শাকিল কাছে এসে বলল, সায়রা আযীয সেখের সঙ্গে তাদের ঘরে গেল। এতক্ষণ অপেক্ষা করেও বেরোতে দেখলাম না। মনে হয় ওখানে থেকেই স্বামীর ভিটেয় মাদ্রাসা তৈরির কাজ করবে।
মাতব্বর বললেন, ঠিক আছে, তুই এখন যা।
শাকিল চলে যাওয়ার পর রশিদ দাঁতে দাঁতে চেপে খুব রাগের সঙ্গে বলল, সায়রা, তখন আমি ছোট ছিলাম বলে পালাতে পেরেছিলি, এবার তোকে জ্যান্ত করব দেব।
মাতব্বর রেগে উঠে বললেন, এসব কি বলছিস? সাফিয়ার ইজ্জৎ লুঠতে গিয়ে একটা হাত ও একটা চোখ হারিয়েছিস, সায়রার কিছু করতে গেলে বাকি হাত ও চোখ হারাবি। আর দারোগা জানতে পারলে তোকে ফাঁসিতে ঝোলাবার ব্যবস্থা। করবে।
তুমি টাকা দিয়ে দারোগাকে আগে বস করো, তারপর দেখ, আমি সায়রার কি করি।
এতদিনে দারোগাকে যতটা বুঝেছি তাতেই মনে হয়েছে বিশ পঞ্চাশ হাজার নয়, লাখ টাকা দিলেও বসে আসবে না। তুই মাথা গরম করিস না। আমাকে চিন্তা করতে দে।
তোমাকে সাফিয়ার ব্যাপারটা কে বলেছে?
কেউ বলে নি। ঘটনার কয়েকদিন পর জয়নুদ্দিন একটা কাগজ আমার হাতে দিয়ে বলল, এটা মিয়া ভাইয়ের বুকের উপর একটা ঢিল চাপা দেয়া ছিল। কাগজটায় তোর অপকীর্তির কথা লেখাছিল।
তাই না কি? তা হলে ঐ লোকটা দারোগাকে ঠিক কথাই বলেছে?
হ্যাঁ, ঠিক কথাই বলেছে। তাইতো দারোগাকে উল্টো সিধে বলে বোঝালাম।
এখন তা হলে কি করবে? আযীয সেখ ও সায়রা আমাদের মান-ইজ্জৎ ডুবিয়ে দেবে আর আমরা চুপ করে বসে থাকব?
তা থাকব না, কিছু একটাতো করতেই হবে। তবে খুব ভাবনা-চিন্তা করে করতে হবে। তাই তো তোকে মাথা গরম করতে নিষেধ করলাম।
দারোগাকে হাত করতে না পারলে আমাদের কোনো আশাই পূরণ হবে না। কাল সকালে থানায় গিয়ে মোটা টাকা দিয়ে হাত করার চেষ্টা করো।
কথাটা অবশ্য তুই ঠিক বলেছিস; কিন্তু দারোগার টাকার লোভ নেই।
তবু তুমি চেষ্টা কর। যদি একলাখ চায়, রাজি হয়ে যেও। কথা শেষ করে রশিদ সেখান থেকে চলে গেল।
মাতব্বর সারাদিন চিন্তা করেও কি করবেন না করবেন ঠিক করতে পারলেন না। একলাখ টাকা চাট্টিখানি কথা নয়। তাতেও যদি দারোগা রাজি না হয় তখন কি করবেন?
রাত্রে খাওয়া দাওয়ার পর বারান্দায় বসে ছেলের সঙ্গে অনেকক্ষণ আলাপ করে সিদ্ধান্ত নিলেন, কাল থানায় গিয়ে একলাখ টাকা দিয়ে দারোগাকে হাত করবেন। আলাপ করতে করতে এগারটা বেজে গেল।
আজ পূর্ণিমা। চাঁদের আলোতে চারপাশ দিনের মতো হয়ে আছে। আলাপ শেষ করে ঘুমাতে যাওয়ার জন্য বাপ বেটা উঠে দাঁড়িয়েছে, এমন সময় রশিদ দেখতে পেল, উঠোনের মাঝখানে লম্বা চওড়া সাদা পোশাকে ঢাকা একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। জিজ্ঞেস করল, কে ওখানে?
লোকটা কোনো সাড়া না দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
ছেলের কথা শুনে মাতব্বরও তাকে দেখতে পেয়ে বললেন, কথা বলছ না কেন? কে তুমি?
লোকটা বলল, আমি জিন।
জিন শুনে রশিদ খুব ভয় পেয়ে কাঁপতে লাগল। সে শুনেছে, জিনেরা মানুষের ক্ষতি করে বেড়ায়।
মাতব্বর বয়স্কলোক। ভয় পেলেন না। জিজ্ঞেস করলেন, এখানে এসেছ কেন?
আপনাদের বাপ বেটাকে কঠিন শাস্তি দিতে।
আমরা তো তোমার কোনো ক্ষতি করি নি, তবু শাস্তি দিতে এসেছ কেন?
আমার ক্ষতি না করলেও গ্রামের গরিবদের অনেক ক্ষতি করেছেন।
না, আমরা কারো কোনো ক্ষতি করি নি। বরং দুঃসময়ে টাকা পয়সা দিয়ে তাদেরকে সাহায্য করি।
যতটুকু সাহায্য করেন তার থেকে অনেক বেশি ক্ষতি করেন।
কার কি ক্ষতি করেছি বলতে পারবে?
কেন পারব না? মঈন সেখের বিধবা স্ত্রী সায়রার ইজ্জৎ লুঠতে গিয়েছিলেন, সেটা বুঝি ভালো কাজ? অবশ্য সেজন্য আপনাকে পুরুষাঙ্গ হারাতে হয়েছে। সুস্থ হয়ে ল্যাংড়া চামচিকা ফজলু ভিখেরির সাথে সায়রার দুর্নাম রটিয়ে তার সাথে নিকে দিতে চেয়েছিলেন। সেজন্য সায়রা সাত বছরের ছেলে হালিমকে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। মঈন সেখের ভিটে দখল করে গাছপালা লাগিয়ে ভোগ করছেন। গ্রামের সুন্দরী বৌ, ঝি নজরে পড়লে তাদের ইজ্জৎ লুটেছেন। আপনার ছেলে ঐ রশিদও অনেক বৌ-বেটির ইজ্জৎ নষ্ট করেছে। সাফিয়ার ইজ্জৎ লুঠতে গিয়ে একটা হাত ও একটা চোখ হারিয়েছে। এখন আবার দারোগাকে একলাখ টাকা দিয়ে হাত করে সায়রা ও আযীয সেখকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বাপ বেটায় আরো যে কতকিছু করেছেন, সেসব বলতে গেলে রাত ভোর হয়ে যাবে। এতদিন আপনাদের অত্যাচার সহ্য করলেও আর পারছি না। তাই যাতে আর কারো কোনো ক্ষতি করতে না পারেন, সেজন্য বাপ বেটার ঘাড় মটকে দিতে এসেছি।
জিনের কথা শুনে রশিদ ভয়ে বাপকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, এবারের মতো মাফ করে দাও। আমরা আর কারো এতটুকু ক্ষতি করব না।
জিনের কথা শুনে মাতব্বরও এবার খুব ভয় পেলেন। তিনি কাকুতি মিনতি করে ছেলের মতো একই কথা বললেন।
জিন বলল, মানুষ খুব বেঈমান। তারা কথা দিয়ে কথা রাখে না। আমি আপনাদের কথা বিশ্বাস করি না। এখন জান বাঁচাবার জন্য যে কথা বলেছেন, কয়েকদিন পর তা ভুলে যাবেন। তাই আপনাদের ঘাড় মটকে দিয়ে চলে যাব।
এই কথা শুনে রশিদ জ্ঞান হারিয়ে বারান্দার মেঝেয় পড়ে গেল। আর মাতব্বর কাকুতি মিনতির সঙ্গে আল্লাহর কসম খেয়ে বললেন, ওয়াদা করছি, আমরা আর কোনো দিন কারো এতটুকু ক্ষতি করব না। যদি যদি করি, তা হলে তোমার যা ইচ্ছা তাই করো।