এখন তার কথা শুনে মাতব্বর বললেন, মঈন সেখ অসুখে পড়ে আমাকে তার বাস্তু বিক্রি করে সেই টাকায় চিকিৎসা করিয়েছে।
আযীয সেখ বললেন, আমি তো জানি মঈন সেখ একরকম বিনা চিকিৎসায় মারা গেছে। তার বৌ আমার কাছ থেকে কিছু কিছু টাকা নিয়ে এসে যতটুকু সম্ভব চিকিৎসা করিয়েছে। তবে তার বৌ-এর কাছে শুনেছি, আপনিও তাকে কিছু টাকা পয়সা দিয়েছেন। আপনার কাছে বাস্তু বিক্রি করলে তার বৌ নিশ্চয় আমাকে জানাত।
মাতব্বর বললেন, মঈন সেখের বৌ সে কথা জানে না।
এমন সময় একটা বোরখা পরা মেয়ে দাঁড়িয়ে উঠে বলল, মাতব্বর সাহেব, আপনার কথা সত্য নয়। আযীয চাচা সত্য কথা বলেছেন।
মাতব্বর খুব রেগে গিয়ে বললেন, কে তুই? তোকে এখানে কথা বলতে বলেছে কে?
বোরখাপরা মেয়েটি বলল, আমি কে সে কথা পরে বলছি। আপনি গ্রামের মাতব্বর, সবার সঙ্গে ভদ্রভাবে কথা বলাইতো উচিত। আশা করি, এরপর কারো সঙ্গে অভদ্র ভাষায় কথা বলবেন না। যাই হোক, আমি কে জানতে চান? আমি মরহুম মঈন সেখের বিধবা স্ত্রী সায়রা বানু। প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য যাকে আপনি ল্যাংড়া ফকির ফজলুর সঙ্গে মিথ্যে দুর্নাম দিয়ে তার সঙ্গে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। এবার চিনতে পেরেছেন? না প্রতিহিংসা নেয়ার কারণও বলা লাগবে?
বিনা মেঘে বজ্রপাত হলে মানুষ যেমন অবাক হয় অথবা ভয় পেয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে, সায়রার কথা শুনে সবাই-এর অবস্থা সেইরকম হল। অনেকক্ষণ কেউ কোনো কথা বলতে পারল না।
প্রথমে সায়রা সরকারী লোকদের উদ্দেশ্য করে বলল, আপনারাই বলুন, একজন বিধবা ও তার এতিম ছেলের বাস্তুতে কি স্কুল প্রতিষ্ঠা করা উচিত? আমার ছেলের ইচ্ছা, ওখানে বাবার নামে একটা মাদ্রাসা করার। সেই অসিলায় আল্লাহ তার বাবাকে বেহেশত নসীব করবেন। আর ছেলের মতো আমিও তাই চাই।
সরকারী লোকদের একজন বললেন, আমরা জেনেশুনে ঐ জায়গায় স্কুল করব না।
ততক্ষণে মাতব্বর সামলে নিয়েছেন। বললেন, আপনারা ওর কথা বিশ্বাস করবেন না। ওযে মঈন সেখের বিধবা স্ত্রী তার প্রমাণ কি? মুখ ঢেকে রেখেছে কেন? খুলে দেখাক।
সায়রা বলল, মাতব্বর সাহেব, আপনার এত বয়স হল, নামায কালামও পড়েন, আর এটা জানেন না, পর-পুরুষদের সামনে মুখ দেখান মেয়েদের জন্য হারাম?
সরকারী লোকদের একজন বললেন, আপনার কথা ঠিক। তবে প্রমাণ করার জন্য শুধু মুখ দেখান যায়েজ।
সায়রা মুখের নেকাব সরিয়ে মাতব্বরকে উদ্দেশ্য করে বলল, এবার চিনতে পারছেন? তারপর আযীয সেখের কাছে গিয়ে বলল, আপনি বলুন তো চাচা, আমি সায়রা কিনা।
মাতব্বর চিনতে পেরে মুখ নিচু করে নিলেন। কোনো কথা বলতে পারলেন না।
আযীয সেখ বললেন, হ্যাঁ মা, তুমি মঈন সেখের বিধবা স্ত্রী সায়রা।
রশিদ এতক্ষণ কিছু বলে নি। এবার বলল, তুমি এতদিন কোথায় ছিলে? আজই বা হঠাৎ এলে কেন?
সায়রা মুখে নেকাব ঢাকা দিয়ে বলল, এতদিন কোথায় ছিলাম সে কথা আপনাদের জানার দরকার কি? আর এসেছি স্বামীর ভিটেয় মাদ্রাসা করার জন্য।
রশিদ জিজ্ঞেস করল, তোমার ছেলে কোথায়?
সায়রা বলল, সেকথাও আপনাদের জানার দরকার নেই। তা আপনার এরকম অবস্থা হল কি করে? নিশ্চয় পাপের ফল।
এই কথা শুনে রশিদ রাগ সামলাতে পারল না। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে গর্জে উঠল, এই মাগি বড় বড় বেড়েছিস দেখছি। তোর বাড় যদি না কমিয়েছি তো আমি দিলদার মাতব্বরের ছেলেই না।
সায়রাও রাগের সঙ্গে বলল, মুখ সামলে কথা বলুন। দিলদার মাতব্বরের ছেলে বলেই তো বাবার স্বভাব পেয়েছেন। একটা হাত ও একটা চোখ হারিয়েও স্বভাব পাল্টায় নি। বেশি বাড়াবাড়ি করলে আমিও হাত পা হারাবার কাহিনী সবার সামনে ফাঁস করে দেব।
রশিদ আরো রেগে গিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল, দু’জন পুলিশসহ দারোগাকে আসতে দেখে মাতব্বর ছেলেকে বললেন। চুপ কর, দারোগা সাহেব আসছেন।
দারোগা কাছে এসে মাতব্বরের সঙ্গে সালাম বিনিময়ে করে জিজ্ঞেস করলেন, কি ব্যাপার? এত লোকজন কেন?
মাতব্বর তাদের বসার ব্যবস্থা করে সরকারী লোকদের দেখিয়ে বললেন, ওনারা এই গ্রামে হাই স্কুল করার জন্য এসেছেন। তাই লোকজন ডাকা হয়েছে কোথায় স্কুল হবে পরামর্শ করার জন্য।
তা কোথায় হবে ঠিক হয়েছে?
মাতব্বর বলার আগে সায়রা বলল, উনি আমার বাস্তুতে স্কুল করার কথা বলছেন, আমি আপত্তি করে বলেছি, ওখানে মাদ্রাসা করব।
সায়রা থেমে যেতে মাতব্বর বললেন, ওর স্বামী মারা যাওয়ার আগে আমার কাছে বাস্তু বিক্রি করেছে। স্বামী মারা যাওয়ার পর ও প্রায় বিশ বাইশ বছর আগে ছেলেকে নিয়ে গ্রাম ছেড়ে চলে গিয়েছিল। আজ হঠাৎ এসে বাস্তুর দাবি করছে। আপনিই বলুন, এটা করা কি ওর ঠিক হচ্ছে?
মাতব্বরের কথার কোনো উত্তর না দিয়ে দারাগো সরকারী লোকদের বললেন, স্কুল করার জন্য আপনারা তো জমি কিনবেন তাই না?
তাদের একজন বললেন, তাতো বটেই। আমরা ন্যায্য দাম দিয়ে জমি কিনবো।
ঠিক আছে, আপনারা সপ্তাহখানেক পরে আসুন। এরমধ্যে আমি গ্রামের সবার সঙ্গে আলাপ করে রাখব, কে স্কুলের জন্য জমি বিক্রি করবে। আপনারা প্রথমে থানায় এসে আমার সঙ্গে দেখা করবেন। আমি আপনাদের এখানে নিয়ে আসব।
সরকারী লোকেরা বললেন, সেটাই ভালো হবে। তা হলে আজ আমরা আসি বলে সালাম বিনিময় করে চলে গেলেন।