দবির জিজ্ঞেস করল, কিন্তু তুমি তো ভিন গাঁয়ের লোক আমাদের ঘর চিনলে কি করে? আর মাতব্বরের ছেলেকেই বা চিনলে কি করে? ঘরে না গিয়ে এতক্ষণ ছিলেই বা কোথায়?
ওসব আপনার জানার দরকার নেই। এখন আমার কথার উত্তর দিন। মেয়ের। বিয়ে দেন নি কেন? সেয়ানা মেয়ে ঘরে রাখতে নেই, তা জানেন না?
দবির বলল, বিয়ে দিয়েছি। তারপর সাফিয়ার সব ঘটনা বলল।
আপনার মেয়ের নাম কি?
সাফিয়া।
জামায়ের নাম ঠিকানা বলুন। দবির নাম ঠিকানা বলার পর বলল, কয়েকদিনের মধ্যেই জামাই আসবে সাফিয়াকে নিয়ে যেতে।
কিন্তু জামাই যদি বাকি টাকাটা চায়?
যাতে না চায়, সে ব্যবস্থা আমি করব। আপনাদেরকে অনেক কষ্ট দিলাম। মনে কিছু নেবেন না। এবার আসি বলে লোকটা দাঁড়িয়ে পড়ল।
দবির লোকটার কথা শুনে খুব খুশী হয়েছে। সেও দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, এতরাতে অন্ধকারে যাবেন কি করে? এখানেই থাকুন, কাল সকালে যাবেন।
লোকটা বলল, থাকতে পারব না, আমাকে যেতেই হবে। আমার কাছে টর্চ লাইট আছে, অসুবিধে হবে না।
কিন্তু আপনি যাবেন কোথায়?
তা বলা যাবে না। শুনুন, আমার কথা কাউকেই বলবেন না। তারপর সাফিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, তোমাকে ছোট বোনের মতো মনে করে বলছি। আমার কথা তোমার স্বামীকেও বলবে না। আমি যদি কখনো তোমার শ্বশুরবাড়িতে যাই, তখন আমাকে না চেনার ভান করে থাকবে। ভুলেও আমার কাছে আসবে না, আমার সঙ্গে কথাও বলবে না। তারপর সালাম বিনিময় করে চলে গেল।
সবাই তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দবির মেয়েকে জিজ্ঞেস করল, তোর কি মনে হয় এই লোকই তোকে মাতব্বরের ছেলের হাত থেকে বাঁচিয়েছে? লোকটা তো বলল, একটা বুড়ো লোক বাঁচিয়েছে।
সাফিয়া বলল, তখন আমি বুড়ো লোক দেখেছিলাম, কিন্তু ওনাকে দেখে ও ওনার কথা শুনে মনে হচ্ছে, উনিই আমাকে বাঁচিয়েছেন।
হাজেরা বলল, যেই বাঁচাক না কেন লোকটা যে বলল, জামাই এসে সাফিয়াকে নিয়ে যাবে, সত্যিই কি জামাই আসবে?
দবির বলল, সে কথা আল্লাহই জানে। দেখা যাক না আসে কিনা।
.
সাফিয়ার শ্বশুর হারিস ছেলে হান্নানকে নিয়ে ক্ষেতে কাজ করছিল। হঠাৎ দেখতে পেল, সাদা পাইজামা পাঞ্জাবী পরা দাড়িওয়ালা লম্বা চওড়া একটা বুড়ো লোক তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
বুড়ো লোকটাকে মৌলভী মনে করে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করল, কিছু বলবেন হুজুর?
বুড়ো লোকটা বলল, আপনার নাম হারিস না?
জি।
আর ঐ ছেলের নাম নিশ্চয় হান্নান?
হারিস অবাক হয়ে বলল, জি। কিন্তু আপনাকে তো চিনতে পারছি না?
আমি ভিন গাঁয়ের লোক, চিনবেন কি করে?
তা এখানে এসেছেন কেন?
কয়েকটা কথা বলতে এসেছি।
কি কথা বলুন।
আশ-পাশের ক্ষেতে যারা কাজ করছে সবাইকে ডাকুন। তাদের সামনে বলব।
হারিস ছেলেকে বলল, যা সবাইকে ডেকে নিয়ে আয়। ইনাকে দেখিয়ে বলবি হুজুর ডাকছেন।
কিছুক্ষণের মধ্যে দু’একজন করে পনের বিশজন লোক এসে গেল।
বুড়ো লোকটা বলল, আমি কিছু আলাপ করব। তার আগে কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করব। আপনাদের মধ্যে যিনি একটু জ্ঞানী, তিনি উত্তর দেবেন।
ওদের মধ্যে সাত্তার জ্ঞানী লোক। সবাই তাকে দেখিয়ে বলল, উনি উত্তর দেবেন।
বুড়ো লোকটা সাত্তারকে উদ্দেশ্য করে বলল, আপনারা তো মুসলমান, তাই?
সাত্তার বলল, জি।
মুসলমানদের হারাম খাওয়া নিষেধ, তা নিশ্চয় জানেন?
জি, জানি।
আপনারা নামায রোযা করেন?
জি, করি।
হারাম খেয়ে নামায রোযা করলে আল্লাহ কবুল করে না। তা জানেন?
জি জানি, মৌলবীদের মুখে শুনেছি।
তা হলে আপনারা হারাম খান কেন?
আমরা চাষ করে গায়ে গতরে খেটে খাই। হারাম খেতে যাব কেন?
ছেলের বিয়ে দিয়ে মেয়ের বাপের কাছে থেকে সোনা-দানা, টাকা পয়সা দাবি করে নেয়া যে হারাম, তা জানেন?
এটা হারাম হবে কেন? সব ছেলের বাপেরা নেয় এবং বিয়ের সময় মেয়ের বাবাও মেয়ে জামাইকে কিছু দেয়।
সবাই দেয়া-নেয়া করে না। তবে আজকাল বেশিরভাগ লোক দেয়া-নেয়া করে। মনে করুণ আপনারা দুই ভাই। আপনি কি অন্য ভাইয়ের কাছে থেকে অন্যায়ভাবে কোনো কিছু দাবি করে নিতে পারেন?
না পারি না।
এটা নিশ্চয় হারাম হবে?
হ্যাঁ হবে।
এক মুসলমান আর এক মুসলমানের ভাই, এটা জানেন তো?
জি জানি।
তা হলে ছেলের বিয়ের সময় মেয়ের বাপের কাছে যা কিছু দাবি করে নেয়া হয়, তা সেই ভাইয়ের কাছে অন্যায়ভাবে দাবি করে নেয়া হল নাকি?
এই কথার উত্তর দিতে না পেরে সাত্তার চুপ করে রইল।
তাই দেখে বুড়ো লোকটা আবার বলল, হাদিসে আছে, রাসুলুল্লাহ (দঃ) বলিয়াছেন, “এক মুসলমান অন্য মুসলমানের ভাই। এক মুসলমান অন্য মুসলমানের জন্য হারাম, তার জান-মাল এবং তাহার সম্পদ(১)।” [(১) বর্ণনায় : আবু হোরাইরা (রাঃ)-মুসলিম।]
তা হলে বুঝে দেখুন, ছেলের বিয়ে দিয়ে মেয়ের বাপের কাছ থেকে যা কিছু দাবি করে নেয়া হয়, তা নিশ্চয় হারাম হবে। তবে হ্যাঁ, মেয়ের বাপের যদি কিছু দেয়ার সামর্থ থাকে এবং খুশী হয়ে কিছু মেয়ে জামাইকে দিতে চায়, তা দিতে পারে। কিন্তু তা সবাইকে জানিয়ে নয়; গোপনে দেবে। তা না হলে সবাইকে জানিয়ে দিলে তার দেখা দেখি অন্য ছেলেরা ও তাদের গার্জেনরা বিয়ের সময় ঐসব দাবি করবে। এই ব্যাপারটা বিজাতীয়দের সমাজে প্রচলন। তারা এটাকে বিয়ের পণ বলে। বিজাতীয়দের কোনো জিনিস মুসলমানদের অনুসরণ করা উচিত নয়, বরং গোনাহর কাজ। আমাদের নবী করিম (দঃ) বলিয়াছেন, “যে বিবাহে যত খরচ কম হবে, সেই বিবাহে আল্লাহর রহমত তত বেশী বর্ষিত হবে।”