আসে নি। ফজলু এখন যে কথা বলল, তা মাতব্বরের শেখান বুলি। আপনারা বিশ্বাস করেন আর নাই করেন, যা সত্য তাই বললাম।

কেউ কিছু বলার আগে মাতব্বরের একজন চামচা সামসু বলল, আমি ও শাকিল যে একরাতে তোর ঘরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ঘরের ভিতর পুরুষ মানুষের গলা পেয়ে বেড়া ফাঁক করে তোদর দু’জনকে কুকর্ম করতে দেখলাম, সেটাও কি মিথ্যে?

সায়লা বলল, হ্যাঁ মিথ্যে। এই কথাটাও মাতব্বর সাহেব তোমাকে বলতে শিখিয়েছে। আমি আল্লাহর কসম কেটে বলছি। কুকর্ম করা তো দূরের কথা, ফজলু আমার গায়ে কোনো দিন হাতও দেয় নি।

ইমাম সাহেব শাকিলকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমিও এই ঘটনা দেখেছ?

শাকিল বলল, হ্যাঁ দেখেছি।

ইমাম সাহেব এবার ফজলুকে জিজ্ঞেস করলেন। সামসু ও শাকিল যে কথা বলল, তা কি সত্য?

ফজলু বলল, জি হুজুর সত্য।

এবার মাতব্বর লোকজনদের উদ্দেশ্য করে বললেন। তোমরাতো নিজেরা সবকিছু শুনলে। এখন তোমাদের উপরেই বিচারের রায় ছেড়ে দিলাম।

সবার আগে করিম সেখের বড় ছেলে আসগর বলল, ওদের দুজনকে পাথর মেরে মেরে ফেলা হোক।

তার কথা শুনে মাতব্বরের লোকজন বলে উঠল, হ্যাঁ, তাই করা হোক।

গ্রামের বেশিরভাগ লোক বুঝতে পারল, সায়রা লম্পট মাতব্বরের লিঙ্গ কেটে দিয়েছে বলে মাতব্বরই মিথ্যে বদনাম দিয়ে তাকে শাস্তি দেয়ার জন্য এই বিচারের। ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু তারা গরিব বলে কেউ প্রতিবাদ করতে সাহস পেল না।

গতকাল আবু তাহের নামে এক লোক ভাইরা মুসার বাড়িতে বেড়াতে এসেছেন। তিনি একজন আলেম। শহরের এক মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন। ভাইরা মুসার সঙ্গে তিনিও বিচার শুনতে এসেছেন।

বিচারের রায় শুনে কেউ যখন কোনো প্রতিবাদ করল না তখন তিনি দাঁড়িয়ে বললেন, রায় ইসলামী আইন অনুসারে হয়েছে, কিন্তু এই আইন সাধারণ মানুষকে প্রয়োগ করার ক্ষমতা ইসলাম দেয় নি। কেবল মাত্র ইসলামী রাষ্ট্রের যিনি প্রধান, তিনিই এই আইন প্রয়োগ করতে পারেন। তা ছাড়া মাতব্বরের ব্যাপারে বিবাদিনী যা কিছু বললেন, সে ব্যাপারে সত্য মিথ্যা যাচাই করে সেটার বিচার আগে করা উচিত।

আবু তাহেরের কথা শুনে মাতব্বর খুব রেগে উঠে বললেন, কে তুমি? তোমাকে এই গ্রামের লোক বলেতো মনে হচ্ছে না।

আবু হাতের বললেন, আমি আপনাদের গ্রামের মুসার ভাইরা। পটুয়াখালী শহরে বাড়ি। গতকাল বেড়াতে এসেছি।

তা এখানে এসেছেন কেন? যান, ভাইরার ঘরে যান। তারপর মুসাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, মেহমানকে নিয়ে চলে যাও।

মুসার অবস্থা স্বচ্ছল। তবে খুব সহজ সরল লোক। গ্রামের সাতে পাঁচে নেই। সায়রার ব্যাপারটা জানে বলে তার বিচারের রায় শোনার জন্য এসেছে। মাতব্বরের স্বভাব চরিত্র জানে। তাই তার কথা শুনে প্রতিবাদ না করে ভাইরার একটা হাত ধরে বলল, আমরা ঘরে যাই চলুন।

আবু তাহের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, বিচারের শেষ দেখে তবে যাব।

মাতব্বর বললেন, তা হলে চুপচাপ বসে থাকুন, একটা কথা বলবেন না। তারপর ইমাম সাহেবকে বললেন, রায়টা আপনি ঘোষণা করুন।

ইমাম সাহেবের বাড়িও পটুয়াখালী শহরে। তিনি আবু তাহেরকে চেনেন। তাই মাতব্বর অনেক টাকা দিয়ে যে রায় দিতে বলেছিলেন। তা বলতে পারলেন না। কিছুক্ষণ চিন্তা করে আবু তাহেরকে দেখিয়ে বললেন, উনি মস্ত বড় আলেম। উনি ঠিক কথা বলেছেন। তবে এক কাজ করতে পাবেন। ওদের দুজনের বিয়ে দিয়ে দেন। তারপর মাতব্বরের কানের কাছে ফিসফিস করে বললেন, আপনার ঘটনাটি গ্রামের সবাই জেনে গেছে। আপনার উপর সবাই খুব অসন্তুষ্ট। এখন বিচারের রায় নিয়ে বেশি কচলাকচলি করা ঠিক হবে না। নচেৎ লোকজন আপনারও বিচার করতে চাইবে।

ইমাম সাহেবের কথা শুনে মাতব্বর আর দেরি করল না। বললেন, আমিও এই রায় ঘোষণা করছি।

পাথর মেরে মেরে ফেলার কথা শুনে ফজলুর কলজে শুকিয়ে গিয়েছিল। ইমাম সাহেব ও মাতব্বরের রায় শুনে কলজেয় পানি এল। সেই সঙ্গে খুশীতে মন নাচতে লাগল।

ফজলুর মা জয়তুন বিবিরও ছেলের মতো অবস্থা।

আর সায়রা রাগে ও দুঃখে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে সবার অলক্ষ্যে ছেলের হাত ধরে চলে আসার সময় শুনতে পেল, মাতব্বর বলছে, কালই আমি ওদের বিয়ের ব্যবস্থা করব।

বিচার বসেছিল এশার নামাযের পর। মাতব্বর হ্যাজাক লাইটের ব্যবস্থা করেছিলেন। সেটা লোকজনের সামনে ছিল। সায়রা ছেলেকে নিয়ে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, সেখানটা অন্ধকার মতো ছিল। তাই সে যখন ছেলেকে নিয়ে চলে আসে তখন কেউ জানতে পারল না।

ঘরে এসে সায়রা কাঁদতে কাঁদতে বলল, আল্লাহগো, তুমি আমাকে আর কত দুঃখ দেবে? আমি যে সহ্য করতে পারছি না। তারপর নিজের ও ছেলের কাপড় চোপড় জমা করে একটা পুঁটলি বাঁধতে লাগল।

হালিম সাত আট বছরের ছেলে। সবকিছু বুঝতে না পারলেও একটু একটু বুঝে। কিছুদিন আগে পাড়ার সমবসয়ী রজবের সঙ্গে যখন খেলা করছিল তখন রজবের বড় ভাই তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, তোর মা যখন মাতব্বরের ধো*ন কেটে নেয় তখন তুই কোথায় ছিলি?

ধো*ন কি জিনিস হালিম জানে। তাই লজ্জা পেয়ে কিছু না বলে সেখান থেকে পালিয়ে এসেছিল। আসার সময় তার মনে হয়েছিল, তাই বুঝি সেদিন মায়ের কাপড়ে, বিছানায় ও ঘরের মেঝেয় অত রক্ত দেখেছে।

আজ বিচারে গিয়ে বুঝতে পেরেছে মাতব্বর ফজলু চাচার সঙ্গে মায়ের বিয়ে দিতে চায়। ঘরে এসে মাকে কাঁদতে দেখে বলল, এখন কি হবে মা? তুমি কি ফজলু চাচাকে বিয়ে করবে? ও ল্যাংড়া। সবাই ল্যাংরা চামচিকা বলে। ওকে আমি বাবা বলতে পারব না। আমরা এখান থেকে অন্য কোথাও চলে যাই চল মা।

ততক্ষণ সায়রার পুঁটলি বাঁধা হয়ে গেছে। চোখ মুছে বলল, ঐ ল্যাংড়া চামচিকাকে বিয়ে করার চেয়ে গলায় দড়ি দিয়ে মরাও ভালো।

হালিম মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, তুমি মরে গেলে আমার কি হবে! কাকে আমি মা বলে ডাকব?

সায়রা পুঁটলিটা এক হাতে নিয়ে অন্য হাতে হালিমের হাত ধরে বলল, তোর জন্যই তো মরতে পারছি না। নচেৎ কবেই গলায় দড়ি দিতাম। তারপর হাঁটতে শুরু করে বলল, আমরা অনেক দূরে এমন জায়গায় যাব, যেখানে মাতব্বরের মতো বদমাইশ লোক নেই। সেখানে লোকের ঘরে ঘরে কাজ করে তোকে লেখাপড়া করিয়ে মানুষ করব। তুই মানুষ হয়ে একদিন এই গ্রামে ফিরে এসে মাতব্বরকে শায়েস্তা করে তোর মায়ের উপর অত্যাচারের প্রতিশোধ নিবি।

হালিম বলল, তুমি দেখে নিও মা। আমি বড় হয়ে তোমার কথা মতো সবকিছু করব।

পরের দিন সকালে ফজলুকে আসতে দেখে মাতব্বর বললেন, কিরে ফজলু, সায়রাকে বিয়ে করার জন্য মন বুঝি আর তর সইছে না? এত সকালেই এসে পড়েছিস দেখছি?

ফজলু স্লান মুখে বলল, কাকে বিয়ে করব? সায়রাতো কাল রাতেই ছেলেকে নিয়ে চলে গেছে।

বিচার শুরুর আগে মাতব্বর ইমাম সাহেবকে বলেছিলেন, আমার লোকেরা পাথর মেরে মেরে ফেলার কথা বলবে। গ্রামের লোকজন যদি আপত্তি না করে তা হলে সায়রাকে ঐ শাস্তি দেয়ার কথা বলবেন। ফজলুকে বাঁচাবার ব্যবস্থা আমি করব। আর গ্রামের লোকজন যদি আপত্তি করে, তা হলে ওদের বিয়ে দেয়ার কথা বলবেন। তাই আবু তাহেরের কথা শুনে ইমাম সাহেব ওদের বিয়ে দেয়ার কথা বলছেন। মাতব্বরের দৃঢ় ধারণা ছিল, সায়রা কিছুতেই ফজলুকে বিয়ে করবে না। রাতের মধ্যে হয় বিষ খাবে, নচেৎ গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করবে।

এখন ফজলুর কথা শুনে মাতব্বরের মনে হল, সায়রা যেন তার গালে পায়ের জুতো খুলে মেরে খিলখিল করে হেসে বলছে, লম্পট মাতব্বর, সেদিন তোর পুরুষাঙ্গ কেটেছি, আর আজ তোর গালে মুতে দিয়ে চলে গেলাম।

এইসব মনে হতে মাতব্বর রেগে লাল হয়ে কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলেন না। বড় বড় চোখ বের করে ফজলুর দিকে তাকিয়ে রইলেন।

তাই দেখে ফজলু ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল, এতে আমার কি দোষ? ঐ শালী রাতের বেলা পালিয়ে যাবে জানলে সারারাত ওর ঘর পাহারা দিতাম।

মাতব্বর রাগের সঙ্গে বললেন, তুই এখান থেকে দূর হয়ে যা।

তার উপর মাতব্বর রেগে গেল কেন ফজলু বুঝতে পারল না। খোঁড়াতে খোঁড়াতে চলে গেল।

এমন সময় করিম সেখের বড় ছেলে আসগর এসে বলল, চাচা শুনেছেন, সায়রা ছেলেকে নিয়ে রাতেই পালিয়ে গেছে?

মাতব্বরের রাগ তখনও পড়ে নি। গম্ভীর স্বরে বললেন, পালিয়ে যাবে কোথায়? যেখানেই যাক না কেন, ধরে এনে কি করি সবাই দেখবে। ওকে ধরে আনার জন্য লোক লাগাচ্ছি, তুমিও তাই কর।

আসগর বলল, আপনি না বললেও ওকে খোঁজার ব্যবস্থা করতাম। এই কথা বলে চলে গেল।

মাতব্বর চামচাদের দ্বারা সায়রাকে ধরে আনার জন্য খোঁজ করলেও তার নাম গন্ধও পেল না। শেষে মাতব্বর মঈন সেখের বাস্তুভিটে দখল করে ফলের বাগান করলেন।

.

সে সব বিশ বাইশ বছর আগের কথা। এখন মাতব্বর বুড়ো হয়ে গেছেন। তার একমাত্র ছেলে রশিদের বিয়ে দিয়েছেন। দু’তিনটে পোতা-পুতিনের দাদা হয়েছেন। রশিদ পুরো বাপের চরিত্র পেয়েছে। কোনো মেয়ে চোখে ধরলে তাকে যেমন করে তোক ভোগ করবেই। মাতব্বর ছেলের দুশ্চরিত্রের কথা জেনেও নিজের কথা ভেবে তাকে কিছু বলতে পারেন না। টাকা পয়সা দিয়ে ছেলের অপকর্ম চাপা দেয়ার চেষ্টা করেন।

আজ কয়েকজন লোক রক্তাক্ত রসিদকে ধরাধরি করে তাদের বৈঠকখানায় নিয়ে এলে মাতব্বর ছেলের অবস্থা দেখে হায় হায় করে উঠে বললেন, কোন হারামির বাচ্চা এমন কাজ করল?

লোকজনের মধ্যে মাতব্বরের চাকর জয়নুদ্দিন বলল, আমি গাভীর জন্য বাগানের পুকুর পাড়ে ঘাস কাটতে গিয়ে ওনাকে বেহুঁশ হয়ে পড়ে থাকতে দেখে লোকজন ডেকে নিয়ে এলাম।

মাতব্বর তাড়াতাড়ি রসিদকে সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে নিজেও সঙ্গে গেলেন। থানার পাশ থেকে হাসপাতাল যাওয়ার পথ। তাই মাতব্বর ভাবলেন, প্রথমে থানায় গিয়ে ছেলেকে দেখিয়ে কেস করবেন। তারপর হাসপাতালে নিয়ে যাবেন।

দারোগা আলি হোসেনের সঙ্গে মাতব্বরের খুব খাতির। পুকুরের বড় মাছ, বাগানের ফল পাকাড়ী ও তরীতরকারী পাঠিয়ে দেন। তাছাড়াও ঈদ বকরীঈদে টাকা পয়সাও দেন। তাই বাহেরচর গ্রামের কোনো ব্যাপারেই দারোগা নাক গলান না। কেউ কোনো ব্যাপারে থানায় কেস করতে গেলে কেস না নিয়ে মাতব্বরের কাছে পাঠিয়ে দেন।

থানায় এসে মাতব্বর আলি হোসেনকে দেখতে না পেয়ে একজন পুলিশকে জিজ্ঞেস করলেন, আলি হোসেন দারোগা কোথায়?

পুলিশ মাতব্বরকে চেনে। বলল, ওনাকে হঠাৎ অন্য থানায় বদলী করা হয়েছে। ওনার জায়গায় অন্য একজন এসেছেন।

ওনার নাম কি?

হালিম।

উনি কোথায়?

উনি ভিতরের রুমে কাজ করছেন। আপনি বসুন আমি ডেকে নিয়ে আসছি।

এখন বসার সময় নেই। ছেলের অবস্থা দেখছেন না? হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। ওনাকে তাড়াতাড়ি ডাকুন।

হালিম দারোগা এসে সালাম বিনিময় করে রসিদের অবস্থা দেখে বললেন, ওনার এরকম অবস্থা কে করল?

মাতব্বর বললেন, কে করেছে আপনি খুঁজে বের করবেন। সেইজন্য তো কেস করতে এলাম। যা কিছু করার তাড়াতাড়ি করুণ, ওকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।

হালিম দারোগা কেস লিখে জিজ্ঞেস করলেন, কাকে আপনার সন্দেহ হয়?

মাতব্বর বললেন, আমার ছেলের গায়ে হাত তোলার সাহস গ্রামের কোনো লোকেরই নেই। এখন আমি কারো নাম বলতে পারব না। ছেলেকে নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছি, ফিরে এসে আপনাকে খবর দেব, আপনি আসবেন। তখন বিস্তারিত আলাপ করব। এর মধ্যে আপনি তদন্ত শুরু করুন, কার দ্বারা এই কাজ হয়েছে। এখন আসি বলে লোকজনদের বললেন, রশিদকে ভ্যান গাড়িতে তোল, হাসপাতালে যেতে হবে। তারপর নিচু স্বরে বললেন, আসামীকে ধরতে পারলে মোটা পুরস্কার পাবেন।

.

০৪.

সাফিয়া দবিরের বড় মেয়ে। দবিরের আরো তিন চারটে ছেলেমেয়ে আছে। সে খুব গরিব। অন্যের খেতে খামারে কাজ করে সংসার চালায়। যেদিন কাজ হয় না, সেদিন সবাইকে নিয়ে উপোস থাকে। পাঁচ ছয় বছর আগে গ্রামে প্রাইমারী স্কুল হলেও অভাবের কারণে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করানোর কথা ভাবতেই পারে নি। সাফিয়া দেখতে শুনতে ভালো, স্বাস্থ্যও ভালো। বয়স প্রায় বিশ বছর। দবির অনেক চেষ্টা-চরিত্র করে বছর দেড়েক আগে পাশের গ্রামের হারেসের ছেলে হান্নানের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিল। বিয়ের সময় জামাইকে পাঁচ হাজার টাকা যৌতুক দেয়ার কথা থাকলেও সব টাকা দবির দিতে পারে নি। বলেছিল, কিছু দিনের মধ্যে বাকিটা দিয়ে দেবে। কিন্তু এক বছর হয়ে যাওয়ার পরও যখন দিতে পারল না তখন জামাই ও তার মা-বাবা বৌকে মারধর করে বাপের কাছ থেকে টাকা নিয়ে আসার জন্য পাঠায়। সাফিয়া জানে, বাবা দিতে পারবে না। তবু কয়েকবার এসেছে। দবির মেয়ের উপর অত্যাচারের কথা জেনেও দিতে পারে নি। সাফিয়া বাপের দুবরস্থার কথা জেনে শ্বশুর বাড়ির অত্যাচার সহ্য করে স্বামীর ঘর। করছিল। শেষে যখন তারা মারধর করে ঘর থেকে বের করে দিয়ে বলে দেয় টাকা যদি না নিয়ে আসিস, তা হলে তোকে তালাক দিয়ে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে ছেলের আবার বিয়ে দেব। সেই থেকে আজ চার পাঁচ মাস হল মা বাপের সংসারে রয়েছে।

সাফিয়া লেখাপড়া না করলেও বেশ চালাক চতুর। সাবালক হওয়ার পর বাইরে বেরোলে সবাই যে তার দিকে তাকিয়ে থাকে বুঝতে পারে। তাই খুব। দরকার না হলে ঘরের আশপাশ ছাড়া দূরে কোথা যায় না।

দবির ও তার বৌ হাজরা মাতব্বরের ছেলে রশিদের স্বভাব চরিত্রের কথা জানে। তাই তারাও মেয়েকে বড় একটা বাইরে যেতে দেয় না। তবু একদিন সাফিয়া রসিদের সামনে পড়ে গিয়েছিল। সে দিন হাজেরার খুব জ্বর থাকায় সাফিয়াকে মাতব্বরের পুকুরে থেকে পানি আনতে পাঠিয়েছিল। পানি নিয়ে ফেরার সময় রসিদের সামনে পড়ে যায়।

রশিদ তখন বাইরে থেকে ঘরে ফিরছিল। সাফিয়াকে দেখে পথ আগলে বলল, তুই দবিরের মেয়ে না?

রশিদকে দেখে সাফিয়ার বুক ভয়ে ধুকধুক করতে লাগল। কোনোরকমে বলল, হ্যাঁ।

রশিদ বলল, বিয়ের পর তুই আগের থেকে আরো বেশি সুন্দরী হয়েছিস। তারপর জিজ্ঞেস করল, তুই রোজ আমাদের পুকুর থেকে পানি নিতে আসিস?

সাফিয়া বলল, না, মা নিয়ে যায়। আজ তার খুব জ্বর, তাই আমি এসেছি।

রশিদ বলল, তোর মা পানি নিতে আসে। তার কষ্ট হয় না? এবার থেকে তুই আসবি বুঝলি?

সাফিয়া কিছু না বলে পাশকেটে চলে এসেছিল। তারপর থেকে সে আর কোনো দিন মাতব্বরের পুকুর থেকে পানি আনতে যায় নি।

মেয়ে স্বামীর ঘর থেকে চলে আসায় দবির খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে। মাতব্বরের ছেলে রশিদের কথা ভেবে। তাই তাকে বাইরে কোথাও যেতে নিষেধ করে দিয়েছে।

গত দুদিন দবির কাজ পাই নি। তাই তার ঘরে দুদিন হাঁড়িও চড়ে নি। আজ খা পড়ায় একজনের কাজে গেছে।

দুপুরের দিকে ছোট ছেলেমেয়েদের কান্না সহ্য না করতে পেরে হাজেরা সন্ধ্যের সময় দিয়ে যাবে বলে পাড়ার সুবেদ আলি চাচার বৌ-এর কাছ থেকে এক কেজি চাল ধার নিয়ে এসে সাফিয়াকে বলেছিল, যাতো মা, মাতব্বরের পুকুর পাড় থেকে কিছু কলমী শাক নিয়ে আয়। শুধু নুন ভাত কি করে তোরা খাবি।

সাফিয়ার তখন রশিদের কথা মনে পড়তে বলল, সেদিন পানি আনতে গিয়ে মাতব্বরের ছেলের সামনে পড়ে গিয়েছিলাম। তাকে দেখলে আমার খুব ভয় করে।

অন্য সময় হলে হাজেরা মেয়ের কথা বুঝতে পারত। তাকে না পাঠিয়ে নিজেই যেত, কিন্তু দু’দিন পেটে কিছু পড়েনি তার উপর গায়ে জ্বর। তাই বুঝতে না পেরে রাগের সঙ্গে বলল, মাতব্বরের ছেলে কি তোকে গিলে খেয়ে ফেলবে? যা বললাম কর।

সাফিয়া মাকে রেগে যেতে দেখে আর কিছু না বলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও শাক তুলতে গিয়েছিল।

হাজেরা মেয়েকে কাঁদতে কাঁদতে খালি হাতে ফিরে আসতে দেখে জিজ্ঞেস করল, কাঁদছিস কেন? কি হয়েছে?

সাফিয়া চোখের পানি ফেলতে ফেলতে ঘটনাটা বলে বলল, বুড়ো লোকটা এসে না রক্ষা করলে আমাকে গলায় দড়ি দিতে হত।

হাজেরা বলল, আল্লাহ বুড়ো লোকটার ভালো করুক। তারপর আবার বলল, রশিদ বুড়োটাকে কিছু বলে নি?

তা আমি কি করে বলব? উনি রশিদের ঘাড় এমন জোরে ধরেছিল, রশিদ নড়াচড়া করতে পারে নি। জান মা, লোকটাকে দেখে মনে হল, যেন ফেরেস্তা। লম্বা চওড়া, মুখ ভর্তি দাড়ি, ফরসা টকটকে দেখতে কি সুন্দর। আমাকে বলল, তুমি ঘরে চলে যাও, এ আর কোনোদিন তোমার দিকে চোখ তুলে তাকাবে না।

হাজেরা কিছুক্ষণ অবাক হয়ে মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে থেকে বলল, এরকম লোকতো এ তল্লাটে কখনও দেখি নি। মনে হয়, দূরের অন্য কোনো গ্রামের মানুষ ঐ পথ দিয়ে যাচ্ছিল।

সন্ধ্যাবেলা দবির ফিরে এলে হাজেরা স্বামীকে ঘটনাটা জানাল।

শুনে দবির খুব রেগে উঠে বলল, ওকে বাইরে পাঠাতে তোমাকে নিষেধ করেছি না? আর কনোদিন পাঠাবে না। তারপর মেয়েকে রাগারাগি করে বলল, তোকেও তো বাইরে যেতে নিষেধ করেছি। তবু গেলি কেন?

হাজেরা বলল, ও তো বাইরে যেতে চায় নি। আমিই জোর করে পাঠিয়েছি।

রাতে খাওয়ার পর ছোট ভাই-বোনেরা ঘুমিয়ে পড়লেও সাফিয়ার চোখে ঘুম নেই। সে দুপুরের ঘটনাটা ভাবছিল, বুড়ো লোকটা কে হতে পারে? মা বলল, এ তল্লাটে ওরকম লোক নেই। তা হলে আল্লাহ কি কোনো ফেরেস্তাকে পাঠিয়েছিল। আমার ইজ্জত রক্ষা করার জন্য।

দবির ও হাজেরার চোখেও ঘুম নেই। এক সময় দবির স্ত্রীকে বলল, রশিদের চোখে যখন সাফিয়া পড়েছে তখন আজ রক্ষা পেলেও পরে পাবে না। ওকে স্বামীর ঘরে পাঠিয়ে দেয়াই ভালো।

হাজেরা বলল, সে কথা আমিও ভাবছি। কিন্তু বাকি তিন হাজার টাকাটা না দিলে সাফিয়া কি যেতে চাইবে? না ওকে পাঠান ঠিক হবে? জামাই তো বলেই দিয়েছে, টাকা না নিয়ে এলে তালাক দিয়ে ফেরৎ পাঠিয়ে দেবে।

দবির একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে অনেকক্ষণ চুপ করে রইল।

হাজেরা বলল, কিছু বলছ না যে?

দবির আবার একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলল, ওর জন্য খুব চিন্তা হয়। জানি ওর ভাগ্যে কি আছে।

এমন সময় শুনতে পেল, বাইরে থেকে কেউ যেন বলছে, দবির ভাই কি ঘুমিয়ে পড়েছেন?

অচেনা গলা শুনে ভয়ে তাদের গলা শুকিয়ে গেল। দবির ও হাজেরা একে অপরের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল।

আবার শুনতে পেল, দবির ভাই, একটু বাইরে আসুন, কথা আছে।

স্বামী কিছু বলতে যাচ্ছে দেখে হাজেরা তার মুখে হাত চাপা দিয়ে ফিস ফিস করে বলল, নিশ্চয় রশিদের লোক। কথা বলো না, চুপ করে থাক।

রশিদ বৌ-এর হাতটা সরিয়ে দিয়ে বলল, কে তুমি?

নাম বললে আমাকে চিনবেন না। কোনো ভয় নেই। বাইরে আসুন।

এত রাতে এসেছ কেন? যা বলার দিনে এসে বলো।

দিনে আসতে পারব না। আপনি ভয় পাচ্ছেন কেন? আল্লাহর কসম খেয়ে বলছি, আমার কোনো খারাপ উদ্দেশ্য নেই। আপনার ভালোর জন্যই এসেছি। দু’একটা কথা বলেই চলে যাব।

লোকটা শুদ্ধ ভাষায় কথা বলছে শুনে রশিদ বৌকে বলল, রশিদের লোক হলে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলছে কি করে? মনে হয় ভিন গাঁয়ের লোক।

একটা ঘরের মধ্যেই সাফিয়া ভাইবোনের নিয়ে অন্য বিছানায় ঘুমায়। সেও লোকটার কথা শুনেছে। উঠে এসে মা বাবাকে অনুচ্চ স্বরে বলল, মনে হয় সেই বুড়ো লোকটা এসেছে।

দবির বলল, তোর একথা মনে হল কেন?

এই লোকের গলা ঠিক সেই বুড়ো লোকটার মতো।

কি হল ভাই আল্লাহর কসম কেটে বললাম, তবু বিশ্বাস হচ্ছে না?

দবির আর দেরি করল না। হারিকেনের পলতে বাড়িয়ে হাতে করে দরজা খুলে বেরিয়ে এল।

লোকটা এগিয়ে এসে সালাম দিল।

দবির সালামের উত্তর দিয়ে হারিকেন উঁচু করে বলল, কে আপনি? আপনাকে তো চিনতে পারছি না।

দরজার আড়াল থেকে মুখ বাড়িয়ে সাফিয়া তাকে দেখে ঠিক চিনতে পারল। গলা একই রকম হলেও এর দাড়ি ছোট ও কালো। সে লোকটার দাড়ি ছিল খুব লম্বা ও ধবধবে সাদা। তবে মুখটা যেন একইরকম মনে হল। ভাবল, তখন হয়তো ভুল দেখেছিলাম। তাই বাবার কাছে এসে বলল, উনিই আমাকে মাতব্বরের ছেলের হাত থেকে বাঁচিয়েছেন।

মেয়ের কথা শুনে দবিরের ভয় কেটে গেল। বলল, একটা পাটি এনে বিছিয়ে দে।

সাফিয়া ঘর থেকে একটা পাটি এনে বিছিয়ে দিতে দবিরর বলল, আপনি বসুন।

লোকটা বসে বলল, আপনিও বসুন। দু’চারটে কথা জিজ্ঞেস করব।

দবির বলল, আপনার পরিচয় আগে বলুন।

আমাকে আপনি করে বলবেন না। আমি আপনার চেয়ে বয়সে ছোট। আমার পরিচয় জানার দরকার নেই। যা বলছি শুনুন, তারপর সাফিয়াকে দেখিয়ে বলল, ওর জন্য কোনো দুশ্চিন্তা করবেন না। মনে হয়, মাতব্বরের ছেলের কি অবস্থা। হয়েছে তা আপনারা শোনেন নি। যে বুড়ো লোকটা আপনার মেয়ের ইজ্জৎ বাঁচিয়েছেন, তিনি মাতব্বরের ছেলের একটা হাত কেটে দিয়েছেন আর একটা চোখ তুলে নিয়েছেন। সে আর কোনো দিন কোনো মেয়ের দিকে নজর দেবে না। আমার কথা সত্য না মিথ্যা খোঁজ নিলেই জানতে পারবেন।

দবির মনে মনে খুশী হয়ে বলল, তোমাকে দেখে তো মনে হচ্ছে ভিন গাঁয়ের লোক। একথা তুমি জানলে কি করে? আর এত রাতেই বা আমাদের কথাটা জানাতে এসেছ কেন?

আমি সে সময় ওখান দিয়ে যাচ্ছিলাম, আপনার মেয়ের আর্তচিৎকার শুনে বাগানের ভিতর তাকাতে দেখতে গেলাম, মাতব্বরের ছেলে আপনার মেয়ের শালীনতাহানীর চেষ্টা করছে। পরক্ষণে দেখলাম, একটা বুড়োলোক মাতব্বরের ছেলের ঘাড় ধরে দাঁড় করিয়ে আপনার মেয়েকে চলে যেতে বললেন। আপনার মেয়ে চলে যাওয়ার পর বুড়ো লোকটা মাতব্বরের ছেলের প্রথমে একটা হাত কেটে দিল। তারপর তার একটা চোখ তুলে নিল।

দবির জিজ্ঞেস করল, কিন্তু তুমি তো ভিন গাঁয়ের লোক আমাদের ঘর চিনলে কি করে? আর মাতব্বরের ছেলেকেই বা চিনলে কি করে? ঘরে না গিয়ে এতক্ষণ ছিলেই বা কোথায়?

ওসব আপনার জানার দরকার নেই। এখন আমার কথার উত্তর দিন। মেয়ের। বিয়ে দেন নি কেন? সেয়ানা মেয়ে ঘরে রাখতে নেই, তা জানেন না?

দবির বলল, বিয়ে দিয়েছি। তারপর সাফিয়ার সব ঘটনা বলল।

আপনার মেয়ের নাম কি?

সাফিয়া।

জামায়ের নাম ঠিকানা বলুন। দবির নাম ঠিকানা বলার পর বলল, কয়েকদিনের মধ্যেই জামাই আসবে সাফিয়াকে নিয়ে যেতে।

কিন্তু জামাই যদি বাকি টাকাটা চায়?

যাতে না চায়, সে ব্যবস্থা আমি করব। আপনাদেরকে অনেক কষ্ট দিলাম। মনে কিছু নেবেন না। এবার আসি বলে লোকটা দাঁড়িয়ে পড়ল।

দবির লোকটার কথা শুনে খুব খুশী হয়েছে। সেও দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, এতরাতে অন্ধকারে যাবেন কি করে? এখানেই থাকুন, কাল সকালে যাবেন।

লোকটা বলল, থাকতে পারব না, আমাকে যেতেই হবে। আমার কাছে টর্চ লাইট আছে, অসুবিধে হবে না।

কিন্তু আপনি যাবেন কোথায়?

তা বলা যাবে না। শুনুন, আমার কথা কাউকেই বলবেন না। তারপর সাফিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, তোমাকে ছোট বোনের মতো মনে করে বলছি। আমার কথা তোমার স্বামীকেও বলবে না। আমি যদি কখনো তোমার শ্বশুরবাড়িতে যাই, তখন আমাকে না চেনার ভান করে থাকবে। ভুলেও আমার কাছে আসবে না, আমার সঙ্গে কথাও বলবে না। তারপর সালাম বিনিময় করে চলে গেল।

সবাই তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দবির মেয়েকে জিজ্ঞেস করল, তোর কি মনে হয় এই লোকই তোকে মাতব্বরের ছেলের হাত থেকে বাঁচিয়েছে? লোকটা তো বলল, একটা বুড়ো লোক বাঁচিয়েছে।

সাফিয়া বলল, তখন আমি বুড়ো লোক দেখেছিলাম, কিন্তু ওনাকে দেখে ও ওনার কথা শুনে মনে হচ্ছে, উনিই আমাকে বাঁচিয়েছেন।

হাজেরা বলল, যেই বাঁচাক না কেন লোকটা যে বলল, জামাই এসে সাফিয়াকে নিয়ে যাবে, সত্যিই কি জামাই আসবে?

দবির বলল, সে কথা আল্লাহই জানে। দেখা যাক না আসে কিনা।

.

সাফিয়ার শ্বশুর হারিস ছেলে হান্নানকে নিয়ে ক্ষেতে কাজ করছিল। হঠাৎ দেখতে পেল, সাদা পাইজামা পাঞ্জাবী পরা দাড়িওয়ালা লম্বা চওড়া একটা বুড়ো লোক তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

বুড়ো লোকটাকে মৌলভী মনে করে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করল, কিছু বলবেন হুজুর?

বুড়ো লোকটা বলল, আপনার নাম হারিস না?

জি।

আর ঐ ছেলের নাম নিশ্চয় হান্নান?

হারিস অবাক হয়ে বলল, জি। কিন্তু আপনাকে তো চিনতে পারছি না?

আমি ভিন গাঁয়ের লোক, চিনবেন কি করে?

তা এখানে এসেছেন কেন?

কয়েকটা কথা বলতে এসেছি।

কি কথা বলুন।

আশ-পাশের ক্ষেতে যারা কাজ করছে সবাইকে ডাকুন। তাদের সামনে বলব।

হারিস ছেলেকে বলল, যা সবাইকে ডেকে নিয়ে আয়। ইনাকে দেখিয়ে বলবি হুজুর ডাকছেন।

কিছুক্ষণের মধ্যে দু’একজন করে পনের বিশজন লোক এসে গেল।

বুড়ো লোকটা বলল, আমি কিছু আলাপ করব। তার আগে কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করব। আপনাদের মধ্যে যিনি একটু জ্ঞানী, তিনি উত্তর দেবেন।

ওদের মধ্যে সাত্তার জ্ঞানী লোক। সবাই তাকে দেখিয়ে বলল, উনি উত্তর দেবেন।

বুড়ো লোকটা সাত্তারকে উদ্দেশ্য করে বলল, আপনারা তো মুসলমান, তাই?

সাত্তার বলল, জি।

মুসলমানদের হারাম খাওয়া নিষেধ, তা নিশ্চয় জানেন?

জি, জানি।

আপনারা নামায রোযা করেন?

জি, করি।

হারাম খেয়ে নামায রোযা করলে আল্লাহ কবুল করে না। তা জানেন?

জি জানি, মৌলবীদের মুখে শুনেছি।

তা হলে আপনারা হারাম খান কেন?

আমরা চাষ করে গায়ে গতরে খেটে খাই। হারাম খেতে যাব কেন?

ছেলের বিয়ে দিয়ে মেয়ের বাপের কাছে থেকে সোনা-দানা, টাকা পয়সা দাবি করে নেয়া যে হারাম, তা জানেন?

এটা হারাম হবে কেন? সব ছেলের বাপেরা নেয় এবং বিয়ের সময় মেয়ের বাবাও মেয়ে জামাইকে কিছু দেয়।

সবাই দেয়া-নেয়া করে না। তবে আজকাল বেশিরভাগ লোক দেয়া-নেয়া করে। মনে করুণ আপনারা দুই ভাই। আপনি কি অন্য ভাইয়ের কাছে থেকে অন্যায়ভাবে কোনো কিছু দাবি করে নিতে পারেন?

না পারি না।

এটা নিশ্চয় হারাম হবে?

হ্যাঁ হবে।

এক মুসলমান আর এক মুসলমানের ভাই, এটা জানেন তো?

জি জানি।

তা হলে ছেলের বিয়ের সময় মেয়ের বাপের কাছে যা কিছু দাবি করে নেয়া হয়, তা সেই ভাইয়ের কাছে অন্যায়ভাবে দাবি করে নেয়া হল নাকি?

এই কথার উত্তর দিতে না পেরে সাত্তার চুপ করে রইল।

তাই দেখে বুড়ো লোকটা আবার বলল, হাদিসে আছে, রাসুলুল্লাহ (দঃ) বলিয়াছেন, “এক মুসলমান অন্য মুসলমানের ভাই। এক মুসলমান অন্য মুসলমানের জন্য হারাম, তার জান-মাল এবং তাহার সম্পদ(১)।” [(১) বর্ণনায় : আবু হোরাইরা (রাঃ)-মুসলিম।]

তা হলে বুঝে দেখুন, ছেলের বিয়ে দিয়ে মেয়ের বাপের কাছ থেকে যা কিছু দাবি করে নেয়া হয়, তা নিশ্চয় হারাম হবে। তবে হ্যাঁ, মেয়ের বাপের যদি কিছু দেয়ার সামর্থ থাকে এবং খুশী হয়ে কিছু মেয়ে জামাইকে দিতে চায়, তা দিতে পারে। কিন্তু তা সবাইকে জানিয়ে নয়; গোপনে দেবে। তা না হলে সবাইকে জানিয়ে দিলে তার দেখা দেখি অন্য ছেলেরা ও তাদের গার্জেনরা বিয়ের সময় ঐসব দাবি করবে। এই ব্যাপারটা বিজাতীয়দের সমাজে প্রচলন। তারা এটাকে বিয়ের পণ বলে। বিজাতীয়দের কোনো জিনিস মুসলমানদের অনুসরণ করা উচিত নয়, বরং গোনাহর কাজ। আমাদের নবী করিম (দঃ) বলিয়াছেন, “যে বিবাহে যত খরচ কম হবে, সেই বিবাহে আল্লাহর রহমত তত বেশী বর্ষিত হবে।”

আপনারা যদি মুসলমান বলে দাবি করেন, তা হলে এখন থেকে ছেলের বিয়ে দেয়ার সময় মেয়ের বাপের কাছে দাবি করে কোনো কিছু নেবেন না এবং মেয়ের বিয়ে দেয়ার সময় যদি ছেলের বাপ কোনো কিছু দাবি করে, তা হলে সেখানে মেয়ের বিয়ে দেবেন না।

জাব্বার নামে এক লোক বলল, তা হলে তো মেয়েদের বিয়েই হবে না।

কে বলেছে হবে না, নিশ্চয় হবে। আল্লাহ ও তার রাসুলে (দঃ) এর হুকুম মোতাবেক আপনারা চলুন। দেখবেন, আল্লাহ সে ব্যবস্থা করে দেবেন। আজকাল আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (দঃ) এর হুকুম কেউ মেনে চলছে না। তাই মুসলমানরা আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং নানান সমস্যায় ভুগছে।

এবার আমি আসি। আপনাদের অনেক কাজের ক্ষতি করলাম, সে জন্য মাফ চাইছি বলে বুড়োলোকটা চলে যেতে উদ্দত হলে সাত্তার বলল, হুজুর, আপনার পরিচয় বললেন না?

আমি আল্লাহর এক নাদান বান্দা বলে হাঁটতে শুরু করল।

.

একদিন হারিস মসজিদ থেকে এশার নামায পড়ে ঘরের কাছে এসেছে, এমন সময় পিছন থেকে একজন লোকের গলা শুনতে পেল, এই যে ভাই শুনুন।

হারিস ঘুরে দাঁড়াল, লোকটা কাছে এসে সালাম দিল।

অন্ধকার রাত বলে হারিস হারিকেন নিয়ে নামায পড়তে গিয়েছিল। সালামের উত্তর দিয়ে হারিকেনটা উপরে তুলে বলল, আপনাকে মসজিদে নামায পড়তে দেখলাম না?

হ্যাঁ, আমি থানার দারোগা। আপনার সঙ্গে কিছু আলাপ আছে।

পুলিশের নাম শুনলে এখনও প্রত্যন্ত অঞ্চলের লোকেরা ভয় পায়। হারিসও পেল। তবু সাহস করে বলল, একটু দাঁড়ান আপনার বসার ব্যবস্থা করে আসি। তারপর ঘরে ঢুকে স্ত্রীকে ও ছেলে হান্নানকে বলল, থানা থেকে দারোগা সাহেব এসেছেন।

হান্নান ভয় পেয়ে বলল, হঠাৎ দারোগা সাহেব আমাদের ঘরে এল কেন?

হারিস বলল, কি যেন আলাপ করবেন বললেন, তুই এই দাওয়াতে একটা পাটি বিছিয়ে দে, আমি ওনাকে নিয়ে আসি।

হারিসের স্ত্রী সবুরন বলল, কিছু খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে না কি?

হারিস বলল, সে পরে হয় হবে, এখন যাই ওনাকে নিয়ে আসি।

দারোগা বুঝতে পারল, ওরা ভয় পেয়েছে। তাই হারিস ফিরে এলে বলল, রাতে এসেছি বলে আপনারা ভয় পাবেন না। অল্প কিছুক্ষণ আলাপ করেই চলে যাব।

দারোগার কথা শুনে হারিসের ভয় কমল। বলল, চলুন ভিতরে বসে আলাপ করবেন।

ভিতরে এসে দারোগা তাদেরকে বসতে বলে নিজেও বসলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, আপনার ছেলে মেয়ে কয়টা?

হারিস বলল, তিন ছেলে ও দুই মেয়ে। তারপর হান্নানকে দেখিয়ে বলল, ও সবার বড়।

ছেলেমেয়ের কারো বিয়ে দেন নি?

বড় ছেলে ও বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছি, বাকিরা ছোট।

কত দিন হল বড় ছেলের বিয়ে দিয়েছেন?

তা প্রায় দেড় বছর হতে চলল।

পোতা পুতিন হয় নি?

না।

বৌমা এখন কোথায়? এখানে না বাপের বাড়িতে?

বাপের বাড়িতে।

বাপের বাড়ি কোন গ্রামে?

বাহেরচর গ্রামে।

বৌমা কত দিন আগে বাপের বাড়ি গেছে?

হারিস লেখাপড়া তেমন না জানলেও খুব চালাক লোক। প্রথমে দারোগার কথা শুনে ভেবেছিল, গ্রামের কেউ হয়তো চুরি ডাকাতি করেছে, তার খোঁজ নিতে এসেছেন। তা না করে তার পরিবারিক সবকিছু জিজ্ঞেস করছেন দেখে চিন্তা করল, তা হলে কি বিয়াই তার মেয়ের উপর অত্যাচারের কথা থানায় জানিয়েছে। তাই বোধ হয় দারোগা সাহেব এসেছেন। কথাটা চিন্তা করে ঘাবড়ে গেল।

তাকে চুপ করে থাকতে দেখে দারাগো সাহেব বললেন, বৌমা কতদিন তার বাপের বাড়িতে আছে বললেন না যে?

যতটা সম্ভব সংযত কণ্ঠে হারিস বলল, এই তো কয়েকদিন আগে ছেলে বৌকে সেখানে রেখে এসেছে।

আপনি মুসলমান ও নামাযীলোক হয়ে মিথ্যা কথা বলছেন কেন?

হারিস আরো ঘাবড়ে গিয়ে তোতলাতে তোতলাতে বলল, আমি মিথ্যে বলতে যাব কেন?

দারোগা সাহেব গর্জে উঠলেন, আবার মিথ্যে কথা বলছেন। আমি তো জানি, বৌমার বাপ আপনার দাবি করা টাকা দিতে পারে নি বলে বৌমাকে সবাই মিলে মারধর করতেন। পাঁচ-ছয়মাস আগে মারধর করার পর বের করে দিয়েছেন। আর বলেছেন, বাকি সব টাকা না নিয়ে এলে তালাক দিয়ে আবার ছেলের বিয়ে দেবেন? শুনুন, আপনারা জানেন কিনা জানি না, সরকার নির্দেশ দিয়েছে, ছেলের বিয়েতে যারা যৌতুক দাবি করবে, তাদের কমপক্ষে পাঁচ বছর জেল ও পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হবে।

আমি কিছু দিন হল এই থানায় নতুন এসেছি। গ্রামে গ্রামে ঘুরে খোঁজ নিচ্ছি কারা ছেলের বিয়েতে যৌতুক দাবি করছে, আর কারা বাপের বাড়ি থেকে যৌতুক আনার জন্য বৌয়ের উপর অত্যাচার করছে। বাহেরচর গ্রামে খোঁজ নিতে গিয়ে দবির সেখের কাছ থেকে তাদের মেয়ের উপর অত্যাচারের কথা শুনে এসেছি। আমি থানায় বলে এসেছি, কিছুক্ষণের মধ্যে পুলিশ এসে আপনাকে, আপনার স্ত্রী ও এই ছেলেকে ধরে নিয়ে যাবে। তারপর বুঝবেন যৌতুক দাবি করার ও বৌমার উপর অত্যাচার করার ফল।

হারিস ও হান্নানের তখন দু’দিন আগে ক্ষেতে কাজ করার সময় হুজুরের কথা মনে পড়ল। দু’জনেই হাউ-মাউ করে কেঁদে উঠে দারোগা সাহেবের পা ধরতে গেল।

দারোগা সাহেব বাধা দিয়ে বললেন, এখন আর কাঁদলে কি হবে? যে পাপ আপনারা করেছেন, তার ফল তো ভোগ করতেই হবে।

হারিস কাঁদতে কাঁদতেই দু’দিন আগে হুজুরের কথা বলে বলল, ভেবেছি, আর কখনো ছেলের বিয়েতে যৌতুক দাবি করব না। আপনি আমাদের এবারের মতো মাফ করে দিন। কথা দিচ্ছি, এরকম কাজ আর করব না। আর বিয়াই এর কাছে পাওনা টাকাও চাইব না।

থানায় ধরে নিয়ে যাবে ও তাদের জেল-জরিমানা হবে শুনে হারিসের স্ত্রী সবুরন ভয়ে চোখের পানিতে বুক ভাসাচ্ছিল আর মনে মনে বলছিল, কি ঝকমারী করে বৌ-এর গায়ে হাত তুলেছিলাম। স্বামী থেমে যেতে ঘরের ভিতর থেকেই ভিজে গলায় বলল, হ্যাঁ দারোগা সাহেব, এবারের মতো আমাদের মাফ করে দিন। আমরা আর কোনো ছেলের বিয়েতে যৌতুক দাবি করব না। কালকেই হান্নানকে পাঠাব বৌকে নিয়ে আসতে।

দারাগা মনে মনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বললেন, ঠিক আছে, আপনারা আমার মা বাবার বয়সী, তাই এবারের মতো কিছু করলাম না। কিন্তু আবার যদি শুনি বৌমার উপর আপনারা এতটুকু অত্যাচার করেছেন, তা হলে সেদিন বুঝবেন কি করি। আর একটা কথা, আপনারা খোঁজ নিয়ে রাখবেন, এই গ্রামের অন্য কোনো ঘরে যৌতুকের কারণে কোনো বৌ-এর উপর অত্যাচার হচ্ছে কিনা–সে রকম যদি কেউ থাকে, তবে তাকে সরকারের আইনের কথা ও আমার কথা বলবেন। যখন আসব তখন তাদের কথা আমাকে বলবেন। আর একটা কথা, আমি গ্রামের লোকজনদের বলছি ছোট ছেলেমেয়েদের যেন স্কুলে পাঠায়। যারা পাঠাবে না সরকার তাদের বিরুদ্ধে এ্যাকসান নেবে। আপনার ছেলেমেয়েদেরও পাঠাবেন। তারপর দাঁড়িয়ে উঠে বললেন, এবার আসি।

হারিস বলল, কিছু না খেয়েই যাবেন? একটু বসুন গরিবের ঘরে কিছু মুখে দিয়ে যাবেন।

খেয়ে গেলে দেরি হয়ে যাবে। ততক্ষণ পুলিশরা চলে আসবে। তারপর সালাম বিনিময় করে চলে যাওয়ার সময় বললেন, বৌমাকে নিয়ে আসার পর থানায় গিয়ে দাওয়াত দেবেন, তখন এসে খাব।

দারোগা চলে যাওয়ার পর সবুরন তাদের কাছে এসে ছেলেকে বলল, কাল সকালেই তুই বৌকে নিয়ে আসতে যাবি। দারোগা সাহেব যদি শোনে বৌকে নিয়ে আসি নি, তা হলে কি করবে সে কথাতো বলেই গেল।

হান্নান বলল, আমি আনতে গেলে যদি গ্রামের লোকজন নিয়ে আমার শ্বশুর বেঁধে রাখে? তার চেয়ে আব্বা গিয়ে নিয়ে আসুক।

সবুরন বলল, তোর আব্বাকেও যদি বেঁধে রাখে? তখন কি হবে? তোকে বেঁধে রাখলে তোর আব্বা গিয়ে তাদের কাছে মাফ চেয়ে তোকে ও তোর বৌকে তবু নিয়ে আসতে পারবে।

হারিস বলল, সব থেকে ভালো হবে আমরা তিনজনেই যাই চল। দোষ স্বীকার করে মাফ চেয়ে বেয়াইকে বলব, বাকি টাকা আর দিতে হবে না। বৌকে নিয়ে যেতে এসেছি।

হান্নান বলল, সেটাই ভালো হবে।

৫-৬. মাতব্বর দুদিন পর

০৫.

মাতব্বর দু’দিন পর হাসপাতাল থেকে ফিরে তিনচার দিন থানায় লোক পাঠিয়েছিলেন। দারোগাকে নিয়ে আসার জন্য। আট দিন হয়ে যাওয়ার পরও যখন এল না তখন একদিন হাসপাতালে ছেলেকে দেখতে যাওয়ার পথে থানায় গেলেন।

দারোগা সালাম বিনিময় করে বললেন, আপনার ছেলের খবর কি বলুন।

মাতব্বর তার কথার উত্তর না দিয়ে গম্ভীরকণ্ঠে বললেন, কয়েকদিন লোক দিয়ে ডেকে পাঠালাম, গেলেন না কেন?

কাজে ব্যস্ত ছিলাম। তা ছাড়া আপনি ডাকলেই যেতে হবে, এরকম নির্দেশ সরকার আমাকে দেয় নি। ওসব কথা বাদ দিয়ে ছেলের খবর বলুন।

মাতব্বর আরো রেগে গিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বিরক্ত স্বরে বললেন, ছেলের আর খবর কি। একটা হাত ও একটা চোখ হারিয়ে তার জীবনটা বরবাদ হয়ে গেছে। আপনি কি খোঁজ খবর করেছেন তার এরকম অবস্থা কে করল?

দারোগা বললেন, তা আবার করি নি। দু’জন লোকও লাগিয়েছি। কিন্তু আজও কোনো হদিস পাচ্ছি না।

মাতব্বর বললেন, সেদিন ছেলের অবস্থা দেখে আমার মাথার ঠিক ছিল না। তাই কথাটা আপনাকে জানাতে পারি নি। আমার কাজের লোক জয়নুদ্দিন ঐ সময় একটা লোককে ওখান থেকে মাঠের রাস্তার দিকে চলে যেতে দেখেছে। লোকটা বেশ লম্বা চওড়া, ইয়া বড় পাকা দাড়ি, মাথায় গোল টুপি। দেখলে মনে হবে হুজুর মানুষ।

দারোগা বললেন, রাস্তা দিয়ে কত লোক যাতায়াত করে, হুজুর যে ঐ কাজ করেছে তা কি জয়নুদ্দিন দেখেছে?

না, তা দেখে নি।

লোকটা নিশ্চয় আপনাদের গ্রামের নয়?

না, ওরকম লোক আমাদের গ্রামে নেই। অন্য গ্রামের হতে পারে?

আচ্ছা, আশ পাশের গ্রামের কোনো লোকের সঙ্গে আপনার শত্রুতা আছে?

না।

জয়নুদ্দিন যে লোককে দেখেছে, সে রকম কোনো লোককে কখনো আপনি দেখেছেন?

না। তবে দু’দিন আগে শুনলাম, পাশের গ্রামে নাকি ঐ রকম একজন লোককে দেখা গেছে। ক্ষেতে যারা কাজ করছিল, তাদেরকে ছেলের বিয়ে দেয়ার সময় যৌতুক না নেয়ার জন্য ওয়াজ করেছেন।

কার কাছে কথাটা শুনেছেন?

ঐ গ্রামে আমার এক আত্মীয় আছে, সে আমার ছেলের খবর জানতে এসেছিল। তার কাছে শুনেছি।

তারা লোকটাকে চেনে কিনা জিজ্ঞেস করেন নি?

করেছিলাম। বলল, চেনে না। আরো বলল, তারা ওনার পরিচয় জানতে চেয়েছিল, উনি বলেন নি।

আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে, উনি আলেমলোক। উনি শুধু শুধু আপনার ছেলের ঐ রকম অবস্থা করতে যাবেন কেন?

তা অবশ্য ঠিক। আপনি একটু ভালো করে সন্ধান করুন। সেদিন বললাম না, অপরাধীকে ধরতে পারলে মোটা টাকা পুরস্কার দেব?

অপরাধীকে খুঁজে বের করাই আমাদের কাজ। আর এই কাজ করার জন্য সরকার বেতন দেয়। এখানে পুরষ্কার দেয়ার কথা বলছেন কেন?

অপরাধীকে ধরলে আমি খুশী হব। তাই পুরস্কার দেয়ার কথা বলছি।

শুনুন মাতব্বর সাহেব, পুরস্কারের লোভে আমি কিছু করব না। যা কর্তব্য তাই করব। এবার আপনি আসুন, আমার জরুরি কিছু কাজ আছে।

আগে যিনি দারোগা ছিলেন তিনি মাতব্বরকে খুব তোয়াজ করে চলতেন, মাতব্বর থানায় এলে চা-নাস্তা খাওয়াতেন। এই নতুন দারোগা তাকে পাত্তা দিচ্ছেন না দেখে মাতব্বর প্রথম থেকে অসন্তুষ্ট হয়েছেন। এখন তাকে চলে যেতে বলায় আরো বেশী অসন্তুষ্ট হলেন। বললেন, নতুন এসেছেন তো, তাই এই এলাকার কে কেমন লোক জানেন না। জানলে আমার কথাকে অপগ্রাহ্য করতে পারতেন না। ঠিক আছে, এখন আসি। তারপর থানা থেকে বেরিয়ে এলেন।

রশিদ প্রায় দেড় মাস পর হাসপাতাল থেকে ফিরে এল। একদিন আব্বাকে। জিজ্ঞেস করল, যে লোক আমার এই অবস্থা করেছে, সেই লোকের কি খোঁজ পাওয়া গেছে?

মাতব্বর বললেন, কয়েকজন লোক লাগিয়েছি, তারা আজও কোনো খোঁজ পায় নি। এমন কি থানায় কেস করে দারোগাকে খুঁজে বের করতে বলেছিলাম; তিনিও পারেন নি।

শুনলাম, সাফিয়ার শ্বশুর শাশ্বড়ি এসে নাকি তাকে নিয়ে গেছে?

ঘটনার কয়েকদিন পর জয়নুদ্দিন একটা কাগজ মাতব্বরের হাতে দিয়ে বলেছিল, এটা মিয়া ভাইদের বুকের উপর ঢিল চাপা দেয়া ছিল। সেদিন মিয়া ভাইয়ের অবস্থা দেখে আপনাকে দিতে ভুলে গেছি। কাগজটা পড়ে মাতব্বর বুঝতে পারেন, বুড়ো লোকটা কেন রশিদের একটা হাতও একটা চোখ নষ্ট করে দিয়েছে।

এখন রশিদ সাফিয়ার কথা জিজ্ঞেস করতে ভাবলেন, তা হলে ও কি সেদিন সাফিয়ার ইজ্জত লুঠতে চেয়েছিল?

বাবাকে চুপ করে থাকতে দেখে রশিদ আবার বলল, সাফিয়াকে ওর শ্বশুর শ্বাশুড়ী এসে নিয়ে গেছে কিনা বললে না যে?

মাতব্বর বললেন, হ্যাঁ, নিয়ে গেছে। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, তুই কি সাফিয়ার স্বামী শ্বশুরকে সন্দেহ করিস?

না, তাদেরকে সন্দেহ করি না। আচ্ছা, দবির সেখ তাদেরকে যৌতুকের বাকি টাকা দিয়েছে কি না জান?

দবির টাকা কোথায় পাবে যে দেবে। শুনেছি, তারা এসে যৌতুকের বাকি টাকা ছাড়াই সাফিয়াকে নিয়ে গেছে। বলেছে, ঐ টাকা আর দিতে হবে না।

হঠাৎ তারা এত ভালো মানুষ হয়ে গেল কেন খোঁজ নিয়েছ?

তা আবার নিই নি। কিছুদিন আগে ওদের গ্রামে একজন হুজুর এসে সবাইকে যৌতুক নিতে নিষেধ করে বলেছেন, এটা হারাম। আরো বলেছেন, ছেলের বাবারা যেন বিয়ের সময় মেয়ের বাবাদের কাছে যৌতুক দাবি না করে, আর মেয়ের বাবারাও যেন যৌতুক দিয়ে মেয়ের বিয়ে না দেয়। এর কয়েকদিন পর থানার নতুন দারোগাও আশ-পাশের গ্রামের লোকজনদের ঐ কথা জানিয়ে বলেছেন, কেউ যদি ছেলের বিয়েতে যৌতুক দাবি করে, তা হলে থানায় খবর দিতে। সরকার নাকি যৌতুকের বিরুদ্ধে আইন করেছে, যৌতুক নিয়ে যে বিয়ে করবে তার জেল-জরিমান হবে। মনে হয়, সেই ভয়ে সাফিয়ার শ্বশুর-শাশুড়ি এসে যৌতুক ছাড়াই নিয়ে গেছে।

রশিদ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে জিজ্ঞেস করল, আমাদের গ্রামে সেই হুজুর বা দারোগা এসে সে কথা লোকজনদের বলে নি?

হুজুর এসেছিলেন কিনা জানি না। তবে দারোগা নাকি একদিন এসে বলেছেন। আরো বলেছেন, সবাই যেন ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠায়। নচেৎ ছেলেমেয়েদের মুগ্ধ করে রাখার জন্য এ্যাকসান নেবেন। সেদিন আমি হাসপাতালে তোর কাছে গিয়েছিলাম। এসে লোকজনের মুখে এসব কথা শুনেছি। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, যে তোর এই অবস্থা করল, তাকে দেখলে কি চিনতে পারবি?

না। সে পেছন থেকে চুপিচুপি এসে এত জোরে আমার ঘাড় ধরেছিল যে, ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে দেখার ক্ষমতা আমার ছিল না। আমি অনেক চেষ্টা করেছি নিজেকে ছাড়াবার; কিন্তু পারি নি। লোকটার গায়ে কি দারুণ শক্তি। কানের গোড়ায় ধরা হাতটা চাপ দিয়ে আমাকে অজ্ঞান করে ফেলল। তারপর কি হয়েছিল জানি না।

কিন্তু আমি ভেবে পাচ্ছি না, তুই ঐ সময়ে পুকুর পাড়ে গিয়েছিলি কেন? আর কেনই বা লোকটা তোর এরকম অবস্থা করল?

রশিদ সত্য কথা বলতে না পেরে মিথ্যে করে বলল, এমনি একটু ঘুরতে গিয়েছিলাম। হঠাৎ লোকটা আমার পিছন থেকে ঘাড় ধরে ফেলল। তারপরের ঘটনা একটু আগে তো বললাম।

লোকটা শুধু শুধু তোর ঘাড়ই বা ধরবে কেন? আর তোর এই অবস্থাই বা করবে কেন? আমার তো মনে হচ্ছে, এর পিছনে নিশ্চয় কোনো কারণ আছে, যা তুই গোপন করছিস।

রশিদ বিরক্তি কণ্ঠে বলল, কি আবার গোপন করব? যা সত্য তাইতো বললাম। এই কথা বলে সেখান থেকে চলে গেল।

মাতব্বর ছেলের গমন পথের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললেন, কাগজটার লেখা পড়েই বুঝেছি, তুই সাফিয়ার ইজ্জত লুঠতে গিয়েছিলি।

.

বাহেরচর গ্রামে এবছর হাইস্কুল হবে। সে ব্যাপারে আজ তিনজন সরকারী লোক এসেছেন মাতব্বরের কাছে।

মাতব্বর সে কথা দু’তিনজন লোকের দ্বারা গ্রামবাসীকে জানিয়ে তার বাড়ির সামনে ডেকে পাঠালেন।

গ্রামের লোকজন এসে কোথায় স্কুল হবে, সে ব্যাপারে পরামর্শ করে মাতব্বরকে জায়গা দিতে বললেন।

মাতব্বর মরহুম মঈন সেখের যে বাস্তু দখল করে নিয়েছেন, সেখানে স্কুল করার কথা জানিয়ে বললেন, ঐ জায়গাটা গ্রামের মাঝখানে। ওখানে স্কুল হলে সবার জন্য সুবিধে।

গ্রামের সবাই জানে, ওটা মরহুম মঈন সেখের বাস্তু। তার বৌ সায়রা ছেলেকে নিয়ে গ্রাম থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর মাতব্বর ভোগ-দখল করেছেন। তবু কেউ সাহস করে কোনো প্রতিবাদ করতে পারল না।

কেউ কিছু বলছে না দেখে করিম সেখের ভাই আযীয সেখ বললেন, ওটাতো মরহুম মঈন সেখের বাস্তু। তার একটা এতিম ছেলে আছে। এতিমের জায়গায়। স্কুল করা ঠিক হবে না।

সায়রা মাতব্বরের পুরুষাঙ্গ কেটে দেয়ার ঘটনাটা গ্রামের লোকজন জেনে যাওয়ার পর থেকে মাতব্বরকে সবাই ঘৃণার নজরে দেখলেও ধনীলোক বলে তার মাতব্বরী ছাড়াতে পারে নি। কিন্তু আযীয সেখ কোনো ব্যাপারেই মাতব্বরের সঙ্গে কখনও যোগাযোগ রাখে নি। আজ হাইস্কুলের ব্যাপারে সরকার থেকে লোক এসেছে শুনে এসেছেন। ওনার অবস্থা আগে ভালো না থাকলেও এখন খুব ভালো। পাঁচ-পাঁচটা জোয়ান ছেলে। সবাই রুজী রোজগার করে। তাই মাতব্বর ও আযীয সেখের এরকম ব্যবহার দেখেও তাকে ঘাটায় নি।

এখন তার কথা শুনে মাতব্বর বললেন, মঈন সেখ অসুখে পড়ে আমাকে তার বাস্তু বিক্রি করে সেই টাকায় চিকিৎসা করিয়েছে।

আযীয সেখ বললেন, আমি তো জানি মঈন সেখ একরকম বিনা চিকিৎসায় মারা গেছে। তার বৌ আমার কাছ থেকে কিছু কিছু টাকা নিয়ে এসে যতটুকু সম্ভব চিকিৎসা করিয়েছে। তবে তার বৌ-এর কাছে শুনেছি, আপনিও তাকে কিছু টাকা পয়সা দিয়েছেন। আপনার কাছে বাস্তু বিক্রি করলে তার বৌ নিশ্চয় আমাকে জানাত।

মাতব্বর বললেন, মঈন সেখের বৌ সে কথা জানে না।

এমন সময় একটা বোরখা পরা মেয়ে দাঁড়িয়ে উঠে বলল, মাতব্বর সাহেব, আপনার কথা সত্য নয়। আযীয চাচা সত্য কথা বলেছেন।

মাতব্বর খুব রেগে গিয়ে বললেন, কে তুই? তোকে এখানে কথা বলতে বলেছে কে?

বোরখাপরা মেয়েটি বলল, আমি কে সে কথা পরে বলছি। আপনি গ্রামের মাতব্বর, সবার সঙ্গে ভদ্রভাবে কথা বলাইতো উচিত। আশা করি, এরপর কারো সঙ্গে অভদ্র ভাষায় কথা বলবেন না। যাই হোক, আমি কে জানতে চান? আমি মরহুম মঈন সেখের বিধবা স্ত্রী সায়রা বানু। প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য যাকে আপনি ল্যাংড়া ফকির ফজলুর সঙ্গে মিথ্যে দুর্নাম দিয়ে তার সঙ্গে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। এবার চিনতে পেরেছেন? না প্রতিহিংসা নেয়ার কারণও বলা লাগবে?

বিনা মেঘে বজ্রপাত হলে মানুষ যেমন অবাক হয় অথবা ভয় পেয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে, সায়রার কথা শুনে সবাই-এর অবস্থা সেইরকম হল। অনেকক্ষণ কেউ কোনো কথা বলতে পারল না।

প্রথমে সায়রা সরকারী লোকদের উদ্দেশ্য করে বলল, আপনারাই বলুন, একজন বিধবা ও তার এতিম ছেলের বাস্তুতে কি স্কুল প্রতিষ্ঠা করা উচিত? আমার ছেলের ইচ্ছা, ওখানে বাবার নামে একটা মাদ্রাসা করার। সেই অসিলায় আল্লাহ তার বাবাকে বেহেশত নসীব করবেন। আর ছেলের মতো আমিও তাই চাই।

সরকারী লোকদের একজন বললেন, আমরা জেনেশুনে ঐ জায়গায় স্কুল করব না।

ততক্ষণে মাতব্বর সামলে নিয়েছেন। বললেন, আপনারা ওর কথা বিশ্বাস করবেন না। ওযে মঈন সেখের বিধবা স্ত্রী তার প্রমাণ কি? মুখ ঢেকে রেখেছে কেন? খুলে দেখাক।

সায়রা বলল, মাতব্বর সাহেব, আপনার এত বয়স হল, নামায কালামও পড়েন, আর এটা জানেন না, পর-পুরুষদের সামনে মুখ দেখান মেয়েদের জন্য হারাম?

সরকারী লোকদের একজন বললেন, আপনার কথা ঠিক। তবে প্রমাণ করার জন্য শুধু মুখ দেখান যায়েজ।

সায়রা মুখের নেকাব সরিয়ে মাতব্বরকে উদ্দেশ্য করে বলল, এবার চিনতে পারছেন? তারপর আযীয সেখের কাছে গিয়ে বলল, আপনি বলুন তো চাচা, আমি সায়রা কিনা।

মাতব্বর চিনতে পেরে মুখ নিচু করে নিলেন। কোনো কথা বলতে পারলেন না।

আযীয সেখ বললেন, হ্যাঁ মা, তুমি মঈন সেখের বিধবা স্ত্রী সায়রা।

রশিদ এতক্ষণ কিছু বলে নি। এবার বলল, তুমি এতদিন কোথায় ছিলে? আজই বা হঠাৎ এলে কেন?

সায়রা মুখে নেকাব ঢাকা দিয়ে বলল, এতদিন কোথায় ছিলাম সে কথা আপনাদের জানার দরকার কি? আর এসেছি স্বামীর ভিটেয় মাদ্রাসা করার জন্য।

রশিদ জিজ্ঞেস করল, তোমার ছেলে কোথায়?

সায়রা বলল, সেকথাও আপনাদের জানার দরকার নেই। তা আপনার এরকম অবস্থা হল কি করে? নিশ্চয় পাপের ফল।

এই কথা শুনে রশিদ রাগ সামলাতে পারল না। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে গর্জে উঠল, এই মাগি বড় বড় বেড়েছিস দেখছি। তোর বাড় যদি না কমিয়েছি তো আমি দিলদার মাতব্বরের ছেলেই না।

সায়রাও রাগের সঙ্গে বলল, মুখ সামলে কথা বলুন। দিলদার মাতব্বরের ছেলে বলেই তো বাবার স্বভাব পেয়েছেন। একটা হাত ও একটা চোখ হারিয়েও স্বভাব পাল্টায় নি। বেশি বাড়াবাড়ি করলে আমিও হাত পা হারাবার কাহিনী সবার সামনে ফাঁস করে দেব।

রশিদ আরো রেগে গিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল, দু’জন পুলিশসহ দারোগাকে আসতে দেখে মাতব্বর ছেলেকে বললেন। চুপ কর, দারোগা সাহেব আসছেন।

দারোগা কাছে এসে মাতব্বরের সঙ্গে সালাম বিনিময়ে করে জিজ্ঞেস করলেন, কি ব্যাপার? এত লোকজন কেন?

মাতব্বর তাদের বসার ব্যবস্থা করে সরকারী লোকদের দেখিয়ে বললেন, ওনারা এই গ্রামে হাই স্কুল করার জন্য এসেছেন। তাই লোকজন ডাকা হয়েছে কোথায় স্কুল হবে পরামর্শ করার জন্য।

তা কোথায় হবে ঠিক হয়েছে?

মাতব্বর বলার আগে সায়রা বলল, উনি আমার বাস্তুতে স্কুল করার কথা বলছেন, আমি আপত্তি করে বলেছি, ওখানে মাদ্রাসা করব।

সায়রা থেমে যেতে মাতব্বর বললেন, ওর স্বামী মারা যাওয়ার আগে আমার কাছে বাস্তু বিক্রি করেছে। স্বামী মারা যাওয়ার পর ও প্রায় বিশ বাইশ বছর আগে ছেলেকে নিয়ে গ্রাম ছেড়ে চলে গিয়েছিল। আজ হঠাৎ এসে বাস্তুর দাবি করছে। আপনিই বলুন, এটা করা কি ওর ঠিক হচ্ছে?

মাতব্বরের কথার কোনো উত্তর না দিয়ে দারাগো সরকারী লোকদের বললেন, স্কুল করার জন্য আপনারা তো জমি কিনবেন তাই না?

তাদের একজন বললেন, তাতো বটেই। আমরা ন্যায্য দাম দিয়ে জমি কিনবো।

ঠিক আছে, আপনারা সপ্তাহখানেক পরে আসুন। এরমধ্যে আমি গ্রামের সবার সঙ্গে আলাপ করে রাখব, কে স্কুলের জন্য জমি বিক্রি করবে। আপনারা প্রথমে থানায় এসে আমার সঙ্গে দেখা করবেন। আমি আপনাদের এখানে নিয়ে আসব।

সরকারী লোকেরা বললেন, সেটাই ভালো হবে। তা হলে আজ আমরা আসি বলে সালাম বিনিময় করে চলে গেলেন।

দারোগা এবার মাতব্বরকে উদ্দেশ্য করে বললেন, এই মহিলা বিশ বা পঞ্চাশ বছর আগে চলে গেলেও জায়গাটাতো ওনার স্বামীর। আর তিনি যে আপনার কাছে বাস্তু বিক্রি করেছেন, তার দলিল নিশ্চয় আছে?

মাতব্বর আমতা আমতা করে বললেন, দলিল করার আর সময় পেলাম কোথায়? তার আগেই তো মঈন সেখ মারা গেল।

দারোগা বললেন, এরকম ক্ষেত্রে ইসলামের হুকুম হল, দু’জনকেই কুরআন শরীফ মাথায় রেখে শপথ করতে হবে। প্রথমে আপনি বলবেন, আমি মঈন সেখের বাস্তু কিনেছি। যদি এই কথা মিথ্যে বলে থাকি, তা হলে আল্লাহর গযব আমার মাথায় পড়বে।

আপনি শফত করার পর ঐ মহিলা বলবেন, আমার স্বামী বাস্তু বিক্রি করেন নি। এই কথা যদি মিথ্যে বলে থাকি, তা হলে আল্লাহর গযব আমার মাথায় পড়বে।

দারোগার কথা শুনে প্রথমে সায়রা বলে উঠল, আমি শপথ করতে রাজি।

দারোগা মাতব্বরকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি শপথ করতে রাজি আছেন?

কুরআন শরীফ মাথায় নিয়ে শপথ করলে অল্প দিনের মধ্যেই তার উপর আল্লাহর গযব নাজিল করবেন, সেকথা মাতব্বর জানেন। তাই বললেন, সায়রা যখন ওখানে মাদ্রাসা করবে বলছে তখন আর ঐ জায়গা আমি দাবি করব না।

মাতব্বর থেমে যেতে সায়রা বলল, দারোগা সাহেব, আমার স্বামীর যদি আরো জায়গা থাকত, তা হলে সেই জায়গা স্বেচ্ছায় দিয়ে দিতাম। তার দামও নিতাম না। স্বামীর রুহের মাফফেরাতের জন্য আমি ওখানে একটা দ্বিনী প্রতিষ্ঠান করে এই গ্রামের ছেলে মেয়েদের ও বড়দের মধ্যে শিক্ষা প্রচার করতে চাই। আমার ছেলেরও তাই ইচ্ছা।

দারোগা জিজ্ঞেস করলেন, আপনার ছেলে কোথায়?

সে সরকারী চাকরি করে। এখানে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করার জন্য আমাকে পাঠিয়েছে। ছুটির জন্য দরখাস্ত করেছিল, পায় নি। ছুটি পেলে কিছু দিনের মধ্যে আসবে বলেছে। আমি গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার পর মাতব্বর সাহেব আমার স্বামীর বাস্তু দখল করেছেন। ওনাকে দখল ছেড়ে দিতে বলুন। আমি মাদ্রাসা তৈরির কাজ শুরু করব।

দারোগা আসার আগে সায়রাকে দেখে ও তার কথা শুনে মাতব্বরের মনে প্রতিহিংসার আগুন জ্বলে উঠেছিল। এখন আবার সে দারোগা যে সব কথা বলল, সেসব শুনে সেই আগুনে যেন ঘি ঢেলে দিল। মনে মনে বললেন, কি করে মাদ্রাসা করিস, দেখে নেব। সুযোগ মতো চামচাদের দিয়ে ইজ্জৎ মেরে তোর লাশ শিয়াল কুকুর দিয়ে না খাইয়েছি তো আমার নাম দিলদার মাতব্বর না।

মাতব্বরকে চুপ করে থাকতে দেখে দারোগা জিজ্ঞেস করলেন, এ ব্যাপারে আপনি কি কিছু বলবেন?

ওখানে আমি নানারকম ফলের গাছ লাগিয়েছিলাম। সে সব এখন ফলছে। কয়েকদিনের মধ্যে বিক্রি করে দেব। তারপর সায়রা মাদ্রাসা তৈরির কাজ শুরু করবে।

সায়রা বলল, আমার জায়গা এতদিন অন্যায়ভাবে ভোগ দখল করেছেন। একটা গাছও বিক্রি করতে দেব না। যতটুকু জায়গায় মাদ্রাসার ঘর হবে, সেইটুকু জায়গার গাছ কেটে আমি বিক্রি করব। বাকি জায়গার গাছ থাকবে।

সায়রাকে দেখে ও তার কথা শুনে বাপের মতো রশিদও রাগে ফুলতেছিল। এবার তার কথা শুনে চিৎকার করে বলল, গাছ আমরা লাগিয়েছি, ওসব আমাদের, আমরা বিক্রি করবই। কি করে বাধা দাও দেখব।

দারোগাকে উদ্দেশ্য করে সায়রা বলল, মাতব্বরের ছেলের কথা শুনলেন তো, এখন আপনিই এর ফায়সালা করে দিন।

দারোগা বললেন, আমি আইনের লোক। আইন মোতাবেক মাতব্বর সাহেব আপনার জায়গা দখল করে অন্যায় করেছেন। ওনার ছেলে গায়ের জোরে যে কথা। বললেন, তাও আইনের দৃষ্টিতে অপরাধ। ওনারা বাড়াবাড়ি করলে আপনি আইনের আশ্রয় দিতে পারেন। সে ব্যাপারে আমি আপনাকে সাহায্য করব। কারণ অত্যাচারিতকে সাহায্য করাই মানবতা। তা ছাড়া আইনের বিরুদ্ধে কেউ কিছু করলে আইনের লোক হয়ে কিছু না করা অমানুষের কাজ। যাতে আপনি মাদ্রাসা তাড়াতাড়ি প্রতিষ্ঠা করতে পারেন, সে ব্যাপারে আমি মাতব্বর সাহেবের সঙ্গে আলাপ করে পরে আপনাকে জানাব। আপনি আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখবেন। এখন এসব কথা থাক, গ্রামের লোকজন যখন রয়েছেন তখন স্কুলের ব্যাপারে আলাপ করা যাক। তারপর আযীয সেখকে দেখিয়ে বললেন, উনি হাই স্কুল করার ব্যাপারে বেশ কিছু দিন আগে আমার সঙ্গে আলাপ করেছিলেন। সে সময় জায়গাও দেবেন বলেছিলেন। আমি ওনার কথা মতো সরকারের কাছে আবেদন করেছিলাম। সরকার আবেদন মঞ্জুর করে আজ লোক পাঠিয়েছে। আযীয সেখ স্কুলের জন্য যে জমিটা আমাকে দেখিয়েছেন, সেটা গ্রামের মাঝামাঝি ও মাঠের ধারে। উনি জমির দামও নেবেন না। সেই টাকা স্কুলঘর তৈরির কাজে লাগাতে বলেছেন। এখন আপনারা যদি আযীয সেখের জমিতে স্কুল করতে রাজি থাকেন, তা হলে বলুন। আমি সরকারী লোকদের সেকথা জানাব।

গ্রামের সব লোকজন একসঙ্গে বলে উঠল, আমরা রাজি। শুধু মাতব্বর ও রশিদ চুপ করে রইলেন।

তাই দেখে দারোগা ওনাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আপনি কিছু বললেন না যে?

আযীয সেখের অবস্থা আগে খারাপ থাকলেও এখন অনেক ভালো। ছোট ছেলে ইয়াসীর শহরে লেখাপড়া শেষ করে কুয়েতে চাকরি করে। তার পাঠান টাকায় অনেক জমি-জায়গা কিনেছেন।

কিছুদিন থেকে মাতব্বর লক্ষ্য করছেন, গ্রামের লোকজন তাকে আগের মতো মান্য করে না, ভক্তি শ্রদ্ধাও করে না। করে আযীয সেখকে। ইদানিং তারা তাকে মাতব্বর করতে চায়, সেকথা চামচাদের মুখে শুনেছেন। তাই মাতব্বর আযীয সেখের প্রতি খুব অসন্তুষ্ট। তাকে খুব হিংসাও করেন। স্কুলের জন্য টাকা না নিয়ে জমি দেবে শুনে অপমান বোধ করে তার উপর খুব রেগে গেলেন এবং হিংসা আরো বেড়ে গেল। দারোগার কথা শুনে সামলে নিয়ে বিদ্রূপ কণ্ঠে বললেন, আজকাল আযীয সেখের অনেক টাকা হয়েছে। সেতো বিনামূল্যে স্কুলের জন্য জমি দেবেই। আমি আর কি বলব? গ্রামের লোকজন যখন রাজি তখন আমিও রাজি।

দারোগা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে লোকজনদের চলে যেতে বললেন। সবাই চলে যাওয়ার পর সঙ্গের পুলিশ দু’জনকে বললেন, আপনারা এগোন, আমি একটু পরে আসছি।

পুলিশ দু’জন চলে যাওযার পর মাতব্বর ছেলেকে বললেন, দারোগা সাহেবের জন্য নাস্তার ব্যবস্থা কর।

রশিদ যেতে উদ্দ্যত হলে দারোগা তাকে নিষেধ করে বললেন, আমি বাইরে কারো বাড়িতে খাই না। দু’একটা কথা বলে চলে যাব। শুনুন, যে লোকটা আপনার ছেলের এই অবস্থা করেছে, তার সন্ধান পাওয়া গেছে।

কথাটা শুনে মাতব্বর আনন্দিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তাকে এ্যারেস্ট করেছেন?

খবর পেয়ে দু’জন পুলিশ নিয়ে সেখানে গিয়ে লোকটাকে পেয়েও এ্যারেস্ট করতে পারি নি।

এ্যারেস্ট করতে পারলেন না কেন?

ঘটনাটা বলছি শুনুন। লোকটার সন্ধান করার জন্য আমি যে কয়েকজন লোক লাগিয়েছি, তাতো আপনাকে বলেছি। আজ সকাল আটটার সময় তাদের একজন এসে জানাল, আপনার বর্ণনা মতো একজন লোককে এই গ্রামের পাশের গ্রামের দিকে যেতে দেখেছে। আমি দু’জন পুলিশ নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে রওয়ানা দিলাম।

গ্রামের কাছাকাছি গেছি, এমন সময় লোকটাকে ফিরে আসতে দেখে আমরাও তার দিকে এলোলাম। কাছাকাছি হতে লোকটা আমার সঙ্গে সালাম বিনিময় করে বলল, দারোগা সাহেব যে? কেমন আছেন?

ভালো আছি বলে আমি তার পরিচয় জিজ্ঞেস করলাম।

লোকটা বলল, আমি আল্লাহর এক নাদান বান্দা। আমার আর কোনো পরিচয় নেই।

বললাম, আপনার পরিচয় জানা আমার খুব দরকার।

কেন?

আপনার মতো একজন লোককে আমরা খুঁজছি।

কেন বলুন তো?

লোকটা বহেরচর গ্রামের মাতব্বরের ছেলে রশিদের একটা হাত কেটে দিয়েছে, আর একটা চোখও তুলে নিয়েছে।

লোকটা মৃদু হেসে বলল, আমাকে দেখে কি মনে হয়, আমিই সেই লোক?

বললাম, নোকমুখে লোকটার যে বর্ণনা পেয়েছি, সেসব আপনার সঙ্গে মিলে গেছে।

লোকটা বলল, ঠিকই বলেছেন। লোকটা অবশ্য আমারই মতো দেখতে। আমি তাকে চিনি এবং কেন সে ঐরকম জঘন্য কাজ করেছে তাও জানি। তবে তার সম্পর্কে যদি কিছু জানতে চান, তা হলে আমি যা করতে বলব, তা করার পর বলব।

বললাম, ঠিক আছে, বলুন কি করতে হবে।

বলল, আপনি একজন শিক্ষিত লোক হয়ে এটা বুঝতে পারছেন না কেন, কেউ শুধু শুধু এরকম জঘন্য কাজ করতে পারে না। নিশ্চয় এর পিছনে বড় কোনো কারণ আছে। আর প্রায় বিশ বাইশ বছর আগে সেই রকম কোনো বড় কারণে মাতব্বর সাহেব পুরুষাঙ্গ হারিয়েছেন। সেই কারণগুলো ওনাদের কাছে থেকে জানুন। তারপর আমিই আপনাকে সেই লোককে এ্যারেস্ট করার জন্য সন্ধান দেব।

তার কথা শুনে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কে আপনি? এর আগে আপনাকে তো কখনও দেখি নি।

বলল, বললাম না, আমি আল্লাহর এক নাদান বান্দা?

আমার ধারণা হল, এই লোকই সেই লোক। তাই সঙ্গের পুলিশ দু’জনকে লোকটাকে এ্যারেস্ট করতে বললাম।

তখন লোকটা ঝোলা থেকে একমুঠো বালি নিয়ে আমাদের চোখে মুখে ছুঁড়ে দিয়ে হো হো করে হাসতে লাগল।

আমরা চোখ মুখ পরিষ্কার করে দেখি লোকটা নেই। মনে হল বাতাসে মিলিয়ে গেছে। হতভম্ব হয়ে চারদিকে দেখতে লাগলাম। হঠাৎ শুনতে পেলাম, অনেক দূর থকে লোকটা যেন বলছে, যা জানতে বললাম জানুন, জানার পর আমি নিজে এসে অপরাধীকে ধরার ব্যবস্থা করে দেব।

শব্দটা আসছিল মাঠের দিক থেকে। আমরা সেদিকে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেলাম না। কিন্তু তার গলার শব্দ পেলাম, আহত রশিদের বুকের উপর ঢিল চাপা দেয়া একটা কাগজ ছিল। সেই কাগজটা মাতব্বর সাহেবের কাছে। আছে। তাতে লেখা আছে কেন লোকটা রশিদের এরকম অবস্থা করল।

এখন আপনারা যদি ঘটনার কারণটা বলেন ও সেই কাগজটা দেন, তা হলে আসামীকে ধরতে পারতাম।

মাতব্বর চিন্তা করলেন, আসামীকে ধরার জন্য থানায় কেস করা উচিত হয় নি। তাড়াতাড়ি বললেন, ঘটনার কারণ জানা থাকলে থানায় কেস দিতাম না। আমি নিজেই আসামীকে ধরে যা করার করতাম। আপনারা আসামীকে ধরে তার কাছ থেকে যা কিছু জানার জানবেন। আর কাগজের কথা যে বললেন, তা ঠিক নয়। আমার কাছে কোনো কাগজ নেই। আমার বিশ্বাস যে লোক আপনাদের চোখে বালি ছুঁড়ে পালিয়ে গেল, সেই আসামী। ভালো করে খুঁজলে তাকে ধরতে পারতেন।

দারোগা বললেন, বললাম না, আমারও মনে হয়েছিল ঐ লোকটা আসামী? তাইতো পুলিশ দু’জনকে এ্যারেস্ট করতে বলেছিলাম। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, এ্যারেস্ট করতে পরি নি। তবে একথা ঠিক, কতদিন আর পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে থাকবে? একদিন না একদিন ধরা পড়তেই হবে। ঐ যে কথায় আছে, চোরের দশদিন আর গৃহস্থের একদিন। আচ্ছা, এখন আসি তা হলে বলে সালাম বিনিময় করে দারোগা চলে গেলেন।

বাপবেটা দু’জনেই দারোগার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলেন। আড়াল হয়ে যেতে মাতব্বর বললেন, মনে হচ্ছে দারোগা গ্রামের লোকজনের কাছ থেকে আমাদের সম্পর্কে অনেক কিছু জেনেছে।

রশিদ বলল, গ্রামের কারো সাহস হবে না আমাদের কথা দারোগাকে জানাতে। তবে আযীয সেখের সঙ্গে দারোগার খুব খাতির শুনেছি। সে হয়তো জানাতে পারে।

হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হয়। শুনলাম, লোকজন তাকে মাতব্বর করার জন্য শলাপরামর্শ করছে।

কথাটা শুনে তুমি চুপ করে রয়েছ কেন? থানায় গিয়ে টাকা দিয়ে দারোগাকে হাত করো। তাকে দিয়েই আযীয সেখকে ঢিড করতে হবে।

দারোগা যখন লোকজনকে চলে যেতে বলেন তখন মাতব্বর চামচা শাকিলের কানে কানে বলেছিলেন, “সায়রা কোথায় যায় জেনে এসে বলবি।” তাকে আসতে দেখে ছেলেকে বললেন, চুপ কর, শাকিলকে একটা কাজে পাঠিয়েছিলাম, কি বলে শুনি।

শাকিল কাছে এসে বলল, সায়রা আযীয সেখের সঙ্গে তাদের ঘরে গেল। এতক্ষণ অপেক্ষা করেও বেরোতে দেখলাম না। মনে হয় ওখানে থেকেই স্বামীর ভিটেয় মাদ্রাসা তৈরির কাজ করবে।

মাতব্বর বললেন, ঠিক আছে, তুই এখন যা।

শাকিল চলে যাওয়ার পর রশিদ দাঁতে দাঁতে চেপে খুব রাগের সঙ্গে বলল, সায়রা, তখন আমি ছোট ছিলাম বলে পালাতে পেরেছিলি, এবার তোকে জ্যান্ত করব দেব।

মাতব্বর রেগে উঠে বললেন, এসব কি বলছিস? সাফিয়ার ইজ্জৎ লুঠতে গিয়ে একটা হাত ও একটা চোখ হারিয়েছিস, সায়রার কিছু করতে গেলে বাকি হাত ও চোখ হারাবি। আর দারোগা জানতে পারলে তোকে ফাঁসিতে ঝোলাবার ব্যবস্থা। করবে।

তুমি টাকা দিয়ে দারোগাকে আগে বস করো, তারপর দেখ, আমি সায়রার কি করি।

এতদিনে দারোগাকে যতটা বুঝেছি তাতেই মনে হয়েছে বিশ পঞ্চাশ হাজার নয়, লাখ টাকা দিলেও বসে আসবে না। তুই মাথা গরম করিস না। আমাকে চিন্তা করতে দে।

তোমাকে সাফিয়ার ব্যাপারটা কে বলেছে?

কেউ বলে নি। ঘটনার কয়েকদিন পর জয়নুদ্দিন একটা কাগজ আমার হাতে দিয়ে বলল, এটা মিয়া ভাইয়ের বুকের উপর একটা ঢিল চাপা দেয়া ছিল। কাগজটায় তোর অপকীর্তির কথা লেখাছিল।

তাই না কি? তা হলে ঐ লোকটা দারোগাকে ঠিক কথাই বলেছে?

হ্যাঁ, ঠিক কথাই বলেছে। তাইতো দারোগাকে উল্টো সিধে বলে বোঝালাম।

এখন তা হলে কি করবে? আযীয সেখ ও সায়রা আমাদের মান-ইজ্জৎ ডুবিয়ে দেবে আর আমরা চুপ করে বসে থাকব?

তা থাকব না, কিছু একটাতো করতেই হবে। তবে খুব ভাবনা-চিন্তা করে করতে হবে। তাই তো তোকে মাথা গরম করতে নিষেধ করলাম।

দারোগাকে হাত করতে না পারলে আমাদের কোনো আশাই পূরণ হবে না। কাল সকালে থানায় গিয়ে মোটা টাকা দিয়ে হাত করার চেষ্টা করো।

কথাটা অবশ্য তুই ঠিক বলেছিস; কিন্তু দারোগার টাকার লোভ নেই।

তবু তুমি চেষ্টা কর। যদি একলাখ চায়, রাজি হয়ে যেও। কথা শেষ করে রশিদ সেখান থেকে চলে গেল।

মাতব্বর সারাদিন চিন্তা করেও কি করবেন না করবেন ঠিক করতে পারলেন না। একলাখ টাকা চাট্টিখানি কথা নয়। তাতেও যদি দারোগা রাজি না হয় তখন কি করবেন?

রাত্রে খাওয়া দাওয়ার পর বারান্দায় বসে ছেলের সঙ্গে অনেকক্ষণ আলাপ করে সিদ্ধান্ত নিলেন, কাল থানায় গিয়ে একলাখ টাকা দিয়ে দারোগাকে হাত করবেন। আলাপ করতে করতে এগারটা বেজে গেল।

আজ পূর্ণিমা। চাঁদের আলোতে চারপাশ দিনের মতো হয়ে আছে। আলাপ শেষ করে ঘুমাতে যাওয়ার জন্য বাপ বেটা উঠে দাঁড়িয়েছে, এমন সময় রশিদ দেখতে পেল, উঠোনের মাঝখানে লম্বা চওড়া সাদা পোশাকে ঢাকা একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। জিজ্ঞেস করল, কে ওখানে?

লোকটা কোনো সাড়া না দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।

ছেলের কথা শুনে মাতব্বরও তাকে দেখতে পেয়ে বললেন, কথা বলছ না কেন? কে তুমি?

লোকটা বলল, আমি জিন।

জিন শুনে রশিদ খুব ভয় পেয়ে কাঁপতে লাগল। সে শুনেছে, জিনেরা মানুষের ক্ষতি করে বেড়ায়।

মাতব্বর বয়স্কলোক। ভয় পেলেন না। জিজ্ঞেস করলেন, এখানে এসেছ কেন?

আপনাদের বাপ বেটাকে কঠিন শাস্তি দিতে।

আমরা তো তোমার কোনো ক্ষতি করি নি, তবু শাস্তি দিতে এসেছ কেন?

আমার ক্ষতি না করলেও গ্রামের গরিবদের অনেক ক্ষতি করেছেন।

না, আমরা কারো কোনো ক্ষতি করি নি। বরং দুঃসময়ে টাকা পয়সা দিয়ে তাদেরকে সাহায্য করি।

যতটুকু সাহায্য করেন তার থেকে অনেক বেশি ক্ষতি করেন।

কার কি ক্ষতি করেছি বলতে পারবে?

কেন পারব না? মঈন সেখের বিধবা স্ত্রী সায়রার ইজ্জৎ লুঠতে গিয়েছিলেন, সেটা বুঝি ভালো কাজ? অবশ্য সেজন্য আপনাকে পুরুষাঙ্গ হারাতে হয়েছে। সুস্থ হয়ে ল্যাংড়া চামচিকা ফজলু ভিখেরির সাথে সায়রার দুর্নাম রটিয়ে তার সাথে নিকে দিতে চেয়েছিলেন। সেজন্য সায়রা সাত বছরের ছেলে হালিমকে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। মঈন সেখের ভিটে দখল করে গাছপালা লাগিয়ে ভোগ করছেন। গ্রামের সুন্দরী বৌ, ঝি নজরে পড়লে তাদের ইজ্জৎ লুটেছেন। আপনার ছেলে ঐ রশিদও অনেক বৌ-বেটির ইজ্জৎ নষ্ট করেছে। সাফিয়ার ইজ্জৎ লুঠতে গিয়ে একটা হাত ও একটা চোখ হারিয়েছে। এখন আবার দারোগাকে একলাখ টাকা দিয়ে হাত করে সায়রা ও আযীয সেখকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বাপ বেটায় আরো যে কতকিছু করেছেন, সেসব বলতে গেলে রাত ভোর হয়ে যাবে। এতদিন আপনাদের অত্যাচার সহ্য করলেও আর পারছি না। তাই যাতে আর কারো কোনো ক্ষতি করতে না পারেন, সেজন্য বাপ বেটার ঘাড় মটকে দিতে এসেছি।

জিনের কথা শুনে রশিদ ভয়ে বাপকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, এবারের মতো মাফ করে দাও। আমরা আর কারো এতটুকু ক্ষতি করব না।

জিনের কথা শুনে মাতব্বরও এবার খুব ভয় পেলেন। তিনি কাকুতি মিনতি করে ছেলের মতো একই কথা বললেন।

জিন বলল, মানুষ খুব বেঈমান। তারা কথা দিয়ে কথা রাখে না। আমি আপনাদের কথা বিশ্বাস করি না। এখন জান বাঁচাবার জন্য যে কথা বলেছেন, কয়েকদিন পর তা ভুলে যাবেন। তাই আপনাদের ঘাড় মটকে দিয়ে চলে যাব।

এই কথা শুনে রশিদ জ্ঞান হারিয়ে বারান্দার মেঝেয় পড়ে গেল। আর মাতব্বর কাকুতি মিনতির সঙ্গে আল্লাহর কসম খেয়ে বললেন, ওয়াদা করছি, আমরা আর কোনো দিন কারো এতটুকু ক্ষতি করব না। যদি যদি করি, তা হলে তোমার যা ইচ্ছা তাই করো।

জিন বলল, আল্লাহর কসম খেয়ে যখন ওয়াদা করলেন তখন মাফ করে দিলাম। কিন্তু মনে রাখবেন, ওয়াদা ভঙ্গ করলে আপনাদের ঘাড় মটকে দেবই। সেদিন কোনো অজুহাত শুনব না। তারপর সেখান থেকে চলে যাওয়ার সময় বলল, রশিদের এই অবস্থা আমিই করেছি। দুনিয়া চষে ফেললেও কেউ আমার খোঁজ পাবে না।

.

০৬.

বিশ বাইশ বছর আগে সায়রা সাত বছরের হালিমকে নিয়ে গ্রাম থেকে পালিয়ে আসার সময় ভাবল, ভাইয়ের বাড়িতে গিয়ে থাকবে। গতর খাঁটিয়ে ছেলেকে মানুষ করবে। হঠাৎ তার মনে হল, ভাইয়ের বাড়ি বেশি দূরে নয়। মাতব্বর জানতে পারলে লোক পাঠিয়ে ধরে নিয়ে এসে হয় ফজলুর সঙ্গে নিকে দেবে। আর তা না হলে সেই লোকদের বলবে ইজ্জৎ লুঠে নিয়ে গলাটিপে মেরে নদীতে ভাসিয়ে দিতে। কথাটা মনে হতে ভাইয়ের বাড়ির পথ বদলে বাস বাস্তার পথ ধরল। ঘণ্টা দুই হাঁটার পর বাস রাস্তায় উঠে পটুয়াখালী শহরের দিকে হাঁটতে লাগল। যখন শহরে এসে পৌঁছাল তখন মসজিদে ফজরের আজান হচ্ছে।

আসার সময় ক্লান্ত হয়ে পথে অনেক জায়গায় বিশ্রাম নিয়েছে। এক জায়গায় বিশ্রাম নেয়ার সময় হালিমতো ঘুমিয়ে পড়েছিল। সায়রা তাকে জাগিয়ে অনেক কষ্ট সহ্য করে এসেছে। তাই শহরের পৌঁছে রাস্তার ধারে একটা বাড়ির খোলা বারান্দায় বিশ্রাম নিতে গিয়ে মায়ে পুতে ঘুমিয়ে পড়ল।

কারো ডাকাডাকিতে ঘুম ভেঙে যেতে সায়রা দেখল, একজন বয়স্ক মহিলা ঝাড় হাতে দাঁড়িয়ে আছে।

তাকে জাগতে দেখে মহিলাটি বলল, কে তুমি? এখানে ঘুমিয়েছিলে কেন? যাও এখান থেকে।

সায়রা বলল, আমি গ্রাম থেকে এসেছি কারো বাড়িতে কাজ করব বলে।

মহিলা জিজ্ঞেস করল, ছেলেটা কে?

আমারই ছেলে।

ওর বাবা নেই?

না, পাঁচ ছ’মাস হল মারা গেছে। মারা যাওয়ার পর খুব কষ্টে দিন কাটছিল। কষ্ট সহ্য করতে না পেরে ছেলেকে নিয়ে কাজের চেষ্টায় এসেছি। আমাকে আপনি রাখবেন? সংসারের সবকাজ আমি করব।

মহিলা মুখ ঝামটা মেরে বলল, না রাখব না। তোমার মতো সুন্দরী স্বাস্থ্যবতী কাঁচা বয়সের মেয়েকে ঘরে রাখা মানে খাল কেটে কুমীর আনা। তোমাকে দেখলেই আমার স্বামীর মাথা ঘুরে যাবে। তাড়াতাড়ি এখান থেকে চলে যাও।

আমরা কাল থেকে কিছু খাই নি। বাসি কিছু থাকলে ছেলেটাকে অন্তত কিছু দিন। আল্লাহ আপনার ভালো করবে।

মহিলার স্বামী ডায়বেটিস রুগী। ডাক্তারের কথামতো প্রতিদিন ভোরে এক দেড় ঘণ্টা হাঁটেন। আজও হাঁটতে গেছেন। সায়রা বাসি খাবার চাইতে ভাবল, স্বামীর ফেরার সময় হয়ে গেছে। ফিরে এসে এর কথা জেনে যদি কাজ করার জন্য রাখতে চায়। তাই বাসি খাবার দেয়ার ইচ্ছা থাকলেও বলল, না, ঘরে বাসি খাবার কিছু নেই। তুমি ছেলেকে নিয়ে তাড়াতাড়ি চলে যাও।

সায়রা একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে হালিমকে জাগাল। তারপর একটা হাত ধরে অন্য হাতে কাপড়ের পুঁটলি নিয়ে বাড়িবাড়ি ঘুরতে লাগল কাজের চেষ্টায়। কিন্তু তার রূপ ও কাঁচা বয়স, তার উপর সাত বছরের ছেলেসহ কেউ কাজে রাখতে চাইল না। তবে কেউ কেউ তাদেরকে খেতে দিয়েছে।

এভাবে দিনের বেলা কাজের চেষ্টা করে আর রাতে কারো বাড়ির বারান্দায় ঘুমায়। আজ যে বাড়ির বারান্দায় ঘুমিয়েছিল, সেই বাড়ির মালিক আবু তাহের। উনিই বাহেরচর গ্রামের মুসার ভাইরা। তিনি মসজিদে ফজরের নামায পড়তে যাওয়ার সময় তাদেরকে দেখে ভাবলেন, আল্লাহর কুদরত বোঝা মানুষের অসাধ্য। কেউ পাকা বাড়িতে খাটের উপর গদীতে ঘুমায়, আবার কেউ রাস্তা ঘাটে মাটিতে ঘুমায়। কেউ মাছ-গোস, পোলাও-কোর্মা খাচ্ছে, আবার কেউ না খেতে পেয়ে অখাদ্য কুখাদ্য খাচ্ছে। আবার কেউ না খেয়ে দিন কাটাচ্ছে। প্রায় প্রত্যেক দিন তিনি কোনো না কোনো ভিক্ষুককে এখানে ঘুমিয়ে থাকতে দেখেন। আজও সেরকম মনে করে মসজিদে চলে গেলেন। রাস্তার লাইট পোেস্ট বেশ দূরে। তা ছাড়া ওনার বাড়ির সামনে একটা বড় লিচু গাছ থাকায় বারান্দাটা অন্ধকার। তাই ভিক্ষুকের জায়গায় একটা মেয়ে যে তার ছেলেকে নিয়ে ঘুমিয়ে আছে, তা বুঝতে পারলেন না।

আবু তাহের নামাযের পর কুরআন তেলাওয়াত করেন। তারপর এশরাকের নামায পড়ে ফেরেন। প্রতিদিনকার মতো আজও ফিরে এসে ভিক্ষুককে জাগাতে গিয়ে সায়রাকে চিনতে পারলেন।

এখন বেশ একটু বেলা হয়েছে। তাছাড়া সায়রা মুখে কাপড় ঢেকে ঘুমালেও ঘুমের ঘোরে খুলে গেছে।

বিচারের দিন ঘরে এসে ভাইরা মুসার মুখে মাতব্বরের স্বভাবের কথা ও সায়রা যে তার পুরুষাঙ্গ কেটে দিয়েছিল এবং প্রতিশোধ নেয়ার জন্য মাতব্বর যে বিচারের প্রহসন করেছিলেন, সেসব শুনেছিলেন। প্রমাণ করার জন্য সায়রা যখন মুখের নেকাব খুলেছিল তখন তাকে দেখেছিলেন। ঐ দিন যে ছেলেকে নিয়ে গ্রাম ছেড়ে পালিয়েছে, তাও পরের দিন ভাইরার মুখে শুনেছেন। তাই তাকে চিনতে না পেরে ভাবলেন, তা হলে মেয়েটা ছেলেকে নিয়ে এখানে পালিয়ে এসেছে? মা ও ছেলের মলিন মুখ দেখে যা বোঝার বুঝে গেলেন। ছেলেটার গায়ে হাত দিয়ে জাগিয়ে বললেন, তোমার মাকে জাগাও।

হালিম মাকে জাগিয়ে বলল, আম্মা ওঠো, অনেক বেলা হয়ে গেছে।

সায়রা একজন দাড়ি টুপিওয়ালা লোককে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে তাড়াতাড়ি গায়ে মাথায় কাপড় দিয়ে উঠে বসল। তারপর পুঁটলিটা নিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, চল।

আবু তাহের বললেন, তুমি আমাকে না চিনলেও আমি তোমাকে চিনি। বাহেরচরের মরহুম মঈন সেখের স্ত্রী না তুমি?

সায়রা বলল, জি।

তোমাদের গ্রামের মুসা আমার ছোট ভাইরা। তোমার বিচারের সময় আমি তার সঙ্গে ছিলাম। ঐ রাতেই তুমি গ্রাম ছেড়েছ, তা পরের দিন শুনেছি। মুসার কাছে তোমার ও তোমার প্রতি মাতব্বরের অত্যাচারের কথাও শুনেছি। মাতব্বর মানুষ নয় পশু। গ্রাম ছেড়ে এসে ভালই করেছে। এখানে এসে যে বিপদে পড়েছ, তা বুঝতে পারছি। মানুষের বিপদে সাহায্য করা প্রত্যেকের উচিত। তুমি মেয়ে মানুষ, তোমার বয়স কাঁচা। এখানে পদে পদে বিপদ। বিপদগ্রস্থ মানুষকে সাহায্য করলে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (দঃ) খুশী হবেন। তাই আমি তোমাকে সাহায্য করতে চাই। আমাকে বাপ-চাচার মতো মনে করে আমাদের বাড়িতে থাক। মনে হচ্ছে, এই তিন চার দিন তোমাদের তেমন খাবার জোটে নি। ঘরে চল, কিছু খাওয়ার পর যা বলার বলল।

আবু তাহেরের কথা শুনে সায়রা মুখ নিচু করে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে ভাবল, বিচারের সময় পাথর মারার বিরুদ্ধে ইনিই তা হলে প্রতিবাদ করেছিলেন। শহরে এরকম লোক আছে ভেবে অবাক হল।

মাকে চুপ করে কাঁদতে দেখে হালিম বলল, চল না মা, লোকটা খেতে দেবে বলছে। আমি যে আর ভুখ সহ্য করতে পারছি না।

আবু তাহের হালিমকে বললেন, আমি তোমার নানা হই। মাকে সাথে করে নিয়ে এস। তারপর ঘরে ঢুকে স্ত্রীকে সংক্ষেপে সায়রা ও হালিমের পরিচয় বলে বললেন, ওদেরকে ডেকে নিয়ে এসে কিছু খেতে দাও।

আবু তাহেরের স্ত্রী ফারযানা বেগম এস,এস, সি পাশ হলেও আলেম স্বামীর সংস্পর্শে আলেমা হয়ে গেছেন। তাই স্বামীর কথা শুনে বেরিয়ে এলেন। সায়রাকে কাঁদতে দেখে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, কেঁদে আর কি করবি মা, সবই তকুদীর। তারপর তাদেরকে ঘরে নিয়ে এসে কলতলা দেখিয়ে বললেন, হাত মুখ ধুয়ে আয়, আমি তোদের খাওয়ার ব্যবস্থা করি।

ফারযানা বেগম স্বামীর কাছে সায়রার সম্পর্কে অল্প কিছু শুনে তার বিপদের কথা আঁচ করতে পেরেছিলেন। খাওয়ার পর সায়রার কাছে বিস্তৃত শুনে বললেন, আমাদের কোনো ছেলে সন্তান আল্লাহ দেন নি। দু’টো মেয়ে দিয়েছিলেন। বড়টা ছোট বেলায় পানিতে ডুবে মারা গেছে। ছোটটা বিয়ের পর ছেলেপুলে হওয়ার আগে মারা গেছে। এটা গ্রাম নয় যে কারো বাড়িতে কাজ করে পেটের ভাত জোগাবি। এটা শহর। এখানকার মানুষের দয়া মায়া কম। তা ছাড়া শহরের লোকজনের চরিত্রও ভালো না। কারো বাড়িতে কাজ পেলেও সুযোগ পেলে তোর ইজ্জতের উপর হামলা করবে। আল্লাহ যখন তোদেরকে আমাদের কাছে এনে দিয়েছে তখন এখানেই থাক। আমাদের কাছে মেয়ের মতো থাকবি। তোর ছেলেকে লেখাপড়া করিয়ে মানুষ করব।

অকূল সাগরে সাঁতার কাটতে কাটতে ডুবে যাওয়ার আগে পায়ে মাটি ঠেকলে যেমন বাঁচার আনন্দে আনন্দিত হয়, ফারনা বেগমের কথা শুনে সায়রারও তাই হল। আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে তার দু’পা জড়িয়ে ধরে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল; কোথায় আর যাব আম্মা, আপনারা ছাড়া আমার যে আর জায়গা নেই। আমি আপনাদের মেয়ে হয়েই থাক।

তার কথা শুয়ে ফারযানা বেগমের চোখে পানি এসে গেল। চোখ মুছে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বললেন, তোদেরকে পেয়ে কত যে খুশী হয়েছি তা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। তারপর সায়রার চোখ মুছে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ছেলের কি নাম রেখেছিস?

হালিম।

হালিম আল্লাহর গুণবাচক নাম। শুধু ঐ নাম রাখতে নেই। তাই আজ থেকে ওর নাম আব্দুল হালিম। যার অর্থ হল আল্লাহর গোলাম। তারপর হালিমকে বললেন, তুই আমাকে নানি ডাকবি আর ওনাকে নানা ডাকবি। আমরা তোকে লেখাপড়া করাব।

হালিম যখন পাড়ার ছেলেমেয়েদের বই-খাতা নিয়ে স্কুলে যেত দেখত তখন তারও খুব ইচ্ছা হত বই-খাতা নিয়ে স্কুলে যেতে। একদিন মাকে সেকথা বলেছিল। সায়রা বলেছিল, গরিবের ছেলের আবার লেখাপড়া। তোর বাপ দু’বেলা পেটের ভাত যোগাড় করতে পারে না, তোর বই খাতা কিনে দেবে কি করে?

এখন লেখাপড়া করাবার কথা শুনে হালিম খুশী হয়ে বলে উঠল, সত্যি বলছ নানি?

ফারযানা বেগম বললেন, হ্যাঁরে সত্যি। তোর নানাকে বলব তোকে মাদ্রাসায় ভর্তি করে দিতে।

সায়রা বলল, আমি আপনাদের আম্মা আব্বা বলে ডাকব। আপনাদের কাছে। আমিও লেখাপড়া করব।

তার কথা শুনে ফারনা বেগমের চোখে আবার পানি চলে এল। তাকে জড়িয়ে ধরে চুমো খেয়ে বললেন, মেয়ে হিসাবে যখন গ্রহণ করেছি তখন তো আমাদেরকে আম্মা আব্বা বলবি। মেয়েকে কি আর আমরা মুগ্ধ করে রাখব? তোকে আমরা সব বিষয়ে শিক্ষিত করে তুলব।

সায়রা ফারযানা বেগমের পায়ে হাত ছুঁয়ে সালাম করে বলল, দোয়া করবেন, আল্লাহ যেন আমাকে আপনাদেকে আজীবন সেবা করার সুযোগ দেন।

.

আবু তাহের ও ফারযানা বেগমের হৃদয়ে সন্তানের জন্য যে আগুন জ্বলছিল, সায়রা ও হালিমকে পেয়ে আল্লাহ সেই আগুনে যেন পানি ঢেলে দিলেন।

আবু তাহের হালিমকে মাদ্রাসায় ভর্তি করে দিলেন। আর ফারযানা বেগম অবসর সময়ে সায়রাকে আরবি, বাংলা ও ইংরেজি শেখাতে লাগলেন। সেই সাথে মা বেটাকে ধর্মীয় শিক্ষা দিয়ে অনুসরণ করাতে লাগলেন।

মা ও ছেলের মেধা ভালো। তাই সায়রা ফারযানা বেগমের কাছে লেখা পড়া করে ক্রমশ আলেমা হয়ে উঠতে লাগল। আর আবু তাহেরের প্রচেষ্টায় হালিম প্রতি বছর ফাস্ট হয়ে একের পর এক উপরের ক্লাসে উঠতে লাগল।

সায়রা ছোটবেলা থেকে সুন্দরী। পনের ষোল বছর বয়সে বিয়ে হওয়ার পর আরো সুন্দরী হয়ে ওঠে। বিয়ের দু’বছরের মধ্যে হালিম জন্মাবার পর ও সংসারের অভাব অনটের জন্য চেহারার জৌলুস কমে গিয়েছিল। আবু তাহেরে বাড়িতে ভালো খেয়ে ভালো পরে ও নিশ্চিতে থাকার ফলে বছর খানেকের মধ্যে তার চেহারার জৌলুস অনেক বেড়ে গেল। এখন তার বয়স পাঁচিশ ছাব্বিশের মতো। কিন্তু অচেনা কেউ দেখলে মনে করবে এখনও তার বিয়ে হয় নি।

সবকিছু দেখে শুনে ফারযানা বেগম একদিন স্বামীকে বললেন, সায়রার আবার বিয়ে দেয়া উচিত। কতই বা বয়স? আজকাল ওর বয়সেই মেয়েদের বিয়ে হচ্ছে।

আবু তাহের বললেন, আমার মনের কথা আল্লাহ তোমার মুখ দিয়ে বলালেন। কথাটা আমিও তোমাকে বলব বলব করেও বলা হয় নি। তুমি ওকে বলে দেখ কি বলে। হালিম আমাদের কাছেই থাকবে। ওকে মস্ত বড় আলেম করার ইচ্ছা করেছি, বাকি আল্লাহর মর্জি।

ফারযানা বেগম একদিন সায়রাকে স্বামীর ইচ্ছার কথা জানিয়ে বললেন, আমারও তাই ইচ্ছা। আমাদের ভুল বুঝবি না। আমরা তোর ভালোর জন্য কথাটা বললাম, নিজের পেটের মেয়ে হলেও তাই করতাম।

সায়রা কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে রইল। তারপর চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলল, কোনো কারণেই আমি আপনাদের ভুল বুঝব না। আপনারা যে আমার ভালো চান, তা জানি। কিন্তু আম্মা কিছুতেই আমি আর বিয়ে করব না। আপনারা আশ্রয় দিয়ে যে উপকার করেছেন, সারাজীবন আপনাদের সেবা যত্ন করলেও তার। প্রতিদান হবে না। তবু আজীবন তাই করে যাব। এখানে আসার পর হালিমকে। নিয়ে যে স্বপ্ন দেখেছি, সেই স্বপ্ন পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আমি শান্তি পাব না। আপনারা দোয়া করবেন, আল্লাহ যেন আমার স্বপ্ন পূরণ করেন। আপনারা যা বলবেন, জান দিয়ে হলেও তা করব। শুধু বিয়ের কথা বলবেন না। আপনি আব্বাকে আমার কথাগুলো জানিয়ে বলবেন, আপনাদের ইচ্ছা পূরণ করতে পারলাম না বলে মাফ চাইছি। তারপর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।

ফারজানা বেগম তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, কাঁদিস না মা, কাঁদিস না। তোর কাঁচা বয়সের কথা চিন্তা করে আমরা তোর আবার বিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। তুই যখন চাচ্ছিস না তখন আর তোর অমতে কিছু করব না। হালিমকে নিয়ে কি স্বপ্ন দেখেছিস বলতো শুনি।

হালিমকে আমি এমনভাবে মানুষ করতে চাই, যেন বাহেরচর গ্রামের মাতব্বর বা তার মতো আর কেউ যেন গরিবদের উপর এতটুকু অত্যাচার করতে না পারে, কোনো বৌ-বেটি যেন তাদের হাতে ইজ্জৎ না হারায়। সবাই যেন শান্তিতে বাস করতে পারে। বলুন আম্মা, আপনারাও কি তাই চাইবেন না?

ফারযানা বেগম বললেন, নিশ্চয় চাইব। দোয়া করি, আল্লাহ যেন তোর মনের আশা পূরণ করেন। তোর আব্বাকেও দোয়া করতে বলব।

রাতে ঘুমাবার সময় ফারযানা বেগম স্বামীকে সায়রার বিয়েতে অমতের ও তার স্বপ্নের কথা বললেন।

আবু তাহের বললেন, ওর উদ্দেশ্য মহৎ। আল্লাহ বান্দাদের মহৎ উদ্দেশ্য পূরণ করেন। দোয়া করি, তিনি যেন ওর স্বপ্ন সফল করেন।

.

হালিম কামিলে খুব ভালো রেজাল্ট করে একদিন মা ও নানা-নানিকে জানাল, ঢাকায় গিয়ে ইংলিশে অনার্স করবে।

সায়রা ছেলেকে তার স্বপ্নের কথা আগেই জানিয়েছিল। তাই ঢাকায় পড়তে যাওয়ার কথা শুনে সবার আগে বলে উঠল, আর পড়াশুনা করার দরকার নেই। এবার আমার স্বপ্ন পূরণ করার কথা চিন্তা কর কিভাবে কি করবি।

হালিম বলল, আম্মা স্বপ্ন শুধু তুমি দেখ নি, আমিও দেখেছি। তখন ছোট ছিলাম, তবু কিছু বুঝতে শিখেছিলাম। তাই গ্রাম ছেড়ে আসার সময় মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, বড় হয়ে যেমন করে তোক তোমার প্রতি অত্যাচারের প্রতিশোধ নেব। আর গ্রামের গরিব লোকদের মাতব্বরের অত্যাচার থেকে রক্ষা করব। গ্রামে ফিরে সে সব করার উপযুক্ত এখনও হই নি। উপযুক্ত হওয়ার জন্য আমাকে অনেক কিছু শিখতে হবে। ঢাকায় গিয়ে পড়াশোনার সাথে সাথে সেসব শিখব। সবাই দোয়া করুন, আল্লাহ যেন আমাকে কামিয়াব করেন।

ফারযানা বেগম বললেন, আর নানা-নানির স্বপ্ন পূরণ করিব না?

হালিল বলল, নিশ্চয় করব। আপনারা মুরুব্বী। আপনাদের স্বপ্ন পূরণ করলে আল্লাহ খুশী হবেন। আপনাদের কি স্বপ্ন বলুন।

আমরা কতদিন থেকে স্বপ্ন দেখছি। কামিল পাশ করার পর তুই উপার্জন করবি, আমরা তোর বিয়ে দিয়ে লাল টুকটুকে নাতবৌ নিয়ে আসব।

কথাটা শুনে সায়রা ও আবু তাহেবের মুখে হাসি ফুটে উঠল।

আর হালিম লজ্জা পেয়ে কয়েক সেকেন্ড মুখ নিচু থেকে বলল, আপনাদের স্বপ্নও ইনশাআল্লাহ পূরণ করব। তবে তার আগে আম্মার স্বপ্ন পূরণ করার সময় পর্যন্ত আমাকে সময় দিতে হবে।

ফারযানা বেগম মেকী একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (দঃ) যখন সবার থেকে মায়ের আদেশ মানার প্রধান্য দিয়েছেন তখন সময় তো দিতেই হবে। দোয়া করি, মায়ের স্বপ্ন সফল করার পর আমাদের স্বপ্ন পূরণ করার তওফিক আল্লাহ তোকে যেন দেন। সবাই একসঙ্গে বলে উঠল, আমিন।

৭-৮. দুবছর হতে চলল

০৭.

দু’বছর হতে চলল হালিম ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ছে। সে এখন পাঁচিশ ছাব্বিশ বছরের যুবক। সাড়ে ছ’ফুট লম্বা, চুয়াল্লিশ ইঞ্চি ছাতি, ফর্সা টকটকে, খাড়া নাক, চওড়া কপালের নিচে একজোড়া ভ্রমর কালো দাড়ি রাখায় চেহারার সৌন্দর্য আরো বেড়ে গেছে। যে কেউ তার দিকে তাকালে সহজে দৃষ্টি সরিয়ে নিতে পারে না। ক্লাসের সেরা ছাত্র। ফার্স্ট ইয়ার ক্লাস করার সময় আকর্ষণীয় চেহারার কারণে ছেলেদের কাছে ঈর্ষণীয় হলেও মেয়েদের কাছে আকর্ষণীয় ছিল। তবে তার দাড়ির জন্য কেউ কাছে আসে নি। ফার্স্ট ইয়ারের পরীক্ষায় সবার থেকে ভালো রেজাল্ট করার পর থেকে শুধু মেয়েরা নয়, ছেলেরাও বন্ধুত্ব করার জন্য কাছে ভীড়তে শুরু করল।

হালিম খুব ধীর ও নম্র স্বভাবের ছেলে। প্রয়োজন ছাড়া যেচে কারো সঙ্গে কথা বলে না। মেয়েদেরকে খুব এড়িয়ে চলে। তা সত্ত্বেও সেকেন্ড ইয়ারে যখন ছেলেমেয়েরা নানান অজুহাতে তার কাছে আসতে লাগল তখন বিরক্ত বোধ করলেও তাদের সঙ্গে আলাপ করে। যারা নোট চায়, তাদেরকে নোট দেয়। কিন্তু কাউকেই যেমন ঘনিষ্ঠ হতে দেয় নি, তেমনি নিজেও কারো সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয় নি।

মেয়েদের মধ্যে রাফিয়া বড় লোকের সুন্দরী কন্যা ও ভালো ছাত্রী। হালিম তার নজর কাড়লেও ধারে কাছে যায় নি। এমনকি পরিচয়ও করে নি।

ফার্স্ট ইয়ারে যে সব সহপাঠিরা নোট নেয়ার জন্য ও বন্ধুত্ব করার জন্য রাফিয়ার কাছে ভীড় করত, তাদের বেশিরভাগ ছেলে মেয়ে এখন হালিমের কাছে ভীড় করে। এজন্যে সে হালিমকে খুব ঈর্ষা করে।

একদিন রাফিয়া ঘনিষ্ঠ বান্ধবী শবনমকে বলল, কিরে, সবাই হালিমের কাছে নোট দিতে যায়, তুই যাস নি?

শবনম তার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে বলল, না যাই নি।

কেন বলতো?

আমি তো তোর কাছে নোট নিই। তা ছাড়া মোল্লা টাইপ ছেলেদের আমি মোটেই পছন্দ করি না। দেখলে গা রি-রি করে।

রাফিয়া হেসে উঠে বলল, কেন রে, মোল্লারা কি তোর কোনো ক্ষতি করেছে?

আমার না করলেও অন্যের করেছে। কেন, তুই কি জানিস না, মুক্তিযুদ্ধের সময় মোল্লারা পাক বাহিনীকে সাহায্য করেছিল, মুক্তিবাহিনীর খোঁজ দিয়েছিল, পাক বাহিনীর লিডারদের খুশী করার জন্য মেয়ে যোগাড় করে দিয়েছে?

তোর কথা অস্বীকার করব না। তবে তুইও বোধ হয় জানিস না, সব মোল্লারা পাক বাহিনীকে সাহায্য সহযোগিতা করে নি। বরং মুক্তি বাহিনীকে টাকা পয়সা ও আশ্রয় দিয়ে সাহায্য করেছে। আবার অনেক মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। তাদের অনেকে কমান্ডিংও করেছেন। আসল কথা কি জানিস, সব মানুষ যেমন এক রকম হয় না, তেমনি সব মোল্লারাও খারাপ নয়। ভালো মন্দ সব মানুষের মধ্যে আগের যুগেও ছিল এযুগেও আছে এবং ভবিষ্যৎ যুগেও থাকবে। এ কথা তুই জানিস কিনা জানি না। মোল্লারাই কিন্তু আল্লাহকে ভয় করে ধর্মের বিধি-বিধান মেনে চলে। তারা কারো এতটুকু ক্ষতি করে না। এমন কি যে কোনো অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকে।

শবনম রেগে উঠে বলল, তুই ঘোড়ার ডিম জানিস। দাদির কাছে শুনেছি। তাদের গ্রামের মাতব্বর দাড়ি রেখে মাথায় টুপি দিয়ে নানান অপকীর্তি করে বেড়াত। ঘরে চারটে স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও গরিব ঘরের মেয়েদের ইজ্জৎ নষ্ট করত। এদিকে আবার নামায রোযাও ঠিকমতই করত।

রাফিয়া আবার হেসে উঠে বলল, দু’একজন মোল্লা খারাপ বলে সব মোল্লাই যে খারাপ, তা ভাবা ঠিক নয়। আমিও নানির কাছে শুনেছি, আগেকার পুরুষদের শক্তি সামর্থ যেমন বেশি ছিল, তেমনি সেক্সও বেশি ছিল। যারা সেক্সি ছিল, তারা একাধিক বিয়ে করত। শুধু পুরুষদের নয়, মেয়েদেরও ছিল। তারা স্বামীর কাছে তৃপ্তি না পেলে অবৈধ পন্থায় সেক্স মেটাত। আকজালও যে এরকম নেই তা নয়। কি গ্রামে কি শহরে খোঁজ নিলে জানতে পারবি। পেপারে পড়িস নি, দু’তিন ছেলেমেয়ের মা অন্যের সঙ্গে প্রেম করে পালিয়ে যাচ্ছে। এর কারণ অনুসন্ধান করলে জানা যাবে, ঐ মেয়েটি স্বামীর। কাছে থেকে সেক্সের ব্যাপারে তৃপ্তি পায় নি।

গ্রামের থেকে শহরের শিক্ষিত পুরুষরা ঘরে স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন ক্লাবে বা নিষিদ্ধ পল্লীতে গিয়ে সেক্স মেটাচ্ছে। তুলনামূলকভাবে দেখলে অন্যদের চেয়ে মোল্লারা অনেক ভালো। তারা সেক্স মেটাবার জন্য অবৈধ পথে না গিয়ে একাধিক বিয়ে করে।

তুই এসব জানলি কি করে? এগুলোও কি তোর নানির কাছে শুনেছিস?

হ্যাঁ, তুই ঠিক বলেছিস। উনি পুরুষ ও নারী সম্পর্কে আরো এমন অনেক কথা বলেছেন, যা শুনলে তোর বিশ্বাসই হবে না।

নাই বিশ্বাস হোক, তবু তুই বল।

ওরা অফ পিরিয়ডে বারান্দায় এককোণে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। রাফিয়া ঘড়ি দেখে বলল, অন্য দিন বলব। এখন সময় হয়ে গেছে ক্লাসে যাই চল।

ক্লাসে যেতে যেতে শবনম বলল, তুই তা হলে মোল্লাদের পছন্দ করিস?

রাফিয়া অবজ্ঞা স্বরে বলল, আরে দূর, তোর মতো আমিও ওদেরকে একদম পছন্দ করি না।

তবে তুই যে এতক্ষণ ওদের ফরে কথা বললি?

ওগুলো নানির কাছে শোনা কথা, আমার নয়।

তাই বল, আমি তো মনে করেছি, হালিম মোল্লা বলে মোল্লাদের ফরে বললি।

রাফিয়া দাঁড়িয়ে পড়ে চোখ পাকিয়ে বলল, হালিমের কথা বললি কেন তোকে বলতে হবে।

কথাটা হঠাৎ মনে হল, তাই বললাম, কিন্তু তোর রাগ দেখে মনে হচ্ছে, দেয়ার ইজ সামথিং হ্যাঁজ?

তুই কিন্তু সত্যিই খুব বাড়াবাড়ি করছিস।

আমি বাড়াবাড়ি করি নি। করছিস তুই। কথাটা হঠাৎ মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। কথাটা সিরিয়াসভাবে নিচ্ছিস কেন? তারপর স্যারকে ক্লাসে ঢুকতে দেখে বলল, চল যাই।

.

একদিন রাফিয়া একটা বই নেয়ার জন্য লাইব্রেরিতে ঢুকে দেখল, হালিম এক কোণের টেবিলে বসে নোট করছে। সে মোল্লা ও তার থেকে ভালো ছাত্র বলে ঈর্ষায় তাকে সব সময় এড়িয়ে চলে। এমন কি তার দিকে ভালো করে তাকিয়েও দেখে নি। কিন্তু আজ তার দিক থেকে দৃষ্টি ফেরাতে পারল না। তার আজ প্রথম মনে হল, এত সুন্দর ছেলে জীবনে দেখে নি। হঠাৎ তার মন বলে উঠল, যাকে তুই অপছন্দ করিস, ঈর্ষা করিস, তার দিকে ঐভাবে তাকিয়ে কি দেখছিস? কেউ দেখে ফেললে কি ভাববে?

রাফিয়া দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে লাইব্রেরিয়ানের কাছ থেকে বই নিল। তারপর গেটের দিকে এগোল। কিন্তু মনের অজান্তে হালিমের টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল।

হালিম একমনে নোট করছিল। হঠাৎ সামনে তাকিয়ে রাফিয়াকে দেখে বেশ অবাক হল। কারণ আজ দেড় বছরের মধ্যে তাকে এত কাছে আসতে দেখে নি। মৃদু হেসে বলল, কিছু বলবেন?

রাফিয়া মুখে কিছু না বলে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল।

তা হলে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বসুন।

রফিয়া বসে বলল, ডিস্টার্ব করলাম বোধ হয়?

না, ডিস্টার্ব কিসের? এক মিনিট অপেক্ষা করুন বলে হালিম লেখাটা শেষ করে বলল, এখানে আলাপ করা ঠিক হবে না। বাইরে গিয়ে কোথাও বসি চলুন। তারপর দু’জনে লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে এসে নিরিবিলি জায়গায় বসে হালিম বলল, এবার বলুন।

রাফিয়া বলল, আপনাকে একাকি পাওয়াই যায় না। লাইব্রেরিতে বই নিতে এসে আপনাকে দেখে আলাপ করতে এসেছিলাম।

কিন্তু আমার সঙ্গে আলাপ করতে হলে একটা শর্ত আছে।

শর্তটা কি শুধু আমার জন্য, না সবার জন্য?

ছেলেদের জন্য নয়, শুধু মেয়েদের জন্য।

কিন্তু আমি তো আপনাকে ছেলে-মেয়ে সবার সঙ্গে আলাপ করতে দেখেছি?

আপনার কথা ঠিক; তবে কি জানেন, কোনো মেয়ে একাকি আলাপ করতে চাইলে তাকেই শুধু শর্তের কথা বলি।

সে রকম কেউ এসেছিল না কি?

হ্যাঁ, অনেকেই এসেছে। শর্ত শুনে গালাগালি করে ফিরে গেছে।

রাফিয়া অবাক হয়ে বলল, শর্তটা বলুন তো শুনি।

হালিম মৃদু হেসে বলল, আপনারও গলাগালি করতে খুব ইচ্ছা করছে বুঝি?

না, শর্তটা জানতে খুবই ইচ্ছা করছে।

আমি সিওর, শর্তটা শুনলে আপনিও গালাগালি করবেন।

রাফিয়া চিন্তা করল, নিশ্চয় শর্তটা খুব অশালীন। তাই মেয়েরা শুনে গালাগালি করেছে। তবু কতটা অশালীন জানার জন্য বলল, কথা দিচ্ছি, গালাগালি করব না।

তা হলে আজ শুধু শর্তটা বলি। আলাপ অন্য দিন করা যাবে। শর্তটি হল, কাল থেকে আপনি একটা বড় ওড়না দিয়ে মাথাসহ সারা শরীর ঢেকে ক্লাশ করতে আসবেন। যে সব মেয়েরা আপনার মতো পোশাক পরে তাদের সঙ্গে আমি আলাপ করি না।

শর্ত শুনে রাফিয়া রাগের ছোটে দাঁড়িয়ে পড়ল আর মুখটা লাল হয়ে উঠল। ননসেন্স, অভদ্র, ছোটলোক বলতে যাচ্ছিল, ঠোঁট কামড়ে সামলাবার চেষ্টা করল।

হালিম বলল, প্লীজ বসুন। নচেৎ ভাববো, কথা দিয়েছেন বলে মুখ ফুটে গালাগালি না করলেও মনে মনে করছেন।

রাফিয়া বসল না। খুব রাগের সঙ্গে বলল, কেন, এই পোশাক কি খুবই অশালীন?

হালিম তার রাগকে পাত্তা না দিয়ে বলল, তা বলব না, তবে এই পোশাকে যুবতী মেয়েদের দেখলে মনে হয়, তারা যেন যৌবন দেখিয়ে ছেলেদের মন আকর্ষণ করছে। আবার কোনো ছেলে যদি আকর্ষিত হয়ে তাদের কাছে গিয়ে কিছু বলে, তা হলে পায়ের জুতো খুলে অথবা মুখের ভাষায় পুরস্কৃত করে ছাড়ে।

রাফিয়া আর রাগ সামলাতে পারল না। বলল, সত্যিই আপনি একটা অদ্র, ইতর ও ছোটলোক। পায়ের জুতো খুলে আপনাকেও পিটিয়ে পুরস্কৃত করার ইচ্ছা করছে।

হালিম হাসিমুখে বলল, ইচ্ছে যখন করছে তখন পুরস্কৃত করুন বাধা দেব না।

তাকে হাসতে দেখে ও তার কথা শুনে রফিয়া এত রেগে গেল যে, তার মনে হল জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে। রাগে ফুলতে ফুলতে ব্লডি, ননসেন্স, ফুল বলে হনহন করে সেখান থেকে চলে গেল।

শবনম ওকে খুঁজতে লাইব্রেরিতে যাচ্ছিল। দেখতে পেয়ে বলল, কি রে, তোর কি হয়েছে? খুব রেগে রয়েছিস মনে হচ্ছে?

রাফিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে রাগ সামলাল। তারপর ঘটনাটা বলে বলল, ওযে এত অভদ্র ও ইতর ভাবতেই পারি নি। ওর মোল্লাগিরি না ছাড়িয়েছি তো আমার নাম রাফিয়া না। ও শুধু আমাকে অপমান করে নি, যারা আলাপ করতে গেছে সবাইকে করেছে। ওকে এমন শিক্ষা দেব, জীবনে আর কখনো কোনো মেয়েকে অপমান করার সাহস পাবে না। তারপর কি করবে না করবে বলল।

শবনম ক্রুর হেসে বলল, হ্যাঁ, এটাই ওর উপযুক্ত শাস্তি। কিন্তু তুই কি কাজটা করতে পারবি?

রাফিয়া দৃঢ়স্বরে বলল, পারব না মানে, একশবার পারব। তোকে যা বললাম, তুই শুধু সেই কাজটা করবি।

শবনম বলল, তাতো করবই। এখন বাসায় চল যাই।

.

পরের দিন ছুটি থাকায় রাফিয়া ছোট ভাইয়া আশফাকের সঙ্গে কেনাকাটা করতে মার্কেটে গিয়েছিল। মার্কেট থেকে বেরিয়ে গাড়ির কাছে আসার সময় দেখল, তাদের গাড়ির কাছে তিনটে ছেলে রিকশা থেকে নেমে মার্কেটের দিকে যাচ্ছে। রিকশাওয়ালা ভাড়া চাইতে তাদের একজন ফিরে এসে তার গালে প্রচণ্ড একটা চড় মেরে বলল, এটাই তোর ভাড়া।

রিকশাওয়ালা ছোকরা বয়সী। আজ দুতিন বছর রিকশা চালাচ্ছে। এরকম ব্যবহার কারো কাছ থেকে পায় নি। চড় খেয়ে তার দু’চোখে পানি এসে গেছে। হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছে বলল, আপনারা ভদ্রলোক হয়ে ভাড়া চাইতে মারলেন?

ছেলেটা বলল, তোর ভাগ্য ভালো টাকা পয়সা কোড়ে না নিয়ে একটা চড় মেরেছি।

ততক্ষণে রাফিয়া ও আশফাক গাড়ির কাছে চলে এসেছে।

রিকশাওয়ালা গালে হাত বুলোতে বুলোতে আশফাককে উদ্দেশ্য করে বলল, দেখেছেন ভাই, ওনারা প্রায় দু’ঘণ্টা আমার রিকশায় চেপে ভাড়া না দিয়ে চলে যাচ্ছিলেন, ভাড়া চাইতে আমাকে মারলেন।

আশফাক টগবগে যুবক। বছর দুই আগে মাস্টার্স কমপ্লিট করে ভালো বেতনের চাকরি করছে। রিকশাওয়ালা বলার আগে ঘটনাটা দেখে রেগে ছিল। এখন রিকশাওয়ালার কথা শুনে আরো রেগে গিয়ে ছেলেটাকে বলল, ওর ভাড়া দিয়ে মারলেন কেন?

ছেলেটা লোলুপ দৃষ্টিতে রাফিয়ার দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বলল, বেশ করছি মেরেছি, তাতে আপনার কি? নিজের কাজে যান।

আশফাক কঠিন স্বরে বলল, ওর ভাড়া দিয়ে মাফ চেয়ে নিন।

সঙ্গের ছেলে দুটো একটু এগিয়ে গিয়েছিল। আশফাকের কথা শুনতে পেয়ে ফিরে এসে একজন বলল, সঙ্গে মেয়ে আছে বলে কিছু বললাম না, নচেৎ আমাদের ব্যাপারে নাক গলানর মজা বুঝিয়ে দিতাম।

আশফাক তার কথা গ্রাহ্য না করে আবার ছেলেটাকে উদ্দেশ্য করে একইস্বরে বলল, কি হল? ভাড়াটা দিয়ে মাফ চেয়ে নিন।

ছেলেটা সঙ্গিদের উদ্দেশ্যে বলল, ধরতো শালাকে আমাদের সঙ্গে লাগার মজা বুঝিয়ে দিই। তারপর এগিয়ে এসে মুখে ঘুষি চালাল।

হালিম একটু আগে মার্কেটিং করতে এসে ঘটনাটা দেখছিল। এবার দ্রুত এগিয়ে এসে ছেলেটার ঘুষি একহাতে ধরে অন্য হাতে তারই মুখে প্রচণ্ড জোরে কয়েকটা ঘুষি মারল। তারপর তাকে শূন্যে তুলে সঙ্গি দু’জনের গায়ে ছুঁড়ে দিল।

ছেলে তিনজন এই এলাকার মাস্তান। মার্কেটের ও আশপাশের দোকানদারদের কাছ থেকে নিয়মিত চাঁদা তুলে। এদেরকে এই এলাকার সবাই চিনে। তাই ঘটনাটা সবাই দেখলেও কেউ এগিয়ে এল না। শুধু দর্শকের ভূমিকা পালন করছে।

মাস্তান তিনজনের কাছে রিভলবার আছে। আহত মাস্তানটা তাদের উপর এসে পড়লে তারা তাকে ধরে মাটিতে শুইয়ে দিয়ে দু’জনেই রিভলবার বের করল।

ততক্ষণে হালিম ওদের কাছে পৌঁছে গিয়ে একজনের রিভলবার ধরা হাতে কিক মারল। রিভলবারটা শূন্যে উড়ে কিছুটা দূরে ঠকাশ করে পড়ল। হালিম তাকে সামনে ধরে রেখে অন্য মাস্তানের দিকে এগোল। ফলে ঐ মাস্টানটা গুলি করতে পারল না। হালিম আরো কাছে এসে ধরা মাস্তানকে নিয়ে শুয়ে পড়ে রিভলবার ধরা মাস্তানকে ল্যাং মারল।

মাস্তানটা পড়ে গেলেও তাড়াতাড়ি দাঁড়িয়ে উঠে পরপর দু’টো ফায়ার করল।

ঐ কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে হালিম ধরে রাখা মাস্তানকে সামনে আড়াল করেছিল, কিন্তু তার আগেই প্রথম গুলিটা হালিমের একটা হাতের বাজুতে ঢুকে গেল। আর দ্বিতীয় গুলিটা ঐ মাস্তানের বুকে ফুটে করে ঢুকে গেল। বাজুতে গুলি খেয়েও হালিম দমল না। ধরে থাকা মাস্তানকে ছেড়ে দিয়ে রিভলবার ধরা মাস্তানকে আবার ল্যাং মারতে আবার সেও পড়ে গেল। হালিম দ্রুত উঠে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে রিভলবার কেড়ে নিয়ে তার দিকে তাক করে বলল, নড়লেই গুলি করব।

দোকানদাররা এতক্ষণ এগিয়ে না এলেও যে সব কাস্টোমার ও পথচারিরা ঘটনাটা দেখছিল, তারা এবার এগিয়ে এসে মাস্তানটাকে উত্তম মধ্যম দিতে লাগল। এমন সময় সিভিল ড্রেসে একটা জীপে আর্মি যাচ্ছিল। তারা গুলির শব্দ শুনে গাড়ি পার্ক করল। তারপর সেখানে এসে সবাইকে সরে যেতে বলল।

তাদেরকে দেখে আশফাক কাছে গিয়ে ঘটনাটা বলল।

হালিম আর্মিদের চিনতে পেরে রিভলবার সেখানেই ফেলে দিয়ে লোকজনের সঙ্গে মিশে গেল।

আর্মিরা পাবলিকদের সরিয়ে তিনটে পিস্তলসহ মাস্তানদের গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে চলে গেল।

তাদের আগেই হালিম একটা স্কুটারে উঠে, ড্রাইভারকে মেডিকেলে যেতে বলল।

রাফিয়া এতক্ষণ হালিমের সাহস ও মাস্তানদের সঙ্গে লড়াই দেখে এত অবাক হয়েছিল যে, আর্মিরা কখন মাস্তানদের নিয়ে চলে গেছে খেয়াল নেই। আশফাক যখন বলল, হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকবি, বাসায় যারি না–তখন বাস্তবে ফিরে এল। বলল, জান ভাইয়া, যে ছেলেটা মাস্তানদের সঙ্গে লড়াই করছিল তাকে আমি চিনি। ভার্সিটিতে আমাদের সঙ্গে পড়ে। ওর নাম হালিম।

আশফাক হালিমকে মাস্তানদের সঙ্গে অকুতভয়ে লড়তে দেখে খুব অবাক হয়ে ভেবেছিল ছেলেটা মাস্তানের হাতটা ধরতে আর একটু দেরি হলেই ঘুষিটা তার নাকে পড়তে। এখন রাফিয়ার কথা শুনে আর একবার অবাক হল। বলল, তাই নাকি? তা হলে তো ছেলেটার খোঁজ নিতে হয়। তুই একটু দাঁড়া, আমি আসছি বলে হালিমকে খুঁজতে লাগল। না পেয়ে একজনকে জিজ্ঞেস করল, যে ছেলেটা মাস্তানদের সঙ্গে লড়াই করছিল তাকে দেখেছেন?

লোকটা বলল, উনিতো একটু আগে স্কুটারে উঠে চলে গেলেন। জামা কাপড়ে অনেক রক্ত দেখলাম। মনে হয় ওনাকেও গুলি লেগেছে। তাই হয়তো মেডিকেলে গেছেন।

আশফাক ফিরে এসে রাফিয়াকে লোকটার কথা বলে বলল, আমারও মনে হচ্ছে মেডিকেলে গেছে। ওখানে গিয়ে খোঁজ নিয়ে বাসায় ফিরব কি বলিস?

রাফিয়া বলল, তাই চল।

ওরা মেডিকেলে পৌঁছে জানতে পারল, হালিমকে অপারেশন থিয়েটারে নেয়া হয়েছে।

প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে হালিমকে বেডে নিয়ে এলে আশফাক রাফিয়াকে নিয়ে সেখানে এল।

তাদেরকে দেখে নার্স জিজ্ঞেস করল, আপনারা কি রোগীর আত্মীয়?

আশফাক বলল, না, তবে পরিচিত।

নার্স আবার জিজ্ঞেস করল, ইনার বাসার ঠিকানা জানেন? পকেটে মানিব্যাগ পাওয়া গেছে। তাতে কিছু টাকা ও একটা কাগজে হলের ঠিকানা রয়েছে।

আশফাক রাফিয়ার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল।

রাফিয়া বুঝতে পেরে নার্সকে বলল, বাসার ঠিকানা জানি না। তারপর জিজ্ঞেস করল, ওনার অবস্থা এখন কেমন?

নার্স বলল, মোটামুটি ভালো। হাতের বাজুতে গুলি ছিল। বের করা হয়েছে। চার পাঁচ ঘণ্টার আগে জ্ঞান ফিরবে না। আপনারা এখন যান।

আশফাক বাইরে এসে রাফিয়াকে বলল, এখন বাসায় যাই চল, বিকেলে না হয় আসা যাবে।

রাফিয়া বলল, তাই চল।

গাড়িতে উঠে আশফাক বলল, ছেলেটা আমাকে বাঁচাতে গিয়ে বিপদে পড়ল ভেবে খুব খারাপ লাগছে। ভাবছি, বিকেলে দেখতে এসে ডাক্তারকে বলব, ওনার চিকিৎসার বিল আমি দেব।

হালিমের সৎসাহস ও লড়াই এর কলাকৌশল দেখে রাফিয়া মুগ্ধ হয়েছিল। সে গুলি খেয়েছে শোনার পর থেকে খুব দুশ্চিন্তায় ভুগছিল। প্রতিশোধ নেয়ার কথাও ভুলে গেছে। ছোট ভাইয়ার কথা শুনে বলল, হ্যাঁ, ওনার চিকিৎসার সব খরচ আমাদেরই দেয়া উচিত। বিকেলে আমিও তোমার সঙ্গে আসব।

বেশতো আসবি।

ওনার সম্পর্কে আর কিছু জানিস?

না, ক্লাসমেট হিসাবে চিনতাম। গতকাল কিছুক্ষণ আলাপ করে বুঝতে পারলাম, ধর্মঘেঁষা ও গোঁড়া টাইপের ছেলে।

বাড়ি কোথায় জানিস না?

না। আশফাক আর কিছু না বলে চুপ করে রইল।

.

বিকেলে ওরা মেডিকেলে এসে দেখল, হালিম বালিশে হেলান দিয়ে বেডের উপর বসে আছে। কাছে এসে আশফাক সালাম দিয়ে বলল, কেমন আছেন?

আশফাক একা এলে হালিমের চিনতে হয়তো একটু দেরি হত। রাফিয়া সঙ্গে থাকায় চিনতে দেরি হল না। সালামের উত্তর দিয়ে বলল, আল্লাহর রহমতে ভালো।

ওবেলা মেডিকেল থেকে ফেরার সময় রাফিয়া দেখতে আসার কথা বললেও বাসায় এসে চিন্তা করল, গতকাল যাকে যা তা বলে অপমান করেছে তাকে দেখতে যাওয়া ঠিক হবে না। তাই আশফাক যখন সাড়ে চারটের সময় তাকে বলল, কইরে, তুই এখনও রেডি হস নি? মেডিকেলে যাবি যে? তখন ছোট ভাইয়া কিছু মনে করতে পারে ভেবে অনিচ্ছা সত্ত্বেও এসেছে। রেডের কাছে এসে হালিমের দিকে একবার তাকিয়ে মাথা নিচু করে রয়েছে।

হালিম বুঝতে পেরে রাফিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলল, দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বেডের নিচে টুল আছে, টেনে বসুন। তারপর আশফাককে বলল, আপনি বেড়েই বসুন।

আশফাক রাফিয়ার মুখে লজ্জার আভা দেখে একটা কিছু আন্দাজ করে টুলটা টেনে বলল, বস। তারপর বেডের উপর হালিমের পাশে বসে তার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনার এরকম অবস্থার জন্য আমিই দায়ী। গুলিটা যদি বুকে বা মাথায় লাগত, তা হলে কি হত ভেবে খুব খারাপ লাগছে।

হালিম বলল, ঘটনাটা আপনাকে উপলক্ষ করে ঘটে থাকলেও নিজেকে দায়ী ভাবছেন কেন? আমি যা কর্তব্য তাই করেছি। কর্তব্য পালন করার জন্য ঝুঁকিতে নিতেই হবে। আজ মানুষ কর্তব্যজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। তাই সমাজে যেমন অশান্তি তেমনি সন্ত্রাসীরাও বেপরওয়া হয়ে উঠেছে।

আশফাক বলল, আপনি খুব খাঁটি কথা বলেছেন। তারপর বলল, রাফিয়া আমার ছোট বোন। ঐ বলেছে আপনি ওর ক্লাসমেট। সুস্থ হওয়ার পর একদিন ওর সঙ্গে বাসায় আসবেন।

হালিম কিছু না বলে চুপ করে রইল।

আশফাক রাফিয়াকে বলল, তুই একদিন ওনাকে বাসায় নিয়ে আসবি।

রাফিয়া মুখে না বলে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।

আশফাক তাকে মাথা নিচু করে বসে থাকতে দেখে চিন্তা করল, যে রাফিয়া প্রগলভ ও চঞ্চল হরিণীর মতো, সে কেন ওভাবে বসে রয়েছে? তা হলে কি তার অনুমান ঠিক। অনুমানটা ঠিক কিনা জানার জন্য তাকে বলল, তুই ওনার সঙ্গে কথা বল, আমি একটু আসছি। কথা শেষ করে বেরিয়ে গেল।

রাফিয়া হালিমের দিকে তাকাতে চোখে চোখ পড়ে গেল। দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে বলল, গতকালের ঘটনার জন্য দুঃখিত। সেজন্যে ক্ষমা চাইছি।

হালিম বলল, ক্ষমা চাওয়ার দরকার নেই। আমি কিছু মনে করি নি। প্রত্যেকের নিজস্ব মতামত প্রকাশ করার অধিকার আছে। আমি আমারটা বলেছি, আপনি আপনারটা বলেছেন। এতে কারো অপরাধ হয় নি।

তবু বলুন ক্ষমা করেছেন?

দেখুন, আমার মতো আপনি কোনো অপরাধ করেন নি। শুধু শুধু ক্ষমা চেয়ে নিজেকে ছোট করছেন কেন? ক্ষমা চাইলে আল্লাহর কাছে চান। কারণ তাঁকে না চিনে ও তাঁর বাণীকে না জেনে অপরাধ করেছেন।

রাফিয়া কি বলবে ভেবে না পেয়ে চুপ করে রইল।

হালিম আবার বলল, কি জানেন, আমরা লেখাপড়া করে নিজেদেরকে খুব জ্ঞানী মনে করি। তাই অন্য কেউ যদি আমাদেরকে অজানা ভালো কথাও বলে, তা আমরা গ্রহণ করি না। এটা আমাদের অহমিকা। আসলে অল্প জ্ঞানীরাই জ্ঞানের অহঙ্কার করে। অথচ বড় বড় মনীষীদের জীবনী পড়লে জানা যায়। ওঁনারা নিজেদের জ্ঞানকে সমুদ্রের কয়েক ফোঁটা পানির সঙ্গে তুলনা করেছেন। জানেন কিনা জানি না, সমুদ্রের তবু সীমানা আছে; কিন্তু জ্ঞান সমুদ্রের কোনো সীমানা নেই। কুয়ার ব্যাঙ যেমন মনে করে কুয়ার থেকে বড় জলাশয় নেই, তেমনি অধিকাংশ শিক্ষিত লোক মনে করেন তার থেকে বড় জ্ঞানী কেউ নেই। থাক এসব কথা, আপনি হয়তো বিরক্ত হচ্ছেন। এবার আপনি কিছু বলুন।

মেডিকেলে আসার আগে রাফিয়া সেজেগুঁজে ড্রেসিং টেবিলে আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে বুঝতে পেরেছিল, কেন তরুণ, যুবক ও বৃদ্ধরা তাদের মতো মেয়েদের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে? কেন ছেলেরা প্রেম নিবেদন করতে আসে? কেন শিক্ষিত, অশিক্ষিত ও বখাটে ছেলেরা ধরে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে? তখন তার মন বলেছিল, হালিম তাকে ঐসব থেকে রক্ষা করার জন্য বড় ওড়না দিয়ে মাথাসহ গোটা শরীর ঢেকে ক্লাশ করতে যেতে বলেছে। তাই মেডিকেলে আসার সময় মাথায় কিছু না দিলেও ওড়না দিয়ে সারা শরীর ঢেকে এসেছে। এখন হালিমের কথা শুনে খুব ভালো লাগল। সে কিছু বলতে বললে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, না, বিরক্ত হয় নি। একটা অনুরোধ করব, রাখবেন?

বলুন, রাখার মতো হলে নিশ্চয় রাখব।

আমি আপনার বন্ধু হতে চাই।

এই অনুরোধ রাখতে পারব না। প্লীজ, কথাটা ফিরিয়ে নিন।

রাফিয়া বড়লোকের মেয়ে। চার ভাইয়ের একমাত্র বোন। রূপসী ও ভালো ছাত্রী। উঁচু সোসাইটিতে খুব সুনাম। ভার্সিটিতে ছেলেরা তার সঙ্গে দু’একটা কথা বলতে পারলে ধন্য মনে করে। তাই তার অহঙ্কার থাকা স্বাভাবিক। হালিম। বন্ধুত্বের প্রস্তাব ফিরিয়ে নিতে বললে অহঙ্কারে আঘাত লাগল, রেগে উঠে বলল, কেন বলুন তো?

সে কথা পরে বলছি। তার আগে আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দিন। আপনার তো বন্ধুর অভাব নেই, তবু কেন এই অভদ্র, ইতর, ছোটলোকের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চাচ্ছেন?

খুব রেগে ছিল বলে রাফিয়া হালিমের কথার উত্তর দিতে না পেরে চুপ করে রইল।

কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে হালিম আবার বলল, আপনি উত্তর দিতে না পারলেও আমি জানি।

তা হলে জিজ্ঞেস করলেন কেন?

সে কথা না শোনাই ভালো।

নাই ভালো হোক, তবু আমি শুনতে চাই।

আপনি আমার উপর রেগে আছেন। কথাটা শুনলে আরো রেগে যাবেন। তাই বলতে চাচ্ছিলাম না। একান্তই যখন শুনতে চান তখন বলছি শুনুন, দু’টো কারণে কথাটা ফিরিয়ে নিতে বলেছি। তার একটা কারণ বলি, আপনি ছেলে হলে অথবা আমি মেয়ে হলে কোনো আপত্তি করতাম না।

ছেলেমেয়ের মধ্যে বন্ধুত্ব হলে দোষ কিসের? বিশেষ করে শিক্ষাঙ্গনে?

এ ব্যাপারে বলতে গেলে অনেক কথা বলতে হবে এবার অনেক সময়ও লাগবে। আপনি চাইলে পরে একদিন আলাপ করা যাবে। এখন এতটুকু বলতে পারি, পরিণত বয়সের ছেলে মেয়েদের মধ্যে বন্ধুত্ব ও মেলামেশা করতে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সাঃ) কুরআন ও হাদিসে নিষেধ করেছেন।

এমন সময় আশফাক কয়েক পদের ফলের দু’তিনটে প্যাকেট নিয়ে এসে বেডের পাশের টেবিলের উপর রাখল।

হালিম সেদিক তাকিয়ে বলল, এটা আপনি ঠিক করলেন না।

আশফাক বলল, ঠিক বেঠিক জানি না। মন চাইল তাই নিয়ে এলাম। তারপর রাফিয়াকে বলল, চল, এবার আমরা যাই।

রাফিয়া উঠে দাঁড়াতে আশফাক আবার বলল, আমি হয়তো আর আসতে পারব না, রাফিয়া এসে দেখে যাবে।

হালিম বলল, কারো আসার প্রয়োজন নেই। কাল হয়তো আমি ছাড়া পেয়ে যাব।

আশফাক বলল, রাফিয়ার সঙ্গে একদিন বাসায় এলে খুশী হব।

হালিম রাফিয়ার দিকে এক পলক তাকিয়ে নিয়ে বলল, আপনাকে খুশী করতে পারব কিনা জানি না। তবে আল্লাহ রাজি থাকলে একদিন আসব।

আশফাক আসি বলে রাফিয়াকে নিয়ে বেরিয়ে এসে গাড়িতে উঠল।

হালিম বন্ধুত্বের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছে বলে রাফিয়ার মন খারাপ।

তাই দেখে গাড়ি চলতে শুরু করার পর আশফাক জিজ্ঞেস করল, তোর মন খারাপ কেন? হালিম কি তোকে তেমন কিছু বলেছেন? ফিরে এসে শুনতে পেলাম, ছেলেমেয়েদের মধ্যে বন্ধুত্ব ও মেলামেশার কথা কি যেন বলছিলেন?

রাফিয়া বলল, আমি বন্ধু হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলাম, গ্রহণ করল না। কারণ জিজ্ঞেস করতে কুরআন হাদিসের বাণী শুনিয়ে দিলেন।

তোর মতো মেয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিল শুনে খুব অবাক লাগছে।

ভার্সিটিতে পড়লে কি হবে, খুব গোঁড়া ধার্মিক।

তা হতে পারে, তবে ছেলেটা খুব সুন্দর। কথাবার্তাও খুব মার্জিত। গোড়া ধার্মিক বলে তোর সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চায় নি, সেজন্য মন খারাপের কি আছে? তা হারে, হালিম ছাত্র হিসাবে কেমন?

ভার্সিটির সেরা ছাত্র। ফার্স্ট ইয়ারের পরীক্ষায় আমাকে টপকে গেছে।

আশফাক হেসে উঠে বলল, তাই তো বলি আমার বোনটার কেন মন খারাপ? ওকে টপকাবার জন্য এ বছর নিশ্চয় ভালো করে পড়াশোনা করছিস?

তাতো করছি; কিন্তু টপকাতে পারব বলে মনে হয় না। তবে ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে পারলে হয়তো টপকাতে পারতাম।

মানুষ চেষ্টা করলে অনেক কিছু করতে পারে, তুইও কর। বন্ধুত্বও পাবি, টপকাতে ও পারবি।

দু’টোরই জন্য নিশ্চয় চেষ্টা করব। ওকে টপকাতে পারি আর না পারি, ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব করে গোঁড়ামি ছাড়াবই।

ছোট বোনটা যে খুব জেদী, আশফাক জানে। একবার যে কাজ করবে বলবে, তা সবাই বাধা দিলেও করবেই। তাই আবার হেসে উঠে বলল, দেখিস, বন্ধুত্ব করতে গিয়ে জড়িয়ে পড়িস না যেন।

কথাটার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে রাফিয়া লজ্জা পেলেও গাল ফুলিয়ে বলল, ছোট বোনকে এরকম কথা বলতে পারলে?

তুই রাগ করছিস কেন? বড় ভাই হিসাবে সাবধান করলাম।

ততক্ষণে গাড়ি বাসায় পৌঁছে গেছে। তাই রাফিয়া আর কিছু বলল না।

.

রাফিয়া ও তার ভাই যেন দেখতে না আসে সে জন্যে হালিম মিথ্যে করে বলেছিল, কাল বাসায় চলে যাবে। মেডিকেলে তাকে এক সপ্তাহ থাকতে হল। তারপর হলে ফিরে ডাক্তারের কথা মতো আরো এক সপ্তাহ রেস্ট নিল। প্রায় পনের দিন পর ক্লাস করতে এল।

.

ঐ দিন মেডিকেল থেকে ফিরে রাফিয়া হালিমকে নিয়ে অনেক চিন্তা করল, কিভাবে তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করবে।

পরের দিন ভার্সিটিতে এসে শবনমকে গতকালের ঘটনা জানিয়ে বলল, ওকে আপমান করার জন্য তোকে নিয়ে যে প্ল্যান করেছিলাম, তা আর সম্ভব নয়। তাই অন্য একটা প্ল্যান করেছি। বলছি শোন, কুরআন-হাদিসে মেয়েদের সম্পর্কে কি বলা হয়েছে সেসব জেনে ধার্মিক মেয়ের অভিনয় করে ওকে কাছে টানার চেষ্টা করব। যখন দেখব, আমাকে পাওয়ার জন্য পাগল হয়েছে তখন অভিনয় করার কথা বলে অপমান করে কুকুরের মতো তাড়িয়ে দেব। প্ল্যানটা কি রকম বল। দেখি?

শবনম বলল, প্ল্যানটা নিঃসন্দেহে ভালো, কিন্তু তুই যদি হেরে যাস?

রাফিয়া কপাল কুঁচকে বলল, হেরে যাব মানে? তুই তো জানিস, হার কি জিনিস আমি জানি না।

তা জানি; কিন্তু অভিনয় করতে গিয়ে যদি ধরা পড়ে যাস? অথবা তার প্রেমে পড়ে যাস?

দূর, ঐ মোল্লার প্রেমে আমি পড়ব, একথা ভাবতে পারলি? শোন, আমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট সিওর, প্ল্যানটা সাকসেসফুল করতে পারব।

পারলে তো ভালোই, না পারলে ভবিষ্যতে তোকেই পস্তাতে হবে।

আরে যাহ, পস্তাবার মতো কোনো কাজ করলে তো পস্তাবো।

তা হলে আমার আর কিছু বলার নেই।

এক সপ্তাহ কেটে যাওয়ার পরও যখন হালিম ক্লাশ করতে এল না তখন রাফিয়া চিন্তা করল, তা হলে কি গুলিলাগা হাতে ইনফেকশান হয়েছে? ঐ দিন ফেরার সময় ড্রাইভারকে মেডিকেলে যেতে বলল, সেখানে গিয়ে জানতে পারল, কোনো ইনফেকশান হয় নি। আজ সকালে তাকে ছেড়ে দেয় হয়েছে। পরের সপ্তাহেও যখন এল না তখন ভাবল হয়তো দেশের বাড়িতে গেছে।

আজ তাকে ক্লাশে দেখে স্বস্তি পেল। ক্লাশ শেষ হওয়ার পর বাইরে এসে দেখল, হালিম লাইব্রেরির দিকে যাচ্ছে। কাছে এসে সালাম দিয়ে বলল, কেমন আছেন?

হালিম হাঁটতে হাঁটতেই সালামের উত্তর দিয়ে বলল, ভালো। আপনি কেমন আছেন? আপনার ছোট ভাইয়া ভালো আছেন?

রাফিয়া বলল, হ্যাঁ, ভালো। তারপর বলল, একটু সময় হবে, আলাপ করব।

এতক্ষণ হালিম তার দিকে ভালো করে তাকায় নি। আলাপ করার কথা শুনে। থমকে দাঁড়িয়ে দেখল, মাথা রুমাল দিয়ে বাঁধা, সারা শরীর ওড়না দিয়ে ঢাকা। বলল, ঠিক আছে, চলুন ঐ ঘাসের উপর বসি। বসার পর বলল, এবার বলুন কি আলাপ করতে চান।

আমি ইসলামের গোঁড়ামিত্বের ব্যাপারে আলাপ করতে চাই।

আপনি বোধ হয় জানেন না, ইসলামে গোঁড়ামির স্থান নেই। তবু কি কি জিনিস আপনার কাছে গোঁড়ামি বলে মনে হয়?

আমার ধারণা, মোল্লাদের হীন মনোবৃত্তি ও গোঁড়ামির কারণে মুসলমানরা অন্যান্য জাতির চেয়ে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। বিশেষ করে নারীরা সমাজ, দেশ। ও দশের জন্য কিছু করতে পারছে না। তারা ঘরে বাইরে সব জায়গায় পুরুষদের কাছে অহরহ নির্যাতিত হচ্ছে।

আপনার ধারণা আংশিক সত্য হলেও পুরোটা নয়।

ব্যাখ্যা করুন।

আসলে মোল্লাদের হীন মনোবৃত্তির কারণে নারীরা নির্যাতিত হচ্ছে না। তারা মেয়েদের পর্দা করতে বলে। কারণ নারীরা কন্যা, জায়া ও জননী। তাই তারা স্নেহ, ভালবাসা ও শ্রদ্ধার পাত্রী। অশিক্ষা ও কুশিক্ষার ফলে এবং সৃষ্টিকর্তা তাদেরকে যে অধিকার দিয়েছেন ও তাদের কর্তব্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন, সে সব না জানার ফলে নির্যাতিত হচ্ছে। অপরপক্ষে পুরুষদের শক্তি সামর্থ নারীদের তুলনায় বেশি, তারা রুজী-রোজগার করে, তারা সংসারের কর্তা। সৃষ্টিকর্তা নারীদের প্রতি যে কর্তব্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন, তা তারাও জানে না। ফলে নারীদের উপর যথেচ্ছা অত্যাচার করে। শুধু যে অশিক্ষিত সমাজে নারীরা নির্যাতিত হচ্ছে তা নয়, শিক্ষিত সমাজেও হচ্ছে। এর কারণ শিক্ষিত সমাজের নারী-পুরুষেরা সৃষ্টিকর্তার বিধি বিধান জানেও না, মানেও না। তারা পশ্চাত্য সভ্যতা অনুকরণ-অনুসরণ করতে গিয়ে ধর্মকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। নারী পুরুষ উভয়েই যদি আধুনিক শিক্ষার পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করে যার যা কর্তব্য পালন করত, তা হলে নারীরা নির্যাতিত হত না। তারপর রাফিয়াকে জিজ্ঞেস করল, আপনি তো মুসলমান।

নিশ্চয়।

কুরআন যে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর বাণী নিশ্চয় বিশ্বাস করেন?

করি।

কুরআনে মুসলমান নর-নারীর জন্য যেসব বিধি বিধান দিয়েছেন, তা কি জানেন?

না।

কেন জানেন না বলতে পারেন?

রাফিয়া একথার উত্তর দিতে না পেরে চুপ করে রইল।

অল্পক্ষণ অপেক্ষা করে হালিম বলল, আল্লাহ কুরআন পাকে তার বান্দাদের বিশেষ করে মুসলমানদের যা কিছু বলেছেন, সেসব মুসলমান হিসাবে নারী পুরুষ নির্বিশেষে জানা উচিত কিনা বলুন?

হ্যাঁ, উচিত।

তা হলে চিন্তা করে দেখুন, একজন শিক্ষিত মুসলিম নারী হয়েও আপনি উচিত কাজটি করছেন না কেন? আসলে সারা বিশ্বের নর-নারীদের মধ্যে খুব অল্প সংখ্যক ছাড়া কেউ-ই উচিত কাজগুলো করছে না। তাই সারা পৃথিবী জুড়ে আজ অশান্তির আগুন জ্বলছে। যেসব দেশ আজ শিক্ষা, সংস্কৃতি, সভ্যতা ও জ্ঞান বিজ্ঞানে চরম উন্নতি সাধন করেছে, সেসব দেশের মানুষও কি শান্তিতে বাস করতে পারছে? পারছে না, বরং সেসব দেশে সন্ত্রাস, খুন, ধর্ষণ, সুদ ও ঘুষ আমাদের মতো অল্পশিক্ষিত ও অনুন্নত দেশগুলোর চেয়ে অনেক বেশি। উন্নত দেশগুলোতে নারীদের অবাধ স্বাধীনতার ফলে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ কুমারী মেয়ে জারজ সন্তান জন্ম দিচ্ছে। উঁচু নিচু সব সমাজের দাম্পত্য জীবনের মধুর সম্পর্ক গরলে পরিণত হয়েছে।

আপনি হয়তো আমার কথা শুনে খুব বিরক্ত হচ্ছেন। তবু আরো দুএকটা কথা বলে পারছি না। নারী স্বাধীনতা মানে উচ্ছঙখল বা বেহায়াপনা নয়। রাস্তা ঘাটে, বাজারে, স্কুল-কলেজ-ভার্সিটিতে, সভা-সমিতিতে নারীদের রূপ-যৌবন দেখিয়ে বেড়ান যদি নারী স্বাধীনতা ও সভ্য সমাজের পরিচয় হয়, তা হলে সেই স্বাধীনতা ও সভ্যতা শুধু নারীদের নয়, সমাজ ও দেশের কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। বরং নারীকে, সমাজকে ও দেশকে অবনতির শেষ ধাপে পৌঁছে দেবে। আর নারীরা পূর্বযুগের মতো চরম নির্যাতিত হবে। ইদানিং তো নারীরা পুরুষদের খেলার সামগ্রীর মতো হয়ে গেছে। এরপর যে কি হবে তা আল্লাহ ভালো জানেন।

মেয়েরা সেজেগুজে অর্ধনগ্ন হয়ে সবখানে যাতায়াত করে কেন? নিশ্চয় পুরুষদেরকে রূপ-যৌবন দেখাবার জন্য? কিন্তু পুরুষরা যখন তাদের দিকে বারবার তাকিয়ে দেখবে তখন তারাই আবার পুরুষদের অভদ্র-ইতর-ছোটলোক বলবে। বলাটা কি ঠিক হবে? পুরুষদের দেখাবার জন্যই তো মেয়েরা ঐভাবে বেরোয়। পুরুষরা না দেখলে মেয়েদের সাজগোজ করে বেরোবার তো কোনো মূল্যই রইল না। তবে আর পুরুষদেরকে অদ্র-ইতর-ছোটলোক বলবে কেন?

একটা কথা মনে রাখবেন, যেহেতু নারীরা কন্যা, জায়া ও জননী, সেহেতু তারা খুব মূল্যবান। আর মূল্যবান জিনিস যত্র-তত্র সহজে পাওয়া গেলে তা আর মূল্যবান থাকে না। ছোট্ট একটা উদাহরণ দিচ্ছি, পুরুষ ও নারীর শরীরের যে অঙ্গগুলো সব সময় ঢাকা থাকে সেই অঙ্গগুলো। সব সময় ভোলা অঙ্গগুলো থেকে অনেক সুন্দর ও মূল্যবান। তাই মূল্যবান জিনিসকে হেফাজতে রাখার জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (দঃ) কুরআন ও হাদিসে আদেশ করেছেন। সেই সব আদেশ ও নিষেধ যারা মানুষকে বলে, আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত সভ্য সমাজের লোকেরা তাদেরকে মোল্লা ও গোঁড়া বলে বিদ্রূপ করে।

আমার কথা শুনে কতটা রাগ বা বিরক্ত হচ্ছেন জানি না। তবু অনুরোধ করব, মোল্লারা যা কিছু বলে, সেগুলো কুরআন-হাদিসে আছে কিনা জানার চেষ্টা করুন। চিন্তা করলে খুব অবাক লাগে, পৃথিবীর উন্নত দেশের উচ্চশিক্ষিত মানুষেরা কুরআন-হাদিস পড়ে ইসলামকে জানতে পেরে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করছে। আর মুসলামনরা সেই কুরআন-হাদিসের জ্ঞান অর্জন না করে ভিন্ন ধর্মের শিক্ষা সংস্কৃতিকে ভালো মনে করে সেসব অনুসরণ করছে। শুধু তাই নয়, ইসলামের বিরুদ্ধে এমন অনেক কিছু বলছে ও করছে, তারা যে ইসলাম থেকে বাদ হয়ে। যাচ্ছে তাও জানে না।

শুনুন, আইন করে পৃথিবী থেকে অপরাধ বা অপরাধ প্রবণতা দূর করা কিছুতেই সম্ভব নয়। যদি সম্ভব হত, উন্নত ও অনুন্নত দেশগুলোতে এত অপরাধ হত না। একমাত্র আল্লাহভীতিই মানুষের সব রকমের অপরাধ প্রবণতা দূর করতে পারে। আর আল্লাহকে তারাই ভয় করবে, যারা আল্লাহর পরিচয় জানবে। আল্লাহর পরিচয় জানতে হলে সব রকমের জ্ঞান অর্জনের সাথে সাথে কুরআন হাদিসের জ্ঞান অর্জন করতে হবে এবং সেসব অনুসরণও করতে হবে। প্রকৃত মানুষ ও যারা প্রকৃত আল্লাভীরু, তাদের সম্পর্কে আল্লাহ কুরআনপাকে বলিয়াছেন,

“সকল পুণ্য ইহাতেই নহে যে, তোমরা স্বীয় মুখকে পূর্ব দিকে কর কিংবা পশ্চিম দিকে, বরং পুণ্য তো ইহা যে, কোনো ব্যক্তি ঈমান রাখে আল্লাহর প্রতি, কীয়ামত দিবসের প্রতি, ফেরেশতাদের প্রতি, কিতাব এবং নবীগণের প্রতি। আর মাল প্রদান করে আত্মীয়স্বজন এবং এতিমদিগকে এবং মিসকিনদিগকে এবং (রিক্তহস্তে) মুসাফিরদিগকে, আর ভিক্ষুকদিগকে এবং দাসত্ব মোচনে, আর নামাযের পাবন্দি করে এবং যাকাত আদায় করে; আর যাহারা আপন প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করে, যখন প্রতিজ্ঞা করিয়া বসে, আর যাহারা ধীরস্থির থাকে অভাব অভিযোগে, অসুখে বিসুখে এবং ধর্ম-যুদ্ধে, ইহারাই সত্যিকার মানুষ এবং ইহারাই (সত্যিকার) আল্লাহ ভীরু (১)।” [(১) সুরা-বাকারা, আয়াত-১৭৭, পারা-২]

আর একটা কথা বলে শেষ করব, ইসলাম বড় সহজ, সরল ও উদার ধর্ম। সেখানে গোঁড়ামির কোনো স্থান নেই। ভিন্ন ধর্মের ইসলাম বিদ্বেষী মানুষেরা ইসলাম সম্পর্কে অপপ্রচার চালাচ্ছে। আর মুসলমানদের মধ্যে কিছু স্বার্থান্বেশী মানুষ ইসলামকে জটিল করে ফেলছে। তারপর ঘড়ি দেখে হালিম বলল, চলুন, ক্লাশের সময় হয়ে গেছে।

.

০৮.

রাফিয়ার বাবা হাফিজ উদ্দিন খুব বিত্তশালী। চার পাঁচটা গার্মেন্টসের মালিক। ওনাদের চার ছেলে এক মেয়ে। বড় তিন ছেলে লেখাপড়া শেষ করে তিনটে গার্মেন্টস দেখাশোনা করে। তাদের বিয়ে হয়ে গেছে।

হাফিজ উদ্দিন ছোট ছেলে আশফাককে ও একটা গার্মেন্টস দেখাশোনা করতে বলেছিলেন। আশফাক রাজি না হয়ে ভালো বেতনে চাকরি করছে। তার বিয়ে দেয়ার জন্য হাফিজ উদ্দিন মেয়ের সন্ধান করছেন। উনি ব্যবসা ও সংসারের দায়-দায়িত্ব ছেলে-বৌদের হাতে ছেড়ে দিয়েছেন। সব সময় পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। কেউ এলে তার সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করেন। শুধু বাইরের নয় ছেলে মেয়েদের কাউকে পেলে কমপক্ষে আধ ঘণ্টা আটকে রেখে নানান বিষয়ে আলাপ করবেন। তাই ছেলেমেয়েরা বাবার কাছে সহজে আসে না। একমাত্র রাফিয়াকে পাঁচমিনিটের বেশি আটকাতে পারেন না। বাবা কিছু বলার আগে এমন ব্যস্ততার কথা বলবে, যা শুনে হাফিজ উদ্দিন বলবেন, ঠিক আছে, আমার কাছে আর সময় নষ্ট করিস না। পরে আসিস তখন অনেকক্ষণ আলাপ করব।

ঐ দিন ভার্সিটিতে হালিমের সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর রাফিয়া ইসলামকে জানার জন্য অবসর সময়ে কুরআন-হাদিসের ব্যাখ্যা ও অন্যান্য ইসলামিক বই পড়তে শুরু করল। সেই সাথে ইসলামের বিধি-বিধান মেনে চলে হালিমের মন। জয় করার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু প্রায় আড়াই বছর হতে চলল হালিমের সঙ্গে মেলামেশা করলেও তার মন জয় করতে পারে নি। এমনকি পরিচয়ও জানতে পারে নি। এখন রাফিয়া মাথায় রুমাল বেঁধে ও গায়ে বড় ওড়না দিয়ে ক্লাশ করতে আসে। সেজন্য তাকে বন্ধু-বান্ধবীদের অনেক বিদ্রূপ হজম করতে হয়। ভার্সিটিতে হালিমকে জড়িয়ে তার নামে অনেক কটুক্তিও শুনতে হয়। ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়তে দেখে বাসায় ভাবিরাও বলে, মনে হচ্ছে কোনো হুজুরের পাল্লায় পড়েছ। একদিন তো মেজভাবি বলেই ফেলল, তোমার হুজুর প্রেমিককে একদিন বাসায় নিয়ে এস, আমরাও তার কাছে দীক্ষা নেব। এরকম আরো অনেক কিছু বলে ভাবিরা রাগায়।

প্রথম দিকে তাদের কথা শুনে রাফিয়া খুব রেগে যেত। পরে ইসলামের উপর যত পড়াশোনা করতে লাগল, ততই একদিকে যেমন ইসলামের দিকে আকৃষ্ট হয়ে পড়ল, অপর দিকে তেমনি হালিমকে গভীরভাবে ভালোবেসে ফেলল। এখন তাকে কেউ কিছু বললে রাগে না। বরং তাদেরকে ইসলামের উপর পড়াশোনা করতে বলে হাসিমুখে।

তার হাল হকিকত দেখে একদিন শবনম তাকে বলল, হালিমকে জব্দ করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত সেই তোকে জব্দ করে ফেলল। এরকম যে হবে, তা জানতাম। তাই তোকে আগেই সাবধান করেছিলাম।

রাফিয়া বলল, তোর কথা অস্বীকার করব না। তবে একথা ঠিক, হালিম আমাকে জব্দ করে নি, করেছে ইসলাম। ইসলাম সম্পর্কে পড়াশোনা কর, তা হলে আমার কথা সত্য না মিথ্যা বুঝতে পারবি। তুই জানিস কি না জানি না, একটা দৈনিক পত্রিকায় দেখেছি, আমেরিকার টুইন-টাওয়ার ধ্বংস হওয়ার পর সেখানকার মানুষ ইসলাম সম্পর্কে পড়াশোনা করতে গিয়ে আজ পর্যন্ত সাত চল্লিশ হাজার খ্রিস্টান ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে।

শবনম বলল, তা না হয় বুঝলাম, কিন্তু হালিমের উপর অপমানের প্রতিশোধ নেয়ার পথে কত দূর এগোলি?

রাফিয়া বলল, যারা ইসলামকে জানে ও মানে তাদের মনে প্রতিশোধ নেয়ার ইচ্ছা থাকে না। থাকলেও আল্লাহকে ভয় করে ও তার ভালবাসা পাওয়ার জন্য ক্ষমা করে দেয়। কারণ আল্লাহ ক্ষমাশীল, ক্ষমাকে ভালবাসেন। তাঁর যে বান্দা প্রতিশোধ নেয়ার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও প্রতিপক্ষকে ক্ষমা করে দেয়, আল্লাহ তাকে ভালবাসেন এবং তার অনেক দোষ-ত্রুটি ক্ষমা করে দেন। এটা হাদিসের কথা।

আরে তুই দেখছি পুরোপুরি হুজুর হয়ে গেছিস? এখন হালিম নিশ্চয় তোর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে?

রাফিয়া ছোট্ট একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলল, তোর ধারণা ভুল। সে আমার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে না, বরং আমিই খাচ্ছি।

তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে, হালিম তোকে পাত্তা দিচ্ছে না?

হ্যাঁ, তোর অনুমান ঠিক।

হালিম জানে, তুই তাকে ভালবাসিস?

বুঝতে পারি নি।

সে কিরে? তোর মনের কথা জানাস নি?

হাজার চেষ্টা করেও জানাতে পারি নি।

শবনম অবাক হয়ে বলল, তার সঙ্গে এতদিন মেলামেশা করছিস, জানাতে পারিস নি কেন?

যখনই জানাতে চেয়েছি তখনই জরুরি কাজের কথা বলে কেটে পড়ে।

ওর সম্পূর্ণ পরিচয় জেনেছিস?

না।

জানার চেষ্টা করিস নি?

করেছি, বলে নি।

ও তোকে ভালবাসে কি না বুঝতে পারিস নি?

না।

শবনম আরো অবাক হয়ে বলল, তোর মতো মেয়ে একটা ছেলের কাছে হেরে যাবি ভাবতেই পারছি না। আমার কি মনে হয় জানিস, কোনো মেয়ের কাছ থেকে ছ্যাক খেয়েছে। তাই তোকে পাত্তা দিচ্ছেন না।

কি জানি, তোর কথা হয়তো ঠিক। তবে আমিও দেখে নেব কি কারণে আমাকে পাত্তা দিচ্ছে না।

আমার কথা শোন, তুই আর ওর সঙ্গে মেলামেশা করিস না।

তুই বলার আগেই চেষ্টা করেছি কিন্তু পারি নি। লোহা যেমন চুম্বককে আকর্ষণ করে হালিমও তেমনি আমাকে আকর্ষণ করে। এবার ওর কথা রেখে ক্লাসে যাই চল।

.

কয়েকদিন পর সুযোগ পেয়ে রাফিয়া হালিমকে বলল, অনেক দিন থেকে আপনাকে একটা কথা বলব বলব করেও বলা হয় নি। এখন বলি?

হালিম বলল, এতদিন যখন বলা হয় নি তখন আর বলার প্রয়োজন নেই।

কিন্তু কথাটা যে আমাকে বলতেই হবে।

যা বলতে চান, তা আমি জানি।

হালিমের কথা শুনে রাফিয়ার মন আনন্দে ছলকে উঠল। বলল, কই, বলুন তো শুনি।

আপনি আমাকে ভীষণ ভালোবেসে ফেলেছেন।

রাফিয়া আনন্দে আপ্লুত হয়ে কিছুক্ষণ কথা বলতে পারল না। একদৃষ্টে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। অল্পক্ষণের মধ্যে চোখ দুটোতে পানি ছল ছল করতে লাগল।

তা লক্ষ্য করে হালিম বলল, কি? কথাটা ঠিক বলি নি?

রাফিয়া তার কথার উত্তর না দিয়ে চোখ মুছে বলল, আপনি আমাকে ভালবাসেন না?

হালিমও তার কথার উত্তর না দিয়ে বলল, আমাকে ভালবেসে বিরাট ভুল করেছেন।

যত বিরাট ভুল করি না কেন, সেটা আমার ব্যাপার। আমাকে ভালবাসেন কিনা বলুন।

ভালবাসা খুব পবিত্র জিনিস। মুখের কথায় তা প্রকাশ করা উচিত নয়। ওটা অন্তরের ব্যাপার। কারো অন্তর যদি পবিত্র হয়, তা হলে তার ভালবাসা মূল্যবান। মুখে যারা ভালবাসার কথা বলে তাদের অন্তরে সেই পবিত্রতা নেই।

কিন্তু অন্তরের কথা প্রকাশ করার জন্য আল্লাহ মানুষকে মুখ ও ভাষা দিয়েছেন।

আপনার কথা ঠিক হলেও ভালবাসার ক্ষেত্রে নয়। কারণ ভালবাসার কথা মুখে প্রকাশ করলে ভালবাসা খুব সস্তা হয়ে যায়। মূল্যবান আর থাকে না।

রাফিয়া তার কথা শুনে সন্তুষ্ট হতে না পারলেও বুঝতে পারল, হালিম তাকে অন্তর থেকে ভালবাসে। কি বলবে না বলবে ভেবে ঠিক করতে না পেরে চুপ করে রইল।

বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে হালিম বলল, আমার কথা শুনে আপনি যে সন্তুষ্ট হতে পারেন নি, তা আমি বুঝতে পারছি। শুনুন, আমি আপনার ভালো চাই। তাই বলব, যে পথে এগিয়েছেন, তা খুব দুর্গম। ফিরে গেলে ভবিষ্যৎ জীবন সুখের হবে। আর এটাই আমার কাম্য।

আর আমি যদি বলি যতই দুর্গম হোক, আপনার কাছে পৌঁছানোর জন্য আজীবন সেই পথ পাড়ি দেব এবং আশা করি, ইনশাআল্লাহ একদিন কামিয়াবও হব।

এরকম সিদ্ধান্ত নেয়া আপনার উচিত হয় নি। কারণ আমার পরিচয় আপনি জানেন না।

অনেকবার জানতে চেয়েছি, আপনি এড়িয়ে গেছেন।

হ্যাঁ, এড়িয়ে গেছি। কারণ আমার দেয়ার মতো কোনো পরিচয় নেই।

আমি আপনাকে ভালবেসেছি, আপনার পরিচয়কে নয়।

কথাটা ঠিক বলেন নি। পরিচয়হীনকে সমাজ ঠাঁই দেয় না।

আমি সমাজের পরওয়া করি না।

এ কথাটাও ঠিক বলেন নি। কারণ মানুষ সামাজিক জীব। সমাজ ছাড়া সে থাকতে পারে না। আর পরিচিতরাই সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়।

আপনার জন্য আমি সমাজ ত্যাগ করতে পারব।

হালিম হেসে ফেলে বলল, এটা আপনার আবেগের কথা। আবেগ বেশি দিন থাকে না। বাস্তব জীবনে প্রবেশ করার কিছুদিন পরেই মনে হবে, কি বিরাট ভুল করে ফেলেছেন। ফলে দুর্বিসহ জীবন কাটাতে হবে।

আপনি পরিচয়হীন হলেও শিক্ষা ও কর্ম আপনাকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করবে।

এ কথাটা অবশ্য ঠিক বলেছেন। তাই ভেবেছি, শিক্ষা জীবন শেষ করে কর্মজীবনে প্রবেশ করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হই। তারপর জীবন সঙ্গিনীর কথা চিন্তা করব।

আপনিও ঠিক কথা বলেছেন। তবে এর মধ্যেই মনের মতো জীবনসঙ্গিনী নির্বাচন করে রাখতে বাধা কোথায়। অবশ্য কাউকে যদি পছন্দ হয়।

বাধা সময়ের। অতদিন কি নির্বাচিত পাত্রী বা তার গার্জেনরা অপেক্ষা করবেন?

যদি তারা অপেক্ষা করেন?

যদি কথা দু’এক বছরের জন্য প্রযোজ্য, দীর্ঘ সময়ের জন্য নয়।

সময় যত দীর্ঘ হোক, আমি অপেক্ষা করব।

এটাও আবেগের কথা। তা ছাড়া আপনি করলেও গার্জেনরা করবেন না।

রাফিয়া ছলছল চোখে বলল, গার্জেনদের ব্যাপারটা আমি বুঝবো। আপনি শুধু কথা দিন, আমাকে ভুলে যাবেন না।

কথা দেয়ার আগে আপনার বাবার সঙ্গে আমি দেখা করতে চাই।

এই কথা শুনে রাফিয়ার হার্টবিট বেড়ে গেল। সেই সাথে চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সামলে নিয়ে চোখ মুছে বলল, বেশ তো, এখনই চলুন। আর তো ক্লাশ নেই।

আজ নয়, কাল ভার্সিটি বন্ধ। সকাল নটার সময় যাব, ঠিকানা দিন।

.

হাফিজ উদ্দিন প্রতিদিন সকাল আটটায় নাস্তা খান। আজ নাস্তা খেয়ে নিজস্ব লাইব্রেরিতে একটা সাইকোলজির বই পড়ছিলেন।

রাফিয়া ন’টা বাজার পাঁচ মিনিট আগে এক কাপ চা নিয়ে বাবার কাছে এসে বলল, পড়া বন্ধ করে চা খেয়ে নাও। নচেৎ চা খাওয়ার কথা ভুলে যাবে।

হাফিজ উদ্দিন বই বন্ধ করে বললেন, বস, তোকে অনেক দিন ভালো করে দেখি নি।

রাফিয়া বসে আদুরে গলায় বলল, তোমার সঙ্গে রোজ দেখা হচ্ছে, দেখ নি বলছ কেন?

রোজ দেখা হয় ঠিক, কিন্তু আজকের মতো এত কাছে তো অনেকদিন আসিস নি। জানিস মা, মানুষের মন যে কত বিচিত্র, এই বইটা না পড়লে জানতে পারতাম না। তোকে দেখে কি মনে হচ্ছে জানিস? নিশ্চয় কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছিস। কি, কথাটা ঠিক বলি নি?

রাফিয়া জানে, বাবা একবার কোনো বিষয়ে কথা বলতে শুরু করলে এক দেড় ঘণ্টাতেও শেষ হবে না। শ্রোতার সময় আছে কি না অথবা সে বিরক্ত হচ্ছে কিনা, সেসব খেয়াল করবে না। শ্রোতা কোনো অজুহাত দেখিয়ে চলে যেতে চাইলেও যেতে দেয় না। তাই বাবার কথা শুনে বলল, হ্যাঁ বাবা, তুমি ঠিক বলেছে। আজ ন’টার সময় আমার একজন ক্লাসমেট তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসবে। নটা বাজতে দু’এক মিনিট বাকি। হয়তো এক্ষুনি এসে পড়বে।

হাফিজ উদ্দিন আনন্দিত হয়ে বললেন, তা হলে তো ভালই হল। তার সঙ্গে মানুষের বিচিত্র মনের সম্পর্কে আলাপ করা যাবে। তা হারে, ক্লাশমেট মেয়ে, না ছেলে?

ছেলে। জান বাবা, ছেলেটা ভার্সিটির সেরা ছাত্র।

এমন সময় কাজের বুয়া নাসিরন এসে বলল, একটা ছেলে খালুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। আমি তাকে ড্রইংরুমে বসিয়েছি।

রাফিয়া তাকে চলে যেতে বলে বাবাকে বলল, মনে হচ্ছে, ঐ ছেলেটাই এসেছে। তুমি যাও, আমি একটু পরে আসছি।

হালিম সোফায় বসেছিল। একজন পৌঢ় লোককে পর্দা ঠেলে ঢুকতে দেখে দাঁড়িয়ে সালাম দিল।

হাফিজ উদ্দিন সালামের উত্তর দিয়ে হালিমকে বসতে বলে নিজেও বসলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, তুমিই কি রাফিয়ার ক্লাশমেট?

হালিম বলল, জি।

কি নাম তোমার?

আব্দুল হালিম।

বাবার নাম?

মরহুম সেখ মঈনুদ্দিন।

বাড়ি কোথায়?

পটুয়াখালী জেলার বাহেরচর গ্রামে।

এখানে থাক কোথায়?

সূর্যসেন হলে।

বাড়িতে কে কে আছে?

মা ছাড়া আমার আর কেউ নেই।

তোমার বাবা তা হলে খুব অবস্থাপন্ন লোক ছিলেন?

না, তিনি দিনমজুর ছিলেন।

হাফিজ উদ্দিন অবাক কণ্ঠে বললেন, তা হলে তোমার লেখাপড়ার খরচ জোগাচ্ছে কে?

আল্লাহ।

তা তো বুঝলাম। কিন্তু আল্লাহ নিজে তো কিছু দেন না, কাউকে উপলক্ষ করে দেন। নিশ্চয় তিনি তোমার কোনো আত্মীয়?

না। আমার বাবা মারা যাওয়ার পর মাতব্বরের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে মা গ্রাম ছেড়ে আমাকে নিয়ে যখন পটুয়াখালী শহরে আসেন তখন আমার বয়স সাত বছর। তারপর কিভাবে আবু তাহেরের আশ্রয়ে থেকে লেখাপড়া করছে বলল।

রাফিয়ার সঙ্গে তোমার জানাশোনা কত দিনের?

প্রায় তিন বছর হতে চলল।

মেয়ে এরকম একটা ছেলের সঙ্গে মেলামেশা করে ভেবে হাফিজ উদ্দিন খুব রেগে গেলেন। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে গম্ভীরস্বরে জিজ্ঞেস করলেন, রাফিয়া তোমার পরিচয় জানে?

না।

সে জানতে চায় নি?

চেয়েছেন, আমি বলি নি।

কেন?

আপনার মেয়ে অন্ধের মতো আমাকে ভালবাসেন। পরিচয় জানালে বিশ্বাস করতেন না। ভাবতেন, মিথ্যে পরিচয় দিচ্ছি।

তুমি রাফিয়াকে ভালবাস না?

হ্যাঁ, ভালবাসি।

হাফিজ উদ্দিন আরো রেগে উঠে বললেন, আমি যদি বলি, অর্থ ও সম্পত্তির লোভে বড়লোকের মেয়েকে ভালবাসার ফাঁদে ফেলে বিয়ে করার জন্য তাকে পরিচয় জানাও নি?

তা বলতে পারেন, তবে তা ঠিক নয়। তাকে ভালোবাসি বলেই তার ভালো চাই। তাই আপনার কাছে আমার পরিচয় দিতে এসেছি। এখন আপনার মেয়ের মোহ ভাঙাবার দায়িত্ব আপনাদের। আমি নাম গোত্রহীন এক দিন মজুরের ছেলে হলেও লোভী নই। এবার উঠি তা হলে, বলে হালিম দাঁড়িয়ে পড়ল।

হালিমের সৎ সাহস ও অকপট কথাবার্তায় হাফিজ উদ্দিনের রাগ পড়ে গেল। বুঝতে পারলেন, ছেলেটা খুব বুদ্ধিমান ও সৎ। চলে যাওয়ার কথা শুনে বললেন, বস, কিছু খেয়ে তারপর যাবে।

মাফ করবেন, কিছু খেতে পারব না বলে হালিম সালাম দিয়ে বেরিয়ে গেল।

বাবাকে ড্রইংরুমে যেতে বলে রাফিয়া তিন ভাবিদের কাছে গিয়ে বলল, আমার হুজুর প্রেমিক এসেছেন। বাবা ওনার কাছে গেছে, তোমরা দেখতে চাইলে এস আমার সঙ্গে।

তিন ভাবিই তার সঙ্গে এসে দরজার আড়াল থেকে এতক্ষণ শ্বশুর ও হালিমের কথাবার্তা শুনছিল। হালিমকে ভাবিদের খুব পছন্দ হল। তাকে চলে যেতে দেখে বড় ভাবি রাফিয়াকে বলল, উনি তো কিছু না খেয়ে যাচ্ছেন, ধরে নিয়ে এস।

রাফিয়া বলল, উনি বাবার কথা যখন রাখলেন না তখন আমারও রাখবেন।

সেজ ভাবি খুব ধনী ঘরের উচ্চ শিক্ষিত মেয়ে। হালিমকে দেখে তার পছন্দ হলেও পরিচয় শুনে খুশী হতে পারে নি। অসন্তুষ্ট গলায় ননদকে উদ্দেশ্য করে বলল, নামগোত্রহীন ছেলের পাল্লায় পড়া তোমার উচিত হয় নি। আমাদের সোসাইটির মান-সম্মানের কথা চিন্তা না করে এই পথে পা বাড়াতে পারলে?

রাফিয়া কিছু বলার আগে মেজ ভাবি বলল, ওকে দোষ দিচ্ছ কেন? ওতো ছেলেটার পরিচয় জানার চেষ্টা করেও সফল হয় নি।

বড় ভাবি বলল, হ্যাঁ, তোমাদের দুজনেরই কথা ঠিক। আশা করি, পরিচয় জানার পর রাফিয়া ঐ পথ থেকে ফিরে আসবে।

রাফিয়া ভাবিদের কথা শুনে রেগে গেল। বলল, উনি নাম-গোত্রহীন ছেলে হলেও খুব ধার্মিক ও মহৎ। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ওনাকেই জীবনসঙ্গী করব ইনশাআল্লাহ।

রাফিয়ার ছোট ভাইয়া আশফাক বাসায় ছিল না। ফেরার সময় বাসার কাছাকাছি হালিমকে দেখে সালাম বিনিময় করে বলল, আরে আপনি? এদিকে কোথায় এসেছিলেন?

হালিম বলল, আপনাদের বাসায়।

তাই নাকি? রাফিয়ার সঙ্গে দেখা হয়েছে?

না।

কেন? ওকি বাসায় নেই?

তা জানি না। আমি ওনার সঙ্গে দেখা করতে আসি নি, এসেছিলাম আপনার বাবার সঙ্গে দেখা করতে।

আশফাক অবাক হয়ে বলল, বাবার সঙ্গে দেখা হয়েছে?

হ্যাঁ, হয়েছে। আগে থেকে কি বাবার সঙ্গে আপনার পরিচয় ছিল?

না, আজই পরিচয় হল।

আশফাক আরো অবাক হয়ে বলল, বাবার সঙ্গে পরিচয় নেই অথচ তার সঙ্গে দেখা করতে এলেন, ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছি না।

মাফ করবেন, ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলতে পারছি না। আশা করি, বাসায় গেলেই বুঝতে পারবেন। এবার আসি বলে সালাম বিনিময় করে হালিম হাঁটতে শুরু করল।

হাফিজ উদ্দিন ভিতরে চলে যাওয়ার পর ভাবিরা রাফিয়াকে নিয়ে ড্রইংরুমে বসে কথা বলছিল। আশফাক বাসায় ঢুকে তাদের গলা পেয়ে সেখানে এসে রাফিয়ার কথা শুনে জিজ্ঞেস করল, কাকে জীবনসঙ্গী করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিস রে?

রাফিয়া লজ্জা পেয়ে ছুটে পালিয়ে গেল।

আশফাক ভাবিদেরকে জিজ্ঞেস করল, কি ব্যাপার বলতো?

বড় ভাবি বলল, কিছুক্ষণ আগে হালিম নামে রাফিয়ার এক ক্লাশমেট এসেছিল বাবার সঙ্গে দেখা করতে। এক্ষুনি চলে গেল, তুমি হয়তো তাকে দেখে থাকবে।

হ্যাঁ, দেখেছি। তার সঙ্গে কথাও বলেছি।

মেজ ভাবি বলল, তাকে তুমি চেনো?

হ্যাঁ, চিনি। আপ্যায়ন করিয়েছিলে?

বাবা তাকে কিছু খাওয়ার কথা বলেছিলেন, শুনল না।

রাফিয়া কিছু বলে নি?

বাবার সঙ্গে কথা বলেই চলে গেল। আমরা রাফিয়াকে বলতে বলেছিলাম। বলল, বাবার কথা যখন রাখল না তখন আমার কথাও রাখবে না।

আমি জানলে ধরে নিয়ে আসতাম।

সেজ ভাবি বলল, রাফিয়া ওকে জীবনসঙ্গী করতে চায়, তাও জান না কি?

না, জানি না। তাই বুঝি ওকে জীবনসঙ্গী করার কথা জিজ্ঞেস করতে পালিয়ে গেল?

বড় ভাবি বলল, হ্যাঁ। তারপর জিজ্ঞেস করল, হালিমকে তুমি চেনো কিভাবে?

আশফাক মার্কেটের ঘটনাটা বলে বলল, ঐদিন রাফিয়ার কাছ থেকে ওর পরিচয় জানতে পারি। পরে মেডিকেলে দেখতে গিয়ে আলাপ করি। বাবার সঙ্গে দেখা করতে কেন এসেছিলেন জান?

হ্যাঁ, জানি। এসেছিল তার বায়োডাটা বাবাকে জানাতে। তারপর বাবা ও হালিমের সঙ্গে যা কিছু কথা হয়েছে বলল।

আশফাক অবাক হয়ে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, নামগোত্রহীন হলেও ছেলেটা খুব জিনিয়াস। তবু বলব, তাকে জীবনসঙ্গী করার সিদ্ধান্ত নেয়া রাফিয়ার উচিত হয় নি। তোমরা ওকে কিছু বল নি?

বলিনি আবার, বলার পরতো ঐ কথা বলল।

দেখি, আমি ওর সঙ্গে এ ব্যাপারে আলাপ করব বলে আশফাক সেখান থেকে চলে গেল।

.

পরের দিন ক্লাশ শেষে রাফিয়া হালিমকে বলল, চলুন, কোথাও বসি, আলাপ করব।

হালিম হাঁটতে শুরু করে বলল, আলাপটা অন্য দিন করলে হয় না?

রাফিয়া বলল, না, আজই করব।

ওরা কবি নজরুল ইসলামের কবরের কাছাকাছি এক জায়গায় বসল। বসার পর হালিম বলল, এবার বলুন কি আলাপ করবেন।

কাল আমার সঙ্গে দেখা না করে চলে এলেন কেন?

আপনার সঙ্গেতো প্রায় প্রতিদিন দেখা হচ্ছে। তাই প্রয়োজন মনে করি নি।

বাবা কিছু খেতে বলার পরও খেলেন না, এটা কি উচিত হয়েছে?

না, উচিত হয় নি।

অনুচিত জেনেও কাজটা করলেন কেন?

যাতে আপনার বাবা আমাকে অভদ্র মনে করেন।

সবার কাছে আমি কত ছোট হয়ে গেলাম, সেকথা মনে হয় নি?

হয়েছে। তারপর হালিম অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আর কিছু বলবেন?

হ্যাঁ বলব। বাবার সঙ্গে দেখা করার পর কি বলবেন বলেছিলেন, মনে আছে?

আছে।

তা হলে বলুন।

বললে আপনি দুঃখ পাবেন।

তবু বলুন।

কথাটা আপনার বাবাকে বলেছি। মনে হল, শুনে তিনি খুব রেগে গিয়েছিলেন। তাই আপনাকে আর বলতে চাচ্ছি না।

আমাকে বলতেই হবে।

তা হলে শুনুন, আমিও আপনাকে ভীষণ ভালবাসি। তবে জীবনসঙ্গিনী করার স্বপ্ন কোনো দিন দেখি নি।

কেন বলুন তো?

নামগোত্রহীনদের স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়, কোনো দিন সফল হয় না। স্বপ্নের পিছনে যারা ছোটে, আমি তাদের দলে নই।

স্বপ্ন সফল করার জন্য আমি যদি আপনাকে সাহায্য করি?

সাহায্য নেয়ার যোগ্যতাও আমার নেই।

কে বলেছে নেই? আমি তো জানি যাদের যোগ্যতা আছে, তাদের থেকে আপনার অনেক বেশি আছে।

আপনি আমাকে ভালবাসেন। তাই ঐ কথা বলছেন। আপনার গার্জেন ও আপনাদের হাই সোসাইটির কাছে আমার এতটুকুও যোগ্যতা নেই। তা ছাড়া। আমার একটা সাধনা আছে, সেই সাধনা সফল না হওয়া পর্যন্ত সংসার জীবনে প্রবেশ করতে পারব না। কবে সেই সাধনা আল্লাহ সফল করাবেন, তা তিনিই জানেন। এবার নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, আপনাকে ভালবাসলেও কেন আপনার ডাকে সাড়া দিতে পারছি না? তারপর আর সময় দিতে পারছি না বলে হালিম উঠে দাঁড়াল।

প্লীজ, আর একটু বসুন বলে রাফিয়া তার একটা হাত ধরে বসিয়ে বলল, আগেও বলেছি এখনও বলছি, আপনার সাধনা সফল না হওয়া পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করব। কথা দিন, আমাকে ভুলে যাবেন না?

হালিম হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, কথা দিলে দু’জনকেই দিতে হবে, একজন দিলে তো হবে না।

আমি তো আগেই কথা দিয়েছি।

আমি নিশ্চিত, অতদিন আপনি অপেক্ষা করতে পারবেন না। আর আপনার গার্জেনরা অপেক্ষা করা তো দূরের কথা, ওনারা আমাকে পছন্দই করেন না। যখন শুনবেন আমার জন্য আপনি ওনাদের পছন্দ করা ছেলেকে বিয়ে করতে চাচ্ছেন তখন যেমন করে হোক বিয়ে দেবার চেষ্টা করবেন। কারণ কোনো গার্জেনই চাইবেন না আমার মতো একটা ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে।

রাফিয়া বলল, আমি শিক্ষিত ও ম্যাচিওর। গার্জেনরা যতই চেষ্টা করুন না কেন, আমার অমতে কিছুতেই বিয়ে দিতে পারবেন না। প্রয়োজনে চাকরি করে বাসা ছেড়ে অন্যত্র থাকব। আপনি শুধু ওয়াদা করুন, সাধনা সফল হওয়ার পর আমার কাছে আসবেন।

হালিম ছোট্ট একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলল, তা না হয় করলাম, কিন্তু এসে যদি দেখি আপনি কারো সংসার করছেন, তখন?

রাফিয়া ভিজে গলায় বলল, আল্লাহর কোনো মুমীন বান্দা কখনও ওয়াদা খেলাপ করে না। আশা করি, এরপর আমাকে আর অবিশ্বাস করবেন না?

প্রেম-ভালবাসার মধ্যে অবিশ্বাসের স্থান নেই। যদি থাকে, তাহলে খাঁটি প্রেম-ভালবাসা হয় না। আপনাকে অবিশ্বাস করি নি, যা বাস্তব তাই বলেছি। বুঝতে পারছি, আমার কথায় মনে দুঃখ পেয়েছেন। সেজন্য ক্ষমা চাইছি। বলুন ক্ষমা করে দিয়েছেন?

রাফিয়া চোখ মুছে বলল, আগে ওয়াদা করুন।

ঠিক আছে, করলাম। এবার ক্ষমা পেয়েছি কি না বলুন।

রাফিয়া আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে সুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, প্রেমিক প্রেমিকাদের একে অপরের দোষ-ত্রুটি ক্ষমা করার মাধ্যমে প্রেম আরো গম্ভীর হয়, তাই না?

হালিম মৃদু হেসে বলল, হ্যাঁ, তাই। তারপর বিদায় নিয়ে হালিম চলে গেল।

.

অনার্স কমপ্লীট করা পর্যন্ত তাদের যোগাযোগ থাকলেও আজ প্রায় চার বছর হতে চলল যোগাযোগ নেই। রাফিয়া ভেবেছিল, হালিম মাস্টার্স কমপ্লীট করে সাধনায় নামবে, কিন্তু মাস্টার্স করার সময় তার খোঁজ না পেয়ে চিন্তিত হল। ভাবল, তা হলে সে কি পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে সাধনার কাজে লেগে গেল? আরো ভাবল, তাই যদি হয়, তা হলে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করছে না কেন? তার মন বলে উঠল, সাধনার কাজে হয়তো খুব ব্যস্ত আছে। সময় সুযোগ পেলে নিশ্চয় যোগাযোগ করবে। আশায় আশায় দিন গুনতে গুনতে মাস্টার্স কমপ্লীট করার পরও যখন হালিম যোগাযোগ করল না তখন খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল।

এরমধ্যে একটা ভালো পাত্রের সন্ধান পেয়ে হাফিজ উদ্দিন একদিন স্ত্রীর সামনে মেয়েকে সেকথা জানিয়ে মতামত জানতে চাইলেন।

রাফিয়া বলল, আমি এখন বিয়ে করব না।

মেয়ের কথা শুনে ফাতেমা খাতুন বললেন, লেখাপড়া শেষ করলি। এবার তোর বিয়ে দিয়ে আমরা নিশ্চিন্ত হতে চাই। তুই এখন বিয়ে করতে চাচ্ছিস না কেন? সব সময় কি আর ভালো ছেলে পাওয়া যায়? ছেলে ডাক্তার, মা-বাবার একমাত্র সন্তান। ছেলের বাবা ব্যবসায়ী। ছোট সংসার। এরকম ছেলে হাতছাড়া করা ঠিক হবে না।

রাফিয়া বলল, যতই ভালো হোক, বললাম না, এখন আমি বিয়ে করব না?

কেন করবি না বলবি তো?

পরে বলব বলে রাফিয়া তাদের কাছ থেকে চলে গেল।

হাফিজ উদ্দিন বললেন, মনে হয় ও কোনো ছেলেকে পছন্দ করে। তুমি ওকে জিজ্ঞেস করে দেখে।

ফাতেমা খাতুন বললেন, বড় বৌ বলছিল, অনেক দিন আগে হালিম নামে যে ছেলেটা তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল, তাকে নাকি ও পছন্দ করে।

চার বছর আগের কথা হাফিজ উদ্দিন ভুলে গিয়েছিলেন। কপাল কুঁচকে কিছুক্ষণ চিন্তা করে স্মরণ করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু স্মরণ করতে পারলেন না। বললেন, কই মনে পড়ছে না তো?

তোমার তো কোনো কিছুই মনে থাকে না। সারা দিন রাত বইয়ের মধ্যে ডুবে থাক। কি যে পাও মোটা মোটা বই পড়ে বুঝি না। তারপর আবার বললেন, রাফিয়া অনার্স পড়ার সময় যে ছেলেটা এসে বলল, “আপনাদের মেয়ে আমাকে ভীষণ ভালবেসে ফেলেছে। তারপর তার পরিচয় দিয়ে রাফিয়ার মোহ ভাঙাতে বলেছিল।”

ও হ্যাঁ হ্যাঁ, এবার মনে পড়ছে। কিন্তু সে ছেলেটা তো নামগোত্রহীন গরিব ঘরের। তার বাবা দিনমজুর ছিল। সে অন্যের দয়ায় লেখাপড়া করছে। না-না এ কখনো সম্ভব নয়। এতবড় ভুল রাফিয়া করবে ভাবতেই পারি নি। মনে করেছিলাম এতদিনে তাকে হয়তো ভুলেই গেছে। আমাদের মান-সম্মানের কথা চিন্তা করল না? ওর ভাইয়ারা শুনলে খুব রেগে যাবে। তুমি ওকে বুঝিয়ে বলো।

ঠিক আছে, বলব। তবে কাজ হবে বলে মনে হয় না। তুমি বাবা হলে কি হবে, আমি ওকে পেটে ধরেছি। ওর স্বভাব চরিত্র জানতে আমার বাকি নেই। নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ছোটবেলা থেকে আজ পর্যন্ত কোনো কিছু করে নি।

হাফিজ উদ্দিন রেগে উঠে বললেন, তাই বলে ওর এতবড় অন্যায় মেনে নেব? একটা আস্তাকুঁড়ের ছেলে, যার মা অন্যের বাড়ি কাজ করে খায়, সেই ছেলেকে পছন্দ করতে ওর বিবেকে বাধল না।

তুমি রাগ করছ কেন? মেয়ে বড় হয়েছে, লেখাপড়াও করেছে, ওর অমতে জোর করে কিছু করা ঠিক হবে না। আমি ওকে বুঝিয়ে বলব, বৌমাদেরকেও বোঝাতে বলব। তুমি ঐ ডাক্তার ছেলের গার্জেনদের সঙ্গে আলাপ কর।

ফাতেমা খাতুন মেয়েকে তার বাবার অমতের কথা বলে অনেক বোঝালেন। কাজ না হতে বৌমাদের বোঝাতে বললেন। তারাও ননদকে বোঝাল।

রাফিয়া তাদের সাফ সাফ জানিয়ে দিল, হালিমকে ছাড়া অন্য কোনো ছেলেকে বিয়ে করবে না।

স্ত্রীদের কাছ থেকে তিন ভাইয়া শুনে তারাও সাফ সাফ জানিয়ে দিল, হালিমকে কিছুতেই মেনে নেবে না।

রাফিয়া ভাইয়াদের সামনে কিছু না বললেও ভাবিদেরকে বলল, তোমরা মা বাবা ও ভাইয়াদের জানিয়ে দিও, অন্য কোথাও আমার বিয়ে দেয়ার জন্য যেন চেষ্টা না করে। যদি করে, তা হলে তার পরিণতির জন্য তারাই দায়ী হবে। হালিমকে তোমরা সবাই মেনে না নিলে বিয়েই করব না। প্রয়োজনে যে কোনো চাকরি নিয়ে অন্যত্র থাকব।

তার কথা শুনে সবাই তাকে রাগারাগি করলেও আশফাক কিছু বলল না। রাফিয়াকে সে সব ভাইয়েদের চেয়ে বেশি ভালবাসে। তাই একদিন তাকে জিজ্ঞেস করল, তুই হালিমকে ছাড়া বিয়ে করতে চাচ্ছিস না কেন?

রাফিয়া বলল, তুমি কিন্তু বোকার মতো প্রশ্ন করছ।

আশফাক হেসে ফেলে বলল, তাহলে আর একটা বোকার মতো প্রশ্ন করি, হালিমও নিশ্চয় তোকে ছাড়া বিয়ে করবে না?

ঠিক ঐ কথা বলেন নি। বলেছেন, আমি যদি তার জন্য অপেক্ষা করি, তা হলে আমাকে বিয়ে করার জন্য ফিরে আসবেন।

ফিরে আসবেন মানে? সে কোথায় গেছে?

তা জানি না।

কি পাগলের মতো কথা বলছিস? তার সঙ্গে তোর যোগাযোগ নেই?

না।

কতদিন যোগাযোগ নেই।

প্রায় চার বছর।

কি বলছিস তুই? যে তোর সঙ্গে চার বছর যোগাযোগ রাখে নি, তাকে মনে রেখে বিয়ে করতে চাচ্ছিস না? সে ফিরে আসবে ভাবতে পারলি?

শুধু মনে রেখেছি না, প্রয়োজনে সারাজীবন অপেক্ষাও করব।

এরকম সিদ্ধান্ত নেয়ার পিছনে নিশ্চয় কোনো কারণ আছে। সেটা বলত শুনি।

শেষবারে যখন তার সঙ্গে আলাপ হয় তখন বলেছিলেন, ওনার কি একটা সাধনা আছে। সেটা সফল হওয়ার পর আমার কাছে আসবেন।

সাধনা সফল হতে কত সময় লাগবে কিছু বলেছে?

না।

তুই জিজ্ঞেস করিস নি?

না।

একটু আগে তুই আমাকে বোকা বললি, অথচ তুই-ই বোকার মতো কাজ করেছিস। সাধনা ও সময়ের কথা জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল। আচ্ছা, ওর বায়োডাটা জানিস?

অনেকবার জানতে চেয়েছি, বলেন নি। তবে বাবার সঙ্গে দেখা করতে এসে বাবাকে যখন বলেছিলেন তখন শুনেছি।

যা যা শুনিছিস একটা কাগজে লিখে দে। আমি খোঁজ নেব। যদি জানতে পারি, তার সব কিছু ভালো, তা হলে মা-বাবা ও ভাইয়াদের যেমন করে তোক রাজি করিয়ে তোদের বিয়ের ব্যবস্থা করব।

৯-১০. হালিম অনার্স কমপ্লীট

০৯.

হালিম অনার্স কমপ্লীট করার পর বি,সি, এস, করে। তারপর পুলিশ বিভাগে ঢুকে ট্রেনিং শেষে দারোগার চাকরি নেয়। মাস ছয়েক হল পটুয়াখালী জেলার রাঙ্গীকালি থানায় বদলি হয়ে এসেছে।

জিন যে রাতে মাতব্বর ও তার ছেলে রশিদকে শাসিয়ে গেল তার দু’দিন পর বেলা দশটার সময় দারোগা মাতব্বরের বাড়িতে এলেন।

সালাম বিনিময় করে মাতব্বর আপ্যায়ন করাতে চাইলে দারোগা বললেন, ওসব করা লাগবে না। আমি মঈন সেখের বাস্তুর ব্যাপারে আলাপ করতে এলাম।

রশিদও সেখানে ছিল। বাবা কিছু বলার আগে বলে উঠল, আপনি সায়রাকে বলবেন, সে তার স্বামীর ভিটেয় মাদ্রাসা তৈরির কাজ শুরু করুক। আমারা ওখানে যেসব গাছপালা লাগিয়েছি, সেসবে আমাদের দাবি নেই। ওগুলো মাদ্রাসার কাজে দান করে দিলাম।

দারোগা বললেন, শুনে খুব খুশী হলাম। এবার আসি, সায়রা বানুকে কথাটা জানিয়ে আযীয সেখের সঙ্গে স্কুলের জমির ব্যাপারে আলাপ করতে হবে। তারপর সালাম বিনিময় করে চলে গেলেন।

কিছুদিনের মধ্যে আযীয সেখের তত্ত্বাবধানে সায়রা স্বামীর ভিটেয় মাদ্রাসা ঘর প্রতিষ্ঠা করল। তারপর একদিন দারোগা ও গ্রামের লোকজনদের নিয়ে মাদ্রাসা প্রাঙ্গনে মিটিং ডেকে একটা সমিতি গঠন করে সমিতির লোকজনের উপর মাদ্রাসা। পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হল।

মাদ্রাসা উদ্বোধন করার জন্য পটুয়াখালী শহর থেকে মুসার ভাইরা আবু তাহেরকে আনা হয়েছে। ওনাকে কিছু বলার জন্য আযীয সেখ অনুরোধ করলেন।

আবু তাহের হামদ ও নাত পাঠ করার পর লোকজনদের উদ্দেশ্যে বললেন, এটা একটা দ্বীনি প্রতিষ্ঠান। বাংলা, ইংরেজি ও অন্যান্য সবকিছু ছেলেমেয়েরা স্কুলে শিক্ষা পায়। এখানে শুধু কুরআন ও হাদিস শিক্ষা দেয়া হবে। অর্থাৎ যতটুকু দ্বীনি শিক্ষা করা প্রতিটি মুসলমান ছেলেমেয়ের অবশ্য কর্তব্য, সেসব শিক্ষা দেয়া হবে। আর রাতে এশার নামাযের পর বড়দেরকেও ঐসব শিক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা থাকবে এবং তারা যেন মাতৃভাষা লিখতে ও পড়তে পারে সে ব্যবস্থাও থাকবে। গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ অশিক্ষিত। তাই তারা ধর্ম সম্পর্কে কিছু না জেনে অনেক

বেদয়াতকে ধর্মের কাজ মনে করে মেনে চলে। তাই আমি এই মাদ্রাসায় একটা ইসলামী পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করার সংকল্প করেছি। ইনশাআল্লাহ খুব শিঘ্রী সেই ব্যবস্থা করব। আপনারা দোয়া করবেন, আল্লাহ যেন আমার মনের আশা পূরণ করেন।

আপনাদের কাছে আমার একান্ত অনুরোধ, প্রত্যেকে নিজের ছেলেমেয়েদের এখানে পাঠাবেন এবং আপনারাও রাত্রে এসে দ্বীন-দুনিয়ার শিক্ষা লাভ করবেন। আমাকেও পরিচালনা সমিতির সদস্য করা হয়েছে। তাই প্রতি মাসে একবার এসে আপনাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করব। আপনাদের সহযোগিতা কামনা করে আমি আমার বক্তব্য শেষ করছি, আসোলামু আলাইকুম।

এবার আযীয সেখ বললেন, মাওলানা সাহেব খুব মূল্যবান কথা বলেছেন। শিক্ষার অভাবে, বিশেষ করে দ্বীনি শিক্ষার অভাবে আমরা যেমন অনেক বেদয়াতকে ধর্মের কাজ মনে করে গুনাহ করছি। তেমনি হিংসা-বিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে একে অপরের ক্ষতি করছি। সামান্য কারণে ভাইয়ে ভাইয়ে মারামারি করছি, সামান্য কারণে ও যৌতুকের জন্য স্ত্রীর উপর জুলুম করছি, অনেকে তালাকও দিচ্ছি। ধনীরা গরিবদের শোষণ করছি। আমরা বড়রা যদি ধর্মের সঠিক জ্ঞান অর্জন করে সেইসব মেনে চলতে পারি, তা হলে ইনশাআল্লাহ আমরা ঐ সমস্ত গুনাহ থেকে রক্ষা পাব এবং শান্তিতে বাস করতে পারব। তাই আমিও সবাইয়ের কাছে অনুরোধ করব, আমরা প্রতিদিন এশার নামাযের পর এখানে এসে দ্বীনি শিক্ষা লাভ করব আর ছেলেমেয়েদের পাঠাব। এই প্রতিষ্ঠান যাতে কায়েম থাকে সে চেষ্টা ও তদবীর আমরা করব। এখন বলুন, আপনারা সবাই রাজি আছেন কিনা।

সবাই একসঙ্গে বলে উঠল, হ্যাঁ, রাজি আছি।

আযীয সেখ এবার দারোগাকে কিছু বলতে বললেন।

দারোগা আযীয সেখকে ধন্যবাদ জানিয়ে সবাইয়ের উদ্দেশ্যে সালাম দিয়ে বললেন, আমার আগে মাওলানা সাহেব ও আযীয সেখ যে সমস্ত কথা বলেন, তারপর আমার আর কিছু বলার নেই। তবু দু’একটা কথা বলব। মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড় অভিশাপ হল মূর্খতা। মূর্খ মানুষ যেমন নিজেকে চেনে না, তেমনি তার ভালো মন্দ বিবেচনা শক্তিও নেই। তাই আমাদের নবী হযরত মুহম্মদ (দঃ) বলিয়াছেন, প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য এলেম শিক্ষা করা ফরয অর্থাৎ অবশ্য কর্তব্য। আমরা অনেকে ছেলেদের কম বেশি লেখাপড়া করালেও মেয়েদের প্রতি খুবই উদাসীন। অনেক মনে করে, মেয়েরা লেখাপড়া করে কি করবে? বড় হলে তো তাদের বিয়ে দিয়ে পরের ঘরে পাঠাতে হবে। সেখানে রান্না বান্না ও সংসারের কাজ সারাজীবন করবে। তাই যতদিন মা-বাবার বাড়িতে থাকে ততদিন তাদেরকে রান্না-বান্না ও সংসারের অন্যান্য কাজ করান হয়। কিন্তু আমরা কোনোদিন ভেবে দেখেছি কি, ঐ সব কাজ সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে করার জন্য লেখাপড়ার দরকার। রান্না-বান্না ও সংসারের কাজ-কর্ম ছাড়া মেয়েদের আর একটা প্রধান কাজ হল, সন্তানের পরিচর্যা করা এবং আদব-কায়দা শিক্ষা দিয়ে ও লেখাপড়া করিয়ে মানুষ করা। একজন মূর্খ মা কি এই গুরুদায়িত্ব পালন করতে পারে? কখনই পারে না। শিশুরা যাতে বড় হয়ে মানুষের মতো মানুষ হতে পারে। সে দায়িত্ব মায়েদের। সেই মায়েদের লেখাপড়া না করিয়ে মূর্খ করে রেখে পরের ঘরে সংসার করতে পাঠান আর এক মূর্খতা। তাই আসুন আজ থেকে প্রতিজ্ঞা করি, আমরা যেমন এশার নামাযের পর এখানে শিক্ষালাভ করতে আসব, তেমনি আমাদের ছেলে মেয়েদেরকেও সকালে এখানে পাঠাব। আমি আর বেশি কিছু না বলে আমার বক্তব্য শেষ করছি, আল্লাহ হাফেজ।

আযীয সেখ বললেন, আপনারা কেউ কিছু বলতে চাইলে বলতে পারেন।

কিছুক্ষণ নীরবতার পর মাতব্বর বললেন, এরপর আর কারো কিছু বলার নেই। তারপর লোকজন থেকে একটু দূরে বোরখাপরা সায়রাকে বসে থাকতে দেখে তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তুমিতো বলেছিলে তোমার ছেলে ছুটি পেলে কয়েকদিন পরে আসবে, কিন্তু এতদিন হয়ে গেল এল না কেন?

সায়রা কিছু বলার আগে আবু তাহের হালিমকে দাঁড়াতে বললেন। দারোগা দাঁড়াবার পর বললেন, আপনারা ভালো করে দেখুনতো, ইনাকে চিনতে পারেন কি না?

মাতব্বরের সঙ্গে অনেকে বলে উঠল, চিনব না কেন? উনিতো, রাঙ্গিকালি থানার দারোগা।

আবু তাহের বললেন, উনিই হলেন সায়রা বানুর ও মরহুম মঈন সেখের ছেলে আব্দুল হালিম। যাকে আপনারা হালিম নামে জানতেন। উনিই সরকারের কাছে লেখালেখি করে এই গ্রামে হাইস্কুল করার মঞ্জুরী করিয়েছেন এবং বাপের রুহের মাগফেরাতের জন্য ও গ্রামের মূর্খ ছেলেমেয়ে ও লোকজনদের দ্বীনিশিক্ষা দেয়ার জন্য নিজের পৈত্রিক বাস্তুতে এই মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে দিলেন। এখানকার থানার দারোগা হয়ে আসার পর উনি ইচ্ছা করলে নিজের পরিচয় দিতে পারতেন; কিন্তু কেন দেন নি শুনবেন? ওনার সাধনা ছিল, গ্রামের ধনীরা যেন গরিবদের উপর অত্যাচার করতে না পারেন। আর সেজন্য শিক্ষার দরকার। তাই গ্রামে একটা মাদ্রাসা ও হাইস্কুল করার। হাইস্কুলের কাজ প্রায় শেষ হতে চলেছে, আর আল্লাহর রহমতে মাদ্রাসা তো আজ উদ্বোধন হলই। তাই আমি আজ ওনার আসল পরিচয় আপনাদের জানিয়ে দিলাম। অবশ্য আব্দুল হালিমের ইচ্ছা ছিল, হাই স্কুল উদ্বোধন হওয়ার পর সবাইকে তার পরিচয় জানাবে। মাতব্বর সাহেব সায়রা বানুকে আব্দুল হালিমের কথা জিজ্ঞেস করাতে আজ আমিই জানিয়ে দিলাম।

আবু তাহেরের কথা শুনে সবাই অবাক হয়ে দারোগার দিকে তাকিয়ে রইলেন। কেউ কোনো কথা বলতে পারলেন না।

কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আবু তাহের আবার বললেন, আপনারা যে খুব অবাক, হয়েছেন, তা বুঝতে পারছি। অবশ্য হওয়ারই কথা। মনে রাখবেন, আল্লাহ কখন কাকে কি করেন কেউ বলতে পারে না। আপনাদের গ্রামের সাত বছরের এতিম ছেলে আব্দুল হালিমকে আল্লাহ কত বড় করেছেন। আমি তাকে যতটুকু জানি, তার মতো সৎ চরিত্র ও আল্লাহ ভীরু ছেলে বর্তমান জামানায় নেই বললেই চলে।

ওনাকে হাত তুলে থামিয়ে দারোগা হালিম বললেন, মাওলানা সাহেব আমার সম্পর্কে যা কিছু বলেছেন, তা সত্য। আমিই মরহুম মঈন সেখ ও সায়রা বানুর ছেলে। গ্রামের কিছু লোকের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে আমার মা সাত বছরের আমাকে নিয়ে গ্রাম ছেড়ে পটুয়াখালী চলে যান রাতের অন্ধকারে। সেখানে আমাকে নিয়ে মা যখন একটু আশ্রয়ের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন তখন আল্লাহর ঐ মুমীন বান্দা মাওলানা আবু তাহের আশ্রয় দেন এবং আমার মাকে মেয়ে ও আমাকে নাতি করে নেন। ওনার স্ত্রী আমার মাকে ইসলামী ও দুনিয়াবী শিক্ষায় শিক্ষিত করেন। আর মাওলানা সাহেব আমাকে মাদ্রাসায় ও ভার্সিটিতে পড়িয়ে মানুষ করেন। আমি ওনার ও ওনার স্ত্রীর কাছে এত ঋণী যে, আমার গায়ের চামড়া দিয়ে ওনাদের পায়ের জুতা বানিয়ে দিলেও সে ঋণ শোধ হবে না। যারা ষড়যন্ত্র করে আমার মাকে গ্রাম ছাড়তে বাধ্য করেছিলেন, তাদের উপর এখন আমার কোনো রাগ বা বিদ্বেষ নেই। আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (দঃ)-কে সন্তুষ্ট করার জন্য আমি ও আমার মা মাফ করে দিলাম। আল্লাহ যেন তাদেরকে মাফ করেন। আপনারা দোয়া করবেন, আমি যেন আজীবন ঈমানদারীর সাথে কর্মজীবন অতিবাহিত করতে পারি এবং দেশ ও দশের উন্নতির জন্য কিছু করতে পারি। আর বেশি কিছু আমার বলার নেই বলে মুরুব্বীদের সঙ্গে হাত মোসাফাহ করতে লাগলেন।

এমন সময় একজন প্যান্ট শার্ট পরা সুদর্শন অচেনা যুবক দাঁড়িয়ে সালাম দিতে সবাই অবাক হয়ে তার দিকে তাকালেন।

আবু তাহের সালামের উত্তর দিয়ে তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আমার নাতি। বাড়ি ঢাকায়। গতকাল আমার সঙ্গে এসেছে। তারপর আবার বললেন, মিটিং-এর কাজ আজকের মতো শেষ, এবার আপনারা আসুন। মুরুব্বীরা হালিমের সঙ্গে হাত মোসাফাহ করে চলে যেতে লাগল।

দারোগা সায়রার ছেলে হালিম শুনে মাতব্বর চিন্তা করলেন, সে নিশ্চয় মায়ের প্রতি দুর্ব্যবহারের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য এখানকার থানার দারোগা হয়ে এসেছে। তা হলে ঐ কি জিনের ভেশ ধরে আমাদেরকে ভয় দেখিয়েছে? রশিদের অপকীর্তির জন্য তার এই দশা ঐ করেছে। এরপর আরো কি কিছু করে প্রতিশোধ নেবে? এইসব চিন্তা করে এতক্ষণ আতঙ্কে ভুগছিলেন। হালিমের বক্তব্য শুনে ভাবলেন, আর বোধ হয় কিছু করবে না। রশিদকে বললেন আবু তাহেরের কথাই ঠিক, হালিমের মতো ভালো ছেলে হয় না।

সায়রার ছেলে দারোগা হালিম জেনে রশিদও ভয় পেয়েছিল। আব্বার কথা শুনে বলল, হ্যাঁ, আব্বা, হালিম সত্যিই খুব ভালো। ও যে সায়রার ছেলে ভাবতেই পারি নি।

মাতব্বর বললেন, আমিও ভাবতেই পারি নি। ওর সঙ্গে হাত মোসাফাহ করে ঘরে যাই চল।

লোকজন চলে যাওয়ার পর হালিম আশফাকের সঙ্গে হাত মোসাফাহ করে জিজ্ঞেস করল, আপনি আবু তাহের নানার নাতি শুনে খুব অবাক হয়েছি।

আশফাক কিছু বলতে যাচ্ছিল। তাকে থামিয়ে দিয়ে মুসা বললেন, এখানে কোনো কথা নয়, তোমার মাকে নিয়ে আমাদের ঘরে চল, সেখানে যা বলার বলবে।

.

১০.

আশফাক রাফিয়াকে হালিমের বায়োডাটা লিখে দিতে বললে, সে একটা কাগজে লিখে তার হাতে দিল।

আশফাক সেটা পড়ে বলল, আরে, পটুয়াখালী টাউনে তো আমাদের নানা বাড়ি। ওখানে গিয়ে নানাকে জিজ্ঞেস করলেই হালিমের খোঁজ পাওয়া যাবে। আবু তাহেরের নাম হালিমের বায়োডাটায় থাকলেও উনিই যে ছোট নানা, রাফিয়াও আশফাক তা জানত না।

রাফিয়া বলল, আমারও তাই মনে হয়েছে।

আশফাক বলল, কয়েকদিনের মধ্যে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে নানার কাছে খোঁজ নিতে যাব। তারপর মায়ের কাছে এসে বলল, পটুয়াখালী শহরের মাওলানা আবু তাহেরের নাম শুনেছ?

ফাতেমা খাতুন হেসে ফেলে বললেন, শুনব না কেন? উনি তো আমার ছোট চাচা। ছোট চাচা অন্যখানে জায়গা কিনে বাড়ি করেছেন। উনি তোর আপন ছোট নানা।

আশফাক অবাক হয়ে বলল, জান মা, হালিম নামে যে ছেলেটাকে রাফিয়া পছন্দ করে, তাকে উনিই লেখাপড়া করিয়ে মানুষ করেছেন।

ফাতেমা খাতুন খুব অবাক হয়ে বললেন, কি বলছিস তুই?

হ্যাঁ মা, এই দেখ, বলে রাফিয়া লিখে দেয়া কাগজটা হাতে দিয়ে বলল, এটা হালিমের বায়োডাটা।

ফাতেমা খাতুন পড়ে বললেন, হ্যাঁ, তাইতো?

আশফাক বলল, ভাবছি, ওর সম্পর্কে সবকিছু জানার জন্য তোমাকে নিয়ে পটুয়াখালী যাব।

তোর আব্বা বলেছিল, ছেলেটার মা নাকি একজনের বাসায় কাজ করে। তার বদলে সেই লোক হালিমকে লেখাপড়া করিয়ে মানুষ করেছে। তোর ছোট নানার কথা বলে নি।

সত্য মিথ্যা জানার জন্য আমি তোমাকে নিয়ে যেতে চাই, তুমি যাবে কি না বলো।

তোর বাবাকে বলেছিস?

না, তাকে বললে রেগে যাবে। যাওয়ার ব্যাপারে অন্য কিছু বলে বাবাকে রাজি করাবে।

তুই কি ঐ ছেলের সঙ্গে রাফিয়ার বিয়ে দিতে চাস?

হ্যাঁ চাই। তবে তার আগে ওর সম্পর্কে ছোট নানার কাছে সবকিছু জানব। ভালো হলে রাফিয়াকে ওর হাতে তুলে দেব।

আর যদি খারাপ কিছু হয়?

তা হলে দেব না। রাফিয়াকে সেকথা জানিয়ে আমাদের পছন্দ করা ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেব।

ঠিক আছে, আমি তোর বাবার সঙ্গে আলাপ করব। তার আগে তুই একা গিয়ে নানাদের কাছ থেকে খোঁজ নিয়ে আয়।

কয়েকদিন পর আশফাক নানার বাড়ি বেড়াতে এল। তারপর নানাকে বলল, শুনলাম, ছোট নানা তাদের কাজের বুয়ার হালিম নামে একটা ছেলেকে নাকি লেখাপড়া করিয়ে মানুষ করেছেন?

আশফাকের নানা আব্দুল রহমান ভাইয়েদের মধ্যে বড়। তিনি খুব বিচক্ষণ ব্যক্তি। নাতির কথা শুনে বললেন, নানার বাড়ি এসেছ অনেকদিন পর। ওসব খবর জেনে কি লাভ? যে কদিন থাক খাও, দাও, আনন্দ করে বেড়াও।

আশফাক বলল, পরে যখন আসব তখন আনন্দ করে বেড়াব। এখন এসেছি হালিমের খোঁজ খবর নিতে। তাই যা জিজ্ঞেস করলাম বলুন।

আগে বল, হঠাৎ হালিমের খোঁজ খবর নিতে কেন এসেছ?

ভার্সিটিতে পড়ার সময় হালিমের সঙ্গে রাফিয়ার পরিচয় হয়। তারপর দুজন দু’জনকে পছন্দ করে সিদ্ধান্ত নেয়, বিয়ে করার। তারপর রাফিয়ার ও মা-বাবা ও ভাইয়াদের মতামতের কথা জানাল।

সবাই যখন অমত তখন তুমি কেন ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছো?

হালিমকে আমি চিনি এবং খুব ভালো ছেলে বলেও জানি। তা ছাড়া রাফিয়া হালিমের সংস্পর্শে এসে ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। আমার মনে হয়, ওদের বিয়ে হলে ওরা সুখী হবে। আজ চার বছর হল তার খোঁজ নেই। তাই সবকিছু জানতে এসেছি।

তোমরা ওর সম্পর্কে যা শুনেছ, আমরাও তাই শুনেছি। সবকিছু জানতে হলে তোমার ছোট নানা আবু তাহেরের কাছে যেতে হবে।

আপনিও যাবেন আমার সাথে।

নাতনি যখন পণ করেছে হালিমকে ছাড়া বিয়ে করবে না তখন তো যেতেই হবে। তারপর বললেন, তা হলে এখনই যাই চল।

আবু তাহের ঘরেই ছিলেন। বড় ভাইয়ের সঙ্গে সালাম ও কুশল বিনিময় করে আশফাকের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি কে? তোমাকে যেন চেনাচেনা লাগছে?

আব্দুর রহমান হেসে উঠে বললেন, চেনাচেনা তো লাগবেই। ওতো ফাতেমার ছোট ছেলে আশফাক। তোর কাছে এসেছে হালিমের সব কিছু জানতে। তারপর ঘটনা খুলে বললেন।

আবু তাহের অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে হালিম ও সায়বার পুরো হিস্ট্রি বলে বললেন, সায়রা আমাদের কাজের বুয়া নয়। তাকে আমরা মেয়ে ও হালিমকে নাতি হিসাবে গ্রহণ করেছি। আর হালিম যে ছেলে হিসাবে একটা রত্ন, তা এখানকার সবাই জানে। রাফিয়া হালিমকে পছন্দ করেছে জেনে খুব খুশী হয়েছি। দোয়া করি, “আল্লাহ যেন ওদের জোড়া কবুল করেন।”

আব্দুর রহমান বললেন, হালিম যে একটা রত্ন তা আমরাও জানি। এই বিয়ে হলে আমরাও খুশী হব। ফাতেমা ও হাফিজ উদ্দিনকে আমি আসতে বলব। না এলে ঢাকায় গিয়ে তাদেরকে রাজি করাব।

আবু তাহের বড় ভাই ও নাতিকে আপ্যায়ন করিয়ে আশফাককে বললেন, আমাদের বাড়িতে ও দু’দিন বেড়াবে।

আশফাক বলল, ছোটনানা, এবারের মতো মাফ করবেন। সামনের বার যখন আসব তখন দু’দিন নয় এক সপ্তাহ বেড়াব। চাকরি করি। মাত্র তিন দিনের ছুটি নিয়ে এসেছি।

তা হলে তো কিছু বলার নেই। ভিতরে গিয়ে নানির সঙ্গে দেখা করে এস।

আশফাক ছোট নানির সঙ্গে দেখা করে এলে আব্দুর রহমান তাকে নিয়ে ঘরে ফিরে এলেন।

তারা চলে যাওয়ার পর আবু তাহের স্ত্রীকে হালিম ও রাফিয়ার সবকিছু ঘটনা বলে সায়রাকে ডেকে বললেন, তোর ছেলে ঢাকায় পড়তে গিয়ে একটা মেয়ের সঙ্গে প্রেম করে পালিয়ে এসেছে। মেয়েটি হালিমকে ছাড়া বিয়ে করতে চাচ্ছে না বলে গার্জেনরা তার বিয়ে দিতে পারছে না। হালিমের বাবা দিনমজুর, তার মা কাজের বুয়া জেনে গার্জেনরা হালিমকে পছন্দ করে না। মেয়ের ছোট ভাইয়া বোনকে খুব ভালবাসে। সে হালিমকে পছন্দ করে। মেয়েটির সঙ্গে প্রায় চার বছর হালিম যোগাযোগ রাখে নি। তাই ভাইটা ঠিকানা জোগাড় করে খোঁজ করতে এসেছে। মেয়ে অন্য কেউ নয়, আমার বড় ভাইয়ের মেয়ে ফাতেমার একমাত্র মেয়ে। হালিমের মতো ছেলে এরকম কাজ করবে ভাবতেই পারছি না। ওকে আমি কঠিন শাস্তি দেব।

সায়রা গতকাল দু’দিনের জন্য বাহেরচর থেকে এসেছে। আব্বার কথা শুনে বুঝতে পারল, হালিম যাই করুক না কেন, খুশী হয়েছেন। আর শাস্তির কথাটা খুশীর আমেজ। হাসি চেপে রেখে বলল, আপনি ওর গার্জেন, যত কঠিন শাস্তি দেন না কেন আমি কিছু মনে করব না।

আবু তাহেরের স্ত্রী ফারহানা বেগমও স্বামীর মনোভাব বুঝতে পেরেছেন। সায়রা থেমে যেতে তবু বললেন, আমি মনে করি, হালিম খুব ভালো কাজ করেছে। শহরের বড়লোকের আপটুডেপ মেয়ের সঙ্গে প্রেম করলে না হয় অন্যায় হত। সে প্রেম করেছে আমাদের নাতনির সঙ্গে। তা ছাড়া প্রেম করলেও আমাদের জানিয়ে বিয়েতে করেনি। নাতনি নাতবৌ হয়ে আসবে, এটাতো মস্তবড় সুখবর? শাস্তি দেয়ার কথা আসবে কেন?

আবু তাহের বললেন, তোমার কথা ঠিক হলেও সম্পূর্ণ ঠিক নয়। ইসলামে ছেলেমেয়ের মধ্যে প্রেম করা নিষিদ্ধ জেনেও হালিম করল কেন? তা ছাড়া প্রেম করার পর তাকে বিয়ে করার ওয়াদা করে ও আজ চার বছর তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখে নি কেন? এই দুটো কাজই অন্যায়। তাই তাকে শাস্তি পেতেই হবে।

ফারযানা বেগম কিছু বলার আগে সায়রা বলল, হ্যাঁ আব্বা আপনি ঠিক কথা বলেছেন। হালিমকে শাস্তি পেতে হবে।

আবু তাহের বললেন, হ্যাঁ, তাকে শাস্তি দিতেই হবে।

.

ঐ দিন রাতে আশফাক লঞ্চে ঢাকা ফেরার সময় আব্দুর রহমান বললেন, বেশি দিনের ছুটি নিয়ে আব্বা আম্মাকে নিয়ে আসবে। তাদেরকে যা বলার আমি বলব।

আশফাক বলল, বাবা আসবেন বলে মনে হয় না। মা হয়তো আসতে পারেন।

আশফাক ঢাকায় ফেরার পর মাকে হালিমের ব্যাপারে নানারা যা বলেছেন জানাল।

ফাতেমা খাতুন বললেন, তোর বাবা ও ভাইয়াদের বলে দেখ, তারা কি বলে।

রাফিয়া এক ফাঁকে আশফাককে জিজ্ঞেস করল, হালিমের খোঁজ পেয়েছ?

আশফাক বলল, হ্যাঁ, পেয়েছি। সে এখন রাঙ্গিকালি থানার দারোগা।

ভালো না মন্দ কিছু বললে না যে?

হালিমের সম্পর্কে নানাদের কাছে যা কিছু জেনেছে বলে বলল, তোর কথাই ঠিক, ওর মতো উন্নত চরিত্রের ছেলে হয় না। সারা পটুয়াখালী জেলাতে ওর সুনাম। বড় নানা ও ছোট নানা কি বলেছেন জানিস?

তুমি না বললে জানব কি করে?

বলেছেন, “হালিমের সঙ্গে বিয়ে হলে রাফিয়া সুখী হবে।”

রাফিয়া লজ্জা পেয়েও জিজ্ঞেস করল, ওর সঙ্গে তোমার দেখা হয় নি?

না, জেলা শহর থেকে রাঙ্গিকালি থানা অনেক দূর। তাই যাওয়া হয় নি।

এবার কি করবে ভেবেছ?

সবকিছু জানার পর মা রাজি হয়েছে বুঝতে পারলাম। বাবাও ভাইয়াদেরকে নানাদের মতামত জানিয়ে রাজি করাবার চেষ্টা করব।

যদি রাজি না হয়?

তুই চিন্তা করিস না, তারা রাজি না হলেও আমি আগে যে কথা বলেছি, তা যেমন করে হোক করবই।

রাফিয়া ছলছল চোখের বলল, তুমি আমাকে এত ভালবাস ছোট ভাইয়া? তোমার ঋণ আমি কোনো দিন শোধ করতে পারব না।

এই পাগলি, কাঁদছিস কেন বলে আশফাক তার চোখ মুছে দিয়ে বলল, আমি তোর চোখের পানি সহ্য করতে পারি না। আর কোনো দিন কাঁদবি না। তারপর আবার বলল, আমরা ভাই-বোন, ঋণের কথা বলছিস কেন? আবার কখনো বললে কি শাস্তি দিই দেখবি।

.

আশফাক মাকে আসল কথা বলে গেলেও বাবা ও ভাইয়া ভাবিদের বলেছিল, অফিসের কাজে পটুয়াখালী যাচ্ছে। তাই রাতে খাওয়ার টেবিলে সবাইয়ের উদ্দেশ্যে বলল, সময় করে একদিন নানাদের ঘরে গিয়েছিলাম, ওনারা ভালো আছেন। বাবা ও মাকে যেতে বলেছেন। ছোট নানার সঙ্গেও দেখা হয়েছিল। কথা প্রসঙ্গে হালিমের কথা বললেন। সে এখন ওখানকার রাঙ্গীকালি থানার দারোগা। সারা পটুয়াখালী জেলাতে তার মতো ভালো ছেলে নাকি নেই।

হালিমের কথা শুনে হাফিজ উদ্দিন রেগে গেলেন। রাগের সঙ্গে বললেন, সে থানার দারোগা হোক আর হাইকোর্টের জজ হোক, তাতে আমাদের কি? সেতো কামলার ছেলে, তার মা তোর ছোট নানার বাড়িতে বুয়ার কাজ করে। তার দয়াতেই সে লেখাপড়া করেছে।

আশফাক বাবার রাগকে ভয় করে। তবু সাহস করে বলল, কামলারা কি মানুষ না? তারা যদি কৃষি কাজ না করত, তা হলে ফসল জন্মাত কেমন করে? তারাইতো কঠোর পরিশ্রম করে শহরের মানুষের পেটের অন্ন জোগাচ্ছে। তা ছাড়া হালিমের বাবা অনেক আগে মারা গেছেন। বর্তমানে ছোট নানাই তার গার্জেন। আর তার মা কাজের বুয়াও নন। ছোট নানা-নানি তাকে মেয়ে ও হালিমকে নাতি করে নিয়েছেন। এখন ছোট নানার পরিচয়ই তাদের পরিচয়।

হাফিজ উদ্দিন আরো রেগে গিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। তার আগে বড় ছেলে আশরাফ উদ্দিন বলল, তুই হালিমের হয়ে এত ওকালতি করছিস কেন? তা হলে কি তার সঙ্গে রাফিয়ার বিয়ে দিতে চাস?

আশফাক বলল, হ্যাঁ, চাই। আমি তাকে যতটুকু জেনেছি, তাতে মনে হয়েছে, সে একটা রত্ন। তার সঙ্গে বিয়ে হলে রাফিয়া সুখী হবে। নানারাও তাই বলেছেন।

হাফিজ উদ্দিন গর্জে উঠলেন, খুব লায়েক হয়ে গেছিস দেখছি। খবরদার, ঐ কথা আর মুখে আনবি না।

আশফাক জানে বাবা বেশি রেগে গেলে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। তাই আর কিছু না বলে চুপচাপ খেয়ে উঠে চলে গেল।

পরেরদিন মাকে একাকি পেয়ে বলল, বাবাও ভাইয়াদের মতামত তো শুনলে, এখন কি করবে?

ফাতেমা খাতুন বললেন, আমি কি বলব, তুই যা ভালো বুঝিস কর।

আমি তোমাকে ও রাফিয়াকে নিয়ে নানাদের বাড়িতে গিয়ে ওদের বিয়ে দিতে চাই। তুমি যাবে কিনা বল।

তোর বাবা না গেলে আমি যাব কি করে? তোর সঙ্গে আমাকে ও রাফিয়াকে পাঠাবে বলেও মনে হয় না। তার চেয়ে এক কাজ কর, তুই কাউকে কিছু না বলে রাফিয়াকে নিয়ে যা। তোর নানা-নানিদেরকে আমার ও তোর বাবা ও ভাইয়াদের মতামত জানিয়ে ওদের বিয়ে দিয়ে দিতে বলবি। তারা বিয়ে দিয়েছে শুনলে তোর বাবা রেগে গেলেও তেমন কিছু করবে না। অবশ্য তোকে সবাই খুব বকাবকি করবে।

বাবা ও ভাইয়াদের বকাবকি আমি হজম করতে পারব। ও নিয়ে তুমি চিন্তা করো না।

কিছু দিনের মধ্যে আশফাক অফিস থেকে ছুটি নিয়ে সুযোগমতো রাফিয়াকে নিয়ে পটুয়াখালীতে নানা বাড়িতে এসে উঠল।

পরের দিন খবর পেয়ে আবু তাহের তাদেরকে নিজের বাড়িতে নিয়ে এসে স্ত্রীর সঙ্গে রাফিয়ার পরিচয় করিয়ে দিলেন। তারপর আশফাককে বৈঠকখানায় নিয়ে এসে ঢাকার খবর নিতে লাগলেন।

ফারযানা বেগম রাফিয়াকে ছোটবেলায় দু’একবার দেখেছিলেন। এখন তার রূপ যৌবন দেখে খুব অবাক হলেন। সালাম ও কুশল বিনিময় করে রাফিয়া কদমবুসি করতে এলে জড়িয়ে ধরে প্রথমে মাথায় ও পরে দু’গালে চুমো খেয়ে পাশে বসিয়ে বললেন, তোমার রূপ আমার নাতিকে পাগল করেছে। তা না হলে যে নাতি কোনো মেয়ের মুখের দিকে কখনো তাকিয়ে দেখে না, সে কিনা তোমার প্রেমে পড়ে গেল।

ছোট নানির কথা শুনে রাফিয়া লজ্জা পেয়ে মুখ নিচু করে নিল কোনো কথা বলতে পারল না।

ফারযানা বেগম তার চিবুক ধরে মুখটা তুলে বললেন, এখন নানির কাছে লজ্জা পাচ্ছ, আমার নাতির সঙ্গে প্রেম করার সময় লজ্জা করে নি?

রাফিয়া নানির হাত সরিয়ে দিয়ে লজ্জামিশ্রিত কণ্ঠে বলল, আপনি লজ্জা দিচ্ছেন, তাই লজ্জা পাচ্ছি। আপনার নাতি কোনো দিন লজ্জা দেয় নি। তাই তখন লজ্জা পাই নি। এবার অন্য কথা বলুন।

ফারযানা বেগম বললেন, সায়রা তোমাকে দেখলে খুব খুশী হবে।

রাফিয়া জিজ্ঞেস করল, সায়রা কে?

হালিমের মা।

উনি এখানে থাকেন না?

হ্যাঁ থাকে। বেশ কিছু দিন হল বাহেরচরে গিয়ে আছে স্বামীর ভিটেয় মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করার জন্য। হালিম ঐ এলাকার রাঙ্গিকালি থানার দারোগা। তোমরা এসেছ, তোমার ছোট নানা দু’একদিনের মধ্যে গিয়ে ওদের নিয়ে আসবে।

দুপুরের দিকে বাহেরচর থেকে আবু তাহেরের ভাইরা মুসা এসে জানালেন, কাল মাদ্রাসা উদ্বোধন করার জন্য আপনাকে নিয়ে যেতে সায়রা ও হালিম পাঠিয়েছে।

আবু তাহের ভাইরার সঙ্গে আশফাকের পরিচয় করিয়ে দিলেন। খাওয়া দাওয়ার পর আশফাক মুসাকে বলল, ছোট নানার সঙ্গে আমিও যাব আপনাদের গ্রাম দেখতে।

মুসা বললেন, গেলে খুশীই হব।

বাহেরচরে পৌঁছাতে এশার নামাযের সময় হয়ে গেল। নামায পড়ে এসে আবু তাহের ভাইরাকে, রাফিয়া ও আশফাকের আসার কারণ জানিয়ে বললেন, সায়রাকে এখন এসব কথা বলার দরকার নেই।

পরের দিন আবু তাহের বেলা দশটার সময় মাদ্রাসা উদ্বোধন করতে আসার সময় আশফাককে সঙ্গে এনে লোকজনদের সঙ্গে বসতে বলেছিলেন।

মিটিং শেষে লোকজন চলে যাওয়ার পর হালিম যখন আশফাকের সঙ্গে হাত মোসাফাহ করে আলাপ করছিল তখন মুসা তাদেরকে আলাপ করতে নিষেধ করে ঘরে আলাপ করার কথা বলে সবাইকে নিয়ে ঘরে এলেন।

সবাই বসার পর আবু তাহের হালিমকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তুমি তা হলে আশফাককে চেনো?

জি, চিনি। তবে আপনার নাতি, সেকথা জানতাম না।

তা জানবে কি করে? ও হল আমার বড় ভাইয়ের মেয়ের ঘরের নাতি।

এখানে হালিমকে কোনো কিছু বলতে আবু তাহের নিষেধ করে দিয়েছিলেন। তাই আশফাক চুপ করে রইল।

আবু তাহের আবার বললেন, আজ দুপুরের খাওয়ার পর সায়রা ও তোকে বাড়ি নিয়ে যাব। এখানে দেরি না করে থানায় গিয়ে তৈরি হয়ে আয়। তারপর সায়রাকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতে দেখে বললেন, এখানে কিছু জানতে চাইবি না। ঘরে গেলেই জানতে পারবি।

বাহেরচর থেকে পটুয়াখালী ফিরতে সন্ধে হয়ে গেল। পুরুষরা মসজিদে নামায পড়তে গেল। সায়রা ঘরে ঢুকে মায়ের সঙ্গে সালাম ও কুশল বিনিময় করল। তারপর রাফিয়াকে দেখে জিজ্ঞেস করল, কে আম্মা?

ফারযানা বেগম বললেন, আমার বড় ভাসুরের মেয়ের ঘরের নাতিন। তোর আব্বার সঙ্গে যে ছেলেটা বাহেরচর গিয়েছিল, সে ওর ভাই। ওরা দু’তিন দিন হল ঢাকা থেকে এসেছে। তারপর রাফিয়াকে বললেন, এ হালিমের মা।

রাফিয়া সালাম বিনিময় করে কদমবুসি করতে এলে সায়রা জড়িয়ে ধরে মাথায় চুমো খেয়ে দোয়া করে বললেন, থাক মা থাক, কদমবুসি করা ঠিক না। মুখে সালাম দেয়াই উত্তম।

রাফিয়া বলল, আগে নামায পড়ে নিই চলুন খালা আম্মা, তারপর আলাপ করব।

নামাযের পর ফারযানা বেগম সায়রাকে বললেন, এই রাফিয়ার সঙ্গে তোর ছেলে প্রেম করেছে। তারপর ওদের আসার কারণ বলে বললেন, কালকেই তোর আব্বা ওদের বিয়ের ব্যবস্থা করবে।

গতবারে এসে ফারনা বেগমের কাছে রাফিয়ার পরিচয় শুনেছিল। আজ তাকে দেখে খুব পছন্দ হল। তাই আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বলল, হালিম রাফিয়ার সম্পর্কে আপনাদেরকে আগে কিছু বলেছিল?

ফারযানা বেগম বললেন, না বলে নি। মনে হয়, রাফিয়া যে আমাদের নাতনি। হালিম জানে না আর সে যে এসেছে, তাও জানে না। এখন এসব কথা থাক, তোর আব্বা ওদেরকে নিয়ে এক্ষুনি মসজিদ থেকে এসে পড়বে। রাফিয়াকে নামায পড়ে হালিমের ঘরে থাকতে বলেছি। হালিম মসজিদ থেকে এসে ঘরে ঢুকে রাফিয়াকে দেখে কি করে দেখা যাক।

এমন সময় আবু তাহের মসজিদ থেকে নাতিদের নিয়ে ফিরে এসে ড্রইংরুমে বসে হালিমকে বললেন, তোর নানিকে চা-নাস্তা দিতে বল।

হালিম ভিতরে গিয়ে নানিকে ড্রইংরুমে চা-নাস্তা পাঠাবার কথা বলে জামা কাপড় পাল্টাবার জন্য নিজের রুমে গেল।

রাফিয়া ছোট নানির কথামতো হালিমের ঘরে মাগরিবের নামায পড়ে একটা চেয়ারে বসেছিল। হালিম ঢুকতেই দাঁড়িয়ে সালাম দিল।

হালিম ভূত দেখার মতো চমকে উঠে অস্ফুটস্বরে সালামের উত্তর দিয়ে একদৃষ্টে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। সে যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না।

রাফিয়াও একইভাবে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

কতক্ষণ দু’জনে ঐভাবে ছিল জানতে পারল না। এক সময় রাফিয়ার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগল।

তাই দেখে হালিম সম্বিত ফিরে পেয়ে বলল, আমি স্বপ্ন দেখছি না তো?

রাফিয়া চোখ মুছে কান্নাজড়িত স্বরে বলল, স্বপ্ন নয়, বাস্তব। এই বাস্তব দিনটির জন্য আমাকে চার বছর কঠিন পরীক্ষা দিতে হয়েছে। বাবা ও ভাইয়াদের অনেক লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয়েছে। শেষে আল্লাহ আজ আমার স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করালেন। সেজন্য তার পাক দরবারে জানাচ্ছি শতকোটি শুকরিয়া। তারপর কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে কান্না সামলে নিয়ে আবার বলল, এই চার বছর আমাকে কষ্ট দিয়ে তুমি নিশ্চয় খুব সুখেই ছিলে?

রাফিয়াকে দেখেই হালিমের অন্তর আনন্দে ছলকে উঠেছিল। তারপর চোখে পানি দেখে ও কথা শুনে চোখে পানি এসে গেছে। সে থেমে যেতে ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে হাতজোড় করে বলল, এই চার বছর খুব সুখে ছিলাম, না দুঃখে ছিলাম, তা আল্লাহ ভালো জানেন। একটা কথা বলি, তোমার বিরহ আমাকেও কম দুঃখ দেয় নি। আমার সাধনা সফল করার জন্য সেই দুঃখ সহ্য করেছি। আল্লাহ যেদিন আমার সাধনা সফল করালেন। সেই দিনই তিনি তোমাকে দেখালেন। সেজন্য আমিও তাঁর পাক দরবারে শতকোটি শুকরিয়া জানাচ্ছি। এতদিন যোগাযোগ রাখি নি, তোমার আমার প্রেমের পরীক্ষা করার জন্য। যদিও পূর্ণ বিশ্বাস ছিল, আমাদের প্রেম খাঁটি এবং আল্লাহ আমাদের মিলন করাবেন। তিনি আমার সেই বিশ্বাসেরও সফলতা দেখালেন। সেজন্য আর একবার তাঁর পাক দরবারে শতকোটি শুকরিয়া জানাচ্ছি। এতকিছু পাওয়ার পরও মনে হচ্ছে, দীর্ঘ চার বছর তোমাকে কাঁদিয়ে খুব অন্যায় করেছি। সেজন্য অনুতপ্ত হৃদয়ে ক্ষমা চাইছি।

রাফিয়া আর স্থির থাকতে পারল না। চোখের পানি ফেলতে ফেলতে তার জোড় করা হাত দু’হাতে ধরে বলল, তোমাকে ভুল বুঝে ও তোমার কাছে কৈফিয়ৎ চেয়ে আমিও অন্যায় করেছি। তুমিও আমাকে ক্ষমা করে দাও।

Exit mobile version