মাদ্রাসা উদ্বোধন করার জন্য পটুয়াখালী শহর থেকে মুসার ভাইরা আবু তাহেরকে আনা হয়েছে। ওনাকে কিছু বলার জন্য আযীয সেখ অনুরোধ করলেন।
আবু তাহের হামদ ও নাত পাঠ করার পর লোকজনদের উদ্দেশ্যে বললেন, এটা একটা দ্বীনি প্রতিষ্ঠান। বাংলা, ইংরেজি ও অন্যান্য সবকিছু ছেলেমেয়েরা স্কুলে শিক্ষা পায়। এখানে শুধু কুরআন ও হাদিস শিক্ষা দেয়া হবে। অর্থাৎ যতটুকু দ্বীনি শিক্ষা করা প্রতিটি মুসলমান ছেলেমেয়ের অবশ্য কর্তব্য, সেসব শিক্ষা দেয়া হবে। আর রাতে এশার নামাযের পর বড়দেরকেও ঐসব শিক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা থাকবে এবং তারা যেন মাতৃভাষা লিখতে ও পড়তে পারে সে ব্যবস্থাও থাকবে। গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ অশিক্ষিত। তাই তারা ধর্ম সম্পর্কে কিছু না জেনে অনেক
বেদয়াতকে ধর্মের কাজ মনে করে মেনে চলে। তাই আমি এই মাদ্রাসায় একটা ইসলামী পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করার সংকল্প করেছি। ইনশাআল্লাহ খুব শিঘ্রী সেই ব্যবস্থা করব। আপনারা দোয়া করবেন, আল্লাহ যেন আমার মনের আশা পূরণ করেন।
আপনাদের কাছে আমার একান্ত অনুরোধ, প্রত্যেকে নিজের ছেলেমেয়েদের এখানে পাঠাবেন এবং আপনারাও রাত্রে এসে দ্বীন-দুনিয়ার শিক্ষা লাভ করবেন। আমাকেও পরিচালনা সমিতির সদস্য করা হয়েছে। তাই প্রতি মাসে একবার এসে আপনাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করব। আপনাদের সহযোগিতা কামনা করে আমি আমার বক্তব্য শেষ করছি, আসোলামু আলাইকুম।
এবার আযীয সেখ বললেন, মাওলানা সাহেব খুব মূল্যবান কথা বলেছেন। শিক্ষার অভাবে, বিশেষ করে দ্বীনি শিক্ষার অভাবে আমরা যেমন অনেক বেদয়াতকে ধর্মের কাজ মনে করে গুনাহ করছি। তেমনি হিংসা-বিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে একে অপরের ক্ষতি করছি। সামান্য কারণে ভাইয়ে ভাইয়ে মারামারি করছি, সামান্য কারণে ও যৌতুকের জন্য স্ত্রীর উপর জুলুম করছি, অনেকে তালাকও দিচ্ছি। ধনীরা গরিবদের শোষণ করছি। আমরা বড়রা যদি ধর্মের সঠিক জ্ঞান অর্জন করে সেইসব মেনে চলতে পারি, তা হলে ইনশাআল্লাহ আমরা ঐ সমস্ত গুনাহ থেকে রক্ষা পাব এবং শান্তিতে বাস করতে পারব। তাই আমিও সবাইয়ের কাছে অনুরোধ করব, আমরা প্রতিদিন এশার নামাযের পর এখানে এসে দ্বীনি শিক্ষা লাভ করব আর ছেলেমেয়েদের পাঠাব। এই প্রতিষ্ঠান যাতে কায়েম থাকে সে চেষ্টা ও তদবীর আমরা করব। এখন বলুন, আপনারা সবাই রাজি আছেন কিনা।
সবাই একসঙ্গে বলে উঠল, হ্যাঁ, রাজি আছি।
আযীয সেখ এবার দারোগাকে কিছু বলতে বললেন।
দারোগা আযীয সেখকে ধন্যবাদ জানিয়ে সবাইয়ের উদ্দেশ্যে সালাম দিয়ে বললেন, আমার আগে মাওলানা সাহেব ও আযীয সেখ যে সমস্ত কথা বলেন, তারপর আমার আর কিছু বলার নেই। তবু দু’একটা কথা বলব। মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড় অভিশাপ হল মূর্খতা। মূর্খ মানুষ যেমন নিজেকে চেনে না, তেমনি তার ভালো মন্দ বিবেচনা শক্তিও নেই। তাই আমাদের নবী হযরত মুহম্মদ (দঃ) বলিয়াছেন, প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য এলেম শিক্ষা করা ফরয অর্থাৎ অবশ্য কর্তব্য। আমরা অনেকে ছেলেদের কম বেশি লেখাপড়া করালেও মেয়েদের প্রতি খুবই উদাসীন। অনেক মনে করে, মেয়েরা লেখাপড়া করে কি করবে? বড় হলে তো তাদের বিয়ে দিয়ে পরের ঘরে পাঠাতে হবে। সেখানে রান্না বান্না ও সংসারের কাজ সারাজীবন করবে। তাই যতদিন মা-বাবার বাড়িতে থাকে ততদিন তাদেরকে রান্না-বান্না ও সংসারের অন্যান্য কাজ করান হয়। কিন্তু আমরা কোনোদিন ভেবে দেখেছি কি, ঐ সব কাজ সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে করার জন্য লেখাপড়ার দরকার। রান্না-বান্না ও সংসারের কাজ-কর্ম ছাড়া মেয়েদের আর একটা প্রধান কাজ হল, সন্তানের পরিচর্যা করা এবং আদব-কায়দা শিক্ষা দিয়ে ও লেখাপড়া করিয়ে মানুষ করা। একজন মূর্খ মা কি এই গুরুদায়িত্ব পালন করতে পারে? কখনই পারে না। শিশুরা যাতে বড় হয়ে মানুষের মতো মানুষ হতে পারে। সে দায়িত্ব মায়েদের। সেই মায়েদের লেখাপড়া না করিয়ে মূর্খ করে রেখে পরের ঘরে সংসার করতে পাঠান আর এক মূর্খতা। তাই আসুন আজ থেকে প্রতিজ্ঞা করি, আমরা যেমন এশার নামাযের পর এখানে শিক্ষালাভ করতে আসব, তেমনি আমাদের ছেলে মেয়েদেরকেও সকালে এখানে পাঠাব। আমি আর বেশি কিছু না বলে আমার বক্তব্য শেষ করছি, আল্লাহ হাফেজ।
আযীয সেখ বললেন, আপনারা কেউ কিছু বলতে চাইলে বলতে পারেন।
কিছুক্ষণ নীরবতার পর মাতব্বর বললেন, এরপর আর কারো কিছু বলার নেই। তারপর লোকজন থেকে একটু দূরে বোরখাপরা সায়রাকে বসে থাকতে দেখে তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তুমিতো বলেছিলে তোমার ছেলে ছুটি পেলে কয়েকদিন পরে আসবে, কিন্তু এতদিন হয়ে গেল এল না কেন?
সায়রা কিছু বলার আগে আবু তাহের হালিমকে দাঁড়াতে বললেন। দারোগা দাঁড়াবার পর বললেন, আপনারা ভালো করে দেখুনতো, ইনাকে চিনতে পারেন কি না?
মাতব্বরের সঙ্গে অনেকে বলে উঠল, চিনব না কেন? উনিতো, রাঙ্গিকালি থানার দারোগা।
আবু তাহের বললেন, উনিই হলেন সায়রা বানুর ও মরহুম মঈন সেখের ছেলে আব্দুল হালিম। যাকে আপনারা হালিম নামে জানতেন। উনিই সরকারের কাছে লেখালেখি করে এই গ্রামে হাইস্কুল করার মঞ্জুরী করিয়েছেন এবং বাপের রুহের মাগফেরাতের জন্য ও গ্রামের মূর্খ ছেলেমেয়ে ও লোকজনদের দ্বীনিশিক্ষা দেয়ার জন্য নিজের পৈত্রিক বাস্তুতে এই মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে দিলেন। এখানকার থানার দারোগা হয়ে আসার পর উনি ইচ্ছা করলে নিজের পরিচয় দিতে পারতেন; কিন্তু কেন দেন নি শুনবেন? ওনার সাধনা ছিল, গ্রামের ধনীরা যেন গরিবদের উপর অত্যাচার করতে না পারেন। আর সেজন্য শিক্ষার দরকার। তাই গ্রামে একটা মাদ্রাসা ও হাইস্কুল করার। হাইস্কুলের কাজ প্রায় শেষ হতে চলেছে, আর আল্লাহর রহমতে মাদ্রাসা তো আজ উদ্বোধন হলই। তাই আমি আজ ওনার আসল পরিচয় আপনাদের জানিয়ে দিলাম। অবশ্য আব্দুল হালিমের ইচ্ছা ছিল, হাই স্কুল উদ্বোধন হওয়ার পর সবাইকে তার পরিচয় জানাবে। মাতব্বর সাহেব সায়রা বানুকে আব্দুল হালিমের কথা জিজ্ঞেস করাতে আজ আমিই জানিয়ে দিলাম।