তোমার তো কোনো কিছুই মনে থাকে না। সারা দিন রাত বইয়ের মধ্যে ডুবে থাক। কি যে পাও মোটা মোটা বই পড়ে বুঝি না। তারপর আবার বললেন, রাফিয়া অনার্স পড়ার সময় যে ছেলেটা এসে বলল, “আপনাদের মেয়ে আমাকে ভীষণ ভালবেসে ফেলেছে। তারপর তার পরিচয় দিয়ে রাফিয়ার মোহ ভাঙাতে বলেছিল।”
ও হ্যাঁ হ্যাঁ, এবার মনে পড়ছে। কিন্তু সে ছেলেটা তো নামগোত্রহীন গরিব ঘরের। তার বাবা দিনমজুর ছিল। সে অন্যের দয়ায় লেখাপড়া করছে। না-না এ কখনো সম্ভব নয়। এতবড় ভুল রাফিয়া করবে ভাবতেই পারি নি। মনে করেছিলাম এতদিনে তাকে হয়তো ভুলেই গেছে। আমাদের মান-সম্মানের কথা চিন্তা করল না? ওর ভাইয়ারা শুনলে খুব রেগে যাবে। তুমি ওকে বুঝিয়ে বলো।
ঠিক আছে, বলব। তবে কাজ হবে বলে মনে হয় না। তুমি বাবা হলে কি হবে, আমি ওকে পেটে ধরেছি। ওর স্বভাব চরিত্র জানতে আমার বাকি নেই। নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ছোটবেলা থেকে আজ পর্যন্ত কোনো কিছু করে নি।
হাফিজ উদ্দিন রেগে উঠে বললেন, তাই বলে ওর এতবড় অন্যায় মেনে নেব? একটা আস্তাকুঁড়ের ছেলে, যার মা অন্যের বাড়ি কাজ করে খায়, সেই ছেলেকে পছন্দ করতে ওর বিবেকে বাধল না।
তুমি রাগ করছ কেন? মেয়ে বড় হয়েছে, লেখাপড়াও করেছে, ওর অমতে জোর করে কিছু করা ঠিক হবে না। আমি ওকে বুঝিয়ে বলব, বৌমাদেরকেও বোঝাতে বলব। তুমি ঐ ডাক্তার ছেলের গার্জেনদের সঙ্গে আলাপ কর।
ফাতেমা খাতুন মেয়েকে তার বাবার অমতের কথা বলে অনেক বোঝালেন। কাজ না হতে বৌমাদের বোঝাতে বললেন। তারাও ননদকে বোঝাল।
রাফিয়া তাদের সাফ সাফ জানিয়ে দিল, হালিমকে ছাড়া অন্য কোনো ছেলেকে বিয়ে করবে না।
স্ত্রীদের কাছ থেকে তিন ভাইয়া শুনে তারাও সাফ সাফ জানিয়ে দিল, হালিমকে কিছুতেই মেনে নেবে না।
রাফিয়া ভাইয়াদের সামনে কিছু না বললেও ভাবিদেরকে বলল, তোমরা মা বাবা ও ভাইয়াদের জানিয়ে দিও, অন্য কোথাও আমার বিয়ে দেয়ার জন্য যেন চেষ্টা না করে। যদি করে, তা হলে তার পরিণতির জন্য তারাই দায়ী হবে। হালিমকে তোমরা সবাই মেনে না নিলে বিয়েই করব না। প্রয়োজনে যে কোনো চাকরি নিয়ে অন্যত্র থাকব।
তার কথা শুনে সবাই তাকে রাগারাগি করলেও আশফাক কিছু বলল না। রাফিয়াকে সে সব ভাইয়েদের চেয়ে বেশি ভালবাসে। তাই একদিন তাকে জিজ্ঞেস করল, তুই হালিমকে ছাড়া বিয়ে করতে চাচ্ছিস না কেন?
রাফিয়া বলল, তুমি কিন্তু বোকার মতো প্রশ্ন করছ।
আশফাক হেসে ফেলে বলল, তাহলে আর একটা বোকার মতো প্রশ্ন করি, হালিমও নিশ্চয় তোকে ছাড়া বিয়ে করবে না?
ঠিক ঐ কথা বলেন নি। বলেছেন, আমি যদি তার জন্য অপেক্ষা করি, তা হলে আমাকে বিয়ে করার জন্য ফিরে আসবেন।
ফিরে আসবেন মানে? সে কোথায় গেছে?
তা জানি না।
কি পাগলের মতো কথা বলছিস? তার সঙ্গে তোর যোগাযোগ নেই?
না।
কতদিন যোগাযোগ নেই।
প্রায় চার বছর।
কি বলছিস তুই? যে তোর সঙ্গে চার বছর যোগাযোগ রাখে নি, তাকে মনে রেখে বিয়ে করতে চাচ্ছিস না? সে ফিরে আসবে ভাবতে পারলি?
শুধু মনে রেখেছি না, প্রয়োজনে সারাজীবন অপেক্ষাও করব।
এরকম সিদ্ধান্ত নেয়ার পিছনে নিশ্চয় কোনো কারণ আছে। সেটা বলত শুনি।
শেষবারে যখন তার সঙ্গে আলাপ হয় তখন বলেছিলেন, ওনার কি একটা সাধনা আছে। সেটা সফল হওয়ার পর আমার কাছে আসবেন।
সাধনা সফল হতে কত সময় লাগবে কিছু বলেছে?
না।
তুই জিজ্ঞেস করিস নি?
না।
একটু আগে তুই আমাকে বোকা বললি, অথচ তুই-ই বোকার মতো কাজ করেছিস। সাধনা ও সময়ের কথা জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল। আচ্ছা, ওর বায়োডাটা জানিস?
অনেকবার জানতে চেয়েছি, বলেন নি। তবে বাবার সঙ্গে দেখা করতে এসে বাবাকে যখন বলেছিলেন তখন শুনেছি।
যা যা শুনিছিস একটা কাগজে লিখে দে। আমি খোঁজ নেব। যদি জানতে পারি, তার সব কিছু ভালো, তা হলে মা-বাবা ও ভাইয়াদের যেমন করে তোক রাজি করিয়ে তোদের বিয়ের ব্যবস্থা করব।
৯-১০. হালিম অনার্স কমপ্লীট
০৯.
হালিম অনার্স কমপ্লীট করার পর বি,সি, এস, করে। তারপর পুলিশ বিভাগে ঢুকে ট্রেনিং শেষে দারোগার চাকরি নেয়। মাস ছয়েক হল পটুয়াখালী জেলার রাঙ্গীকালি থানায় বদলি হয়ে এসেছে।
জিন যে রাতে মাতব্বর ও তার ছেলে রশিদকে শাসিয়ে গেল তার দু’দিন পর বেলা দশটার সময় দারোগা মাতব্বরের বাড়িতে এলেন।
সালাম বিনিময় করে মাতব্বর আপ্যায়ন করাতে চাইলে দারোগা বললেন, ওসব করা লাগবে না। আমি মঈন সেখের বাস্তুর ব্যাপারে আলাপ করতে এলাম।
রশিদও সেখানে ছিল। বাবা কিছু বলার আগে বলে উঠল, আপনি সায়রাকে বলবেন, সে তার স্বামীর ভিটেয় মাদ্রাসা তৈরির কাজ শুরু করুক। আমারা ওখানে যেসব গাছপালা লাগিয়েছি, সেসবে আমাদের দাবি নেই। ওগুলো মাদ্রাসার কাজে দান করে দিলাম।
দারোগা বললেন, শুনে খুব খুশী হলাম। এবার আসি, সায়রা বানুকে কথাটা জানিয়ে আযীয সেখের সঙ্গে স্কুলের জমির ব্যাপারে আলাপ করতে হবে। তারপর সালাম বিনিময় করে চলে গেলেন।
কিছুদিনের মধ্যে আযীয সেখের তত্ত্বাবধানে সায়রা স্বামীর ভিটেয় মাদ্রাসা ঘর প্রতিষ্ঠা করল। তারপর একদিন দারোগা ও গ্রামের লোকজনদের নিয়ে মাদ্রাসা প্রাঙ্গনে মিটিং ডেকে একটা সমিতি গঠন করে সমিতির লোকজনের উপর মাদ্রাসা। পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হল।