হালিম খুব ধীর ও নম্র স্বভাবের ছেলে। প্রয়োজন ছাড়া যেচে কারো সঙ্গে কথা বলে না। মেয়েদেরকে খুব এড়িয়ে চলে। তা সত্ত্বেও সেকেন্ড ইয়ারে যখন ছেলেমেয়েরা নানান অজুহাতে তার কাছে আসতে লাগল তখন বিরক্ত বোধ করলেও তাদের সঙ্গে আলাপ করে। যারা নোট চায়, তাদেরকে নোট দেয়। কিন্তু কাউকেই যেমন ঘনিষ্ঠ হতে দেয় নি, তেমনি নিজেও কারো সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয় নি।
মেয়েদের মধ্যে রাফিয়া বড় লোকের সুন্দরী কন্যা ও ভালো ছাত্রী। হালিম তার নজর কাড়লেও ধারে কাছে যায় নি। এমনকি পরিচয়ও করে নি।
ফার্স্ট ইয়ারে যে সব সহপাঠিরা নোট নেয়ার জন্য ও বন্ধুত্ব করার জন্য রাফিয়ার কাছে ভীড় করত, তাদের বেশিরভাগ ছেলে মেয়ে এখন হালিমের কাছে ভীড় করে। এজন্যে সে হালিমকে খুব ঈর্ষা করে।
একদিন রাফিয়া ঘনিষ্ঠ বান্ধবী শবনমকে বলল, কিরে, সবাই হালিমের কাছে নোট দিতে যায়, তুই যাস নি?
শবনম তার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে বলল, না যাই নি।
কেন বলতো?
আমি তো তোর কাছে নোট নিই। তা ছাড়া মোল্লা টাইপ ছেলেদের আমি মোটেই পছন্দ করি না। দেখলে গা রি-রি করে।
রাফিয়া হেসে উঠে বলল, কেন রে, মোল্লারা কি তোর কোনো ক্ষতি করেছে?
আমার না করলেও অন্যের করেছে। কেন, তুই কি জানিস না, মুক্তিযুদ্ধের সময় মোল্লারা পাক বাহিনীকে সাহায্য করেছিল, মুক্তিবাহিনীর খোঁজ দিয়েছিল, পাক বাহিনীর লিডারদের খুশী করার জন্য মেয়ে যোগাড় করে দিয়েছে?
তোর কথা অস্বীকার করব না। তবে তুইও বোধ হয় জানিস না, সব মোল্লারা পাক বাহিনীকে সাহায্য সহযোগিতা করে নি। বরং মুক্তি বাহিনীকে টাকা পয়সা ও আশ্রয় দিয়ে সাহায্য করেছে। আবার অনেক মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। তাদের অনেকে কমান্ডিংও করেছেন। আসল কথা কি জানিস, সব মানুষ যেমন এক রকম হয় না, তেমনি সব মোল্লারাও খারাপ নয়। ভালো মন্দ সব মানুষের মধ্যে আগের যুগেও ছিল এযুগেও আছে এবং ভবিষ্যৎ যুগেও থাকবে। এ কথা তুই জানিস কিনা জানি না। মোল্লারাই কিন্তু আল্লাহকে ভয় করে ধর্মের বিধি-বিধান মেনে চলে। তারা কারো এতটুকু ক্ষতি করে না। এমন কি যে কোনো অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকে।
শবনম রেগে উঠে বলল, তুই ঘোড়ার ডিম জানিস। দাদির কাছে শুনেছি। তাদের গ্রামের মাতব্বর দাড়ি রেখে মাথায় টুপি দিয়ে নানান অপকীর্তি করে বেড়াত। ঘরে চারটে স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও গরিব ঘরের মেয়েদের ইজ্জৎ নষ্ট করত। এদিকে আবার নামায রোযাও ঠিকমতই করত।
রাফিয়া আবার হেসে উঠে বলল, দু’একজন মোল্লা খারাপ বলে সব মোল্লাই যে খারাপ, তা ভাবা ঠিক নয়। আমিও নানির কাছে শুনেছি, আগেকার পুরুষদের শক্তি সামর্থ যেমন বেশি ছিল, তেমনি সেক্সও বেশি ছিল। যারা সেক্সি ছিল, তারা একাধিক বিয়ে করত। শুধু পুরুষদের নয়, মেয়েদেরও ছিল। তারা স্বামীর কাছে তৃপ্তি না পেলে অবৈধ পন্থায় সেক্স মেটাত। আকজালও যে এরকম নেই তা নয়। কি গ্রামে কি শহরে খোঁজ নিলে জানতে পারবি। পেপারে পড়িস নি, দু’তিন ছেলেমেয়ের মা অন্যের সঙ্গে প্রেম করে পালিয়ে যাচ্ছে। এর কারণ অনুসন্ধান করলে জানা যাবে, ঐ মেয়েটি স্বামীর। কাছে থেকে সেক্সের ব্যাপারে তৃপ্তি পায় নি।
গ্রামের থেকে শহরের শিক্ষিত পুরুষরা ঘরে স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন ক্লাবে বা নিষিদ্ধ পল্লীতে গিয়ে সেক্স মেটাচ্ছে। তুলনামূলকভাবে দেখলে অন্যদের চেয়ে মোল্লারা অনেক ভালো। তারা সেক্স মেটাবার জন্য অবৈধ পথে না গিয়ে একাধিক বিয়ে করে।
তুই এসব জানলি কি করে? এগুলোও কি তোর নানির কাছে শুনেছিস?
হ্যাঁ, তুই ঠিক বলেছিস। উনি পুরুষ ও নারী সম্পর্কে আরো এমন অনেক কথা বলেছেন, যা শুনলে তোর বিশ্বাসই হবে না।
নাই বিশ্বাস হোক, তবু তুই বল।
ওরা অফ পিরিয়ডে বারান্দায় এককোণে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। রাফিয়া ঘড়ি দেখে বলল, অন্য দিন বলব। এখন সময় হয়ে গেছে ক্লাসে যাই চল।
ক্লাসে যেতে যেতে শবনম বলল, তুই তা হলে মোল্লাদের পছন্দ করিস?
রাফিয়া অবজ্ঞা স্বরে বলল, আরে দূর, তোর মতো আমিও ওদেরকে একদম পছন্দ করি না।
তবে তুই যে এতক্ষণ ওদের ফরে কথা বললি?
ওগুলো নানির কাছে শোনা কথা, আমার নয়।
তাই বল, আমি তো মনে করেছি, হালিম মোল্লা বলে মোল্লাদের ফরে বললি।
রাফিয়া দাঁড়িয়ে পড়ে চোখ পাকিয়ে বলল, হালিমের কথা বললি কেন তোকে বলতে হবে।
কথাটা হঠাৎ মনে হল, তাই বললাম, কিন্তু তোর রাগ দেখে মনে হচ্ছে, দেয়ার ইজ সামথিং হ্যাঁজ?
তুই কিন্তু সত্যিই খুব বাড়াবাড়ি করছিস।
আমি বাড়াবাড়ি করি নি। করছিস তুই। কথাটা হঠাৎ মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। কথাটা সিরিয়াসভাবে নিচ্ছিস কেন? তারপর স্যারকে ক্লাসে ঢুকতে দেখে বলল, চল যাই।
.
একদিন রাফিয়া একটা বই নেয়ার জন্য লাইব্রেরিতে ঢুকে দেখল, হালিম এক কোণের টেবিলে বসে নোট করছে। সে মোল্লা ও তার থেকে ভালো ছাত্র বলে ঈর্ষায় তাকে সব সময় এড়িয়ে চলে। এমন কি তার দিকে ভালো করে তাকিয়েও দেখে নি। কিন্তু আজ তার দিক থেকে দৃষ্টি ফেরাতে পারল না। তার আজ প্রথম মনে হল, এত সুন্দর ছেলে জীবনে দেখে নি। হঠাৎ তার মন বলে উঠল, যাকে তুই অপছন্দ করিস, ঈর্ষা করিস, তার দিকে ঐভাবে তাকিয়ে কি দেখছিস? কেউ দেখে ফেললে কি ভাববে?