আপনারা যদি মুসলমান বলে দাবি করেন, তা হলে এখন থেকে ছেলের বিয়ে দেয়ার সময় মেয়ের বাপের কাছে দাবি করে কোনো কিছু নেবেন না এবং মেয়ের বিয়ে দেয়ার সময় যদি ছেলের বাপ কোনো কিছু দাবি করে, তা হলে সেখানে মেয়ের বিয়ে দেবেন না।
জাব্বার নামে এক লোক বলল, তা হলে তো মেয়েদের বিয়েই হবে না।
কে বলেছে হবে না, নিশ্চয় হবে। আল্লাহ ও তার রাসুলে (দঃ) এর হুকুম মোতাবেক আপনারা চলুন। দেখবেন, আল্লাহ সে ব্যবস্থা করে দেবেন। আজকাল আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (দঃ) এর হুকুম কেউ মেনে চলছে না। তাই মুসলমানরা আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং নানান সমস্যায় ভুগছে।
এবার আমি আসি। আপনাদের অনেক কাজের ক্ষতি করলাম, সে জন্য মাফ চাইছি বলে বুড়োলোকটা চলে যেতে উদ্দত হলে সাত্তার বলল, হুজুর, আপনার পরিচয় বললেন না?
আমি আল্লাহর এক নাদান বান্দা বলে হাঁটতে শুরু করল।
.
একদিন হারিস মসজিদ থেকে এশার নামায পড়ে ঘরের কাছে এসেছে, এমন সময় পিছন থেকে একজন লোকের গলা শুনতে পেল, এই যে ভাই শুনুন।
হারিস ঘুরে দাঁড়াল, লোকটা কাছে এসে সালাম দিল।
অন্ধকার রাত বলে হারিস হারিকেন নিয়ে নামায পড়তে গিয়েছিল। সালামের উত্তর দিয়ে হারিকেনটা উপরে তুলে বলল, আপনাকে মসজিদে নামায পড়তে দেখলাম না?
হ্যাঁ, আমি থানার দারোগা। আপনার সঙ্গে কিছু আলাপ আছে।
পুলিশের নাম শুনলে এখনও প্রত্যন্ত অঞ্চলের লোকেরা ভয় পায়। হারিসও পেল। তবু সাহস করে বলল, একটু দাঁড়ান আপনার বসার ব্যবস্থা করে আসি। তারপর ঘরে ঢুকে স্ত্রীকে ও ছেলে হান্নানকে বলল, থানা থেকে দারোগা সাহেব এসেছেন।
হান্নান ভয় পেয়ে বলল, হঠাৎ দারোগা সাহেব আমাদের ঘরে এল কেন?
হারিস বলল, কি যেন আলাপ করবেন বললেন, তুই এই দাওয়াতে একটা পাটি বিছিয়ে দে, আমি ওনাকে নিয়ে আসি।
হারিসের স্ত্রী সবুরন বলল, কিছু খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে না কি?
হারিস বলল, সে পরে হয় হবে, এখন যাই ওনাকে নিয়ে আসি।
দারোগা বুঝতে পারল, ওরা ভয় পেয়েছে। তাই হারিস ফিরে এলে বলল, রাতে এসেছি বলে আপনারা ভয় পাবেন না। অল্প কিছুক্ষণ আলাপ করেই চলে যাব।
দারোগার কথা শুনে হারিসের ভয় কমল। বলল, চলুন ভিতরে বসে আলাপ করবেন।
ভিতরে এসে দারোগা তাদেরকে বসতে বলে নিজেও বসলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, আপনার ছেলে মেয়ে কয়টা?
হারিস বলল, তিন ছেলে ও দুই মেয়ে। তারপর হান্নানকে দেখিয়ে বলল, ও সবার বড়।
ছেলেমেয়ের কারো বিয়ে দেন নি?
বড় ছেলে ও বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছি, বাকিরা ছোট।
কত দিন হল বড় ছেলের বিয়ে দিয়েছেন?
তা প্রায় দেড় বছর হতে চলল।
পোতা পুতিন হয় নি?
না।
বৌমা এখন কোথায়? এখানে না বাপের বাড়িতে?
বাপের বাড়িতে।
বাপের বাড়ি কোন গ্রামে?
বাহেরচর গ্রামে।
বৌমা কত দিন আগে বাপের বাড়ি গেছে?
হারিস লেখাপড়া তেমন না জানলেও খুব চালাক লোক। প্রথমে দারোগার কথা শুনে ভেবেছিল, গ্রামের কেউ হয়তো চুরি ডাকাতি করেছে, তার খোঁজ নিতে এসেছেন। তা না করে তার পরিবারিক সবকিছু জিজ্ঞেস করছেন দেখে চিন্তা করল, তা হলে কি বিয়াই তার মেয়ের উপর অত্যাচারের কথা থানায় জানিয়েছে। তাই বোধ হয় দারোগা সাহেব এসেছেন। কথাটা চিন্তা করে ঘাবড়ে গেল।
তাকে চুপ করে থাকতে দেখে দারাগো সাহেব বললেন, বৌমা কতদিন তার বাপের বাড়িতে আছে বললেন না যে?
যতটা সম্ভব সংযত কণ্ঠে হারিস বলল, এই তো কয়েকদিন আগে ছেলে বৌকে সেখানে রেখে এসেছে।
আপনি মুসলমান ও নামাযীলোক হয়ে মিথ্যা কথা বলছেন কেন?
হারিস আরো ঘাবড়ে গিয়ে তোতলাতে তোতলাতে বলল, আমি মিথ্যে বলতে যাব কেন?
দারোগা সাহেব গর্জে উঠলেন, আবার মিথ্যে কথা বলছেন। আমি তো জানি, বৌমার বাপ আপনার দাবি করা টাকা দিতে পারে নি বলে বৌমাকে সবাই মিলে মারধর করতেন। পাঁচ-ছয়মাস আগে মারধর করার পর বের করে দিয়েছেন। আর বলেছেন, বাকি সব টাকা না নিয়ে এলে তালাক দিয়ে আবার ছেলের বিয়ে দেবেন? শুনুন, আপনারা জানেন কিনা জানি না, সরকার নির্দেশ দিয়েছে, ছেলের বিয়েতে যারা যৌতুক দাবি করবে, তাদের কমপক্ষে পাঁচ বছর জেল ও পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হবে।
আমি কিছু দিন হল এই থানায় নতুন এসেছি। গ্রামে গ্রামে ঘুরে খোঁজ নিচ্ছি কারা ছেলের বিয়েতে যৌতুক দাবি করছে, আর কারা বাপের বাড়ি থেকে যৌতুক আনার জন্য বৌয়ের উপর অত্যাচার করছে। বাহেরচর গ্রামে খোঁজ নিতে গিয়ে দবির সেখের কাছ থেকে তাদের মেয়ের উপর অত্যাচারের কথা শুনে এসেছি। আমি থানায় বলে এসেছি, কিছুক্ষণের মধ্যে পুলিশ এসে আপনাকে, আপনার স্ত্রী ও এই ছেলেকে ধরে নিয়ে যাবে। তারপর বুঝবেন যৌতুক দাবি করার ও বৌমার উপর অত্যাচার করার ফল।
হারিস ও হান্নানের তখন দু’দিন আগে ক্ষেতে কাজ করার সময় হুজুরের কথা মনে পড়ল। দু’জনেই হাউ-মাউ করে কেঁদে উঠে দারোগা সাহেবের পা ধরতে গেল।
দারোগা সাহেব বাধা দিয়ে বললেন, এখন আর কাঁদলে কি হবে? যে পাপ আপনারা করেছেন, তার ফল তো ভোগ করতেই হবে।
হারিস কাঁদতে কাঁদতেই দু’দিন আগে হুজুরের কথা বলে বলল, ভেবেছি, আর কখনো ছেলের বিয়েতে যৌতুক দাবি করব না। আপনি আমাদের এবারের মতো মাফ করে দিন। কথা দিচ্ছি, এরকম কাজ আর করব না। আর বিয়াই এর কাছে পাওনা টাকাও চাইব না।