এবার ফজলুর মুখে হাসি ফুটে উঠল। বলল, পারব।
এই তো বাপের বেটার মতো কথা বলেছিস। যা যা বললাম মনে আছে তো?
হ্যাঁ হুজুর, মনে আছে।
তা হলে এবার যা বলে মাতব্বর আবার মুচকি হাসলেন।
.
ফজলু সারাদিন ভিক্ষা করে সন্ধ্যের সময় ঘরে ফিরে। আজ মাতব্বরের কথা শুনে তার মনে বসন্তের বাতাস বইছে। তাই সন্ধের অনেক আগেই ঘরে ফিরে এল।
তার মা জয়তুন বিবি বলল, আজ বেলা থাকতে ফিরে এলি যে?
ফজলু বলল, আজকাল আর কেউ ভিক্ষে দিতে চায় না। সবাই বলে মাফ কর।
জয়তুন বিবি দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলল, কি আর করবি বাবা, আমাদের পোড়া কপাল। ভিক্ষে করা ছাড়া কি আর উপাই আছে।
ফজলু বলল, আজ শরীরটা ভালো নেই। দুপুরেও কেউ খেতে দেয় নি। তাড়াতাড়ি রান্না কর।
এমন সময় হালিমকে আসতে দেখে ফজলু বলল, কিরে বাবা, কেন এয়েছিস।
হালিম বলল, কাল রাত থেকে মায়ের খুব জ্বর। সারাদিন উঠতে পারে নি। দাদিকে মা যেতে বলেছে।
জয়তুন বিবি ছেলের দিকে চেয়ে বলল, তুই একটু দেখে আয়। আমি বেঁধে রেখে যাব।
ফজলু হালিমের সঙ্গে এসে দেখল, সায়রা কাঁথা মুড়ী দিয়ে শুয়ে আছে।
হালিম মায়ের গায়ে হাত রেখে নাড়া দিয়ে বলল, দাদি ফজলু চাচাকে পাঠিয়েছে। সে বেঁধে রেখে আসবে।
কাছাকাছি ঘর বলে ফজলুর মা জয়তুন বিবি প্রায়ই সায়রার কাছে আসে। আর সায়রাও স্বামী বেঁচে থাকতে তাদের ঘরে মাঝে মধ্যে যেত। স্বামী মারা যাওয়ার পরও যায়।
সায়রার চার পাঁচের মতো জ্বর। চোখ বন্ধ করে শুয়েছিল। কোনোরকমে চোখ খুলে বলল, ফজলু ভাই, চাচিকে একটু তাড়াতাড়ি আসতে বল। আমার জান কেমন করছে। আমি বোধ হয় আর বাঁচব না।
ফজলু সায়রার কপালে হাত দিয়ে জ্বর পরীক্ষা করার ইচ্ছাটা দমন করতে পারল না। সায়রার কথা শুনে সাহস করে কপালে হাত রেখে বলল, ইসরে, জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। আমি মাকে ডেকে নিয়ে আসি, মাথায় পানি দিতে হবে। তারপর ঘরে গিয়ে মাকে বলল, এখুনি চল, রাধা-বাড়া পরে করো। সায়রা ভাবির খুব জ্বর, মাথায় পানি দিতে হবে।
জয়তুন বিবি ছেলের সাথে এসে সায়রার মাথায় পানি দিতে দিতে ছেলেকে বলল, তুই কবিরাজকে ডেকে নিয়ে আয়।
কবিরাজের ডিসপেন্সারী মাইল খানেক দূরে বাজারে। ফজলু গিয়ে বলল, কবিরাজ ভাই, জলদি চল। সায়রা ভাবির কাল থেকে খুব জ্বর।
কবিরাজ খুব শক্ত দীলের মানুষ। টাকা ছাড়া কারো চিকিৎসা করে না। ফজলুর কথা শুনে বলল, তোর তো কোনো বড় ভাই নেই, সায়রা ভাবি এল কোথা থেকে?
সায়রা ভাবিকে চিনলে না? মঈন ভাই-এর বৌ।
ও—মঈন সেখের বৌ-এর কথা বলছিস? মঈন সেখ তো প্রায় সাত আট মাস আগে মারা গেছে। আমার ফি ও ওষুধের দাম দেবে কে?
কবিরাজের স্বভাব ফজলু জানে। তাই বলল, মঈন ভাই মারা গেলে ও আমি তো আছি। আমি দেব। তুমি চলোতো কবিরাজ, দেরি হয়ে যাচ্ছে।
তুইতো ভিক্ষে করে খাস, টাকা কোথায় পাবি?
ভিক্ষে করার সময় সবাই চাল দেয় না। কেউ কেউ টাকা পয়সাও দেয়। সেইগুলো আমি খরচ না করে জমিয়ে রেখেছি, সেখান থেকে দেব।
তা হলে চল বলে কবিরাজ ওষুধের ব্যাগ নিয়ে রওয়ানা দিল।
ফজলু যখন কবিরাজকে নিয়ে ফিরে এল তখনও জয়তুন বিবি সায়রার মাথায় পানি ঢালছিল।
কবিরাজ সায়রাকে পরীক্ষা করে ব্যাগ থেকে ওষুধ বের করে কোনটা কখন খাবে বুঝিয়ে দিল। তারপর ফজলুর দিকে চেয়ে বলল, আমার ফি দশ টাকা ও ওষুধের দাম বিশ টাকা, মোট ত্রিশ টাকা দে।
এতক্ষণ পানি ঢালার পর সায়রার জ্বর একটু কমেছে। করিবাজের কথা শুনে বলল, ফজলু ভাই টাকা কোথায় পাবে? আমি ভালো হয়ে করিম চাচার কাছ থেকে চেয়ে তোমাকে দেব।
কবিরাজ অসন্তুষ্ট গলায় বলল, কিন্তু ফজলু তো টাকা দেবে বলে আমাকে ডেকে নিয়ে এল।
কবিরাজের কথা শেষ হতে ফজলু বলল, টাকা আমিই দেব। তুমি আমার সাথে এস। তারপর তাকে নিয়ে বেরিয়ে এল।
কবিরাজ বেরিয়ে আসার সময় বলল, মাথায় পানি ঢালা বন্ধ করা চলবে না। জ্বর আরো না কমলে সারা রাত ঢালতে হবে।
ফজলু ভিক্ষা করে যে টাকা পয়সা পায়, তা থেকে মাকে অল্প কিছু দেয়। বাকিগুলো একটা মাটির ব্যাংকে ফেলে। ব্যাপারটা জয়তুন বিবি জেনে অসন্তুষ্ট না হয়ে বিপদে কাজে লাগবে ভেবে সন্তুষ্টই হয়েছে। কবিরাজকে নিয়ে ফজলু বেরিয়ে যাওয়ার পর বলল, ও ভিক্ষে করে কিছু টাকা জমিয়েছে। সেখান থেকে দেবে। তুই ভালো হয়ে করিম সেখের কাছ থেকে চেয়ে দিয়ে দিস। কবিরাজ কেমন লোক জানিস তো? টাকা না দিলে কারো চিকিৎসা করে না।
সায়রা বলল, হ্যাঁ চাচি, তাই দেব।
ফজলু কবিরাজকে বিদেয় করে এসে বলল, সন্ধ্যে হয়ে গেছে। তুমি এবার ঘরে গিয়ে রান্না কর। আমি ভাবির মাথায় পানি ঢালছি।
জয়তুন বিবি বললেন, তাই কর। হালিম ও সায়রা বোধহয় সারাদিন কিছু খায় নি। আমি হালিমকে নিয়ে যাই। রান্না করে ওকে খাইয়ে ওর হাতে সায়রার জন্য একমুঠো পাঠিয়ে দেব।
ঐ রাতে জয়তুন বিবি ছেলেকে নিয়ে সারারাত সায়রার মাথায় পানি ঢালল। সকালের দিকে জ্বর অনেকটা কমতে সায়রাই তাদেরকে ঘরে চলে যেতে বলল।
প্রায় আট ন’দিন পর সায়রা সুস্থ হল। এই ক’দিন ফজলু ও জয়তুন বিবি দিনে রাতে এসে তার সেবা করেছে। সুস্থ হওয়ার পর। সায়রা করিম সেখের ঘরে কাজে যেতে লাগল। চিকিৎসা করার কথা বলে করিম সেখের কাছ থেকে টাকা চেয়ে এনে একদিন ফজলুকে দিতে গেল।