রশিদ প্রায় দেড় মাস পর হাসপাতাল থেকে ফিরে এল। একদিন আব্বাকে। জিজ্ঞেস করল, যে লোক আমার এই অবস্থা করেছে, সেই লোকের কি খোঁজ পাওয়া গেছে?
মাতব্বর বললেন, কয়েকজন লোক লাগিয়েছি, তারা আজও কোনো খোঁজ পায় নি। এমন কি থানায় কেস করে দারোগাকে খুঁজে বের করতে বলেছিলাম; তিনিও পারেন নি।
শুনলাম, সাফিয়ার শ্বশুর শাশ্বড়ি এসে নাকি তাকে নিয়ে গেছে?
ঘটনার কয়েকদিন পর জয়নুদ্দিন একটা কাগজ মাতব্বরের হাতে দিয়ে বলেছিল, এটা মিয়া ভাইদের বুকের উপর ঢিল চাপা দেয়া ছিল। সেদিন মিয়া ভাইয়ের অবস্থা দেখে আপনাকে দিতে ভুলে গেছি। কাগজটা পড়ে মাতব্বর বুঝতে পারেন, বুড়ো লোকটা কেন রশিদের একটা হাতও একটা চোখ নষ্ট করে দিয়েছে।
এখন রশিদ সাফিয়ার কথা জিজ্ঞেস করতে ভাবলেন, তা হলে ও কি সেদিন সাফিয়ার ইজ্জত লুঠতে চেয়েছিল?
বাবাকে চুপ করে থাকতে দেখে রশিদ আবার বলল, সাফিয়াকে ওর শ্বশুর শ্বাশুড়ী এসে নিয়ে গেছে কিনা বললে না যে?
মাতব্বর বললেন, হ্যাঁ, নিয়ে গেছে। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, তুই কি সাফিয়ার স্বামী শ্বশুরকে সন্দেহ করিস?
না, তাদেরকে সন্দেহ করি না। আচ্ছা, দবির সেখ তাদেরকে যৌতুকের বাকি টাকা দিয়েছে কি না জান?
দবির টাকা কোথায় পাবে যে দেবে। শুনেছি, তারা এসে যৌতুকের বাকি টাকা ছাড়াই সাফিয়াকে নিয়ে গেছে। বলেছে, ঐ টাকা আর দিতে হবে না।
হঠাৎ তারা এত ভালো মানুষ হয়ে গেল কেন খোঁজ নিয়েছ?
তা আবার নিই নি। কিছুদিন আগে ওদের গ্রামে একজন হুজুর এসে সবাইকে যৌতুক নিতে নিষেধ করে বলেছেন, এটা হারাম। আরো বলেছেন, ছেলের বাবারা যেন বিয়ের সময় মেয়ের বাবাদের কাছে যৌতুক দাবি না করে, আর মেয়ের বাবারাও যেন যৌতুক দিয়ে মেয়ের বিয়ে না দেয়। এর কয়েকদিন পর থানার নতুন দারোগাও আশ-পাশের গ্রামের লোকজনদের ঐ কথা জানিয়ে বলেছেন, কেউ যদি ছেলের বিয়েতে যৌতুক দাবি করে, তা হলে থানায় খবর দিতে। সরকার নাকি যৌতুকের বিরুদ্ধে আইন করেছে, যৌতুক নিয়ে যে বিয়ে করবে তার জেল-জরিমান হবে। মনে হয়, সেই ভয়ে সাফিয়ার শ্বশুর-শাশুড়ি এসে যৌতুক ছাড়াই নিয়ে গেছে।
রশিদ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে জিজ্ঞেস করল, আমাদের গ্রামে সেই হুজুর বা দারোগা এসে সে কথা লোকজনদের বলে নি?
হুজুর এসেছিলেন কিনা জানি না। তবে দারোগা নাকি একদিন এসে বলেছেন। আরো বলেছেন, সবাই যেন ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠায়। নচেৎ ছেলেমেয়েদের মুগ্ধ করে রাখার জন্য এ্যাকসান নেবেন। সেদিন আমি হাসপাতালে তোর কাছে গিয়েছিলাম। এসে লোকজনের মুখে এসব কথা শুনেছি। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, যে তোর এই অবস্থা করল, তাকে দেখলে কি চিনতে পারবি?
না। সে পেছন থেকে চুপিচুপি এসে এত জোরে আমার ঘাড় ধরেছিল যে, ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে দেখার ক্ষমতা আমার ছিল না। আমি অনেক চেষ্টা করেছি নিজেকে ছাড়াবার; কিন্তু পারি নি। লোকটার গায়ে কি দারুণ শক্তি। কানের গোড়ায় ধরা হাতটা চাপ দিয়ে আমাকে অজ্ঞান করে ফেলল। তারপর কি হয়েছিল জানি না।
কিন্তু আমি ভেবে পাচ্ছি না, তুই ঐ সময়ে পুকুর পাড়ে গিয়েছিলি কেন? আর কেনই বা লোকটা তোর এরকম অবস্থা করল?
রশিদ সত্য কথা বলতে না পেরে মিথ্যে করে বলল, এমনি একটু ঘুরতে গিয়েছিলাম। হঠাৎ লোকটা আমার পিছন থেকে ঘাড় ধরে ফেলল। তারপরের ঘটনা একটু আগে তো বললাম।
লোকটা শুধু শুধু তোর ঘাড়ই বা ধরবে কেন? আর তোর এই অবস্থাই বা করবে কেন? আমার তো মনে হচ্ছে, এর পিছনে নিশ্চয় কোনো কারণ আছে, যা তুই গোপন করছিস।
রশিদ বিরক্তি কণ্ঠে বলল, কি আবার গোপন করব? যা সত্য তাইতো বললাম। এই কথা বলে সেখান থেকে চলে গেল।
মাতব্বর ছেলের গমন পথের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললেন, কাগজটার লেখা পড়েই বুঝেছি, তুই সাফিয়ার ইজ্জত লুঠতে গিয়েছিলি।
.
বাহেরচর গ্রামে এবছর হাইস্কুল হবে। সে ব্যাপারে আজ তিনজন সরকারী লোক এসেছেন মাতব্বরের কাছে।
মাতব্বর সে কথা দু’তিনজন লোকের দ্বারা গ্রামবাসীকে জানিয়ে তার বাড়ির সামনে ডেকে পাঠালেন।
গ্রামের লোকজন এসে কোথায় স্কুল হবে, সে ব্যাপারে পরামর্শ করে মাতব্বরকে জায়গা দিতে বললেন।
মাতব্বর মরহুম মঈন সেখের যে বাস্তু দখল করে নিয়েছেন, সেখানে স্কুল করার কথা জানিয়ে বললেন, ঐ জায়গাটা গ্রামের মাঝখানে। ওখানে স্কুল হলে সবার জন্য সুবিধে।
গ্রামের সবাই জানে, ওটা মরহুম মঈন সেখের বাস্তু। তার বৌ সায়রা ছেলেকে নিয়ে গ্রাম থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর মাতব্বর ভোগ-দখল করেছেন। তবু কেউ সাহস করে কোনো প্রতিবাদ করতে পারল না।
কেউ কিছু বলছে না দেখে করিম সেখের ভাই আযীয সেখ বললেন, ওটাতো মরহুম মঈন সেখের বাস্তু। তার একটা এতিম ছেলে আছে। এতিমের জায়গায়। স্কুল করা ঠিক হবে না।
সায়রা মাতব্বরের পুরুষাঙ্গ কেটে দেয়ার ঘটনাটা গ্রামের লোকজন জেনে যাওয়ার পর থেকে মাতব্বরকে সবাই ঘৃণার নজরে দেখলেও ধনীলোক বলে তার মাতব্বরী ছাড়াতে পারে নি। কিন্তু আযীয সেখ কোনো ব্যাপারেই মাতব্বরের সঙ্গে কখনও যোগাযোগ রাখে নি। আজ হাইস্কুলের ব্যাপারে সরকার থেকে লোক এসেছে শুনে এসেছেন। ওনার অবস্থা আগে ভালো না থাকলেও এখন খুব ভালো। পাঁচ-পাঁচটা জোয়ান ছেলে। সবাই রুজী রোজগার করে। তাই মাতব্বর ও আযীয সেখের এরকম ব্যবহার দেখেও তাকে ঘাটায় নি।