আবু তাহেরের কথা শুনে সবাই অবাক হয়ে দারোগার দিকে তাকিয়ে রইলেন। কেউ কোনো কথা বলতে পারলেন না।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আবু তাহের আবার বললেন, আপনারা যে খুব অবাক, হয়েছেন, তা বুঝতে পারছি। অবশ্য হওয়ারই কথা। মনে রাখবেন, আল্লাহ কখন কাকে কি করেন কেউ বলতে পারে না। আপনাদের গ্রামের সাত বছরের এতিম ছেলে আব্দুল হালিমকে আল্লাহ কত বড় করেছেন। আমি তাকে যতটুকু জানি, তার মতো সৎ চরিত্র ও আল্লাহ ভীরু ছেলে বর্তমান জামানায় নেই বললেই চলে।
ওনাকে হাত তুলে থামিয়ে দারোগা হালিম বললেন, মাওলানা সাহেব আমার সম্পর্কে যা কিছু বলেছেন, তা সত্য। আমিই মরহুম মঈন সেখ ও সায়রা বানুর ছেলে। গ্রামের কিছু লোকের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে আমার মা সাত বছরের আমাকে নিয়ে গ্রাম ছেড়ে পটুয়াখালী চলে যান রাতের অন্ধকারে। সেখানে আমাকে নিয়ে মা যখন একটু আশ্রয়ের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন তখন আল্লাহর ঐ মুমীন বান্দা মাওলানা আবু তাহের আশ্রয় দেন এবং আমার মাকে মেয়ে ও আমাকে নাতি করে নেন। ওনার স্ত্রী আমার মাকে ইসলামী ও দুনিয়াবী শিক্ষায় শিক্ষিত করেন। আর মাওলানা সাহেব আমাকে মাদ্রাসায় ও ভার্সিটিতে পড়িয়ে মানুষ করেন। আমি ওনার ও ওনার স্ত্রীর কাছে এত ঋণী যে, আমার গায়ের চামড়া দিয়ে ওনাদের পায়ের জুতা বানিয়ে দিলেও সে ঋণ শোধ হবে না। যারা ষড়যন্ত্র করে আমার মাকে গ্রাম ছাড়তে বাধ্য করেছিলেন, তাদের উপর এখন আমার কোনো রাগ বা বিদ্বেষ নেই। আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (দঃ)-কে সন্তুষ্ট করার জন্য আমি ও আমার মা মাফ করে দিলাম। আল্লাহ যেন তাদেরকে মাফ করেন। আপনারা দোয়া করবেন, আমি যেন আজীবন ঈমানদারীর সাথে কর্মজীবন অতিবাহিত করতে পারি এবং দেশ ও দশের উন্নতির জন্য কিছু করতে পারি। আর বেশি কিছু আমার বলার নেই বলে মুরুব্বীদের সঙ্গে হাত মোসাফাহ করতে লাগলেন।
এমন সময় একজন প্যান্ট শার্ট পরা সুদর্শন অচেনা যুবক দাঁড়িয়ে সালাম দিতে সবাই অবাক হয়ে তার দিকে তাকালেন।
আবু তাহের সালামের উত্তর দিয়ে তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আমার নাতি। বাড়ি ঢাকায়। গতকাল আমার সঙ্গে এসেছে। তারপর আবার বললেন, মিটিং-এর কাজ আজকের মতো শেষ, এবার আপনারা আসুন। মুরুব্বীরা হালিমের সঙ্গে হাত মোসাফাহ করে চলে যেতে লাগল।
দারোগা সায়রার ছেলে হালিম শুনে মাতব্বর চিন্তা করলেন, সে নিশ্চয় মায়ের প্রতি দুর্ব্যবহারের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য এখানকার থানার দারোগা হয়ে এসেছে। তা হলে ঐ কি জিনের ভেশ ধরে আমাদেরকে ভয় দেখিয়েছে? রশিদের অপকীর্তির জন্য তার এই দশা ঐ করেছে। এরপর আরো কি কিছু করে প্রতিশোধ নেবে? এইসব চিন্তা করে এতক্ষণ আতঙ্কে ভুগছিলেন। হালিমের বক্তব্য শুনে ভাবলেন, আর বোধ হয় কিছু করবে না। রশিদকে বললেন আবু তাহেরের কথাই ঠিক, হালিমের মতো ভালো ছেলে হয় না।
সায়রার ছেলে দারোগা হালিম জেনে রশিদও ভয় পেয়েছিল। আব্বার কথা শুনে বলল, হ্যাঁ, আব্বা, হালিম সত্যিই খুব ভালো। ও যে সায়রার ছেলে ভাবতেই পারি নি।
মাতব্বর বললেন, আমিও ভাবতেই পারি নি। ওর সঙ্গে হাত মোসাফাহ করে ঘরে যাই চল।
লোকজন চলে যাওয়ার পর হালিম আশফাকের সঙ্গে হাত মোসাফাহ করে জিজ্ঞেস করল, আপনি আবু তাহের নানার নাতি শুনে খুব অবাক হয়েছি।
আশফাক কিছু বলতে যাচ্ছিল। তাকে থামিয়ে দিয়ে মুসা বললেন, এখানে কোনো কথা নয়, তোমার মাকে নিয়ে আমাদের ঘরে চল, সেখানে যা বলার বলবে।
.
১০.
আশফাক রাফিয়াকে হালিমের বায়োডাটা লিখে দিতে বললে, সে একটা কাগজে লিখে তার হাতে দিল।
আশফাক সেটা পড়ে বলল, আরে, পটুয়াখালী টাউনে তো আমাদের নানা বাড়ি। ওখানে গিয়ে নানাকে জিজ্ঞেস করলেই হালিমের খোঁজ পাওয়া যাবে। আবু তাহেরের নাম হালিমের বায়োডাটায় থাকলেও উনিই যে ছোট নানা, রাফিয়াও আশফাক তা জানত না।
রাফিয়া বলল, আমারও তাই মনে হয়েছে।
আশফাক বলল, কয়েকদিনের মধ্যে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে নানার কাছে খোঁজ নিতে যাব। তারপর মায়ের কাছে এসে বলল, পটুয়াখালী শহরের মাওলানা আবু তাহেরের নাম শুনেছ?
ফাতেমা খাতুন হেসে ফেলে বললেন, শুনব না কেন? উনি তো আমার ছোট চাচা। ছোট চাচা অন্যখানে জায়গা কিনে বাড়ি করেছেন। উনি তোর আপন ছোট নানা।
আশফাক অবাক হয়ে বলল, জান মা, হালিম নামে যে ছেলেটাকে রাফিয়া পছন্দ করে, তাকে উনিই লেখাপড়া করিয়ে মানুষ করেছেন।
ফাতেমা খাতুন খুব অবাক হয়ে বললেন, কি বলছিস তুই?
হ্যাঁ মা, এই দেখ, বলে রাফিয়া লিখে দেয়া কাগজটা হাতে দিয়ে বলল, এটা হালিমের বায়োডাটা।
ফাতেমা খাতুন পড়ে বললেন, হ্যাঁ, তাইতো?
আশফাক বলল, ভাবছি, ওর সম্পর্কে সবকিছু জানার জন্য তোমাকে নিয়ে পটুয়াখালী যাব।
তোর আব্বা বলেছিল, ছেলেটার মা নাকি একজনের বাসায় কাজ করে। তার বদলে সেই লোক হালিমকে লেখাপড়া করিয়ে মানুষ করেছে। তোর ছোট নানার কথা বলে নি।
সত্য মিথ্যা জানার জন্য আমি তোমাকে নিয়ে যেতে চাই, তুমি যাবে কি না বলো।
তোর বাবাকে বলেছিস?
না, তাকে বললে রেগে যাবে। যাওয়ার ব্যাপারে অন্য কিছু বলে বাবাকে রাজি করাবে।
তুই কি ঐ ছেলের সঙ্গে রাফিয়ার বিয়ে দিতে চাস?