ইমাম সাহেব বললেন, আমরা বিশ্বাস করি আর না করি তুমি বল।
সায়রা বলল, তা হলে শুনন, ঐ লম্পট মাতব্বর প্রথমে আমাকে বিয়ে করার জন্য রহিমন দাদিকে আমার কাছে পাঠিয়েছিল। আমি রাজি হয় নি বলে এক গভীর রাতে আমার ঘরে ঢুকে ইজ্জতের উপর হামলা করেছিল। আমি তখন কি করেছিলাম আপনারা জানেন। হাসপাতাল থেকে ফিরে আমাকে শায়েস্তা করার জন্য ফজলুকে দিয়ে গ্রামে মিথ্যে বদনাম ছড়িয়ে আজ বিচারের ব্যবস্থা করেছেন। ফজলুর সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক গড়ে উঠে নি। তবে আমার অসুখের সময়। ফজলু ও তার মা আমাকে সেবা করে ভালো করেছে। এরপর থেকে ফজলু আমার ঘরে যাতায়াত করত। কয়েকদিন আগে আমাকে বিয়ে করার কথা বলায় তাকে আমার ঘরে আসতে নিষেধ করে দিই। তারপর থেকে সে আর আসে নি। ফজলু এখন যে কথা বলল, তা মাতব্বরের শেখান বুলি। আপনারা বিশ্বাস করেন আর নাই করেন, যা সত্য তাই বললাম।
কেউ কিছু বলার আগে মাতব্বরের একজন চামচা সামসু বলল, আমি ও শাকিল যে একরাতে তোর ঘরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ঘরের ভিতর পুরুষ মানুষের গলা পেয়ে বেড়া ফাঁক করে তোদর দু’জনকে কুকর্ম করতে দেখলাম, সেটাও কি মিথ্যে?
সায়লা বলল, হ্যাঁ মিথ্যে। এই কথাটাও মাতব্বর সাহেব তোমাকে বলতে শিখিয়েছে। আমি আল্লাহর কসম কেটে বলছি। কুকর্ম করা তো দূরের কথা, ফজলু আমার গায়ে কোনো দিন হাতও দেয় নি।
ইমাম সাহেব শাকিলকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমিও এই ঘটনা দেখেছ?
শাকিল বলল, হ্যাঁ দেখেছি।
ইমাম সাহেব এবার ফজলুকে জিজ্ঞেস করলেন। সামসু ও শাকিল যে কথা বলল, তা কি সত্য?
ফজলু বলল, জি হুজুর সত্য।
এবার মাতব্বর লোকজনদের উদ্দেশ্য করে বললেন। তোমরাতো নিজেরা সবকিছু শুনলে। এখন তোমাদের উপরেই বিচারের রায় ছেড়ে দিলাম।
সবার আগে করিম সেখের বড় ছেলে আসগর বলল, ওদের দুজনকে পাথর মেরে মেরে ফেলা হোক।
তার কথা শুনে মাতব্বরের লোকজন বলে উঠল, হ্যাঁ, তাই করা হোক।
গ্রামের বেশিরভাগ লোক বুঝতে পারল, সায়রা লম্পট মাতব্বরের লিঙ্গ কেটে দিয়েছে বলে মাতব্বরই মিথ্যে বদনাম দিয়ে তাকে শাস্তি দেয়ার জন্য এই বিচারের। ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু তারা গরিব বলে কেউ প্রতিবাদ করতে সাহস পেল না।
গতকাল আবু তাহের নামে এক লোক ভাইরা মুসার বাড়িতে বেড়াতে এসেছেন। তিনি একজন আলেম। শহরের এক মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন। ভাইরা মুসার সঙ্গে তিনিও বিচার শুনতে এসেছেন।
বিচারের রায় শুনে কেউ যখন কোনো প্রতিবাদ করল না তখন তিনি দাঁড়িয়ে বললেন, রায় ইসলামী আইন অনুসারে হয়েছে, কিন্তু এই আইন সাধারণ মানুষকে প্রয়োগ করার ক্ষমতা ইসলাম দেয় নি। কেবল মাত্র ইসলামী রাষ্ট্রের যিনি প্রধান, তিনিই এই আইন প্রয়োগ করতে পারেন। তা ছাড়া মাতব্বরের ব্যাপারে বিবাদিনী যা কিছু বললেন, সে ব্যাপারে সত্য মিথ্যা যাচাই করে সেটার বিচার আগে করা উচিত।
আবু তাহেরের কথা শুনে মাতব্বর খুব রেগে উঠে বললেন, কে তুমি? তোমাকে এই গ্রামের লোক বলেতো মনে হচ্ছে না।
আবু হাতের বললেন, আমি আপনাদের গ্রামের মুসার ভাইরা। পটুয়াখালী শহরে বাড়ি। গতকাল বেড়াতে এসেছি।
তা এখানে এসেছেন কেন? যান, ভাইরার ঘরে যান। তারপর মুসাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, মেহমানকে নিয়ে চলে যাও।
মুসার অবস্থা স্বচ্ছল। তবে খুব সহজ সরল লোক। গ্রামের সাতে পাঁচে নেই। সায়রার ব্যাপারটা জানে বলে তার বিচারের রায় শোনার জন্য এসেছে। মাতব্বরের স্বভাব চরিত্র জানে। তাই তার কথা শুনে প্রতিবাদ না করে ভাইরার একটা হাত ধরে বলল, আমরা ঘরে যাই চলুন।
আবু তাহের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, বিচারের শেষ দেখে তবে যাব।
মাতব্বর বললেন, তা হলে চুপচাপ বসে থাকুন, একটা কথা বলবেন না। তারপর ইমাম সাহেবকে বললেন, রায়টা আপনি ঘোষণা করুন।
ইমাম সাহেবের বাড়িও পটুয়াখালী শহরে। তিনি আবু তাহেরকে চেনেন। তাই মাতব্বর অনেক টাকা দিয়ে যে রায় দিতে বলেছিলেন। তা বলতে পারলেন না। কিছুক্ষণ চিন্তা করে আবু তাহেরকে দেখিয়ে বললেন, উনি মস্ত বড় আলেম। উনি ঠিক কথা বলেছেন। তবে এক কাজ করতে পাবেন। ওদের দুজনের বিয়ে দিয়ে দেন। তারপর মাতব্বরের কানের কাছে ফিসফিস করে বললেন, আপনার ঘটনাটি গ্রামের সবাই জেনে গেছে। আপনার উপর সবাই খুব অসন্তুষ্ট। এখন বিচারের রায় নিয়ে বেশি কচলাকচলি করা ঠিক হবে না। নচেৎ লোকজন আপনারও বিচার করতে চাইবে।
ইমাম সাহেবের কথা শুনে মাতব্বর আর দেরি করল না। বললেন, আমিও এই রায় ঘোষণা করছি।
পাথর মেরে মেরে ফেলার কথা শুনে ফজলুর কলজে শুকিয়ে গিয়েছিল। ইমাম সাহেব ও মাতব্বরের রায় শুনে কলজেয় পানি এল। সেই সঙ্গে খুশীতে মন নাচতে লাগল।
ফজলুর মা জয়তুন বিবিরও ছেলের মতো অবস্থা।
আর সায়রা রাগে ও দুঃখে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে সবার অলক্ষ্যে ছেলের হাত ধরে চলে আসার সময় শুনতে পেল, মাতব্বর বলছে, কালই আমি ওদের বিয়ের ব্যবস্থা করব।
বিচার বসেছিল এশার নামাযের পর। মাতব্বর হ্যাজাক লাইটের ব্যবস্থা করেছিলেন। সেটা লোকজনের সামনে ছিল। সায়রা ছেলেকে নিয়ে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, সেখানটা অন্ধকার মতো ছিল। তাই সে যখন ছেলেকে নিয়ে চলে আসে তখন কেউ জানতে পারল না।