ঐ গ্রামের মঈন সেখ দরিদ্র কৃষক। বছরের বেশিরভাগ দিন সে দিলদার মাতব্বরের চাষ বাসের কাজ করে। তার বৌ সায়রা খুব সুন্দরী। তাদের একমাত্র ছেলে হালিম। হালিম যখন সাত বছরের তখন মঈন সেখ মাস দুই অসুখে ভুগে মারা যায়।
প্রথম স্ত্রী মারা যাওয়ার কিছুদিন পর দিলদার মাতব্বরের আর একটা বিয়ের খায়েস হল। তাই চামচাদের যখন মেয়ের খোঁজ করতে বললেন তখন শাকিল নামে এক চামচা বলল, হুজুর, মেয়ে আমাদের গ্রামেই আছে, দেখতে পরীর মতো।
দিলদার মাতব্বর বললেন, তাই নাকি? তা মেয়েটা কে?
শাকিল বলল, মঈন সেখের বৌ, একটা সাত আট বছরের ছেলে থাকলে কি হবে? দেখলে মনে হবে এখনো বিয়েই হয় নি।
দিলদার মাতব্বর বেশ কিছুদিন আগে মঈন সেখের অসুখের কথা শুনে একদিন দেখতে গিয়েছিলেন। সে সময় তার বৌকে ঘোমটা অবস্থায় দেখলেও শরীরের বাঁধন দেখে লোভাতুর হয়ে উঠেছিলেন। অন্য কারো বৌ হলে কয়েকদিনের মধ্যে ভোগ না করে ছাড়তেন না। মঈন সেখ তারই কামলা, তাই কিভাবে কাজটা করবেন ভেবে ধৈর্যের সঙ্গে চিন্তা করছিলেন, আর দু’একদিন ছাড়া মঈন সেখকে টাকা পয়সা সাহায্য করার অসিলায় তার বৌকে দেখার জন্য যেতেন। কিন্তু একবারের জন্যও ঘোমটা থাকার কারণে তার বৌ-এর মুখ দেখতে পান নি।
একদিন সাড়া না দিয়ে ঢুকে পড়ে দেখলেন, সায়রা স্বামীকে ওষুধ খাওয়াচ্ছে, মাথায় ঘোমটা নেই। গায়েও ভালো করে কাপড় নেই। ঐ অবস্থায় সায়রাকে দেখে মাতব্বর ভিমরি খেলেন। তাকে পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলেন। কোনো উপায় না পেয়ে কবিরাজকে অনেক টাকা দিয়ে মঈন সেখকে মেরে ফেলার ব্যবস্থা করেন। মঈন সেখ মারা যাওয়ার পর তার বৌ ও ছেলেকে সাহায্য করার জন্য যাতায়াত শুরু করেন।
সায়রা গ্রামের অশিক্ষিত সহজ সরল মেয়ে, দিলদার মাতব্বরের কৌশল ধরতে পারল না। ভাবল, স্বামী বারমাস মাতব্বরের ক্ষেতে খামারে কাজ করত, তাই সে মারা যেতে সাহায্য করছে। ঘোমটা অবস্থায় হাত পেতে টাকা নিত।
একদিন মাতব্বর টাকা দেয়ার সময় হালিমকে দেখতে না পেয়ে হঠাৎ করে সায়রার হাত ধরে ঘোমটা সরিয়ে দিয়ে বললেন, আমার কাছে ঘোমটা দেয়ার দরকার নেই। ভেবেছি, ইদ্দতের পর তোমাকে বিয়ে করে ঘরে নিয়ে যাব।
মাতব্বরের কথা শুনে সায়রা লজ্জা পেলেও তার মতলব বুঝতে পেরে খুব রেগে গিয়ে অন্য হাতে ঘোমটা টেনে বলল, হাত ছাড়ুন, নচেৎ চিৎকার করে লোকজন ডাকব।
মাতব্বর মৃদু হেসে বললেন, সেটা করা কি উচিত হবে? লোকজনদের আমাকে কিছু বলার সাহস হবে না, বরং তোমারই দুর্নাম হবে।
সায়রা হাতটা জোর করে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, আমি আপনাকে বাপের মতো মনে করি, আর আপনি কিনা আমাকে বিয়ে করতে চান? যান, চলে যান এখান থেকে। আর কোনোদিন আসবেন না। কথা শেষ করে টাকাগুলো মাতব্বরের পায়ের কাছে ফেলে দিয়ে ছুটে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে খিল দিয়ে দিল।
মাতব্বর কিছুক্ষণ বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে ফিরে আসার সময় বিড় বিড় করে বললেন, ইদ্দৎ শেষ হোক তারপর তোর দেমাগ ভাঙব।
মাতব্বর যখন আসেন তখন হালিম ঘরে ছিল না। পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে খেলা করছিল। কিছুক্ষণ আগে ফিরে মাতব্বরকে মায়ের হাত ধরে কথা বলতে দেখে এতক্ষণ রান্না ঘরের আড়ালে দাঁড়িয়ে সবকিছু দেখছিল ও শুনছিল। ছোট ছেলে বলে ঘটনাটা বুঝতে না পারলেও মাতব্বরের কথায় মা যে খুব রেগে গেছে বুঝতে পারল। মাতব্বর চলে যাওয়ার পর ঘরের দরজার কাছে এসে বলল, মা দরজা খোল, মাতব্বর চলে গেছে।
সায়রা নিজের ভাগ্যের কথা চিন্তা করে কাঁদছিল। মাতব্বর চলে গেছে শুনে। দরজা খুলে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল।
হালিম বলল, তুমি কাঁদছ কেন মা? মাতব্বর তোমাকে বকেছে বুঝি? তুমি দেখে নিও, এবার মাতব্বর এলে ইট মেরে মাথা ফাটিয়ে দেব।
সায়রা কান্না থামিয়ে চোখ মুছে বলল, ছি বাবা, উনি মুরুব্বী মানুষ, ওরকম কথা বলতে নেই। তারপর তাকে পান্তা খেতে দিয়ে বলল, বাইরে কোথাও যাবি না, ঘরে থাকবি। আমি তোর করিম দাদাদের ঘরে যাব। দেখি তাদের সংসারের কোনো কাজ কাম করা যায় কিনা।
করিম সেখের অবস্থা মোটামুটি ভালো, তার চার ছেলে দু’ মেয়ে। সবার বিয়ে হয়ে গেছে। চার ছেলের বৌ ও নাতি-নাতনিদের নিয়ে করিম সেখের একান্নবর্তী পরিবার। দু’জন কাজের মেয়ে থাকলেও সায়রার দুরবস্থার কথা ভেবে করিম সেখের স্ত্রী তিনবেলা খাওয়ার বদলে তাকে কাজে রাখলেন। সায়রা তিন বেলাই খাবার ঘরে নিয়ে এসে ছেলেকে নিয়ে খায়।
সে কথা শুনে দিলদার মাতব্বর তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে চামচাদের বললেন, মঈন সেখের বিধবা বৌকে কত টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করলাম, আর সে কিনা আমার কাছে না এসে করিম সেখের সংসারে কাজ নিল? ঠিক আছে, সময় হলে আমিও দেখে নেব।
দিলদার মাতব্বর সায়রার ইদ্দতের হিসাব রেখেছিলেন। চারমাস দশ দিন হয়েছে দুদিন আগে। তাই আজ চামচাদেরকে বিয়ে করার কথা বলে মেয়ে দেখতে বলেছিলেন। চামচা শাকিলের কথা শুনে মুচকি হেসে বললেন, তুই ব্যবস্থা কর, আমি রাজি। তারপর তিনটে একশ টাকার নোট তাকে দিয়ে বললেন, এগুলো নিয়ে তোর মাকে প্রস্তাব দিতে পাঠাবি। আর বলে দিবি টাকাগুলো যেন মঈন সেখের বিধবা বৌকে দেয়।
শাকিলের বাপ অনেক আগে মারা গেছে। তার মা রহিমন বিবির বয়স প্রায় ষাট বছর। গ্রামের সব ঘরেই তার অবাধ বিচরণ। বৌড়ী ঝিউড়ী কেউ চাচি আবার কেউ দাদি সম্বোধন করে।