আবু তাহের বললেন, তুমি আমাকে না চিনলেও আমি তোমাকে চিনি। বাহেরচরের মরহুম মঈন সেখের স্ত্রী না তুমি?
সায়রা বলল, জি।
তোমাদের গ্রামের মুসা আমার ছোট ভাইরা। তোমার বিচারের সময় আমি তার সঙ্গে ছিলাম। ঐ রাতেই তুমি গ্রাম ছেড়েছ, তা পরের দিন শুনেছি। মুসার কাছে তোমার ও তোমার প্রতি মাতব্বরের অত্যাচারের কথাও শুনেছি। মাতব্বর মানুষ নয় পশু। গ্রাম ছেড়ে এসে ভালই করেছে। এখানে এসে যে বিপদে পড়েছ, তা বুঝতে পারছি। মানুষের বিপদে সাহায্য করা প্রত্যেকের উচিত। তুমি মেয়ে মানুষ, তোমার বয়স কাঁচা। এখানে পদে পদে বিপদ। বিপদগ্রস্থ মানুষকে সাহায্য করলে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (দঃ) খুশী হবেন। তাই আমি তোমাকে সাহায্য করতে চাই। আমাকে বাপ-চাচার মতো মনে করে আমাদের বাড়িতে থাক। মনে হচ্ছে, এই তিন চার দিন তোমাদের তেমন খাবার জোটে নি। ঘরে চল, কিছু খাওয়ার পর যা বলার বলল।
আবু তাহেরের কথা শুনে সায়রা মুখ নিচু করে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে ভাবল, বিচারের সময় পাথর মারার বিরুদ্ধে ইনিই তা হলে প্রতিবাদ করেছিলেন। শহরে এরকম লোক আছে ভেবে অবাক হল।
মাকে চুপ করে কাঁদতে দেখে হালিম বলল, চল না মা, লোকটা খেতে দেবে বলছে। আমি যে আর ভুখ সহ্য করতে পারছি না।
আবু তাহের হালিমকে বললেন, আমি তোমার নানা হই। মাকে সাথে করে নিয়ে এস। তারপর ঘরে ঢুকে স্ত্রীকে সংক্ষেপে সায়রা ও হালিমের পরিচয় বলে বললেন, ওদেরকে ডেকে নিয়ে এসে কিছু খেতে দাও।
আবু তাহেরের স্ত্রী ফারযানা বেগম এস,এস, সি পাশ হলেও আলেম স্বামীর সংস্পর্শে আলেমা হয়ে গেছেন। তাই স্বামীর কথা শুনে বেরিয়ে এলেন। সায়রাকে কাঁদতে দেখে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, কেঁদে আর কি করবি মা, সবই তকুদীর। তারপর তাদেরকে ঘরে নিয়ে এসে কলতলা দেখিয়ে বললেন, হাত মুখ ধুয়ে আয়, আমি তোদের খাওয়ার ব্যবস্থা করি।
ফারযানা বেগম স্বামীর কাছে সায়রার সম্পর্কে অল্প কিছু শুনে তার বিপদের কথা আঁচ করতে পেরেছিলেন। খাওয়ার পর সায়রার কাছে বিস্তৃত শুনে বললেন, আমাদের কোনো ছেলে সন্তান আল্লাহ দেন নি। দু’টো মেয়ে দিয়েছিলেন। বড়টা ছোট বেলায় পানিতে ডুবে মারা গেছে। ছোটটা বিয়ের পর ছেলেপুলে হওয়ার আগে মারা গেছে। এটা গ্রাম নয় যে কারো বাড়িতে কাজ করে পেটের ভাত জোগাবি। এটা শহর। এখানকার মানুষের দয়া মায়া কম। তা ছাড়া শহরের লোকজনের চরিত্রও ভালো না। কারো বাড়িতে কাজ পেলেও সুযোগ পেলে তোর ইজ্জতের উপর হামলা করবে। আল্লাহ যখন তোদেরকে আমাদের কাছে এনে দিয়েছে তখন এখানেই থাক। আমাদের কাছে মেয়ের মতো থাকবি। তোর ছেলেকে লেখাপড়া করিয়ে মানুষ করব।
অকূল সাগরে সাঁতার কাটতে কাটতে ডুবে যাওয়ার আগে পায়ে মাটি ঠেকলে যেমন বাঁচার আনন্দে আনন্দিত হয়, ফারনা বেগমের কথা শুনে সায়রারও তাই হল। আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে তার দু’পা জড়িয়ে ধরে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল; কোথায় আর যাব আম্মা, আপনারা ছাড়া আমার যে আর জায়গা নেই। আমি আপনাদের মেয়ে হয়েই থাক।
তার কথা শুয়ে ফারযানা বেগমের চোখে পানি এসে গেল। চোখ মুছে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বললেন, তোদেরকে পেয়ে কত যে খুশী হয়েছি তা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। তারপর সায়রার চোখ মুছে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ছেলের কি নাম রেখেছিস?
হালিম।
হালিম আল্লাহর গুণবাচক নাম। শুধু ঐ নাম রাখতে নেই। তাই আজ থেকে ওর নাম আব্দুল হালিম। যার অর্থ হল আল্লাহর গোলাম। তারপর হালিমকে বললেন, তুই আমাকে নানি ডাকবি আর ওনাকে নানা ডাকবি। আমরা তোকে লেখাপড়া করাব।
হালিম যখন পাড়ার ছেলেমেয়েদের বই-খাতা নিয়ে স্কুলে যেত দেখত তখন তারও খুব ইচ্ছা হত বই-খাতা নিয়ে স্কুলে যেতে। একদিন মাকে সেকথা বলেছিল। সায়রা বলেছিল, গরিবের ছেলের আবার লেখাপড়া। তোর বাপ দু’বেলা পেটের ভাত যোগাড় করতে পারে না, তোর বই খাতা কিনে দেবে কি করে?
এখন লেখাপড়া করাবার কথা শুনে হালিম খুশী হয়ে বলে উঠল, সত্যি বলছ নানি?
ফারযানা বেগম বললেন, হ্যাঁরে সত্যি। তোর নানাকে বলব তোকে মাদ্রাসায় ভর্তি করে দিতে।
সায়রা বলল, আমি আপনাদের আম্মা আব্বা বলে ডাকব। আপনাদের কাছে। আমিও লেখাপড়া করব।
তার কথা শুনে ফারনা বেগমের চোখে আবার পানি চলে এল। তাকে জড়িয়ে ধরে চুমো খেয়ে বললেন, মেয়ে হিসাবে যখন গ্রহণ করেছি তখন তো আমাদেরকে আম্মা আব্বা বলবি। মেয়েকে কি আর আমরা মুগ্ধ করে রাখব? তোকে আমরা সব বিষয়ে শিক্ষিত করে তুলব।
সায়রা ফারযানা বেগমের পায়ে হাত ছুঁয়ে সালাম করে বলল, দোয়া করবেন, আল্লাহ যেন আমাকে আপনাদেকে আজীবন সেবা করার সুযোগ দেন।
.
আবু তাহের ও ফারযানা বেগমের হৃদয়ে সন্তানের জন্য যে আগুন জ্বলছিল, সায়রা ও হালিমকে পেয়ে আল্লাহ সেই আগুনে যেন পানি ঢেলে দিলেন।
আবু তাহের হালিমকে মাদ্রাসায় ভর্তি করে দিলেন। আর ফারযানা বেগম অবসর সময়ে সায়রাকে আরবি, বাংলা ও ইংরেজি শেখাতে লাগলেন। সেই সাথে মা বেটাকে ধর্মীয় শিক্ষা দিয়ে অনুসরণ করাতে লাগলেন।
মা ও ছেলের মেধা ভালো। তাই সায়রা ফারযানা বেগমের কাছে লেখা পড়া করে ক্রমশ আলেমা হয়ে উঠতে লাগল। আর আবু তাহেরের প্রচেষ্টায় হালিম প্রতি বছর ফাস্ট হয়ে একের পর এক উপরের ক্লাসে উঠতে লাগল।