রাফিয়া দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে লাইব্রেরিয়ানের কাছ থেকে বই নিল। তারপর গেটের দিকে এগোল। কিন্তু মনের অজান্তে হালিমের টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল।
হালিম একমনে নোট করছিল। হঠাৎ সামনে তাকিয়ে রাফিয়াকে দেখে বেশ অবাক হল। কারণ আজ দেড় বছরের মধ্যে তাকে এত কাছে আসতে দেখে নি। মৃদু হেসে বলল, কিছু বলবেন?
রাফিয়া মুখে কিছু না বলে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল।
তা হলে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বসুন।
রফিয়া বসে বলল, ডিস্টার্ব করলাম বোধ হয়?
না, ডিস্টার্ব কিসের? এক মিনিট অপেক্ষা করুন বলে হালিম লেখাটা শেষ করে বলল, এখানে আলাপ করা ঠিক হবে না। বাইরে গিয়ে কোথাও বসি চলুন। তারপর দু’জনে লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে এসে নিরিবিলি জায়গায় বসে হালিম বলল, এবার বলুন।
রাফিয়া বলল, আপনাকে একাকি পাওয়াই যায় না। লাইব্রেরিতে বই নিতে এসে আপনাকে দেখে আলাপ করতে এসেছিলাম।
কিন্তু আমার সঙ্গে আলাপ করতে হলে একটা শর্ত আছে।
শর্তটা কি শুধু আমার জন্য, না সবার জন্য?
ছেলেদের জন্য নয়, শুধু মেয়েদের জন্য।
কিন্তু আমি তো আপনাকে ছেলে-মেয়ে সবার সঙ্গে আলাপ করতে দেখেছি?
আপনার কথা ঠিক; তবে কি জানেন, কোনো মেয়ে একাকি আলাপ করতে চাইলে তাকেই শুধু শর্তের কথা বলি।
সে রকম কেউ এসেছিল না কি?
হ্যাঁ, অনেকেই এসেছে। শর্ত শুনে গালাগালি করে ফিরে গেছে।
রাফিয়া অবাক হয়ে বলল, শর্তটা বলুন তো শুনি।
হালিম মৃদু হেসে বলল, আপনারও গলাগালি করতে খুব ইচ্ছা করছে বুঝি?
না, শর্তটা জানতে খুবই ইচ্ছা করছে।
আমি সিওর, শর্তটা শুনলে আপনিও গালাগালি করবেন।
রাফিয়া চিন্তা করল, নিশ্চয় শর্তটা খুব অশালীন। তাই মেয়েরা শুনে গালাগালি করেছে। তবু কতটা অশালীন জানার জন্য বলল, কথা দিচ্ছি, গালাগালি করব না।
তা হলে আজ শুধু শর্তটা বলি। আলাপ অন্য দিন করা যাবে। শর্তটি হল, কাল থেকে আপনি একটা বড় ওড়না দিয়ে মাথাসহ সারা শরীর ঢেকে ক্লাশ করতে আসবেন। যে সব মেয়েরা আপনার মতো পোশাক পরে তাদের সঙ্গে আমি আলাপ করি না।
শর্ত শুনে রাফিয়া রাগের ছোটে দাঁড়িয়ে পড়ল আর মুখটা লাল হয়ে উঠল। ননসেন্স, অভদ্র, ছোটলোক বলতে যাচ্ছিল, ঠোঁট কামড়ে সামলাবার চেষ্টা করল।
হালিম বলল, প্লীজ বসুন। নচেৎ ভাববো, কথা দিয়েছেন বলে মুখ ফুটে গালাগালি না করলেও মনে মনে করছেন।
রাফিয়া বসল না। খুব রাগের সঙ্গে বলল, কেন, এই পোশাক কি খুবই অশালীন?
হালিম তার রাগকে পাত্তা না দিয়ে বলল, তা বলব না, তবে এই পোশাকে যুবতী মেয়েদের দেখলে মনে হয়, তারা যেন যৌবন দেখিয়ে ছেলেদের মন আকর্ষণ করছে। আবার কোনো ছেলে যদি আকর্ষিত হয়ে তাদের কাছে গিয়ে কিছু বলে, তা হলে পায়ের জুতো খুলে অথবা মুখের ভাষায় পুরস্কৃত করে ছাড়ে।
রাফিয়া আর রাগ সামলাতে পারল না। বলল, সত্যিই আপনি একটা অদ্র, ইতর ও ছোটলোক। পায়ের জুতো খুলে আপনাকেও পিটিয়ে পুরস্কৃত করার ইচ্ছা করছে।
হালিম হাসিমুখে বলল, ইচ্ছে যখন করছে তখন পুরস্কৃত করুন বাধা দেব না।
তাকে হাসতে দেখে ও তার কথা শুনে রফিয়া এত রেগে গেল যে, তার মনে হল জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে। রাগে ফুলতে ফুলতে ব্লডি, ননসেন্স, ফুল বলে হনহন করে সেখান থেকে চলে গেল।
শবনম ওকে খুঁজতে লাইব্রেরিতে যাচ্ছিল। দেখতে পেয়ে বলল, কি রে, তোর কি হয়েছে? খুব রেগে রয়েছিস মনে হচ্ছে?
রাফিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে রাগ সামলাল। তারপর ঘটনাটা বলে বলল, ওযে এত অভদ্র ও ইতর ভাবতেই পারি নি। ওর মোল্লাগিরি না ছাড়িয়েছি তো আমার নাম রাফিয়া না। ও শুধু আমাকে অপমান করে নি, যারা আলাপ করতে গেছে সবাইকে করেছে। ওকে এমন শিক্ষা দেব, জীবনে আর কখনো কোনো মেয়েকে অপমান করার সাহস পাবে না। তারপর কি করবে না করবে বলল।
শবনম ক্রুর হেসে বলল, হ্যাঁ, এটাই ওর উপযুক্ত শাস্তি। কিন্তু তুই কি কাজটা করতে পারবি?
রাফিয়া দৃঢ়স্বরে বলল, পারব না মানে, একশবার পারব। তোকে যা বললাম, তুই শুধু সেই কাজটা করবি।
শবনম বলল, তাতো করবই। এখন বাসায় চল যাই।
.
পরের দিন ছুটি থাকায় রাফিয়া ছোট ভাইয়া আশফাকের সঙ্গে কেনাকাটা করতে মার্কেটে গিয়েছিল। মার্কেট থেকে বেরিয়ে গাড়ির কাছে আসার সময় দেখল, তাদের গাড়ির কাছে তিনটে ছেলে রিকশা থেকে নেমে মার্কেটের দিকে যাচ্ছে। রিকশাওয়ালা ভাড়া চাইতে তাদের একজন ফিরে এসে তার গালে প্রচণ্ড একটা চড় মেরে বলল, এটাই তোর ভাড়া।
রিকশাওয়ালা ছোকরা বয়সী। আজ দুতিন বছর রিকশা চালাচ্ছে। এরকম ব্যবহার কারো কাছ থেকে পায় নি। চড় খেয়ে তার দু’চোখে পানি এসে গেছে। হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছে বলল, আপনারা ভদ্রলোক হয়ে ভাড়া চাইতে মারলেন?
ছেলেটা বলল, তোর ভাগ্য ভালো টাকা পয়সা কোড়ে না নিয়ে একটা চড় মেরেছি।
ততক্ষণে রাফিয়া ও আশফাক গাড়ির কাছে চলে এসেছে।
রিকশাওয়ালা গালে হাত বুলোতে বুলোতে আশফাককে উদ্দেশ্য করে বলল, দেখেছেন ভাই, ওনারা প্রায় দু’ঘণ্টা আমার রিকশায় চেপে ভাড়া না দিয়ে চলে যাচ্ছিলেন, ভাড়া চাইতে আমাকে মারলেন।
আশফাক টগবগে যুবক। বছর দুই আগে মাস্টার্স কমপ্লিট করে ভালো বেতনের চাকরি করছে। রিকশাওয়ালা বলার আগে ঘটনাটা দেখে রেগে ছিল। এখন রিকশাওয়ালার কথা শুনে আরো রেগে গিয়ে ছেলেটাকে বলল, ওর ভাড়া দিয়ে মারলেন কেন?