যাই হোক অতি বিচিত্র এক চরিত্রের কথা বলি। নাম আগেই বলেছি সামছু, মোহাম্মদ সামছু। বয়স পঞ্চাশের মতো। চুল-দাড়ি পাকে নি। কিন্তু ভুরু পেকে গেছে। শক্ত-সমর্থ্য শরীর। অনবরত কথা বলা টাইপ। আমি এই ধরনের মানুষের নাম দিয়েছি Perpitual talking machine. ভদ্রলোক গোল জারে দুটা গোল্ডফিশ জাতীয় মাছ নিয়ে এসেছেন। ছুটির দিন। সকাল ন’টায় এসেছেন। আমি কয়েক মিনিট কথা বলেই বুঝেছি। দুপুরের আগে তিনি বিদায় হবেন না।
আপনার নাম মিসির আলি? আপনার শরীরের অবস্থা তো ভালো না। নিশ্চয়ই হজমের সমস্যা। দৈনিক আধঘণ্টা ফ্রি হ্যান্ড একসারসাইজ করবেন। খালি পেটে তিন গ্লাস পানি খাবেন। ফ্রিজের ঠাণ্ড পানি না। ফ্রিজের পানি আর ইদুর-মারা বিষ একই। ইদুরকে সাত দিন ফ্রিজের ঠাণ্ডা পানি খাওয়াবেন ইদুর মারা যাবে। যদি মারা না যায় আমি কান কেটে আপনার বাসার ঠিকানায় কুরিয়ার সার্ভিসে পাঠিয়ে দিব। নরমাল পানি খাবেন তিন গ্লাস। থ্রি গ্লাসেস। ভাতের সঙ্গে নিয়মিত কালিজিরা ভর্তা খাবেন। আমাদের নবীজি বলেছেন– কালিজিরা হলো মৃত্যু রোগ ছাড়া সকল রোগের মহৌষধ। রাতে ঘুমানোর আগে ইশবগুলের ভুসি। হার্টের কি কোনো সমস্যা আছে?
না।
না বললে তো হবে না, আপনার যা বয়স হার্টের সমস্যা থাকবেই। ঘরে ঢুকেই বুঝেছি ধূমপান করেন। এশট্রেতে সাতটা সিগারেট। ভয়াবহ। সব আর্টারি ব্লক হয়ে গেছে। তবে চিন্তার কিছু নাই। অৰ্জ্জুন গাছের ছাল ব্রাতে পানিতে ভিজিয়ে রাখবেন। সকালে খালি পেটে পানিটা খাবেন। ঘরে দারচিনি নিশ্চয়ই আছে। দারচিনি পাউডার করে রাখবেন। এক চামচ দারচিনির পাউডার মধু দিয়ে মাখিয়ে পেষ্টের মতো বানাবেন। সেই পেষ্ট হাতের তালুতে নিয়ে চেটে চেটে খাবেন। এতে শরীরে ঘাম কিছুটা পেটে যাবে। শরীরের ঘাম শরীরের জন্যে উপকারী।
আমি হঠাৎ ফাঁক পেয়ে বললাম, আমার কাছে কি জন্যে এসেছেন জানতে পারি?
নিশ্চয়ই জানতে পারেন। কাজে এসেছি। অকাজে আসি নাই। অকাজে সময় নষ্ট করার মানুষ আমি না। আলস্য করে এক মিনিট সময় আমি নষ্ট করি না। কারণ অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা। আমি আপনার নাম শুনে এসেছি। শুনেছি। আপনার অনেক বুদ্ধি। সাইকোলজির লোক। আপনার উপর না-কি অনেক বইপত্র লেখা হয়েছে। কিছু মনে করবেন না, সেই সব বই পড়া হয় নাই। বই পড়া, খবরের কাগজ পড়া এইসব বদঅভ্যাস আমার নাই। যৌবনে শরৎ বাবুর একটা বই পড়েছিলাম, নাম দেবদাস। তিনটা ভুল বের করেছিলাম। ভুলগুলি কি শুনতে চান?
জি না শুনতে চাচ্ছি না। আমার কাছে কেন এসেছেন সেটা বলুন।
ভদ্রলোক বিরক্ত গলায় বললেন, আপনি এত তাড়াহুড়া করছেন কেন? মানব সম্প্রদায় ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে তাড়াহুড়ার কারণে। এই জন্যে আল্লাহপাক পবিত্র কোরান শরিফে বলেছেন, হে মানব সম্প্রদায় তোমাদের বড়ই তাড়াহুড়া। যেহেতু তাড়াহুড়া করছেন- মূল কথাটা বলে ফেলি। আমি জারসহ মাছ দুটা আপনাকে দিতে এসেছি। আপনি যদি কিনে নিতে চান সেটা ভালো। আমি যে দামে কিনেছি তার হাফ দামে দিয়ে দিব। প্রতিটি জিনিসের দাম ডিপ্রিসিয়েশন হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কমে। শুধু জমির দাম বাড়ে। উত্তরায় আমার তিনি কাঠা জমি ছিল। পাঁচ বছর আগে বিক্রি করে এখন মাথার চুল ছিঁড়ছি। এই ভুল মানুষ করে? এখন উত্তরায় বার লাখ করে কাঠা। What a shame.
আমি বললাম, মাছের জন্য আপনাকে কত দিতে হবে?
সামছু গম্ভীর গলায় বললেন, আমি জারটা কিনেছি একশ টাকায় আর মাছের জোড়া কিনেছি। একশ’ টাকায়। হাফ প্রাইসে আপনাকে দিয়ে দিচ্ছি, একশ’ টাকা দিলেই হবে। মাছের এক কোটা খাবার ফ্রি পাচ্ছেন। প্রতিদিন চার দানা করে দিলেই হবে। গাদাখানিক খাবার দেবেন না। খাবার যত বেশি দেবেন। মাছ তত হাগবে। জারের পানি ঘন ঘন বদলাতে হবে।
আমি তাড়াতাড়ি মানিব্যাগ খুলে একশ’ টাকা বের করলাম। এই লোক যদি টাকা নিয়ে বিদায় হয় তাহলে জানে বাঁচি।
ভদ্রলোক টাকা পকেটে রাখতে রাখতে বললেন, আমি মানিব্যাগ ব্যবহার করি না। টাকা-পয়সা সবসময় পকেটে রাখি। কারণ মানিব্যাগ চুরি করা পকেটমারদের জানা সহজ। টাকা চুরি করা সহজ না। ভালো কথা, আপনি যদি মাছ না। কিনতে চান তারপরেও এইটা আপনাকে আমি দিয়ে যাব, মাগনাই দিব। আমার স্ত্রী তাই বলে দিয়েছে। সে আবার আপনাকে নিয়ে লেখা বই পড়ে। তার বই পড়ার নেশা আছে। বইমেলায় গিয়ে গত বছর দুইশ’ চল্লিশ টাকার বই কিনেছে। আমি দিয়েছি, ধমক ৷ টাকা তো গাছে ফলে না। কষ্ট করে উপার্জন করতে হয়। ঠিক না?
জি ঠিক।
আমার স্ত্রী মেয়ে খারাপ না আবার ভালোও না। সমান সমান। আমাকে ভক্তি-শ্রদ্ধা করে এইটা ভালো আবার আমাকে বোকা ভাবে এইটা খারাপ। দুয়ে মিলে প্লাস এবং মাইনাসে জিরো। আমার স্ত্রী হলো জিরো। এখন কি আপনি শুনতে চান মাছ কেন দিতে চাই? আপনার ভাবভঙ্গিতে তো আবার বিরাট তাড়াহুড়া। মন দিয়ে আমার কথাই তো শুনছেন না। এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন।
আমি বললাম, এই মুহূর্ত থেকে এদিক-ওদিক তাকাব না। আপনার কথা শুনব। বলে শেষ করুন।
মাছ দিতে চাই কারণ এই মাছ দুটা ভালো না, খারাপ। এদের মধ্যে দোষ আছে। বিরাট দোষ। আমি তো এত কিছু জানি না। সরল মনে কাঁটাবন থেকে কিনে এনেছি। জোড়া দেড়শ’ টাকা চেয়েছিল, মুলামুলি করে একশ’তে কিনেছি। আমার মেয়ের জন্যে কিনেছি। আমার অধিক বয়সের একমাত্ৰ সন্তান বলেই তার প্ৰতি মায়া বেশি। তার বয়স তিন বছর। আমি নাম রেখেছি মালিহা। ভালো নাম জাহানারা। মাছ দিয়ে সে খেলবে। পশু-পাখির প্রতি মমতা হবে। পশু-পাখির প্রতি মমতার প্রয়োজন আছে। কথায় আছে না। জীবে দয়া করে যেই জন। সেইজন সেবিছে ঈশ্বর।