ছোট নানির কথা শুনে রাফিয়া লজ্জা পেয়ে মুখ নিচু করে নিল কোনো কথা বলতে পারল না।
ফারযানা বেগম তার চিবুক ধরে মুখটা তুলে বললেন, এখন নানির কাছে লজ্জা পাচ্ছ, আমার নাতির সঙ্গে প্রেম করার সময় লজ্জা করে নি?
রাফিয়া নানির হাত সরিয়ে দিয়ে লজ্জামিশ্রিত কণ্ঠে বলল, আপনি লজ্জা দিচ্ছেন, তাই লজ্জা পাচ্ছি। আপনার নাতি কোনো দিন লজ্জা দেয় নি। তাই তখন লজ্জা পাই নি। এবার অন্য কথা বলুন।
ফারযানা বেগম বললেন, সায়রা তোমাকে দেখলে খুব খুশী হবে।
রাফিয়া জিজ্ঞেস করল, সায়রা কে?
হালিমের মা।
উনি এখানে থাকেন না?
হ্যাঁ থাকে। বেশ কিছু দিন হল বাহেরচরে গিয়ে আছে স্বামীর ভিটেয় মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করার জন্য। হালিম ঐ এলাকার রাঙ্গিকালি থানার দারোগা। তোমরা এসেছ, তোমার ছোট নানা দু’একদিনের মধ্যে গিয়ে ওদের নিয়ে আসবে।
দুপুরের দিকে বাহেরচর থেকে আবু তাহেরের ভাইরা মুসা এসে জানালেন, কাল মাদ্রাসা উদ্বোধন করার জন্য আপনাকে নিয়ে যেতে সায়রা ও হালিম পাঠিয়েছে।
আবু তাহের ভাইরার সঙ্গে আশফাকের পরিচয় করিয়ে দিলেন। খাওয়া দাওয়ার পর আশফাক মুসাকে বলল, ছোট নানার সঙ্গে আমিও যাব আপনাদের গ্রাম দেখতে।
মুসা বললেন, গেলে খুশীই হব।
বাহেরচরে পৌঁছাতে এশার নামাযের সময় হয়ে গেল। নামায পড়ে এসে আবু তাহের ভাইরাকে, রাফিয়া ও আশফাকের আসার কারণ জানিয়ে বললেন, সায়রাকে এখন এসব কথা বলার দরকার নেই।
পরের দিন আবু তাহের বেলা দশটার সময় মাদ্রাসা উদ্বোধন করতে আসার সময় আশফাককে সঙ্গে এনে লোকজনদের সঙ্গে বসতে বলেছিলেন।
মিটিং শেষে লোকজন চলে যাওয়ার পর হালিম যখন আশফাকের সঙ্গে হাত মোসাফাহ করে আলাপ করছিল তখন মুসা তাদেরকে আলাপ করতে নিষেধ করে ঘরে আলাপ করার কথা বলে সবাইকে নিয়ে ঘরে এলেন।
সবাই বসার পর আবু তাহের হালিমকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তুমি তা হলে আশফাককে চেনো?
জি, চিনি। তবে আপনার নাতি, সেকথা জানতাম না।
তা জানবে কি করে? ও হল আমার বড় ভাইয়ের মেয়ের ঘরের নাতি।
এখানে হালিমকে কোনো কিছু বলতে আবু তাহের নিষেধ করে দিয়েছিলেন। তাই আশফাক চুপ করে রইল।
আবু তাহের আবার বললেন, আজ দুপুরের খাওয়ার পর সায়রা ও তোকে বাড়ি নিয়ে যাব। এখানে দেরি না করে থানায় গিয়ে তৈরি হয়ে আয়। তারপর সায়রাকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতে দেখে বললেন, এখানে কিছু জানতে চাইবি না। ঘরে গেলেই জানতে পারবি।
বাহেরচর থেকে পটুয়াখালী ফিরতে সন্ধে হয়ে গেল। পুরুষরা মসজিদে নামায পড়তে গেল। সায়রা ঘরে ঢুকে মায়ের সঙ্গে সালাম ও কুশল বিনিময় করল। তারপর রাফিয়াকে দেখে জিজ্ঞেস করল, কে আম্মা?
ফারযানা বেগম বললেন, আমার বড় ভাসুরের মেয়ের ঘরের নাতিন। তোর আব্বার সঙ্গে যে ছেলেটা বাহেরচর গিয়েছিল, সে ওর ভাই। ওরা দু’তিন দিন হল ঢাকা থেকে এসেছে। তারপর রাফিয়াকে বললেন, এ হালিমের মা।
রাফিয়া সালাম বিনিময় করে কদমবুসি করতে এলে সায়রা জড়িয়ে ধরে মাথায় চুমো খেয়ে দোয়া করে বললেন, থাক মা থাক, কদমবুসি করা ঠিক না। মুখে সালাম দেয়াই উত্তম।
রাফিয়া বলল, আগে নামায পড়ে নিই চলুন খালা আম্মা, তারপর আলাপ করব।
নামাযের পর ফারযানা বেগম সায়রাকে বললেন, এই রাফিয়ার সঙ্গে তোর ছেলে প্রেম করেছে। তারপর ওদের আসার কারণ বলে বললেন, কালকেই তোর আব্বা ওদের বিয়ের ব্যবস্থা করবে।
গতবারে এসে ফারনা বেগমের কাছে রাফিয়ার পরিচয় শুনেছিল। আজ তাকে দেখে খুব পছন্দ হল। তাই আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বলল, হালিম রাফিয়ার সম্পর্কে আপনাদেরকে আগে কিছু বলেছিল?
ফারযানা বেগম বললেন, না বলে নি। মনে হয়, রাফিয়া যে আমাদের নাতনি। হালিম জানে না আর সে যে এসেছে, তাও জানে না। এখন এসব কথা থাক, তোর আব্বা ওদেরকে নিয়ে এক্ষুনি মসজিদ থেকে এসে পড়বে। রাফিয়াকে নামায পড়ে হালিমের ঘরে থাকতে বলেছি। হালিম মসজিদ থেকে এসে ঘরে ঢুকে রাফিয়াকে দেখে কি করে দেখা যাক।
এমন সময় আবু তাহের মসজিদ থেকে নাতিদের নিয়ে ফিরে এসে ড্রইংরুমে বসে হালিমকে বললেন, তোর নানিকে চা-নাস্তা দিতে বল।
হালিম ভিতরে গিয়ে নানিকে ড্রইংরুমে চা-নাস্তা পাঠাবার কথা বলে জামা কাপড় পাল্টাবার জন্য নিজের রুমে গেল।
রাফিয়া ছোট নানির কথামতো হালিমের ঘরে মাগরিবের নামায পড়ে একটা চেয়ারে বসেছিল। হালিম ঢুকতেই দাঁড়িয়ে সালাম দিল।
হালিম ভূত দেখার মতো চমকে উঠে অস্ফুটস্বরে সালামের উত্তর দিয়ে একদৃষ্টে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। সে যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না।
রাফিয়াও একইভাবে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
কতক্ষণ দু’জনে ঐভাবে ছিল জানতে পারল না। এক সময় রাফিয়ার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগল।
তাই দেখে হালিম সম্বিত ফিরে পেয়ে বলল, আমি স্বপ্ন দেখছি না তো?
রাফিয়া চোখ মুছে কান্নাজড়িত স্বরে বলল, স্বপ্ন নয়, বাস্তব। এই বাস্তব দিনটির জন্য আমাকে চার বছর কঠিন পরীক্ষা দিতে হয়েছে। বাবা ও ভাইয়াদের অনেক লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয়েছে। শেষে আল্লাহ আজ আমার স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করালেন। সেজন্য তার পাক দরবারে জানাচ্ছি শতকোটি শুকরিয়া। তারপর কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে কান্না সামলে নিয়ে আবার বলল, এই চার বছর আমাকে কষ্ট দিয়ে তুমি নিশ্চয় খুব সুখেই ছিলে?