থানায় ধরে নিয়ে যাবে ও তাদের জেল-জরিমানা হবে শুনে হারিসের স্ত্রী সবুরন ভয়ে চোখের পানিতে বুক ভাসাচ্ছিল আর মনে মনে বলছিল, কি ঝকমারী করে বৌ-এর গায়ে হাত তুলেছিলাম। স্বামী থেমে যেতে ঘরের ভিতর থেকেই ভিজে গলায় বলল, হ্যাঁ দারোগা সাহেব, এবারের মতো আমাদের মাফ করে দিন। আমরা আর কোনো ছেলের বিয়েতে যৌতুক দাবি করব না। কালকেই হান্নানকে পাঠাব বৌকে নিয়ে আসতে।
দারাগা মনে মনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বললেন, ঠিক আছে, আপনারা আমার মা বাবার বয়সী, তাই এবারের মতো কিছু করলাম না। কিন্তু আবার যদি শুনি বৌমার উপর আপনারা এতটুকু অত্যাচার করেছেন, তা হলে সেদিন বুঝবেন কি করি। আর একটা কথা, আপনারা খোঁজ নিয়ে রাখবেন, এই গ্রামের অন্য কোনো ঘরে যৌতুকের কারণে কোনো বৌ-এর উপর অত্যাচার হচ্ছে কিনা–সে রকম যদি কেউ থাকে, তবে তাকে সরকারের আইনের কথা ও আমার কথা বলবেন। যখন আসব তখন তাদের কথা আমাকে বলবেন। আর একটা কথা, আমি গ্রামের লোকজনদের বলছি ছোট ছেলেমেয়েদের যেন স্কুলে পাঠায়। যারা পাঠাবে না সরকার তাদের বিরুদ্ধে এ্যাকসান নেবে। আপনার ছেলেমেয়েদেরও পাঠাবেন। তারপর দাঁড়িয়ে উঠে বললেন, এবার আসি।
হারিস বলল, কিছু না খেয়েই যাবেন? একটু বসুন গরিবের ঘরে কিছু মুখে দিয়ে যাবেন।
খেয়ে গেলে দেরি হয়ে যাবে। ততক্ষণ পুলিশরা চলে আসবে। তারপর সালাম বিনিময় করে চলে যাওয়ার সময় বললেন, বৌমাকে নিয়ে আসার পর থানায় গিয়ে দাওয়াত দেবেন, তখন এসে খাব।
দারোগা চলে যাওয়ার পর সবুরন তাদের কাছে এসে ছেলেকে বলল, কাল সকালেই তুই বৌকে নিয়ে আসতে যাবি। দারোগা সাহেব যদি শোনে বৌকে নিয়ে আসি নি, তা হলে কি করবে সে কথাতো বলেই গেল।
হান্নান বলল, আমি আনতে গেলে যদি গ্রামের লোকজন নিয়ে আমার শ্বশুর বেঁধে রাখে? তার চেয়ে আব্বা গিয়ে নিয়ে আসুক।
সবুরন বলল, তোর আব্বাকেও যদি বেঁধে রাখে? তখন কি হবে? তোকে বেঁধে রাখলে তোর আব্বা গিয়ে তাদের কাছে মাফ চেয়ে তোকে ও তোর বৌকে তবু নিয়ে আসতে পারবে।
হারিস বলল, সব থেকে ভালো হবে আমরা তিনজনেই যাই চল। দোষ স্বীকার করে মাফ চেয়ে বেয়াইকে বলব, বাকি টাকা আর দিতে হবে না। বৌকে নিয়ে যেতে এসেছি।
হান্নান বলল, সেটাই ভালো হবে।
৫-৬. মাতব্বর দুদিন পর
০৫.
মাতব্বর দু’দিন পর হাসপাতাল থেকে ফিরে তিনচার দিন থানায় লোক পাঠিয়েছিলেন। দারোগাকে নিয়ে আসার জন্য। আট দিন হয়ে যাওয়ার পরও যখন এল না তখন একদিন হাসপাতালে ছেলেকে দেখতে যাওয়ার পথে থানায় গেলেন।
দারোগা সালাম বিনিময় করে বললেন, আপনার ছেলের খবর কি বলুন।
মাতব্বর তার কথার উত্তর না দিয়ে গম্ভীরকণ্ঠে বললেন, কয়েকদিন লোক দিয়ে ডেকে পাঠালাম, গেলেন না কেন?
কাজে ব্যস্ত ছিলাম। তা ছাড়া আপনি ডাকলেই যেতে হবে, এরকম নির্দেশ সরকার আমাকে দেয় নি। ওসব কথা বাদ দিয়ে ছেলের খবর বলুন।
মাতব্বর আরো রেগে গিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বিরক্ত স্বরে বললেন, ছেলের আর খবর কি। একটা হাত ও একটা চোখ হারিয়ে তার জীবনটা বরবাদ হয়ে গেছে। আপনি কি খোঁজ খবর করেছেন তার এরকম অবস্থা কে করল?
দারোগা বললেন, তা আবার করি নি। দু’জন লোকও লাগিয়েছি। কিন্তু আজও কোনো হদিস পাচ্ছি না।
মাতব্বর বললেন, সেদিন ছেলের অবস্থা দেখে আমার মাথার ঠিক ছিল না। তাই কথাটা আপনাকে জানাতে পারি নি। আমার কাজের লোক জয়নুদ্দিন ঐ সময় একটা লোককে ওখান থেকে মাঠের রাস্তার দিকে চলে যেতে দেখেছে। লোকটা বেশ লম্বা চওড়া, ইয়া বড় পাকা দাড়ি, মাথায় গোল টুপি। দেখলে মনে হবে হুজুর মানুষ।
দারোগা বললেন, রাস্তা দিয়ে কত লোক যাতায়াত করে, হুজুর যে ঐ কাজ করেছে তা কি জয়নুদ্দিন দেখেছে?
না, তা দেখে নি।
লোকটা নিশ্চয় আপনাদের গ্রামের নয়?
না, ওরকম লোক আমাদের গ্রামে নেই। অন্য গ্রামের হতে পারে?
আচ্ছা, আশ পাশের গ্রামের কোনো লোকের সঙ্গে আপনার শত্রুতা আছে?
না।
জয়নুদ্দিন যে লোককে দেখেছে, সে রকম কোনো লোককে কখনো আপনি দেখেছেন?
না। তবে দু’দিন আগে শুনলাম, পাশের গ্রামে নাকি ঐ রকম একজন লোককে দেখা গেছে। ক্ষেতে যারা কাজ করছিল, তাদেরকে ছেলের বিয়ে দেয়ার সময় যৌতুক না নেয়ার জন্য ওয়াজ করেছেন।
কার কাছে কথাটা শুনেছেন?
ঐ গ্রামে আমার এক আত্মীয় আছে, সে আমার ছেলের খবর জানতে এসেছিল। তার কাছে শুনেছি।
তারা লোকটাকে চেনে কিনা জিজ্ঞেস করেন নি?
করেছিলাম। বলল, চেনে না। আরো বলল, তারা ওনার পরিচয় জানতে চেয়েছিল, উনি বলেন নি।
আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে, উনি আলেমলোক। উনি শুধু শুধু আপনার ছেলের ঐ রকম অবস্থা করতে যাবেন কেন?
তা অবশ্য ঠিক। আপনি একটু ভালো করে সন্ধান করুন। সেদিন বললাম না, অপরাধীকে ধরতে পারলে মোটা টাকা পুরস্কার দেব?
অপরাধীকে খুঁজে বের করাই আমাদের কাজ। আর এই কাজ করার জন্য সরকার বেতন দেয়। এখানে পুরষ্কার দেয়ার কথা বলছেন কেন?
অপরাধীকে ধরলে আমি খুশী হব। তাই পুরস্কার দেয়ার কথা বলছি।
শুনুন মাতব্বর সাহেব, পুরস্কারের লোভে আমি কিছু করব না। যা কর্তব্য তাই করব। এবার আপনি আসুন, আমার জরুরি কিছু কাজ আছে।
আগে যিনি দারোগা ছিলেন তিনি মাতব্বরকে খুব তোয়াজ করে চলতেন, মাতব্বর থানায় এলে চা-নাস্তা খাওয়াতেন। এই নতুন দারোগা তাকে পাত্তা দিচ্ছেন না দেখে মাতব্বর প্রথম থেকে অসন্তুষ্ট হয়েছেন। এখন তাকে চলে যেতে বলায় আরো বেশী অসন্তুষ্ট হলেন। বললেন, নতুন এসেছেন তো, তাই এই এলাকার কে কেমন লোক জানেন না। জানলে আমার কথাকে অপগ্রাহ্য করতে পারতেন না। ঠিক আছে, এখন আসি। তারপর থানা থেকে বেরিয়ে এলেন।