আমি আপনাকে ভালবেসেছি, আপনার পরিচয়কে নয়।
কথাটা ঠিক বলেন নি। পরিচয়হীনকে সমাজ ঠাঁই দেয় না।
আমি সমাজের পরওয়া করি না।
এ কথাটাও ঠিক বলেন নি। কারণ মানুষ সামাজিক জীব। সমাজ ছাড়া সে থাকতে পারে না। আর পরিচিতরাই সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়।
আপনার জন্য আমি সমাজ ত্যাগ করতে পারব।
হালিম হেসে ফেলে বলল, এটা আপনার আবেগের কথা। আবেগ বেশি দিন থাকে না। বাস্তব জীবনে প্রবেশ করার কিছুদিন পরেই মনে হবে, কি বিরাট ভুল করে ফেলেছেন। ফলে দুর্বিসহ জীবন কাটাতে হবে।
আপনি পরিচয়হীন হলেও শিক্ষা ও কর্ম আপনাকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করবে।
এ কথাটা অবশ্য ঠিক বলেছেন। তাই ভেবেছি, শিক্ষা জীবন শেষ করে কর্মজীবনে প্রবেশ করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হই। তারপর জীবন সঙ্গিনীর কথা চিন্তা করব।
আপনিও ঠিক কথা বলেছেন। তবে এর মধ্যেই মনের মতো জীবনসঙ্গিনী নির্বাচন করে রাখতে বাধা কোথায়। অবশ্য কাউকে যদি পছন্দ হয়।
বাধা সময়ের। অতদিন কি নির্বাচিত পাত্রী বা তার গার্জেনরা অপেক্ষা করবেন?
যদি তারা অপেক্ষা করেন?
যদি কথা দু’এক বছরের জন্য প্রযোজ্য, দীর্ঘ সময়ের জন্য নয়।
সময় যত দীর্ঘ হোক, আমি অপেক্ষা করব।
এটাও আবেগের কথা। তা ছাড়া আপনি করলেও গার্জেনরা করবেন না।
রাফিয়া ছলছল চোখে বলল, গার্জেনদের ব্যাপারটা আমি বুঝবো। আপনি শুধু কথা দিন, আমাকে ভুলে যাবেন না।
কথা দেয়ার আগে আপনার বাবার সঙ্গে আমি দেখা করতে চাই।
এই কথা শুনে রাফিয়ার হার্টবিট বেড়ে গেল। সেই সাথে চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সামলে নিয়ে চোখ মুছে বলল, বেশ তো, এখনই চলুন। আর তো ক্লাশ নেই।
আজ নয়, কাল ভার্সিটি বন্ধ। সকাল নটার সময় যাব, ঠিকানা দিন।
.
হাফিজ উদ্দিন প্রতিদিন সকাল আটটায় নাস্তা খান। আজ নাস্তা খেয়ে নিজস্ব লাইব্রেরিতে একটা সাইকোলজির বই পড়ছিলেন।
রাফিয়া ন’টা বাজার পাঁচ মিনিট আগে এক কাপ চা নিয়ে বাবার কাছে এসে বলল, পড়া বন্ধ করে চা খেয়ে নাও। নচেৎ চা খাওয়ার কথা ভুলে যাবে।
হাফিজ উদ্দিন বই বন্ধ করে বললেন, বস, তোকে অনেক দিন ভালো করে দেখি নি।
রাফিয়া বসে আদুরে গলায় বলল, তোমার সঙ্গে রোজ দেখা হচ্ছে, দেখ নি বলছ কেন?
রোজ দেখা হয় ঠিক, কিন্তু আজকের মতো এত কাছে তো অনেকদিন আসিস নি। জানিস মা, মানুষের মন যে কত বিচিত্র, এই বইটা না পড়লে জানতে পারতাম না। তোকে দেখে কি মনে হচ্ছে জানিস? নিশ্চয় কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছিস। কি, কথাটা ঠিক বলি নি?
রাফিয়া জানে, বাবা একবার কোনো বিষয়ে কথা বলতে শুরু করলে এক দেড় ঘণ্টাতেও শেষ হবে না। শ্রোতার সময় আছে কি না অথবা সে বিরক্ত হচ্ছে কিনা, সেসব খেয়াল করবে না। শ্রোতা কোনো অজুহাত দেখিয়ে চলে যেতে চাইলেও যেতে দেয় না। তাই বাবার কথা শুনে বলল, হ্যাঁ বাবা, তুমি ঠিক বলেছে। আজ ন’টার সময় আমার একজন ক্লাসমেট তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসবে। নটা বাজতে দু’এক মিনিট বাকি। হয়তো এক্ষুনি এসে পড়বে।
হাফিজ উদ্দিন আনন্দিত হয়ে বললেন, তা হলে তো ভালই হল। তার সঙ্গে মানুষের বিচিত্র মনের সম্পর্কে আলাপ করা যাবে। তা হারে, ক্লাশমেট মেয়ে, না ছেলে?
ছেলে। জান বাবা, ছেলেটা ভার্সিটির সেরা ছাত্র।
এমন সময় কাজের বুয়া নাসিরন এসে বলল, একটা ছেলে খালুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। আমি তাকে ড্রইংরুমে বসিয়েছি।
রাফিয়া তাকে চলে যেতে বলে বাবাকে বলল, মনে হচ্ছে, ঐ ছেলেটাই এসেছে। তুমি যাও, আমি একটু পরে আসছি।
হালিম সোফায় বসেছিল। একজন পৌঢ় লোককে পর্দা ঠেলে ঢুকতে দেখে দাঁড়িয়ে সালাম দিল।
হাফিজ উদ্দিন সালামের উত্তর দিয়ে হালিমকে বসতে বলে নিজেও বসলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, তুমিই কি রাফিয়ার ক্লাশমেট?
হালিম বলল, জি।
কি নাম তোমার?
আব্দুল হালিম।
বাবার নাম?
মরহুম সেখ মঈনুদ্দিন।
বাড়ি কোথায়?
পটুয়াখালী জেলার বাহেরচর গ্রামে।
এখানে থাক কোথায়?
সূর্যসেন হলে।
বাড়িতে কে কে আছে?
মা ছাড়া আমার আর কেউ নেই।
তোমার বাবা তা হলে খুব অবস্থাপন্ন লোক ছিলেন?
না, তিনি দিনমজুর ছিলেন।
হাফিজ উদ্দিন অবাক কণ্ঠে বললেন, তা হলে তোমার লেখাপড়ার খরচ জোগাচ্ছে কে?
আল্লাহ।
তা তো বুঝলাম। কিন্তু আল্লাহ নিজে তো কিছু দেন না, কাউকে উপলক্ষ করে দেন। নিশ্চয় তিনি তোমার কোনো আত্মীয়?
না। আমার বাবা মারা যাওয়ার পর মাতব্বরের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে মা গ্রাম ছেড়ে আমাকে নিয়ে যখন পটুয়াখালী শহরে আসেন তখন আমার বয়স সাত বছর। তারপর কিভাবে আবু তাহেরের আশ্রয়ে থেকে লেখাপড়া করছে বলল।
রাফিয়ার সঙ্গে তোমার জানাশোনা কত দিনের?
প্রায় তিন বছর হতে চলল।
মেয়ে এরকম একটা ছেলের সঙ্গে মেলামেশা করে ভেবে হাফিজ উদ্দিন খুব রেগে গেলেন। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে গম্ভীরস্বরে জিজ্ঞেস করলেন, রাফিয়া তোমার পরিচয় জানে?
না।
সে জানতে চায় নি?
চেয়েছেন, আমি বলি নি।
কেন?
আপনার মেয়ে অন্ধের মতো আমাকে ভালবাসেন। পরিচয় জানালে বিশ্বাস করতেন না। ভাবতেন, মিথ্যে পরিচয় দিচ্ছি।
তুমি রাফিয়াকে ভালবাস না?
হ্যাঁ, ভালবাসি।
হাফিজ উদ্দিন আরো রেগে উঠে বললেন, আমি যদি বলি, অর্থ ও সম্পত্তির লোভে বড়লোকের মেয়েকে ভালবাসার ফাঁদে ফেলে বিয়ে করার জন্য তাকে পরিচয় জানাও নি?