সায়রা ছোটবেলা থেকে সুন্দরী। পনের ষোল বছর বয়সে বিয়ে হওয়ার পর আরো সুন্দরী হয়ে ওঠে। বিয়ের দু’বছরের মধ্যে হালিম জন্মাবার পর ও সংসারের অভাব অনটের জন্য চেহারার জৌলুস কমে গিয়েছিল। আবু তাহেরে বাড়িতে ভালো খেয়ে ভালো পরে ও নিশ্চিতে থাকার ফলে বছর খানেকের মধ্যে তার চেহারার জৌলুস অনেক বেড়ে গেল। এখন তার বয়স পাঁচিশ ছাব্বিশের মতো। কিন্তু অচেনা কেউ দেখলে মনে করবে এখনও তার বিয়ে হয় নি।
সবকিছু দেখে শুনে ফারযানা বেগম একদিন স্বামীকে বললেন, সায়রার আবার বিয়ে দেয়া উচিত। কতই বা বয়স? আজকাল ওর বয়সেই মেয়েদের বিয়ে হচ্ছে।
আবু তাহের বললেন, আমার মনের কথা আল্লাহ তোমার মুখ দিয়ে বলালেন। কথাটা আমিও তোমাকে বলব বলব করেও বলা হয় নি। তুমি ওকে বলে দেখ কি বলে। হালিম আমাদের কাছেই থাকবে। ওকে মস্ত বড় আলেম করার ইচ্ছা করেছি, বাকি আল্লাহর মর্জি।
ফারযানা বেগম একদিন সায়রাকে স্বামীর ইচ্ছার কথা জানিয়ে বললেন, আমারও তাই ইচ্ছা। আমাদের ভুল বুঝবি না। আমরা তোর ভালোর জন্য কথাটা বললাম, নিজের পেটের মেয়ে হলেও তাই করতাম।
সায়রা কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে রইল। তারপর চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলল, কোনো কারণেই আমি আপনাদের ভুল বুঝব না। আপনারা যে আমার ভালো চান, তা জানি। কিন্তু আম্মা কিছুতেই আমি আর বিয়ে করব না। আপনারা আশ্রয় দিয়ে যে উপকার করেছেন, সারাজীবন আপনাদের সেবা যত্ন করলেও তার। প্রতিদান হবে না। তবু আজীবন তাই করে যাব। এখানে আসার পর হালিমকে। নিয়ে যে স্বপ্ন দেখেছি, সেই স্বপ্ন পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আমি শান্তি পাব না। আপনারা দোয়া করবেন, আল্লাহ যেন আমার স্বপ্ন পূরণ করেন। আপনারা যা বলবেন, জান দিয়ে হলেও তা করব। শুধু বিয়ের কথা বলবেন না। আপনি আব্বাকে আমার কথাগুলো জানিয়ে বলবেন, আপনাদের ইচ্ছা পূরণ করতে পারলাম না বলে মাফ চাইছি। তারপর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।
ফারজানা বেগম তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, কাঁদিস না মা, কাঁদিস না। তোর কাঁচা বয়সের কথা চিন্তা করে আমরা তোর আবার বিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। তুই যখন চাচ্ছিস না তখন আর তোর অমতে কিছু করব না। হালিমকে নিয়ে কি স্বপ্ন দেখেছিস বলতো শুনি।
হালিমকে আমি এমনভাবে মানুষ করতে চাই, যেন বাহেরচর গ্রামের মাতব্বর বা তার মতো আর কেউ যেন গরিবদের উপর এতটুকু অত্যাচার করতে না পারে, কোনো বৌ-বেটি যেন তাদের হাতে ইজ্জৎ না হারায়। সবাই যেন শান্তিতে বাস করতে পারে। বলুন আম্মা, আপনারাও কি তাই চাইবেন না?
ফারযানা বেগম বললেন, নিশ্চয় চাইব। দোয়া করি, আল্লাহ যেন তোর মনের আশা পূরণ করেন। তোর আব্বাকেও দোয়া করতে বলব।
রাতে ঘুমাবার সময় ফারযানা বেগম স্বামীকে সায়রার বিয়েতে অমতের ও তার স্বপ্নের কথা বললেন।
আবু তাহের বললেন, ওর উদ্দেশ্য মহৎ। আল্লাহ বান্দাদের মহৎ উদ্দেশ্য পূরণ করেন। দোয়া করি, তিনি যেন ওর স্বপ্ন সফল করেন।
.
হালিম কামিলে খুব ভালো রেজাল্ট করে একদিন মা ও নানা-নানিকে জানাল, ঢাকায় গিয়ে ইংলিশে অনার্স করবে।
সায়রা ছেলেকে তার স্বপ্নের কথা আগেই জানিয়েছিল। তাই ঢাকায় পড়তে যাওয়ার কথা শুনে সবার আগে বলে উঠল, আর পড়াশুনা করার দরকার নেই। এবার আমার স্বপ্ন পূরণ করার কথা চিন্তা কর কিভাবে কি করবি।
হালিম বলল, আম্মা স্বপ্ন শুধু তুমি দেখ নি, আমিও দেখেছি। তখন ছোট ছিলাম, তবু কিছু বুঝতে শিখেছিলাম। তাই গ্রাম ছেড়ে আসার সময় মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, বড় হয়ে যেমন করে তোক তোমার প্রতি অত্যাচারের প্রতিশোধ নেব। আর গ্রামের গরিব লোকদের মাতব্বরের অত্যাচার থেকে রক্ষা করব। গ্রামে ফিরে সে সব করার উপযুক্ত এখনও হই নি। উপযুক্ত হওয়ার জন্য আমাকে অনেক কিছু শিখতে হবে। ঢাকায় গিয়ে পড়াশোনার সাথে সাথে সেসব শিখব। সবাই দোয়া করুন, আল্লাহ যেন আমাকে কামিয়াব করেন।
ফারযানা বেগম বললেন, আর নানা-নানির স্বপ্ন পূরণ করিব না?
হালিল বলল, নিশ্চয় করব। আপনারা মুরুব্বী। আপনাদের স্বপ্ন পূরণ করলে আল্লাহ খুশী হবেন। আপনাদের কি স্বপ্ন বলুন।
আমরা কতদিন থেকে স্বপ্ন দেখছি। কামিল পাশ করার পর তুই উপার্জন করবি, আমরা তোর বিয়ে দিয়ে লাল টুকটুকে নাতবৌ নিয়ে আসব।
কথাটা শুনে সায়রা ও আবু তাহেবের মুখে হাসি ফুটে উঠল।
আর হালিম লজ্জা পেয়ে কয়েক সেকেন্ড মুখ নিচু থেকে বলল, আপনাদের স্বপ্নও ইনশাআল্লাহ পূরণ করব। তবে তার আগে আম্মার স্বপ্ন পূরণ করার সময় পর্যন্ত আমাকে সময় দিতে হবে।
ফারযানা বেগম মেকী একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (দঃ) যখন সবার থেকে মায়ের আদেশ মানার প্রধান্য দিয়েছেন তখন সময় তো দিতেই হবে। দোয়া করি, মায়ের স্বপ্ন সফল করার পর আমাদের স্বপ্ন পূরণ করার তওফিক আল্লাহ তোকে যেন দেন। সবাই একসঙ্গে বলে উঠল, আমিন।
৭-৮. দুবছর হতে চলল
০৭.
দু’বছর হতে চলল হালিম ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ছে। সে এখন পাঁচিশ ছাব্বিশ বছরের যুবক। সাড়ে ছ’ফুট লম্বা, চুয়াল্লিশ ইঞ্চি ছাতি, ফর্সা টকটকে, খাড়া নাক, চওড়া কপালের নিচে একজোড়া ভ্রমর কালো দাড়ি রাখায় চেহারার সৌন্দর্য আরো বেড়ে গেছে। যে কেউ তার দিকে তাকালে সহজে দৃষ্টি সরিয়ে নিতে পারে না। ক্লাসের সেরা ছাত্র। ফার্স্ট ইয়ার ক্লাস করার সময় আকর্ষণীয় চেহারার কারণে ছেলেদের কাছে ঈর্ষণীয় হলেও মেয়েদের কাছে আকর্ষণীয় ছিল। তবে তার দাড়ির জন্য কেউ কাছে আসে নি। ফার্স্ট ইয়ারের পরীক্ষায় সবার থেকে ভালো রেজাল্ট করার পর থেকে শুধু মেয়েরা নয়, ছেলেরাও বন্ধুত্ব করার জন্য কাছে ভীড়তে শুরু করল।