দারোগা এবার মাতব্বরকে উদ্দেশ্য করে বললেন, এই মহিলা বিশ বা পঞ্চাশ বছর আগে চলে গেলেও জায়গাটাতো ওনার স্বামীর। আর তিনি যে আপনার কাছে বাস্তু বিক্রি করেছেন, তার দলিল নিশ্চয় আছে?
মাতব্বর আমতা আমতা করে বললেন, দলিল করার আর সময় পেলাম কোথায়? তার আগেই তো মঈন সেখ মারা গেল।
দারোগা বললেন, এরকম ক্ষেত্রে ইসলামের হুকুম হল, দু’জনকেই কুরআন শরীফ মাথায় রেখে শপথ করতে হবে। প্রথমে আপনি বলবেন, আমি মঈন সেখের বাস্তু কিনেছি। যদি এই কথা মিথ্যে বলে থাকি, তা হলে আল্লাহর গযব আমার মাথায় পড়বে।
আপনি শফত করার পর ঐ মহিলা বলবেন, আমার স্বামী বাস্তু বিক্রি করেন নি। এই কথা যদি মিথ্যে বলে থাকি, তা হলে আল্লাহর গযব আমার মাথায় পড়বে।
দারোগার কথা শুনে প্রথমে সায়রা বলে উঠল, আমি শপথ করতে রাজি।
দারোগা মাতব্বরকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি শপথ করতে রাজি আছেন?
কুরআন শরীফ মাথায় নিয়ে শপথ করলে অল্প দিনের মধ্যেই তার উপর আল্লাহর গযব নাজিল করবেন, সেকথা মাতব্বর জানেন। তাই বললেন, সায়রা যখন ওখানে মাদ্রাসা করবে বলছে তখন আর ঐ জায়গা আমি দাবি করব না।
মাতব্বর থেমে যেতে সায়রা বলল, দারোগা সাহেব, আমার স্বামীর যদি আরো জায়গা থাকত, তা হলে সেই জায়গা স্বেচ্ছায় দিয়ে দিতাম। তার দামও নিতাম না। স্বামীর রুহের মাফফেরাতের জন্য আমি ওখানে একটা দ্বিনী প্রতিষ্ঠান করে এই গ্রামের ছেলে মেয়েদের ও বড়দের মধ্যে শিক্ষা প্রচার করতে চাই। আমার ছেলেরও তাই ইচ্ছা।
দারোগা জিজ্ঞেস করলেন, আপনার ছেলে কোথায়?
সে সরকারী চাকরি করে। এখানে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করার জন্য আমাকে পাঠিয়েছে। ছুটির জন্য দরখাস্ত করেছিল, পায় নি। ছুটি পেলে কিছু দিনের মধ্যে আসবে বলেছে। আমি গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার পর মাতব্বর সাহেব আমার স্বামীর বাস্তু দখল করেছেন। ওনাকে দখল ছেড়ে দিতে বলুন। আমি মাদ্রাসা তৈরির কাজ শুরু করব।
দারোগা আসার আগে সায়রাকে দেখে ও তার কথা শুনে মাতব্বরের মনে প্রতিহিংসার আগুন জ্বলে উঠেছিল। এখন আবার সে দারোগা যে সব কথা বলল, সেসব শুনে সেই আগুনে যেন ঘি ঢেলে দিল। মনে মনে বললেন, কি করে মাদ্রাসা করিস, দেখে নেব। সুযোগ মতো চামচাদের দিয়ে ইজ্জৎ মেরে তোর লাশ শিয়াল কুকুর দিয়ে না খাইয়েছি তো আমার নাম দিলদার মাতব্বর না।
মাতব্বরকে চুপ করে থাকতে দেখে দারোগা জিজ্ঞেস করলেন, এ ব্যাপারে আপনি কি কিছু বলবেন?
ওখানে আমি নানারকম ফলের গাছ লাগিয়েছিলাম। সে সব এখন ফলছে। কয়েকদিনের মধ্যে বিক্রি করে দেব। তারপর সায়রা মাদ্রাসা তৈরির কাজ শুরু করবে।
সায়রা বলল, আমার জায়গা এতদিন অন্যায়ভাবে ভোগ দখল করেছেন। একটা গাছও বিক্রি করতে দেব না। যতটুকু জায়গায় মাদ্রাসার ঘর হবে, সেইটুকু জায়গার গাছ কেটে আমি বিক্রি করব। বাকি জায়গার গাছ থাকবে।
সায়রাকে দেখে ও তার কথা শুনে বাপের মতো রশিদও রাগে ফুলতেছিল। এবার তার কথা শুনে চিৎকার করে বলল, গাছ আমরা লাগিয়েছি, ওসব আমাদের, আমরা বিক্রি করবই। কি করে বাধা দাও দেখব।
দারোগাকে উদ্দেশ্য করে সায়রা বলল, মাতব্বরের ছেলের কথা শুনলেন তো, এখন আপনিই এর ফায়সালা করে দিন।
দারোগা বললেন, আমি আইনের লোক। আইন মোতাবেক মাতব্বর সাহেব আপনার জায়গা দখল করে অন্যায় করেছেন। ওনার ছেলে গায়ের জোরে যে কথা। বললেন, তাও আইনের দৃষ্টিতে অপরাধ। ওনারা বাড়াবাড়ি করলে আপনি আইনের আশ্রয় দিতে পারেন। সে ব্যাপারে আমি আপনাকে সাহায্য করব। কারণ অত্যাচারিতকে সাহায্য করাই মানবতা। তা ছাড়া আইনের বিরুদ্ধে কেউ কিছু করলে আইনের লোক হয়ে কিছু না করা অমানুষের কাজ। যাতে আপনি মাদ্রাসা তাড়াতাড়ি প্রতিষ্ঠা করতে পারেন, সে ব্যাপারে আমি মাতব্বর সাহেবের সঙ্গে আলাপ করে পরে আপনাকে জানাব। আপনি আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখবেন। এখন এসব কথা থাক, গ্রামের লোকজন যখন রয়েছেন তখন স্কুলের ব্যাপারে আলাপ করা যাক। তারপর আযীয সেখকে দেখিয়ে বললেন, উনি হাই স্কুল করার ব্যাপারে বেশ কিছু দিন আগে আমার সঙ্গে আলাপ করেছিলেন। সে সময় জায়গাও দেবেন বলেছিলেন। আমি ওনার কথা মতো সরকারের কাছে আবেদন করেছিলাম। সরকার আবেদন মঞ্জুর করে আজ লোক পাঠিয়েছে। আযীয সেখ স্কুলের জন্য যে জমিটা আমাকে দেখিয়েছেন, সেটা গ্রামের মাঝামাঝি ও মাঠের ধারে। উনি জমির দামও নেবেন না। সেই টাকা স্কুলঘর তৈরির কাজে লাগাতে বলেছেন। এখন আপনারা যদি আযীয সেখের জমিতে স্কুল করতে রাজি থাকেন, তা হলে বলুন। আমি সরকারী লোকদের সেকথা জানাব।
গ্রামের সব লোকজন একসঙ্গে বলে উঠল, আমরা রাজি। শুধু মাতব্বর ও রশিদ চুপ করে রইলেন।
তাই দেখে দারোগা ওনাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আপনি কিছু বললেন না যে?
আযীয সেখের অবস্থা আগে খারাপ থাকলেও এখন অনেক ভালো। ছোট ছেলে ইয়াসীর শহরে লেখাপড়া শেষ করে কুয়েতে চাকরি করে। তার পাঠান টাকায় অনেক জমি-জায়গা কিনেছেন।
কিছুদিন থেকে মাতব্বর লক্ষ্য করছেন, গ্রামের লোকজন তাকে আগের মতো মান্য করে না, ভক্তি শ্রদ্ধাও করে না। করে আযীয সেখকে। ইদানিং তারা তাকে মাতব্বর করতে চায়, সেকথা চামচাদের মুখে শুনেছেন। তাই মাতব্বর আযীয সেখের প্রতি খুব অসন্তুষ্ট। তাকে খুব হিংসাও করেন। স্কুলের জন্য টাকা না নিয়ে জমি দেবে শুনে অপমান বোধ করে তার উপর খুব রেগে গেলেন এবং হিংসা আরো বেড়ে গেল। দারোগার কথা শুনে সামলে নিয়ে বিদ্রূপ কণ্ঠে বললেন, আজকাল আযীয সেখের অনেক টাকা হয়েছে। সেতো বিনামূল্যে স্কুলের জন্য জমি দেবেই। আমি আর কি বলব? গ্রামের লোকজন যখন রাজি তখন আমিও রাজি।