জিন বলল, আল্লাহর কসম খেয়ে যখন ওয়াদা করলেন তখন মাফ করে দিলাম। কিন্তু মনে রাখবেন, ওয়াদা ভঙ্গ করলে আপনাদের ঘাড় মটকে দেবই। সেদিন কোনো অজুহাত শুনব না। তারপর সেখান থেকে চলে যাওয়ার সময় বলল, রশিদের এই অবস্থা আমিই করেছি। দুনিয়া চষে ফেললেও কেউ আমার খোঁজ পাবে না।
.
০৬.
বিশ বাইশ বছর আগে সায়রা সাত বছরের হালিমকে নিয়ে গ্রাম থেকে পালিয়ে আসার সময় ভাবল, ভাইয়ের বাড়িতে গিয়ে থাকবে। গতর খাঁটিয়ে ছেলেকে মানুষ করবে। হঠাৎ তার মনে হল, ভাইয়ের বাড়ি বেশি দূরে নয়। মাতব্বর জানতে পারলে লোক পাঠিয়ে ধরে নিয়ে এসে হয় ফজলুর সঙ্গে নিকে দেবে। আর তা না হলে সেই লোকদের বলবে ইজ্জৎ লুঠে নিয়ে গলাটিপে মেরে নদীতে ভাসিয়ে দিতে। কথাটা মনে হতে ভাইয়ের বাড়ির পথ বদলে বাস বাস্তার পথ ধরল। ঘণ্টা দুই হাঁটার পর বাস রাস্তায় উঠে পটুয়াখালী শহরের দিকে হাঁটতে লাগল। যখন শহরে এসে পৌঁছাল তখন মসজিদে ফজরের আজান হচ্ছে।
আসার সময় ক্লান্ত হয়ে পথে অনেক জায়গায় বিশ্রাম নিয়েছে। এক জায়গায় বিশ্রাম নেয়ার সময় হালিমতো ঘুমিয়ে পড়েছিল। সায়রা তাকে জাগিয়ে অনেক কষ্ট সহ্য করে এসেছে। তাই শহরের পৌঁছে রাস্তার ধারে একটা বাড়ির খোলা বারান্দায় বিশ্রাম নিতে গিয়ে মায়ে পুতে ঘুমিয়ে পড়ল।
কারো ডাকাডাকিতে ঘুম ভেঙে যেতে সায়রা দেখল, একজন বয়স্ক মহিলা ঝাড় হাতে দাঁড়িয়ে আছে।
তাকে জাগতে দেখে মহিলাটি বলল, কে তুমি? এখানে ঘুমিয়েছিলে কেন? যাও এখান থেকে।
সায়রা বলল, আমি গ্রাম থেকে এসেছি কারো বাড়িতে কাজ করব বলে।
মহিলা জিজ্ঞেস করল, ছেলেটা কে?
আমারই ছেলে।
ওর বাবা নেই?
না, পাঁচ ছ’মাস হল মারা গেছে। মারা যাওয়ার পর খুব কষ্টে দিন কাটছিল। কষ্ট সহ্য করতে না পেরে ছেলেকে নিয়ে কাজের চেষ্টায় এসেছি। আমাকে আপনি রাখবেন? সংসারের সবকাজ আমি করব।
মহিলা মুখ ঝামটা মেরে বলল, না রাখব না। তোমার মতো সুন্দরী স্বাস্থ্যবতী কাঁচা বয়সের মেয়েকে ঘরে রাখা মানে খাল কেটে কুমীর আনা। তোমাকে দেখলেই আমার স্বামীর মাথা ঘুরে যাবে। তাড়াতাড়ি এখান থেকে চলে যাও।
আমরা কাল থেকে কিছু খাই নি। বাসি কিছু থাকলে ছেলেটাকে অন্তত কিছু দিন। আল্লাহ আপনার ভালো করবে।
মহিলার স্বামী ডায়বেটিস রুগী। ডাক্তারের কথামতো প্রতিদিন ভোরে এক দেড় ঘণ্টা হাঁটেন। আজও হাঁটতে গেছেন। সায়রা বাসি খাবার চাইতে ভাবল, স্বামীর ফেরার সময় হয়ে গেছে। ফিরে এসে এর কথা জেনে যদি কাজ করার জন্য রাখতে চায়। তাই বাসি খাবার দেয়ার ইচ্ছা থাকলেও বলল, না, ঘরে বাসি খাবার কিছু নেই। তুমি ছেলেকে নিয়ে তাড়াতাড়ি চলে যাও।
সায়রা একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে হালিমকে জাগাল। তারপর একটা হাত ধরে অন্য হাতে কাপড়ের পুঁটলি নিয়ে বাড়িবাড়ি ঘুরতে লাগল কাজের চেষ্টায়। কিন্তু তার রূপ ও কাঁচা বয়স, তার উপর সাত বছরের ছেলেসহ কেউ কাজে রাখতে চাইল না। তবে কেউ কেউ তাদেরকে খেতে দিয়েছে।
এভাবে দিনের বেলা কাজের চেষ্টা করে আর রাতে কারো বাড়ির বারান্দায় ঘুমায়। আজ যে বাড়ির বারান্দায় ঘুমিয়েছিল, সেই বাড়ির মালিক আবু তাহের। উনিই বাহেরচর গ্রামের মুসার ভাইরা। তিনি মসজিদে ফজরের নামায পড়তে যাওয়ার সময় তাদেরকে দেখে ভাবলেন, আল্লাহর কুদরত বোঝা মানুষের অসাধ্য। কেউ পাকা বাড়িতে খাটের উপর গদীতে ঘুমায়, আবার কেউ রাস্তা ঘাটে মাটিতে ঘুমায়। কেউ মাছ-গোস, পোলাও-কোর্মা খাচ্ছে, আবার কেউ না খেতে পেয়ে অখাদ্য কুখাদ্য খাচ্ছে। আবার কেউ না খেয়ে দিন কাটাচ্ছে। প্রায় প্রত্যেক দিন তিনি কোনো না কোনো ভিক্ষুককে এখানে ঘুমিয়ে থাকতে দেখেন। আজও সেরকম মনে করে মসজিদে চলে গেলেন। রাস্তার লাইট পোেস্ট বেশ দূরে। তা ছাড়া ওনার বাড়ির সামনে একটা বড় লিচু গাছ থাকায় বারান্দাটা অন্ধকার। তাই ভিক্ষুকের জায়গায় একটা মেয়ে যে তার ছেলেকে নিয়ে ঘুমিয়ে আছে, তা বুঝতে পারলেন না।
আবু তাহের নামাযের পর কুরআন তেলাওয়াত করেন। তারপর এশরাকের নামায পড়ে ফেরেন। প্রতিদিনকার মতো আজও ফিরে এসে ভিক্ষুককে জাগাতে গিয়ে সায়রাকে চিনতে পারলেন।
এখন বেশ একটু বেলা হয়েছে। তাছাড়া সায়রা মুখে কাপড় ঢেকে ঘুমালেও ঘুমের ঘোরে খুলে গেছে।
বিচারের দিন ঘরে এসে ভাইরা মুসার মুখে মাতব্বরের স্বভাবের কথা ও সায়রা যে তার পুরুষাঙ্গ কেটে দিয়েছিল এবং প্রতিশোধ নেয়ার জন্য মাতব্বর যে বিচারের প্রহসন করেছিলেন, সেসব শুনেছিলেন। প্রমাণ করার জন্য সায়রা যখন মুখের নেকাব খুলেছিল তখন তাকে দেখেছিলেন। ঐ দিন যে ছেলেকে নিয়ে গ্রাম ছেড়ে পালিয়েছে, তাও পরের দিন ভাইরার মুখে শুনেছেন। তাই তাকে চিনতে না পেরে ভাবলেন, তা হলে মেয়েটা ছেলেকে নিয়ে এখানে পালিয়ে এসেছে? মা ও ছেলের মলিন মুখ দেখে যা বোঝার বুঝে গেলেন। ছেলেটার গায়ে হাত দিয়ে জাগিয়ে বললেন, তোমার মাকে জাগাও।
হালিম মাকে জাগিয়ে বলল, আম্মা ওঠো, অনেক বেলা হয়ে গেছে।
সায়রা একজন দাড়ি টুপিওয়ালা লোককে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে তাড়াতাড়ি গায়ে মাথায় কাপড় দিয়ে উঠে বসল। তারপর পুঁটলিটা নিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, চল।