প্রথম দিকে তাদের কথা শুনে রাফিয়া খুব রেগে যেত। পরে ইসলামের উপর যত পড়াশোনা করতে লাগল, ততই একদিকে যেমন ইসলামের দিকে আকৃষ্ট হয়ে পড়ল, অপর দিকে তেমনি হালিমকে গভীরভাবে ভালোবেসে ফেলল। এখন তাকে কেউ কিছু বললে রাগে না। বরং তাদেরকে ইসলামের উপর পড়াশোনা করতে বলে হাসিমুখে।
তার হাল হকিকত দেখে একদিন শবনম তাকে বলল, হালিমকে জব্দ করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত সেই তোকে জব্দ করে ফেলল। এরকম যে হবে, তা জানতাম। তাই তোকে আগেই সাবধান করেছিলাম।
রাফিয়া বলল, তোর কথা অস্বীকার করব না। তবে একথা ঠিক, হালিম আমাকে জব্দ করে নি, করেছে ইসলাম। ইসলাম সম্পর্কে পড়াশোনা কর, তা হলে আমার কথা সত্য না মিথ্যা বুঝতে পারবি। তুই জানিস কি না জানি না, একটা দৈনিক পত্রিকায় দেখেছি, আমেরিকার টুইন-টাওয়ার ধ্বংস হওয়ার পর সেখানকার মানুষ ইসলাম সম্পর্কে পড়াশোনা করতে গিয়ে আজ পর্যন্ত সাত চল্লিশ হাজার খ্রিস্টান ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে।
শবনম বলল, তা না হয় বুঝলাম, কিন্তু হালিমের উপর অপমানের প্রতিশোধ নেয়ার পথে কত দূর এগোলি?
রাফিয়া বলল, যারা ইসলামকে জানে ও মানে তাদের মনে প্রতিশোধ নেয়ার ইচ্ছা থাকে না। থাকলেও আল্লাহকে ভয় করে ও তার ভালবাসা পাওয়ার জন্য ক্ষমা করে দেয়। কারণ আল্লাহ ক্ষমাশীল, ক্ষমাকে ভালবাসেন। তাঁর যে বান্দা প্রতিশোধ নেয়ার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও প্রতিপক্ষকে ক্ষমা করে দেয়, আল্লাহ তাকে ভালবাসেন এবং তার অনেক দোষ-ত্রুটি ক্ষমা করে দেন। এটা হাদিসের কথা।
আরে তুই দেখছি পুরোপুরি হুজুর হয়ে গেছিস? এখন হালিম নিশ্চয় তোর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে?
রাফিয়া ছোট্ট একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলল, তোর ধারণা ভুল। সে আমার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে না, বরং আমিই খাচ্ছি।
তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে, হালিম তোকে পাত্তা দিচ্ছে না?
হ্যাঁ, তোর অনুমান ঠিক।
হালিম জানে, তুই তাকে ভালবাসিস?
বুঝতে পারি নি।
সে কিরে? তোর মনের কথা জানাস নি?
হাজার চেষ্টা করেও জানাতে পারি নি।
শবনম অবাক হয়ে বলল, তার সঙ্গে এতদিন মেলামেশা করছিস, জানাতে পারিস নি কেন?
যখনই জানাতে চেয়েছি তখনই জরুরি কাজের কথা বলে কেটে পড়ে।
ওর সম্পূর্ণ পরিচয় জেনেছিস?
না।
জানার চেষ্টা করিস নি?
করেছি, বলে নি।
ও তোকে ভালবাসে কি না বুঝতে পারিস নি?
না।
শবনম আরো অবাক হয়ে বলল, তোর মতো মেয়ে একটা ছেলের কাছে হেরে যাবি ভাবতেই পারছি না। আমার কি মনে হয় জানিস, কোনো মেয়ের কাছ থেকে ছ্যাক খেয়েছে। তাই তোকে পাত্তা দিচ্ছেন না।
কি জানি, তোর কথা হয়তো ঠিক। তবে আমিও দেখে নেব কি কারণে আমাকে পাত্তা দিচ্ছে না।
আমার কথা শোন, তুই আর ওর সঙ্গে মেলামেশা করিস না।
তুই বলার আগেই চেষ্টা করেছি কিন্তু পারি নি। লোহা যেমন চুম্বককে আকর্ষণ করে হালিমও তেমনি আমাকে আকর্ষণ করে। এবার ওর কথা রেখে ক্লাসে যাই চল।
.
কয়েকদিন পর সুযোগ পেয়ে রাফিয়া হালিমকে বলল, অনেক দিন থেকে আপনাকে একটা কথা বলব বলব করেও বলা হয় নি। এখন বলি?
হালিম বলল, এতদিন যখন বলা হয় নি তখন আর বলার প্রয়োজন নেই।
কিন্তু কথাটা যে আমাকে বলতেই হবে।
যা বলতে চান, তা আমি জানি।
হালিমের কথা শুনে রাফিয়ার মন আনন্দে ছলকে উঠল। বলল, কই, বলুন তো শুনি।
আপনি আমাকে ভীষণ ভালোবেসে ফেলেছেন।
রাফিয়া আনন্দে আপ্লুত হয়ে কিছুক্ষণ কথা বলতে পারল না। একদৃষ্টে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। অল্পক্ষণের মধ্যে চোখ দুটোতে পানি ছল ছল করতে লাগল।
তা লক্ষ্য করে হালিম বলল, কি? কথাটা ঠিক বলি নি?
রাফিয়া তার কথার উত্তর না দিয়ে চোখ মুছে বলল, আপনি আমাকে ভালবাসেন না?
হালিমও তার কথার উত্তর না দিয়ে বলল, আমাকে ভালবেসে বিরাট ভুল করেছেন।
যত বিরাট ভুল করি না কেন, সেটা আমার ব্যাপার। আমাকে ভালবাসেন কিনা বলুন।
ভালবাসা খুব পবিত্র জিনিস। মুখের কথায় তা প্রকাশ করা উচিত নয়। ওটা অন্তরের ব্যাপার। কারো অন্তর যদি পবিত্র হয়, তা হলে তার ভালবাসা মূল্যবান। মুখে যারা ভালবাসার কথা বলে তাদের অন্তরে সেই পবিত্রতা নেই।
কিন্তু অন্তরের কথা প্রকাশ করার জন্য আল্লাহ মানুষকে মুখ ও ভাষা দিয়েছেন।
আপনার কথা ঠিক হলেও ভালবাসার ক্ষেত্রে নয়। কারণ ভালবাসার কথা মুখে প্রকাশ করলে ভালবাসা খুব সস্তা হয়ে যায়। মূল্যবান আর থাকে না।
রাফিয়া তার কথা শুনে সন্তুষ্ট হতে না পারলেও বুঝতে পারল, হালিম তাকে অন্তর থেকে ভালবাসে। কি বলবে না বলবে ভেবে ঠিক করতে না পেরে চুপ করে রইল।
বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে হালিম বলল, আমার কথা শুনে আপনি যে সন্তুষ্ট হতে পারেন নি, তা আমি বুঝতে পারছি। শুনুন, আমি আপনার ভালো চাই। তাই বলব, যে পথে এগিয়েছেন, তা খুব দুর্গম। ফিরে গেলে ভবিষ্যৎ জীবন সুখের হবে। আর এটাই আমার কাম্য।
আর আমি যদি বলি যতই দুর্গম হোক, আপনার কাছে পৌঁছানোর জন্য আজীবন সেই পথ পাড়ি দেব এবং আশা করি, ইনশাআল্লাহ একদিন কামিয়াবও হব।
এরকম সিদ্ধান্ত নেয়া আপনার উচিত হয় নি। কারণ আমার পরিচয় আপনি জানেন না।
অনেকবার জানতে চেয়েছি, আপনি এড়িয়ে গেছেন।
হ্যাঁ, এড়িয়ে গেছি। কারণ আমার দেয়ার মতো কোনো পরিচয় নেই।