- বইয়ের নামঃ যেখানে কেউ নেই
- লেখকের নামঃ কাসেম বিন আবুবাকার
- প্রকাশনাঃ বিশ্বসাহিত্য ভবন
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১-২. চৈত্রের দুপুর
যেখানে কেউ নেই – কাসেম বিন আবুবাকার
চৈত্রের দুপুর। রোদের তাপে চারদিক খাঁ খাঁ করছে। বাহেরচর গ্রামের মাঠের মাঝখানের রাস্তা দিয়ে কাঁধে সাইড ব্যাগ ঝুলিয়ে সুঠাম দেহের অধিকারী এক সাদা দাড়িওয়ালা বুড়ো লোক হেঁটে চলেছে। ঘামে গায়ের গেঞ্জি ও জামা ভিজে গেছে। রাস্তার পাশে তেমন গাছ পালাও নেই যে ছায়ায় বসে একটু বিশ্রাম নেবে। সামনে গ্রামের কিনারে একটা বাগান দেখতে পেয়ে ওখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেবে ভেবে দ্রুত পা চালাল। কাছে এসে একটা বড় জামগাছের ছায়ায় বসে বিশ্রাম নিতে লাগল। হঠাৎ বাগানের ভিতর কোনো মেয়ের আর্ত চিৎকার ও পরক্ষণে ধস্তাধস্তীর শব্দ শুনে দাঁড়িয়ে উঠে বাগানের ভিতর সন্ধানী দৃষ্টিতে তাকাতে দেখতে পেল, একটা লোক একটা যুবতী মেয়েকে মাটিতে ফেলে দিয়ে শালীনতাহানির চেষ্টা করছে। মেয়েটি নিজেকে রক্ষা করার জন্য আপ্রাণ বাধা দিচ্ছে। বুড়োটা তাড়াতাড়ি সেখানে গিয়ে লোকটার ঘাড় ধরে তুলে দাঁড় করাল। তারপর মেয়েটিকে বলল, তুমি চলে যাও। এ আর কোনো দিন তোমার পেছনে লাগবে না।
সাফিয়া প্রায় বিবস্ত্র হয়ে গিয়েছিল। তাড়াতাড়ি কাপড় গায়ে জড়িয়ে কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়াল। তার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না, মাতব্বরের ছেলে রশিদের হাত থেকে ইজ্জত রক্ষা পেয়েছে। ফ্যাল ফ্যাল করে বুড়োর দিকে তাকিয়ে রইল।
একসময় তার চোখ দিয়ে পানি গড়াতে লাগল।
বুড়োটা বলল, ঘরে অনেক কাঁদবার সময় পাবে, এখন তাড়াতাড়ি চলে যাও।
আজ ঘরে কোনো আনাজ নেই। তাই হাজেরা মেয়ে সাফিয়াকে মাতব্বরের বাগানের পুকুর থেকে কলমী শাক তুলে আনতে পাঠিয়েছিল। সাফিয়া কলমী শাক তুলে পুকুরের পাড়ে উঠে রশিদকে তার দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভয় পেয়ে দ্রুত পাশ কেটে চলে আসছিল। রশিদ পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে মাটিতে শুইয়ে শালীনতাহানীর চেষ্টা করছিল। তারপর একজন অচেনা বুড়ো লোক এসে তার ইজ্জত রক্ষা করাতে কৃজ্ঞতায় চোখে পানি এসে গেছে। তাকে চলে যেতে বলায় একরকম ছুটে চলে গেল।
সাফিয়া চলে যাওয়ার পর বুড়োটা রশিদকে বলল, বাপের স্বভাব পেয়েছিস তাই না? মেয়ে মানুষের লালসার কারণে তোর বাপের যে দশা হয়েছে তাতেও তোর জ্ঞান হল না? আজ তোকে এমন শাস্তি দেব জীবনে আর কোনোদিন মেয়েদের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারবি না।
রশিদ ত্রিশ বছরের শক্তিশালী যুবক। তাই তার ঘাড় ধরতে রেগে গিয়ে নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করে বুঝতে পারল, প্রতিপক্ষ তার চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। তাকে দেখার জন্য ঘাড় ঘোরাতে গিয়ে সফল হল না। নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করতে প্রতিপক্ষের হাতের চাপ বেড়ে যাচ্ছে বুঝতে পেরে এতক্ষণ চুপ করে থাকলেও রাগে ফুলছিল। প্রতিপক্ষের কথা শুনে রাগের সঙ্গে কিছু বলতে যাচ্ছিল; কিন্তু গলা থেকে শব্দ বের হল না। কারণ ততক্ষণে দুই কানের নিচে প্রচণ্ড চাপ অনুভব করে জ্ঞান হারাবার উপক্রম হল এবং কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সত্যিই জ্ঞান হারিয়ে ফেলল।
বুড়োটা তার অবস্থা বুঝতে পেরে মাটিতে শুইয়ে দিল। তারপর ব্যাগ থেকে রশি বের করে ডানহাতের কব্জির একটু উপরে বেঁধে কজ্জিটা কেটে দিয়ে একটা চোখও তুলে নিল, তারপর একটা কাগজে মেয়েদের ইজ্জতের উপর হামলা করার ফল লিখে কাগজটা তার বুকের উপর রেখে একটা মাটির ঢেলা চাপা দিয়ে যেদিক থেকে এসেছিল সেইদকে হাঁটতে শুরু করল।
বাহেরচর গ্রামের অল্প কয়েকজন ছাড়া সবাই গরিব লোক। যে কয়েকজনের অবস্থা ভালো তাদের থেকে দিলদার মাতব্বরের অবস্থা সবার থেকে ভালো। তিনি বাপ-মায়ের একমাত্র সন্তান। গ্রামে প্রাইমারী স্কুল থাকলেও হাই স্কুল প্রায় আট দশ মাইল দূরে। তাই প্রাইমারী পাশ করার পর দিলদার আর পড়াশোনা করেনি। যুবক বয়সে গ্রামের গরিব ঘরের অনেক মেয়ের ইজ্জত নষ্ট করেছে। মেয়ের বাবারা দিলদারের বাবা সালেহ উদ্দিন মাতব্বরের কাছে নালিশ জানিয়ে সুবিচার পায় নি। তিনি টাকা পয়সা দিয়ে সে সব মেয়েদের বিয়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। সালেহ উদ্দিন মাতব্বর চরিত্রহীন ছিলেন না; কিন্তু তারই ছেলে দিলদার যে কেন চরিত্রহীন হল; তা অনেক চিন্তা করেও পান নি। তাই ছেলেকে ভালো করার জন্য পাঁচ মাইল দূরের গ্রামের এক সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দেন।
বিয়ের পর বছর দুই দিলদারের কুকর্ম বন্ধ ছিল। তারপর পরনারীর নেশা আবার জেগে উঠে। বড়লোকের ছেলেদের অনেক চামচা থাকে। দিলদারেরও ছিল। সেই চামচারা মেয়ে জোগাড় করে দিত। এর মধ্যে তার বাবা সালেহ উদ্দিন মাতব্বর মারা গেলেন। বাবা মারা যাওয়ার পর দিলদার গ্রামের মাতব্বর হলেন এবং আরো তিনটে বিয়ে করেন। তারপরও তার নারীর লোভ গেল না। সুযোগ পেলে চামচাদের সাহায্যে গ্রামের গরিব বৌ বেটিদের ভোগ করত। চারটে বিয়ে করলেও প্রথম স্ত্রীর গর্ভে একটি মাত্র ছেলে ছাড়া অন্য তিন স্ত্রীর গর্ভে কোনো সন্তান হয় নি। সেই ছেলেই রশিদ।
রশিদের বয়স যখন বার বছর তখন তার মা মারা যায়। তারপর দিলদার মাতব্বর আবার বিয়ে করার জন্য চামচাদের মেয়ের খোঁজ করতে বললেন।