ফজলু বলল, ওটা তোমার কাছে রাখ। দরকার পড়লে চেয়ে নেব।
সায়রা বলল, তুমি ও চাচি আমাকে না দেখলে মরেই যেতাম। তোমরা আমার যে উপকার করেছ, সে কথা জীবনে ভুলতে পারব না। তুমি কত কষ্ট করে টাকা জমিয়েছিলে। সেই টাকা দিয়ে আমার চিকিৎসা করিয়েছ। এই টাকা তোমাকে নিতেই হবে।
বললাম তো, টাকাটা এখন তোমার কাছেই থাক। দরকার হলে চেয়ে নেব? আমার কাছে থাকলে খরচ হয়ে যাবে বলে ফজলু তার কাছ থেকে চলে গেল।
এরপর ফজলু প্রতিদিন ভিক্ষে করে ফেরার সময় সায়রার সঙ্গে দেখা করে। যেদিন ফিরতে সন্ধ্যে হয়ে যায়, সেই দিন রাতে দেখা করতে যায়।
দিলদার মাতব্বর কিভাবে সায়রার ঘরে যাতায়াত করবে ও তার সঙ্গে কিভাবে কথা বলবে ফজলুকে শিখিয়ে দিয়েছিলেন। সেই সব করার আগেই সায়রার অসুখ হতে ফজলুর সাপেবর হল। মাতব্বর যা কিছু করতে বলেছিল, সে সব করতে হল না।
মাতব্বর তার চামচাদেরকে ফজলু ও সায়রার দিকে লক্ষ্য রাখতে বলেছিলেন। তাদের কাছ থেকে সবকিছু শুনে বললেন, তোমরা গ্রামে রটিয়ে দাও, ফজলু সায়রার ঘরে রাতে থাকে।
কয়েকদিনের মধ্যে চামচরা গ্রামময় কথাটা রটিয়ে দিল।
কথাটা করিম সেখের কানে পড়ার আগেই হঠাৎ একদিন তিনি মারা গেলেন। তার বড় ছেলে আসগরের বৌ চিররুগী। সায়রা তাদের ঘরে কাজে লাগার পর থেকে তার উপর আসগরের চোখ পড়েছিল। এমন কি তাকে নিকে করার কথাও ভেবেছিল। কিন্তু বাপের ভয়ে তা সম্ভব হয় নি। বাপ মারা যাওয়ার পর সেই ইচ্ছাটা প্রবল হল। সায়রা ও ফজলুকে নিয়ে যে কথা গ্রামে কানাঘুষো চলছে, তা শুনে দু’জনের উপরেই খুব রেগে গেল।
একদিন রাস্তায় ফজলুর সঙ্গে দেখা হতে আসগর জিজ্ঞেস করল, গ্রামের লোকজন যে কথা বলছে, তা কি সত্য?
মাতব্বর ফজলুকে শিখিয়ে দিয়েছিলেন, কেউ যদি তোকে সায়রার ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করে, তাহলে বলবি সায়রাকে বিয়ে করবি। তাই যখন তখন ওদের ঘরে যাস।
আসগর জিজ্ঞেস করতে মাতব্বরের শেখান কথা ফজলু বলল। আসগর খুব রেখে গেলেও সংযত কণ্ঠে আবার জিজ্ঞেস করল, সায়রা তোকে নিকে করতে চায়?
হ্যাঁ, চায়। তা না হলে আমাকে রাতে থাকতে দেয় কেন? ঠিক আছে, তুই যা বলে ঘরে এসে এক ফাঁকে সায়রাকে বলল, তুই নাকি খোঁড়া ফকির ফজলুকে নিকে করতে চাস?
গ্রামময় লোকজন বলাবলি করলেও এ পর্যন্ত সায়রার কানে পড়ে নি। আসগরের মুখে শুনে সায়রার পিত্তি জ্বলে উঠল। বলল, কে একথা বলেছে?
কে আবার বলবে? সারা গ্রামের লোক বলাবলি করছে।
তুমি কার কাছে শুনেছ?
ল্যাংড়া ফকির ফজলুর কাছে। সে নিজেই গ্রামের সবাইকে বলে বেড়াচ্ছে?
এতদিনে সায়রা বুঝতে পারল, ফজলু ভাই কেন তার ভিক্ষে করা জমান টাকা দিয়ে তার চিকিৎসা করিয়েছে? চিকিত্সা করার টাকা ফেরত দিতে কেন সে নেয় নি? কেন সে প্রতিদিন তার কাছে আসে?
তাকে চুপ করে থাকতে দেখে আসগর বলল, তুই পরীর মতো দেখতে। আর ফজলু দেখতে চামচিৎকার মতো। তা ছাড়া সে ল্যাংড়া, শরীরের হাড় পাঁজরা দেখা যায়, তাকে নিকে করলে লোকজন তোকে ছি ছি করবে। তার চেয়ে আমার সঙ্গে নিকে বস। আমার কাছে খেয়ে পরে সুখে থাকবি। তোর ছেলেটাও খেয়ে পরে মানুষ হবে। আর শোন, লোকজনের কাছে কথাটা বেশি জানাজানি হওয়ার আগে তোকে নিকে করতে চাই।
সায়রা তখন চিন্তা করছিল, মাতব্বর ফজলুকে দিয়ে ফাঁদ পেতে তাকে জব্দ করতে চায়। আজ ফজলু এলে তাকে কি করবে না করবে ভাবছিল।
সায়রা কিছু না বলে মুখ নিচু করে রয়েছে দেখে আসগর ভাবল; সে তাকে নিকে করতে রাজি। চারদিকে তাকিয়ে কেউ নেই দেখে জড়িয়ে ধরে বলল, তুই কিছু চিন্তা করিস না। একবার শুধু হা বল, দেখবি আমি তোকে এক দু’দিনের মধ্যে নিকে করে ঘরে না তুলেছি তো আমার নাম আসগর না।
সায়রা ধাক্কা দিয়ে তাকে সরিয়ে বলল, মিয়া ভাই, আমাকে জড়িয়ে ধরতে সরম করল না?
আসগর বলল, আমি তো আর তোর আপন মিয়া ভাই নই। আপন ছাড়া যে কোনো সম্পর্কে বিয়ে করা যায়। চিররুগী বলে তোর ভাবি আমাকে কিছুই দিতে পারে না। তোকে নিকে করলে তুই আমাকে সবকিছু দিতে পারবি বলে আবার জড়িয়ে ধরে চুমো খেতে গেল।
সায়রা তার গালে একটা চড় মেলে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে ছুটে সেখান থেকে নিজের ঘরে চলে এল। বিকেলে আর কাজ করতে গেল না। সিদ্ধান্ত নিল, খেতে না পেয়ে মরে গেলেও ওদের ঘরে কাজ করতে যাবে না।
আজ ভিক্ষে করে ফেরার পথে মাতব্বরের সঙ্গে দেখা হতে ফজলু বলল, আপনার কথামতো কাজ করেছি। গ্রামের লোকজন সায়রার সঙ্গে আমার সম্পর্কের কথা জেনে গেছে। এবার আমাদের বিয়ের ব্যবস্থা করবেন না?
মাতব্বর মৃদু হেসে বললেন, হ্যাঁ, এবার তোদের বিয়ের ব্যবস্থা করব।
আপনি কিন্তু বিয়ের আগে নতুন ঘর করে দেবেন বলেছিলেন?
যা যা বলেছি সব ব্যবস্থাই করব। তার আগে তোকে একটা কাজ করতে হবে।
বলুন কি কাজ?
কাজ কিছু না। এখন আমি তোকে যা কিছু শেখাব বিচারের সময় সবার সামনে তুই সেগুলো বলবি।
বিচারের কথা শুনে ফজলু ভেবাচেকা খেয়ে গেল। বলল, কিসের বিচার? কার বিচার?
সে কথা তোর জানার দরকার নেই? শুধু শুনে রাখ, বিচারের মাধ্যমেই তোর বিয়ের ব্যবস্থা হবে।
বিচারের মাধ্যমে কথাটা শুনে ফজলু মনে করল, বিচারের লোকজনের সামনে তাদের বিয়ে হবে। তাই খুশী হয়ে বলল, লোকজনের সামনে কি বলতে হবে শিখিয়ে দেন।