হালিমের সৎসাহস ও লড়াই এর কলাকৌশল দেখে রাফিয়া মুগ্ধ হয়েছিল। সে গুলি খেয়েছে শোনার পর থেকে খুব দুশ্চিন্তায় ভুগছিল। প্রতিশোধ নেয়ার কথাও ভুলে গেছে। ছোট ভাইয়ার কথা শুনে বলল, হ্যাঁ, ওনার চিকিৎসার সব খরচ আমাদেরই দেয়া উচিত। বিকেলে আমিও তোমার সঙ্গে আসব।
বেশতো আসবি।
ওনার সম্পর্কে আর কিছু জানিস?
না, ক্লাসমেট হিসাবে চিনতাম। গতকাল কিছুক্ষণ আলাপ করে বুঝতে পারলাম, ধর্মঘেঁষা ও গোঁড়া টাইপের ছেলে।
বাড়ি কোথায় জানিস না?
না। আশফাক আর কিছু না বলে চুপ করে রইল।
.
বিকেলে ওরা মেডিকেলে এসে দেখল, হালিম বালিশে হেলান দিয়ে বেডের উপর বসে আছে। কাছে এসে আশফাক সালাম দিয়ে বলল, কেমন আছেন?
আশফাক একা এলে হালিমের চিনতে হয়তো একটু দেরি হত। রাফিয়া সঙ্গে থাকায় চিনতে দেরি হল না। সালামের উত্তর দিয়ে বলল, আল্লাহর রহমতে ভালো।
ওবেলা মেডিকেল থেকে ফেরার সময় রাফিয়া দেখতে আসার কথা বললেও বাসায় এসে চিন্তা করল, গতকাল যাকে যা তা বলে অপমান করেছে তাকে দেখতে যাওয়া ঠিক হবে না। তাই আশফাক যখন সাড়ে চারটের সময় তাকে বলল, কইরে, তুই এখনও রেডি হস নি? মেডিকেলে যাবি যে? তখন ছোট ভাইয়া কিছু মনে করতে পারে ভেবে অনিচ্ছা সত্ত্বেও এসেছে। রেডের কাছে এসে হালিমের দিকে একবার তাকিয়ে মাথা নিচু করে রয়েছে।
হালিম বুঝতে পেরে রাফিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলল, দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বেডের নিচে টুল আছে, টেনে বসুন। তারপর আশফাককে বলল, আপনি বেড়েই বসুন।
আশফাক রাফিয়ার মুখে লজ্জার আভা দেখে একটা কিছু আন্দাজ করে টুলটা টেনে বলল, বস। তারপর বেডের উপর হালিমের পাশে বসে তার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনার এরকম অবস্থার জন্য আমিই দায়ী। গুলিটা যদি বুকে বা মাথায় লাগত, তা হলে কি হত ভেবে খুব খারাপ লাগছে।
হালিম বলল, ঘটনাটা আপনাকে উপলক্ষ করে ঘটে থাকলেও নিজেকে দায়ী ভাবছেন কেন? আমি যা কর্তব্য তাই করেছি। কর্তব্য পালন করার জন্য ঝুঁকিতে নিতেই হবে। আজ মানুষ কর্তব্যজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। তাই সমাজে যেমন অশান্তি তেমনি সন্ত্রাসীরাও বেপরওয়া হয়ে উঠেছে।
আশফাক বলল, আপনি খুব খাঁটি কথা বলেছেন। তারপর বলল, রাফিয়া আমার ছোট বোন। ঐ বলেছে আপনি ওর ক্লাসমেট। সুস্থ হওয়ার পর একদিন ওর সঙ্গে বাসায় আসবেন।
হালিম কিছু না বলে চুপ করে রইল।
আশফাক রাফিয়াকে বলল, তুই একদিন ওনাকে বাসায় নিয়ে আসবি।
রাফিয়া মুখে না বলে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।
আশফাক তাকে মাথা নিচু করে বসে থাকতে দেখে চিন্তা করল, যে রাফিয়া প্রগলভ ও চঞ্চল হরিণীর মতো, সে কেন ওভাবে বসে রয়েছে? তা হলে কি তার অনুমান ঠিক। অনুমানটা ঠিক কিনা জানার জন্য তাকে বলল, তুই ওনার সঙ্গে কথা বল, আমি একটু আসছি। কথা শেষ করে বেরিয়ে গেল।
রাফিয়া হালিমের দিকে তাকাতে চোখে চোখ পড়ে গেল। দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে বলল, গতকালের ঘটনার জন্য দুঃখিত। সেজন্যে ক্ষমা চাইছি।
হালিম বলল, ক্ষমা চাওয়ার দরকার নেই। আমি কিছু মনে করি নি। প্রত্যেকের নিজস্ব মতামত প্রকাশ করার অধিকার আছে। আমি আমারটা বলেছি, আপনি আপনারটা বলেছেন। এতে কারো অপরাধ হয় নি।
তবু বলুন ক্ষমা করেছেন?
দেখুন, আমার মতো আপনি কোনো অপরাধ করেন নি। শুধু শুধু ক্ষমা চেয়ে নিজেকে ছোট করছেন কেন? ক্ষমা চাইলে আল্লাহর কাছে চান। কারণ তাঁকে না চিনে ও তাঁর বাণীকে না জেনে অপরাধ করেছেন।
রাফিয়া কি বলবে ভেবে না পেয়ে চুপ করে রইল।
হালিম আবার বলল, কি জানেন, আমরা লেখাপড়া করে নিজেদেরকে খুব জ্ঞানী মনে করি। তাই অন্য কেউ যদি আমাদেরকে অজানা ভালো কথাও বলে, তা আমরা গ্রহণ করি না। এটা আমাদের অহমিকা। আসলে অল্প জ্ঞানীরাই জ্ঞানের অহঙ্কার করে। অথচ বড় বড় মনীষীদের জীবনী পড়লে জানা যায়। ওঁনারা নিজেদের জ্ঞানকে সমুদ্রের কয়েক ফোঁটা পানির সঙ্গে তুলনা করেছেন। জানেন কিনা জানি না, সমুদ্রের তবু সীমানা আছে; কিন্তু জ্ঞান সমুদ্রের কোনো সীমানা নেই। কুয়ার ব্যাঙ যেমন মনে করে কুয়ার থেকে বড় জলাশয় নেই, তেমনি অধিকাংশ শিক্ষিত লোক মনে করেন তার থেকে বড় জ্ঞানী কেউ নেই। থাক এসব কথা, আপনি হয়তো বিরক্ত হচ্ছেন। এবার আপনি কিছু বলুন।
মেডিকেলে আসার আগে রাফিয়া সেজেগুঁজে ড্রেসিং টেবিলে আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে বুঝতে পেরেছিল, কেন তরুণ, যুবক ও বৃদ্ধরা তাদের মতো মেয়েদের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে? কেন ছেলেরা প্রেম নিবেদন করতে আসে? কেন শিক্ষিত, অশিক্ষিত ও বখাটে ছেলেরা ধরে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে? তখন তার মন বলেছিল, হালিম তাকে ঐসব থেকে রক্ষা করার জন্য বড় ওড়না দিয়ে মাথাসহ গোটা শরীর ঢেকে ক্লাশ করতে যেতে বলেছে। তাই মেডিকেলে আসার সময় মাথায় কিছু না দিলেও ওড়না দিয়ে সারা শরীর ঢেকে এসেছে। এখন হালিমের কথা শুনে খুব ভালো লাগল। সে কিছু বলতে বললে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, না, বিরক্ত হয় নি। একটা অনুরোধ করব, রাখবেন?
বলুন, রাখার মতো হলে নিশ্চয় রাখব।
আমি আপনার বন্ধু হতে চাই।
এই অনুরোধ রাখতে পারব না। প্লীজ, কথাটা ফিরিয়ে নিন।