রহিমন বিবি প্রায় দিনই সায়রার কাছে আসে। সায়রা তাকে দাদি বলে ডাকে। রহিমন বিবি মাতব্বরের প্রথম বৌ ছাড়া তিন বৌয়ের ঘটকালি করেছে। আজ শাকিল মাকে যখন টাকাটা দিয়ে মাতব্বরের কথা বলল তখন রহিমন বিবি বলল, মাতব্বরের এত বয়স হল, তিন-তিনটে বৌও রয়েছে, তবু বিয়ে করার সখ গেল না।
শাকিল বলল, যাদের টাকা আছে তাদের সখও আছে।
করিম সেখের তো টাকা আছে, কই, সেতো মাতব্বরের মতো চার পাঁচটি বিয়ে করে নি? আসলে মাতব্বর তোক ভালো না।
মাতব্বর ভালো না মন্দ সে কথা ভাবতে হবে না। তোমাকে যে কাজের ভার দিয়েছেন তা করতে পারলে বেশ কিছু টাকা পাওয়া যাবে। তুমি আজই প্রস্তাবটা সায়রার কাছে দিবে।
সায়রা করিম সেখের ঘর থেকে বেলা তিনটের দিকে ভাত নিয়ে ঘরে এসে দেখল, হালিম ঘুমিয়ে পড়েছে। তাকে জাগিয়ে মায়ে পুতে খেতে বসল।
এমন সময় রহিমন বিবি এসে বলল, কাজ সেরে এখন এলি বুঝি?
সায়রা বলল, হ্যাঁ দাদি, করিম চাচার সংসারে কত মানুষ তাতো জান। খাওয়ার পর অত লোকের হাঁড়ি থালা-বাসন ধুয়ে রেখে তারপর এলাম। ছেলেটা ভুখের চোটে ঘুমিয়ে পড়েছিল।
কি আর করবিরে বুন, সব কপালের লিখন। অমন তরতাজা মঈনকে আল্লাহ তুলে নেবে ভাবতেই পারি নি।
সায়রা বলল, ওসব কথা থাক দাদি, এমন অসময়ে এলে যে?
রহিমন বিবি বলল, তোকে একটা কথা বলতে এলাম, কথাটা ভেবে চিন্তে উত্তর দিবি।
পাতের ভাত কমে গেছে দেখে সায়রা ছেলেকে খেতে বলে হাত মুখ ধুয়ে বলল, কি কথা দাদি?
তোর কাঁচা বয়স, স্বাস্থ্য ভালো, বাকি জীবনটা কিভাবে কাটাবি ভেবেছিস?
সায়রা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, ভেবে আর কি করব? আল্লাহ কপালে যা রেখেছে তাই হবে।
তাতো হবে, কিন্তু লোকের বাড়ি কাজ করে কতদিন চলবি? পাকাপাকি কিছু একটা করাই তো ভালো।
পাকাপাকি করার কথা কি বলছ বুঝতে পারছি না।
বলছি নিকে কর। তা হলে পরের ঘরে কাজ করতে হবে না। ছেলেটাও খেয়ে পরে মানুষ হবে। তা না হলে তুইও যেমন শান্তি পাবি না। তেমনি ছেলেটাও কষ্ট, পাবে। তা ছাড়া গ্রামের ছেলে ছোকরারা তোকে জ্বালাতন করবে। কতদিন তাদের হাত থেকে বাঁচতে পারবি?
সায়রা এই চার মাসের মধ্যে বুঝতে পেরেছে গহীন রাতে করা যেন তার ঘরের চারপাশে চলাফেরা করে। ভয়ে মাথার কাছে বড় হেসো রেখে সারারাত একরকম জেগেই থাকে। একবার ভেবেছিল, ভাই ভাবির কাছে চলে যাবে; কিন্তু তাদের সংসারের দুরবস্থার কথা চিন্তা করে যায় নি। এখন রহিমন দাদির কথা শুনে বলল তোমার কথাগুলো আমিও চিন্তা করেছি। কিন্তু কি কবর ভেবে পাইনি। গ্রামের কেউ কি আমাকে নিকে করতে চাইবে? আর চাইলেও ছেলেটার কি হবে?
রহিমন বিবি বলল, তোর মতো মেয়ের নিকের বরের অভাব আছে নাকি গ্রামে? ছেলেকে নিয়েই তোকে নিকে করার জন্য কতলোক হাঁ করে রয়েছে। মাতব্বর তো তোকে নিকে করার জন্য এক পা। আমি বলি কি সবার থেকে মাতব্বরের ঘরে গেলে তুই সবদিক দিয়ে সুখী হবি। মাতব্বর তোকে রাজরানী করে রাখবে। আর ছেলেটাও মানুষ হবে।
সায়রা বলল, তা আমি জানি দাদি। কিন্তু মাতব্বরের বয়স আমার বাপের বয়সের চেয়ে বেশি। তাকে আমি বাপের মতো মনে করি, তুমিই বলো, তাকে কি নিকে করতে পারি?
বাপের মতো মনে করলে তো বাপ হয়ে যায় না। আর বয়সের কথা যে বললি, পুরুষদের আবার বয়স আছে নাকি? একশ বছরের বুড়োও বিশ বছরের ছুঁড়িকে বিয়ে করছে। ওসব কথা বাদ দিয়ে তুই রাজি হয়ে যা। তারপর কাপড় থেকে তিনশ টাকা বের করে তার হাতে দিয়ে বলল, তোর কষ্ট দেখে মাতব্বর আমাকে দিয়ে পাঠিয়েছে।
সায়রা টাকাটা ফেরত দিয়ে বলল, এটা তাকে ফিরিয়ে দিও। যাকে বাপের মতো মনে করি, জান গেলেও তাকে নিকে করতে পারব না। অন্য কেউ হলে ভেবে দেখতাম।
কিন্তু মাতব্বর কি স্বভাবের লোক তুই তো জানিস না। এই গ্রামে বৌ হয়ে এসেছি আজ পঞ্চাশ বছর হয়ে গেল। সেই থেকে তার স্বভাব চরিত্র জানি। যে মেয়ে একবার তার নজরে ধরবে তাকে ভোগ না করে ছাড়ে না। এখনো সেই স্বভাব যায় নি। তুই তার নজরে পড়েছিস। অন্য কারো সঙ্গে নিকে বসতে দেবে না। আর গ্রামে এমন কেউ নেই, তার মতের বিরুদ্ধে তোকে নিকে করবে। তাই বলছি মাতব্বরের হাত থেকে বেশি দিন ইজ্জৎ বাঁচিয়ে রাখতে পারবি না। ইজ্জত বাঁচাতে হলে তাকে নিকে করা ছাড়া অন্য কোনো রাস্তা নেই।
সায়রা বলল, দশ বছর এই গ্রামে এসেছি। হালিমের বাপের মুখে মাতব্বরের স্বভাবের কথা শুনেছি। তা ছাড়া হালিমের বাপ মারা যাওয়ার পর টাকা দিয়ে আমার ইজ্জৎ লুটতে চেয়েছিল। রাজি হয় নি বলে এবার বিয়ে করতে চাচ্ছে। তার মতলব আমি বুঝি। তোমাকে বলে রাখি দাদি, আমি এই লম্পট মাতব্বরকে কিছুতেই নিকে করব না। তাতে যদি আমার জান যায় অথবা গ্রাম ছাড়তে হয়, তাতেও রাজি।
রহিমন বিবি টাকাগুলো গেট কাপড়ে রেখে বলল, গ্রামের পাঁচটা বৌ বেটির চেয়ে তোকে বেশি ভালোবাসি। তাই তোর ভালোর জন্য বলছি, মাতব্বরের কথা মেনে নে। নচেৎ টাকা ফেরত দিয়েছিস জেনে কি করবে কি জানি। এবার আসিলো বুন। চলে যাওয়ার আগে বলল, আমার কথাটা ভেবে দেখিস।
সায়রাও সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, শুনে যাও দাদি, আমার ভাববার কিছু নেই। জান গেলেও আমি মাতব্বরকে নিকে করব না।